জ্বলদর্চি

আফ্রিকা (মোজাম্বিক)-র লোকগল্প : খরগোশের লেজ / চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প-- আফ্রিকা ( মোজাম্বিক )
চিন্ময় দাশ 

খরগোশের লেজ 

সে বছর দেশে দারুণ খরা। সাত-আট মাস এক ফোঁটা বৃষ্টি নাই। মাঠ-ঘাট ফুটিফাটা। বন-পাহাড় সব শুকিয়ে কাঠ। এক ফোঁটা জল নাই নদীতেও। 
যায় যায় রব চারদিকে। জল না হলে যে প্রাণ বাঁচে না। বনের জীব সব পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছে। যদি জলের দেখা মেলে কোথাও।
সিংহ হল বনের রাজা। তার একটা দায় আছে, প্রজাদের ভালো-মন্দ দেখার জন্য। একটা সভা ডাকল সিংহ। সবাই এসে জুটেছে সভায়। বাঘ, ভালুক, হাতি, নেকড়ে, শেয়াল। এমনকি, পুঁচকে খরগোশ বা কাঠবেড়ালিও। কেউ বাদ যায়নি, কেউ না।
সকলেই কোন না কোনও উপায় বাতলাতে লাগল। নানা জনের নানা মত। কিন্তু কাজের কাজ হতে পারে, তেমনটা কিছুই পাওয়া গেল না। 
সভায় ছিল একটা ভোঁদড়। সে জলেও থাকে, আবার ডাঙাতেও। সে বলল-- রাজামশাই, আমি একটা উপায় বাতলাতে পারি।
সিংহ বলল-- বল, শুনি।
-- নদী তো এখন শুকনো। আমরা সব্বাই মিলে নদীতে গিয়ে নাচানাচি করি। তাতে ভগবান খুশি হয়ে বৃষ্টি দেবে আমাদের।  
সকলের বেশ মনে ধরল কথাটা। খরগোশ বসেছিল একটেরে। সে বলল-- কিন্তু আমি বাপু যাচ্ছি না তোমাদের সাথে। নাচানাচি করে জল পাওয়া যায় কখনও? আমার মাথা এখনও খারাপ হয়নি।
সবাই গিয়ে হাজির হল নদীতে। নদী এখন খটখটে শুকনো। সবাই নাচানাচি করতে লাগল বালিতে। আর কী অবাক করা কান্ড ! কতসময় বাদে, সত্যিই বালি ভিজিয়ে জল জমতে লাগল নদীতে। সে কী আনন্দ সকলের। জল তো নয়, জীবন ফিরে পাওয়া গেছে। যে যার মত জল খেয়ে, ঘরের পথ ধরল সকলে।
ভোঁদড় বলল-- কিন্তু খরগোশের কী হবে? সে তো আসেইনি, নাচেওনি আমাদের সাথে। উল্টে টিটকারি করেছে সবাইকে।
সিংহ বলল-- কী আবার হবে। শুকিয়ে মরবে হতভাগা। এক ফোঁটা জলও পাবে না সে।
রাজার কথায় সবাই খুশি।  খরগোশ বলল-- তোমাদের জল আমি ছুঁয়েও দেখব না। কিন্তু বলল বটে, ভিতরে ভিতরে খরগোশেরও তো প্রাণ আইঢাই। আসলে সে রইল তক্কেতক্কে। কখন সূর্য ডোবে। কখন অন্ধকার হয় চারদিক। 
একসময় রাত নামল। চারদিক শুনসান। ছোট্ট একটুখানি শরীর তার। কে আর জানতে পারছে? চুপিচুপি গিয়ে পেট ভরে জল খেল খরগোশ। তারপর ঘরে ফিরে, নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে লাগল।
সকালে জল খেতে গিয়ে খরগোশের চালাকি চোখে পড়ে গেল সকলের। বালির উপর পায়ের ছাপ পড়ে আছে তার আসা-যাওয়ার। সবাই চেঁচাতে লাগল-- শাস্তি দিতেই হবে পুঁচকেটাকে।
সিংহ বলল-- ধরে নিয়ে আয় হতভাগাকে। বুঝিয়ে দিচ্ছি, কত ধানে কত চাল।
সবই শুনছিল খরগোশ। ধরবে বলে, হনুমান লাফ দিয়েছে, অমনি সুড়ুৎ করে পাথরের গর্তে সেঁধিয়ে গেল সে। 

কী করা যায়, কী করা যায়? ছোট্ট চেহারার খরগোশকে বাগে আনা সোজা কাজ নয়। কোন উপায় আসছে না কারও মাথায়। কিন্তু ছেড়েও দেওয়া যাবে না ব্যাটাকে। এক বুড়ো খরগোশ ছিল সেখানে। থপথপ করে রাজার সামনে এসে বলল-- আমি ধরে দেব খরগোশকে। একটা উপায় বাতলাতে পারি।
শুনে সবার সে কী হাসি। সিংহ বলল-- তুমি ধরবে খরগোশকে? ঠিক আছে। বলো, তোমার কী উপায়?
কচ্ছপ বলল-- পিচ ফলের আঠা ভারী জব্বর। আমার পিঠের খোলে পুরু করে লাগিয়ে দাও সেই আঠা। আমি গিয়ে নদীর জলের কিনারে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকব। অন্ধকারে ঠাহর করে পারবে না খরগোশ। জল খেতে নামলেই, আটকে যাবে বদমাশটা। 
সকলের মুখের হাসি উধাও। উল্টে ভারী মনে ধরল ফন্দিটা। সবাই তারিফ করতে লাগল। 
ভালো করে আঠা মাখানো হল কচ্ছপের পিঠে। থপথপ করে পা ফেলতে ফেলতে নদীর কিনারে গিয়ে বসে পড়ল সে। খোলের ভিতর মুখ ঢুকিয়ে নিতেই, কচ্ছপের কোনও চিহ্নই নাই। ঠিক যেন এক টুকরো পাথর কেউ পেতে রেখেছে জলের কিনারে।

খরগোশ তো অত কথা জানে না। রাত নামতেই, সে এসে হাজির নদীর কাছে। অমনি ভারী আহ্লাদ হল তার মনে। দারুণ ঘাটের ব্যবস্থা হয়েছে তো। ভালোই হলো, জল খাওয়ার জন্য আর পা ভেজাতে হবে না আমাকে। ফুরফুরে মেজাজ খরগোশের।
যেই না একটা পা নামিয়েছে, অমনি সেটা আটকে গেল কচ্ছপের পিঠের খোলে। দ্বিতীয় পা নামাতে, টনক নড়ল বেচারার। পা দুটো যেন কেউ খিল দিয়ে গেঁথে দিয়েছে ঘাটের পাথরে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল খরগোশ।
অমনি লম্বা মুখখানা বেরিয়ে এল কচ্ছপের। বলল-- কী বাছাধন, কেমন জব্দ? রাতটা পোয়াতে দাও. তারপর দেখবে খেলাটা। 
দিনের আলো ফুটল। কচ্ছপ এতক্ষণ ছিল পাথর-টুকরো। সেই ভেক ছেড়ে, এবার ডাঙ্গার দিকে চলল গুটিগুটি পায়ে। থপ থপ করে চলেছে কচ্ছপ। তার পিঠের ওপর একটা কুঁজের মত বসে আছে খরগোশটা। সে এক দারুণ দৃশ্য। 
হা-হা-হা। বন পাহাড় নদী কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করল বনের যত জীব। হাসি আর থামে না তাদের। মরমে মরে যেতে লাগল খরগোশ। চুপ করে আছে। আর, মনে মনে ভাবছে, কী করে রেহাই পাওয়া যাবে এই সঙ্কট থেকে।
  সিংহ বসেছে একটা পাথরের উপর। এখন একেবারেই মহারাজের ভঙ্গী তার। বনের যত জীব এসে হাজির হয়েছে সেখানে। এমন মজা তো আর বড় একটা দেখা যায় না।
সিংহ বলল-- তোমরাই বলো, কী করা যায় এটাকে নিয়ে। মরতে একে হবেই। কীভাবে মারা হবে, সেটাই বলো তোমরা।
কেউ বলল-- গলা কেটে দেওয়া হোক। এক কোপেই শেষ।
অন্য জন চেঁচিয়ে উঠল-- না, না। অতো সুখের মরণ ওর পাওনা নয়। অন্য কিছু ভাবো সবাই।
হাতি বলল-- পায়ের তলায় পিষে দেব?
শেয়ালের ভারি দেমাক পন্ডিত বলে। সে বলল-- যত দুষ্ট বুদ্ধি থাকে ওর মাথায়। আছাড় মেরে, ওর মাথাটা থেঁতলে দেওয়া হোক।
সেটাই সাব্যস্ত হোল। আছড়ে মারা হবে খরগোশকে।
খরগোশ কাঁদো-কাঁদো গলা করে বলল-- আমার একটা আবেদন আছে।
সিংহ বলল-- মরেই তো যাবি। তা বল, শুনি কী তোর আবেদন। 
-- যেন লেজ ধরে আছাড় মারা না হয়। খরগোশের গলায় কাতর সুর-- সবার সামনে সে বড় অপমানের ব্যাপার হবে।
প্রথমে হা-হা করে এক চোট হেসে নিল সিংহ। তারপর গম্ভীর হয়ে বলল-- ঠিক বলেছিস তো। লেজ ধরেই আছড়ানো হবে তোকে। সম্মান তোর পাওনা নয়।
সবাই তাতে হই-হই করে উঠল। আনন্দে মাতোয়ারা সবাই। খরগোশ বলল-- তাহলে, একটা সাধ পূর্ণ করা হোক আমার। মরেই তো যাবো। রাজার কথা অমান্য করছি। রাজাই শাস্তি দিক আমাকে। অন্য কেউ নয়। রাজার হাতেই মরণ হোক আমার।
এ আর এমন কী বাড়তি চাওয়া? কাজটাও কঠিন নয় রাজার জন্য। সবাই একমত। 
সিংহ উঠে এসে, খরগোশের লেজ ধরল। তুলতুলে নরম খরগোশের লেজখানা। আর কী সুন্দর মোলায়েম লোম দিয়ে ঢাকা। অনেকটা কাঠবেড়ালির মত। 

দু'-এক পাক ঘুরিয়ে, তবে আছড়াবো ব্যাটাকে-- এই ভেবে নিয়েছে সিংহ। যেই না ঘোরাতে শুরু করেছে, অমনি খরগোশের জোর এক ঝাঁকুনি। তাতেই কেল্লা ফতে। রাজার হাত থেকে লেজখানা গেল পিছলে। খরগোশ গিয়ে পড়ল খানিক দূরে। অমনি পড়ি-কি-মরি করে, সে কী দৌড় তার।
থাবায় কয়েক গাছি সাদা লোম আটকে ছিল। ফ্যাল-ফ্যাল করে সেদিকেই তাকিয়ে রইল সিংহ। কারোরই করার কিছু নাই এখন। রাজা তো দূর, একটা পুঁচকে জীবের কাছে বোকা বনে গিয়েছে বনের সবাই।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments