জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-২০/ শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-২০

শুভদীপ বসু

বিষয়-আবৃত্তিতে আবহের ব্যবহার

সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার শুধুমাত্র শিল্পীর মুখে নরম আলো পড়ছে। আবহে ভেসে আসছে সকালের শরতের সুবাস,বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উচ্চারণ আর পাখির ডাক। ওই আলো-আবহ আর আধুনিক কবিতার প্রতিটি শব্দ পাশাপাশি থেকে এক মুহুর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলি একটি সুন্দর মায়াময় পরিবেশ তৈরী করছে।
https://youtu.be/NH396EMvT_8
(লিংকে গিয়ে একটি কবিতা শোনা যেতে পারে)
যেকোনো শিল্পমাধ্যম অনেকটাই বহতা নদীর মত।তার সৌন্দর্য কখনই এক রকমের রং বিচ্ছুরণ করে না।প্রতিদিনে ক্ষণে ক্ষণে তার নতুন বিভঙ্গ আমাদের কাছে নবরূপে-নবসাজে-নববেশে প্রকাশিত হয়।সারা পৃথিবীতে এখন এক অস্থির সময়।প্রতিটি মানুষই খুব ব্যস্ত।তাই খুব কম সময়ে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে যাওয়ার জন্য আবৃত্তি শিল্প অন্য শিল্পের হাত ধরে।
কবিরা স্বকন্ঠে কবিতা পড়ে সারা পৃথিবী জুড়ে কিন্তু এই আবৃত্তিশিল্প এর জন্ম বাংলাতেই।মা ঠাকুমার ব্রতকথা পাঠ-স্তোত্র পাঠ থেকে শুরু হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,মধুসূদন দত্ত,কাজী নজরুল ইসলাম,শিশির কুমার ভাদুড়ি, নির্মলেন্দু লাহিড়ী,কাজী সব্যসাচী, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, প্রদীপ ঘোষ দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ ঘোষ, গৌরি ঘোষ,উৎপল কুন্ডু হয়ে এই সময়ের আবৃত্তি শিল্পীদের কণ্ঠে কণ্ঠে এই শিল্পটি বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। বর্তমান সময়ে ব্রততী বন্দোপাধ্যায়, কাজল সুর, সুমন্ত্র সেনগুপ্ত, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, জগন্নাথ বসু, ঊর্মিমালা বসু, বিজয় লক্ষী বর্মন, রত্না মিত্রর মতো প্রথম সারির আবৃত্তিশিল্পীরা তাদের অডিও ক্যাসেট অথবা সরাসরি মঞ্চে আবহের নিত্যনতুন সৃজনের মধ্য দিয়ে কবিতাকে মানুষের মরমে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছেন।আবার বাংলা আবৃত্তির ব্যান্ড বৃষ্টি, মহুল,কবিতা কানেকশন,কবিতাস্কোপ মঞ্চে লাইভ মিউজিক ব্যবহারের একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।এটা আবৃত্তির বাজারিকরণ না বিশ্বায়ন কিংবা শিল্পের তাগিদে সে আলোচনা এখানে নাই বা করলাম আপাতত শুধু এটাই আলোচ্য বিষয় হোক যে আবৃত্তিতে আবহসংগীত এর ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?

  শ্রী কল্যাণ সেন বরাট বলেন- 'আবৃত্তি শিল্পীর সঙ্গে সঙ্গে এই শিল্পে ব্যবহৃত আবহসংগীত এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং খুবই উপযোগী বিষয়।তবে অবশ্যই তা কবিতার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। যদি কবিতার সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রেখে তার সঙ্গীত তৈরি করা যায়,তবে তা কবিতা আবৃত্তির মধ্যে এক প্রাণের পরশ তৈরি করে-যা শ্রোতাকে আবৃত্তিকারের আরো কাছে টেনে আনবে।আবৃত্তিকার এর সঙ্গে শ্রোতাদের একাত্ম করে তুলতে সঠিক আবহসংগীত সত্যিই এক সেতুর কাজ করে।'আবহসংগীত ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয় বিশেষ লক্ষ্য রাখা যেতে পারে-
১) এমন যন্ত্র ব্যবহার করা উচিত যে যন্ত্র কবিতার কথাকে গ্রাস করবে না।
২)মনে রাখতে হবে কবিতার কথাই হল প্রাণ।সেই কথাকে আরও প্রাণময় করে তুলবার জন্য সঙ্গীত এর ব্যবহার।কাজেই সংগীতের দৌরাত্ম্যে যদি আবৃত্তির কথা ঢাকা হয়ে যায় তবে নেহাতই আবহ অর্থহীন হয়ে পড়ে।
৩)কবিতার মর্মার্থ বুঝে,তার ওঠানামার বিষয়টিকে উপলব্ধি করে তারপরেই আবহসংগীত ব্যবহার করা উচিত।
৪) Sound effect এর সঠিক ব্যবহার আবৃত্তিকে প্রাণময় করে তোলে।
৫)যে কোন অনুষ্ঠানে সকলেই আবৃত্তির বোদ্ধা হয়না।তাই কবিতার ভাব কে তার অর্থকে সহজভাবে শ্রোতার মর্মে প্রবেশ করানোর জন্য আবহসংগীত এর একটি বিশেষ ভূমিকা আছে।

আবহসংগীত এর ব্যবহার কবে থেকে শুরু হল?
এই প্রশ্নের উত্তরে যদি মনে হয় এই হাল আমলেই এই শিল্পে আবহসংগীত এর ব্যবহার হচ্ছে তা ভুল। শ্রদ্ধেয় প্রদীপ ঘোষ কিংবা কাজী সব্যসাচীর মতো শিল্পীরা তাদের আবৃত্তির অ্যালবাম গুলিতে আবহসংগীত এর ব্যবহার করেছেন।তবে ঠিক বর্তমান সময়ের মতো কবিতায় আবহসংগীত এর ব্যবহার আগে হত না।শুধুমাত্র কণ্ঠকে আশ্রয় করেই ঘন্টার পর ঘন্টা আবৃত্তির অনুষ্ঠান করেছেন-শম্ভু মিত্র,কাজী সব্যসাচী,প্রদীপ ঘোষ,পার্থ ঘোষ গৌরি ঘোষ,উৎপল কুন্ড মতো শিল্পীরা। এসব আসরে অবশ্যই বলতে হয় কবিতার বোদ্ধা মানুষেরাই বেশি যেতেন। 
তবে বর্তমান সময়ে স্কুল কলেজের অনুষ্ঠানে বিরাট সংখ্যক মানুষদের সামনে আবৃত্তি পরিবেশন করতে গিয়ে শিল্পীরা যখন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক,অভিনব সাউন্ড ইফেক্ট এর ব্যবহার করে শিল্পের বাজারি করণ করছেন, তা শিল্পের ভবিষ্যৎ কে আরো সুদৃঢ় করছে।এখন তো ফেসবুকেও বিভিন্ন মানুষেরা বিজ্ঞাপন দেন-'এখানে সুলভ মূল্যে কবিতার আবহ দেওয়া হয়।'যখন একটি শিল্পঅন্য শিল্পের প্রসারে সাহায্য করছে তখন তার মধ্যে পজিটিভ দিকটি আমি বেশি দেখতে পাই।একটি কবিতার আবৃত্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে যে রকম একজন শিল্পী ভাবেন ঠিক সেভাবেই আবৃত্তির আবহ নির্মাণের ক্ষেত্রে শিল্পীকে ভাবতে হবে। পরিমিতিবোধ শব্দটিকে মাথায় রেখে আদেও আবহ কবিতাটিকে কোন ভিন্নমাত্রা দিচ্ছে,নাকি হত্যা করছে এ বিষয়ে শিল্পীকে সচেতন থাকতে হবে। একই সাথে এটাও বলতে ইচ্ছে হয় শুধুমাত্র সেকেলে ধারণা নিয়ে পড়ে থাকলেই চলবে না।সময়ের সাথে সাথে নিজেকে আমরা যদি পাল্টে না নিই, তাহলে হয়তো যোগ্যতমের উদবর্তন হয় না। সময় যা চাইছে,পরিবেশ যা চাইছে, শ্রোতারা যা চাইছে তাকে প্রাধান্যদিয়ে শিল্পীরা তাদের শিল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে দৃষ্টি দেবেন। আবৃত্তিতে আবহের সংযোজনায় শুধুমাত্র'গেল গেল'রব তুলে যারা এর প্রতিবাদ করেন তাদেরও হয়তো ধ্যান ধারনা পাল্টে নেওয়ার সময় হয়েছে। কলকাতায় আবৃত্তির আবহ নির্মাণের ক্ষেত্রে শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়,আশীষ ঘোষ এর মত মানুষেরা এটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং সুনামের সাথে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন। শেষে এটুকুই বলবো আবৃত্তিশিল্পে যারা মনে করছেন আবহসংগীত এর প্রয়োজনীয়তা নেই তারাও থাকুন আর যারা মনে করছেন আবৃত্তিশিল্পে আবহসংগীত এর প্রয়োজনীয়তা আছে তারাও তাদের কাজ চালিয়ে যান।শ্রোতারাই ঠিক করে নেবেন কাদের তারা বেশি গ্রহণ করছেন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments