জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩৫/ শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩৫

শ্যামল জানা

কিউবিজম্ আফটার 1918

কিউবিজম্-এ, আক্ষরিক অর্থে উদ্ভাবন বলতে যা বোঝায়, তা ঘটেছিল ১৯১৪ সালের মধ্যে৷ তারপর, সেই সব কনসেপ্ট নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছিল তার পরেও আরও কিছুদিন৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরিস্থিতিতে তা একটু স্তিমিত হয়ে গেছিল৷ এই যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর, অর্থাৎ ১৯১৮ সালের পর আর্ট ডিলার লিওন্স রোজেনবার্গ-এর পৃষ্ঠপোষকতায় আবার স্বমহিমায় ফিরে এসেছিল কিউবিজম্৷ আবার শিল্পীদের প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিল কিউবিজম্৷ এবং এভাবেই কেটেছিল অন্তত আরও দু-বছর৷ এবং ১৯২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন কিউবিজম্ আভাঁ-গার্দ মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে উঠছিল, তখন, ওই একই সময়ে প্যারিসে ‘জিওমেট্রিক অ্যাবস্ট্রাকশন’ ও ‘সাররিয়েলিজম্’-এর সূত্রপাত ঘটেছিল৷ ফলে, এই দুই নতুন ইজম্-এর ধারণা ও দর্শনের প্রেক্ষিতে কিউবিজমকে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল৷
এমতাবস্থায়, যে সব উল্লেখযোগ্য কিউবিস্টরা ছিলেন— পিকাসো, ব্রাক, গ্রিস, লেজার, গ্লেইজেস, এবং মেটজিঞ্জার, এঁরা তাঁদের অসম্ভব যোগ্যতা ও শৈলীকে আরও আরও উন্নত করতে থাকলেন৷ ধাপে ধাপে কিউবিজম্-এর সেই বিশাল কর্মযজ্ঞকে ফিরিয়ে আনার চেষ্ট করলেন৷ আর, এ লড়াই তাঁরা অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে চালিয়ে গেলেন আরও প্রায় পাঁচ বছর— ১৯২৫ সাল পর্যন্ত৷ এ ঘটনা সিম্পলি বিশ্বাস করা শক্ত!

আশা করি সবার মনে আছে— সেই ১৯০৭ সালে কিউবিজম্-এর ধারণা তৈরি হয়েছিল, যাকে প্রোটো কিউবিজম্ বলা হয়েছিল৷ তারপর ১৯০৯-এ আর্লি কিউবিজম্-এর সূত্রপাত ঘটল৷ তারপর শীর্ষে পৌঁছে শেষের দিকে স্তিমিত হতে শুরু করল ক্রিস্টাল কিউবিজম্(১৯১৪-১৯১৮) সময়কালে, যা হুবহু প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও সময়কাল৷ এবং স্তিমিত হওয়ার মূল কারণ কিন্তু এই যুদ্ধই৷

সেই উনিশ শতকের শেষের দিকে যখন সারা পৃথিবী জুড়ে আধুনিকতার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল৷ তার প্রেক্ষিতে অর্থনীতি-সমাজনীতি-রাজনীতির আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল সারা পৃথিবী জুড়ে৷ এবং এই আধুনিকতা নানা ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে চলেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত৷ ফলে, স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়েছিল শিল্পে৷ ফলে, অবশ্যম্ভাবী সৃষ্টি হয়েছিল ইজম্-এর৷ এবং আধুনিকতার চলন অনুযায়ী তারও ভাঙচুর চলেছিল ক্রমাগত৷ জন্ম নিচ্ছিল একটার পর একটা ইজম্৷ এই ইতিহাসের প্রেক্ষিতে যদি কিউবিজমকে দেখা যায়, তাহলে বিস্মিত না হয়ে পারা যাবে না!

প্রথমত, নানা বিস্ময়কর বাঁক সম্ববলিত এই দীর্ঘযাত্রার ইতিহাস কিউবিজম্-এর আগে আর কোনো ইজম্-এর নেই৷ দ্বিতীয়ত আরও বিস্ময়কর এই কারণে যে এই কিউবিজম্-এর শীর্ষ সময়কাল(ক্রিস্টাল কিউবিজম্-১৯১৪-১৯১৮) আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল একেবারে একই৷ যে সময়ে সারা পৃথিবী অর্থনীতি-সমাজনীতি-রাজনীতি ইত্যাদি সামগ্রিকভাবে বদলে যাচ্ছিল৷ যে সময়ে মানুষ বেঁচে থাকা বা অস্তিত্বের লড়াইয়েই ভয়ঙ্করভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল৷ এই সময়েও কিউবিজম্ নিজেকে টিকিয়ে রাখছে— চিন্তা তো দূরে থাক, স্রেফ ভাবা যায় না! ১৯১৮-য় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও ১৯২০-তে পুনরুত্থান ঘটিয়ে আরও সাত বছর ১৯২৫ সাল পর্যন্ত কিউবিজম্ মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়েছিল৷ এমন কি ১৯৩০-এও আমেরিকান শিল্পী স্টুয়ার্ট দাভিস এবং ইংরেজ শিল্পী বেন নিকোলসন কিউবিস্ট ছবির প্রদর্শনী করেছেন৷ তবে, এটা ঠিক যে, ফ্রান্সে ১৯২৫ থেকেই কিউবিজম্ স্তিমিত হতে শুরু করে৷
আমরা আগে ড্যানিয়েল-হেনরি কহনউইলিয়ার-এর সম্পর্কে আলোচনা করেছি৷ এই জার্মন মানুষটিকে বিশ শতকের ইয়োরোপ চিত্রশিল্পের ডন বলা হত৷ তৎকালীন চিত্রশিল্পের গতি-প্রকৃতি অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি৷ কারণ, তিনি একাধারে ছিলেন সবচেয়ে বড় আর্ট কালেক্টর, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আর্ট ডিলার এবং প্যারিসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক আর্ট গ্যালারির মালিক৷ তাঁর সামান্য একটু অঙ্গুলি হেলনে বহু আর্টিস্টের উত্থান বা পতন ঘটে যেত৷ এ হেন কহনউইলিয়ার ১৯২৫ সাল নাগাদ কিউবিস্ট আর্টিস্টদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন৷ ফলে অত্যন্ত হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন কিউবিস্ট শিল্পীরা৷
সেই সময় অন্যতম উল্লেখযোগ্য আর্ট ডিলার লিওন্স রোজেনবার্গ এই শিল্পীদের পাশে এসে দাঁড়ালেন৷ তিনি এই হতাশাগ্রস্ত কিউবিস্ট শিল্পীদের নিয়ে ওই দুঃসময়ে প্রদর্শনী করলেন শুধু নয়, ওই প্রদর্শনীর মান বাড়াতে ওঁদের সঙ্গে যুক্ত করলেন তৎকালীন উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের৷ যেমন— লরেন্স, লিপ্চিটজ্, মেটজিঞ্জার, গ্লেইজেস, সিয়াকি, হারবিন এবং সেভেরিনি-র মতো শিল্পীদের৷ ১৯১৮ সালে লিওন্স রোজেনবার্গ প্যারিসের ‘গ্যালারি দে আই’এফোর্ট মডার্নে’-তে একটার পর একটা কিউবিস্ট ছবির সিরিজ প্রদর্শনী করেছিলেন৷ এবং যাঁর প্রয়াসে তিনি এই কাজটি করেছিলেন তিনি হলেন লুইস ভক্সেলস্৷ এই গুরুত্বপূর্ণ মানুষটির কথা আমরা আগে আলোচনা করেছি৷ ইনি ছিলেন সেই সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী ইহুদি শিল্প সমালোচক৷ অত্যন্ত বড় মাপের শিল্পবোদ্ধা৷ তৎকালীন শিল্পীরা নির্দ্ধিধায় তাঁকে মেনে নিতেন৷ এই যে ফভইজম্(১৯০৫) ও কিউবিজম্(১৯০৮) নামদুটি তাঁরই দেওয়া৷ সম্ভবত, তিনি ইহুদি বলে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন৷ যেমন— পিন্টুরিকো, ভ্যাসারি, কোরিওলেস, ক্রিটিয়াস ইত্যাদি৷ যাই হোক, আমরা পুর্বকথনে ফিরে আসি৷
তিনি কিন্তু স্পষ্টই বুঝে গেছিলেন কিউবিজম্ ক্রমশ ফেড আউট হচ্ছে৷ তা সত্ত্বেও তিনি কিউবিস্ট ছবির প্রদর্শনী করার মতো এই আন্তরিক প্রয়াস নিলেন কেন? আসলে, তৎকালীন কিউবিস্টরা ছিলেন অত্যন্ত যোগ্য ও শক্তিশালী৷ তাঁরা নিজেদের অযোগ্যতার কারণে যে স্তিমিত হয়ে যাচ্ছিলেন, তা কিন্তু একেবারেই নয়! আসলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘটে যাওয়ার ফলে সারা পৃথিবীর মানুষের জীবনযাত্রা, বেঁচে থাকার ধরন বা বেঁচে থাকার লড়াইটাই হঠাৎ করে একেবারে পাল্টে গেছিল৷ শুধুমাত্র কিউবিস্ট শিল্পীরা সংকটে পড়েছিলেন তা নয়, তাঁদের কেন্দ্র করে যে গ্যালারিগুলি তৈরি হয়েছিল, তারাও সংকটে পড়েছিল৷ যেমন— “স্যালোঁ দেস ইন্ডিপেন্ডেটস্” ও “স্যাঁলো দে লা সেকশন ডি’ওর”৷ ভক্সেলস্-এর প্রদর্শনী করার এই প্রয়াসের মূল উদ্দেশ্য ছিল— প্রথমত একটি প্রদর্শনী হলে, শিল্পীরা যেমন গ্যালারিকে উজ্জিবীত করে, পাশাপাশি একটা গ্যালারিও তেমনি শিল্পীদের উজ্জিবীত করে৷ ইংরাজিতে যাকে বলে ভাইস ভার্সা৷ দ্বিতীয়ত জনমানসে প্রমাণ করা যে, কিউবিস্ট শিল্পীদের যোগ্যতা একেবারেই স্তিমিত হয়নি, তাঁরা এখনও অত্যন্ত সৃষ্টিশীল ও সজীব আছে৷ হঠাৎ করে সারা পৃথিবীর এই পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার জন্য এঁরা এতটুকু দায়ী নন৷

  এইভাবে কিউবিজম্-এর আপাত-পুনরুত্থান ঘটেছিল মূলত ১৯১৭ থেকে ১৯২৪-এর মধ্যে৷ নির্বাচিত কয়েকজনকে নিয়ে একটি সুন্দর কাঠামোও তৈরি করা হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত সশরীরে মিলিত হতেন৷ এঁদের মধ্যে থিওরি লিখেছিলেন— পিয়েরে রিভার্দে, মৌরিশ রেনাল, ও ড্যানিয়েল-হেনরি কহনউইলিয়ার৷ আর শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন গ্রিস, লেজার ও গ্লেইজেস৷ 
তবে, এখানেও কিন্তু আগেকার ডিটেইল ফিগারেটিভ ছবি, যাকে আমরা ক্ল্যাসিসিজম্ বলি(ছবি-১), মাঝে মাঝে ফিরে আসত৷ সে সম্পূর্ণভাবেও ছবিতে আসত, আবার কিউবিজম্-এর পাশাপাশিও আসত৷ আবার কারোর কারোর ছবি ফিগারেটিভ হলেও হুবহু বাস্তবতা থেকে খানিকটা এড়িয়ে যেত, যাকে নিও-ক্ল্যসিসিজম্ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷
এই সবকিছু মিলিয়ে কিউবিজম্ আবার তিনটি মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হল৷ প্রথমত— যুদ্ধ তখন ছিল সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ইভেন্ট৷ তাকে এড়িয়ে ছবি আঁকা তখন সম্ভব ছিল না৷ আবার যুদ্ধের বিভৎসতা সরাসরি ছবিতে আনতে গেলে পুরোনো ডিটেইল ফিগারেটিভ ছবি বা ক্ল্যাসিসিজম্ ছাড়া কিউবিজম্-এর সাহায্যে সম্ভব নয়৷ ফলে তৎকালীন ফরাসি সমাজ ও সংস্কৃতিতে কিউবিজম্ পাল্টে গিয়ে কনজারভেটিজম্-এ পাল্টে গেল৷ দ্বিতীয়ত— কিউবিজম্-এ এত বড় বড় উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা(পিকাসো, ব্রাক, মেটজিঞ্জার, লেজার, গ্লেইজেস, প্রমুখ) ছিলেন, যে, তাঁরা অধিকাংশই ‘আমিই সুপ্রিম’, এই মনোভাব থেকে কেউ কাউকে মেনে নিতে পারতেন না৷ ফলে, প্রত্যেকের শৈলী তাঁর নিজের মতো হত৷ ফলে, কিউবিজম্-এর একাধিক ধরন তৈরি হয়েছিল৷প্রদর্শনীতে ঢুকে মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়তেন৷ কোনটা বিশুদ্ধ কিউবিজম্, এই নিয়ে প্রচণ্ড বিতর্ক তৈরি হত৷ তৃতীয়ত— ততদিনে যুদ্ধ-পরিস্থিতি বাধ্যতামূলকভাবে জন্ম দিয়েছিল অন্তত চারটে ইজম্-এর— রিয়েলিজম্, ন্যাচারালিজম্, ডাডাইজম্ ও সাররিয়েলিজম্৷ স্বাভাবিকভাবেই মানুষ ওই জটিল ও বিতর্কিত কিউবিজম্-এর তুলনায় এই নতুন ইজমগুলিকে অনেক বেশি সহজ, সঠিক ও প্রাসঙ্গিক মনে করল৷ নিশ্চিতভাবে বোঝা গেল কিউবিজম্-এর নটেগাছের ভবিষ্যৎ কী?                                                (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments