জ্বলদর্চি

পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা-৩০/ বিমল মণ্ডল

Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal

পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
পর্ব- ৩০

পঞ্চম অধ্যায় 
শব্দ ভাণ্ডার ( Vocabulary) 

 মান্য চলিত  বাংলা ভাষার মতো পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষাতে ব্যবহৃত বিভিন্ন উৎসজাত শব্দ দেখা যায়। তবে মান্যচলিত বাংলা ভাষার শব্দগুলোর তুলনায় কালানুক্রমিক ও পর্যায়গত  দিক থেকে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় সংস্কৃত  মূল শব্দ অর্থাৎ  তৎসম, অর্ধ- তৎসম, তদ্ভব, দেশি মূল শব্দ অর্থাৎ অষ্ট্রিক- দ্রাবিড় গোষ্ঠী ইত্যাদি, আগন্তুক মূল শব্দ অর্থাৎ হিন্দি, বেদেশি,আরবি- ফারসি, তুর্কী ইত্যাদি  পরিলক্ষিত হয়। এখানে ওড়িয়া শব্দের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। এছাড়া মৎস্যজীবীদের   কথ্যভাষায়  অঞ্চলভিত্তিক বেশ কিছু শব্দ পাওয়া যায়  যা চলিত বাংলায় ব্যবহার দেখা যায় না। তবে এখানে  যে শব্দগুলো  পাওয়া যায় তা সবসময়  এই শব্দগুলির উৎসমূল প্রায়শই নির্ণয়  করা যায় না,তাই এইশব্দগুলিকে অজ্ঞাতমূল শব্দাবলী হিসেবে  চিহ্নিত করে হয়ে থাকে।

পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় মৎস্যজীবীদের  কথ্যভাষা সংগ্রহ করতে গিয়ে আমার সমীক্ষায় দেখা গেছে চলিত বাংলার মতো প্রায়ই সংস্কৃত মূল শব্দাবলীর ব্যবহার। এই জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের অঞ্চলগুলি হল- দীঘা, রামনগর-১,২, কাঁথি-১, ২,খেজুরী-২,নন্দীগ্রাম-১,হলদিয়া, সুতাহাটা,মহিষাদল। এই অঞ্চলগুলিতে প্রায়ই ৬০- ৭০ শতাংশ সংস্কৃত মূল, ৫-১০ শতাংশ আরবি- ফারসি, ৫ শতাংশ দেশিমূল,৫শতাংশ ওড়িয়া,২শতাংশ  হিন্দি এবং অবশিষ্ট শতাংশের ইংরেজি, অজ্ঞাতমূল ও অন্যান্য শব্দাবলী ব্যবহার হতে দেখা যায়। 

সংস্কৃত মূলের মধ্যে তদ্ভব ও অর্ধতৎসম শব্দের ব্যবহার এখানে বেশি দেখা যায়।তবে তৎসম শব্দের  ব্যবহার খুবই কম দেখা গেলেও এই শব্দের  উচ্চারণ হয় প্রায়ই অর্ধতৎসম শব্দের মতো ব্যবহৃত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখানে ব্যবহৃত তদ্ভব শব্দগুলো চলিত বাংলায় প্রায়ই অপ্রচলিত। তবে উপভাষা  দিক থেকে এখানে  রাঢ়ী বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য দেখা গেলেও  মধ্যবাংলার কাব্যসাহিত্যে এগুলোর ব্যবহার দেখা যায়। সেই দিক থেকে এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষার একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব থেকে যায়।

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের জনগণ ধর্মগত দিক থেকে হিন্দু ও মুসলমান  সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। তাই ধর্মীয় কারণে এঁদের কথ্যভাষা ব্যবহারে যথেষ্ট সংস্কৃত,হিন্দি,পর্তুগিজ, চিনা,ইংরেজি, আরবি- ফারসি, ওড়িয়া শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।
বর্তমানে আধুনিক জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংযোগের ফলে কিংবা স্মার্টফোন, কম্পিউটার, দুরদর্শনের দৌলতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরিচিতির মধ্য দিয়ে নানান শব্দ অর্থাৎ কৃষি সরঞ্জাম,ঔষধ- পত্রাদি, পোষাক পরিধান প্রভৃতির মধ্য দিয়ে ইংরেজি, হিন্দি শব্দও এই সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় গৃহীত হয়েছে। আবারও চলিতবাংলার সংস্পর্শেও কিছু ইংরেজি শব্দ এখানে প্রবেশ করেছে। তবে মান্যচলিত বাংলা ভাষায় এখানকার  ব্যবহৃত শব্দগুলো  প্রায়ই অপরিবর্তিত ভাবে উচ্চারিত হলেও এখানে তা ঈষৎ পরিবর্তিত আকারে উচ্চারিত হতে দেখা যায়।

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় যে সব শব্দ ভাণ্ডারের উপাদান পাওয়া যায় সে পরিচয় গুলি হল—
১.সংস্কৃত মূল— তৎসম,অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব। 
২.দেশি মূল— অষ্ট্রিক- দ্রাবিড়, অজ্ঞাতমূল।
৩.আগন্তুক শব্দ—বিদেশি,হিন্দি, আরবি-ফারসি,পর্তুগীজ, ইংরেজি। 
৪.সংকর শব্দ।

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় যে শব্দভাণ্ডার আমার সমীক্ষাতে উঠে এসেছে তা উৎস ও শ্রেণী বিভাগ সহ পরবর্তী পর্বে আলোচিত হবে।

Post a Comment

0 Comments