জ্বলদর্চি

মে দিবস শপথ নেওয়ার দিন/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

মে দিবস শপথ নেওয়ার দিন

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

সোভিয়েত রাশিয়া পতনের পর নানা মহলে সেই ঘটনার অবমূল্যায়ন যতই হোক না কেন, তবু তার যুগান্তকারী মহিমা যারা অস্বীকার করে তাদের মূর্খ বলা ছাড়া উপায় নেই। মাও জেদং একবার বলেছিলেন, "কখনো শ্রেণি সংঘাত ব্যাপারটাকে যেন ভুলে না যাওয়া হয়"( never forget the class struggle)। আর এই শ্রেণি সংঘাত থেকে জন্ম নেয় 'মে দিবস'। ইতিহাস তাঁর স্মৃতি থেকে যতটুকু বলে,  তাতেই জেনেছি মানুষ যবে থেকে সমাজবদ্ধ জীব হল, তবে থেকে সমাজে চলে এসেছে শোষণ। মুষ্টিমেয় কিছু লোক সমাজপতি হিসেবে তৎপর থেকেছে, আর বাকি বৃহৎ অংশের জনগণ তাদের তাঁবেদারী করতে বাধ্য হয়েছে। জীবনের সব দিক থেকে তারা বঞ্চিত থেকেছে। আমি আপনি কিংবা সে, সবাই স্বপ্ন দেখি শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি। কিন্তু তা নিছক কল্পনা। কিন্তু যেদিন কল্পনা থেকে মানুষ নেমে এলো রাস্তায়, তার নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে, সেই দিনটির নাম 'মে দিবস'। 

  সৃষ্টির আদি লগ্নে আদিম সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এই ব্যবস্থায় মানুষের ওপর মানুষের শোষণ ছিল না। যা পাওয়া যেত, তা সবাই মিলে ভাগ করে খেয়ে পরে বাঁচতো। সেসময় কোনো সামাজিক শ্রেণিভাগ ও ছিল না। সকলে মিলে যৌথভাবে জীবনযাপন করতো। সামাজিক শ্রেণিভাগ না থাকার কারণে শ্রেণীদ্বন্দ্বও ছিল না। কিন্তু সামাজিক বিবর্তনের ফলে সমাজের অভ্যন্তরে বিভিন্ন চাহিদার সৃষ্টি হয়। এই চাহিদা থেকে সমাজের দ্বিতীয় স্তরে দাস ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই সময় সমাজে সৃষ্টি হয় দাস ও দাসপ্রভু। দাসপ্রভুরা ক্রীতদাসদের পন্য বলে মনে করতো। আর পাঁচটা পণ্যের মত ক্রীতদাসদের কেনাবেচা চলত। যার যত ক্রীতদাস থাকবে, সে তত সমাজের উচুঁ স্তরে অবস্থান করতো। এই সময় থেকে শুরু হল সমাজে শ্রেণিবিভাগ। তারপর এলো শিল্পবিপ্লব। এ সময় শ্রমিক শোষণ এক স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। এই শিল্প বিপ্লবের ফলে বাজারে পণ্যের আবির্ভাব হলো। তখন যন্ত্রপাতি দিয়ে উৎপাদন শুরু। যে কাপড় একটি যন্ত্র দশ ঘন্টায় তৈরি করতে পারে, সেই কাপড় একজন তাতি তার কলে বিশ ঘন্টায় উৎপাদন করে। তাই তাঁতির কাছ থেকে মালিকরা একটি কাপড়ের বিনিময়ে দশ ঘণ্টার মজুরির দাম দিত। অথচ তাঁতি বিশ ঘন্টা খাটলো। যখন বাজারে পণ্য এল, তখন সৃষ্টি হল 'সারপ্লাস ভ্যালু।' এই 'সারপ্লাস ভ্যালু' কি, তা জানা দরকার। ধরা যাক এখন শ্রমিকের মজুরি চারশত টাকা। একটি কাপড় কলে মালিক একটি শাড়ি তৈরিতে শ্রমিকের খরচ ধরা আছে দশ টাকা। এই চারশত টাকায় শ্রমিক খাটবে ৮ ঘন্টা। ধরি, প্রথম চার ঘন্টায় একটি শ্রমিক তাঁতকলে চল্লিশটি শাড়ি তৈরি করবে। তাতেই কিন্তু সেই শ্রমিকের মজুরি উঠে এলো। বাকি চার ঘণ্টায় সে আরও চল্লিশটি কাপড় তৈরি করবে, যাতে শ্রমের মূল্য আর-ও  চারশত টাকা আয় হবে। তা মালিক পাবে। এতে শ্রমিকের কোন ভাগ নেই। একে বলে উদ্ধৃত মূল্য বা 'সারপ্লাস ভ্যালু'। এই 'সারপ্লাস ভ্যালু' কার কাছে থাকবে, তাই নিয়ে শুরু হলো মালিক ও শ্রমিকদের চরমদ্বন্দ্ব। এই সারপ্লাস ভ্যালু মালিকের হাতে জমতে জমতে বৃহৎ শিল্পপতির সৃষ্টি হল। প্রত্যেকটি কাপড়ে সুতার দাম এক, যন্ত্রপাতির খরচ, টাকার সুদ স্থির। তাই সর্বপ্রকার মূল্য সৃষ্টির উৎস হলো শ্রমিকের পরিশ্রম। এই যে এত টাকা মুনাফা শিল্পপতিদের পকেটে যাচ্ছে এর জন্ম কোথায়? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর তা হলো শ্রমিকের শ্রম। অন্যভাবে বলতে গেলে, যারা ঠাণ্ডা ঘরে বসে আছে, এই বস্তিতে থাকা, হাড়জিড়জিড়ে কালো লোকগুলোর রক্ত ওঠা পরিশ্রমের ফসল। যেন বেঁচে থাকতে হলে তাদের এই টাকা কর দিতে হবে। তাই কমিউনিস্ট ইশতেহারে বলা হয়েছে, "মজুরি খেটে কি মজুরের সম্পত্তি সৃষ্টি হয়? একেবারেই না। শ্রমিকের পরিশ্রম সৃষ্টি করে মূলধন অর্থাৎ সেই ধরনের সম্পত্তি যা মজুরকেই শোষণ করতে থাকে।" মার্কস তাঁর ক্যাপিটাল গ্রন্থে বললেন, "পুঁজি যেন মরা মেহনত, শুধু পিশাচের মত জীবন্ত মানুষের মেহনত চুষে বেঁচে রয়েছে।" তাই অতিরিক্ত মুনাফার লোভে পুঁজিপতি, শ্রমিককে যথেষ্ট খাওয়ার সময় না দিয়ে, ঘুমোনোর উপযুক্ত অবসর না রেখে, তাদের বারো ঘণ্টা বা তার বেশি সারাদিনে খাটতে বাধ্য করলো। কারণ শ্রমিককে যত খাটানো যাবে মুনাফা তত বেশি হবে। মুনাফা যত বেশি হবে পুঁজি তত বৃদ্ধি পাবে। আর বৃদ্ধি পেলে দেশে-বিদেশে কাটবে আরামের জীবন। এই অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে শ্রমিকদের অবস্থা জীবন্ত ভূত। তখনই দাবি উঠেছিল, কলকারখানায় শ্রমিকদের গোটা জীবন কিনে নেওয়া যাবে না। এই ভাবে গড়ে উঠলো শোষক মানে বুর্জোয়া আর শোষিত মানে প্রলেতারিয়েত শ্রেণি। এক নতুন শ্রেণীদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হল। তাই 'পৃথিবীর ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস'। যখন এই অবস্থা চলছিল ইউরোপের অধিকাংশ দেশে রাজাদের শাসন ছিল। সেই রাজারা পুঁজিপতিদের প্রশ্রয় দিতেন। অন্যদিকে যেহেতু আমেরিকায় রাজা নেই, এক ধরনের গণতন্ত্র চালু ছিল। তাই প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার জায়গা ছিল। কাল মার্কস সারা জীবন এই শোষণমুক্তির পথ বাতলে, কয়েক বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন। মার্কস তাই লিখেছিলেন, "যে অস্ত্র তাদেরই মৃত্যুকে ডেকে আনে, বুর্জোয়ারা শুধু সেই অস্ত্র নির্মাণ করে নিরস্ত হয়নি, সেই অস্ত্র যারা ধারণ করবে তেমন লোকেদের ও বুর্জোয়া শ্রেণি সৃষ্টি করেছে তারা হল আধুনিককালের মজুর শ্রমিক শ্রেণি।"
   মার্কস মারা যাবার তিন বৎসর পর, এক সন্ধ্যায় শিকাগো শহরের প্রকাণ্ড খড়ের বাজারে শ্রমিক-মালিক সংঘর্ষ। মালিক শ্রেণীর গুলিবর্ষণে কয়েকজন শ্রমিক সহ বহু হতাহত। আর সেই খবর সব শিল্পোন্নত দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো - আর মুখ বুজে সহ্য নয়। চাই প্রতিরোধ সংগ্রাম, শ্রেণিযুদ্ধ। তারিখ ছিল মে মাসের প্রথম সপ্তাহে, সারা বিশ্বজুড়ে এক সম্মেলনের মাধ্যমে পহেলা মে, শ্রমজীবী মানুষের প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে মানুষজন রাস্তায় বেরোবে, মিছিলে মিছিলে রাজপথ কাঁপিয়ে দেবে, নতুন করে সংগ্রামের জন্য শ্রমিক মেহনতি মানুষ অঙ্গীকারবদ্ধ হবে। 

  কিন্তু আমরা বর্তমানে কি দেখছি, দেশের বর্তমান সরকার শুধু পুঁজির পরমাত্মা নয়, পুঁজির সাথে একাত্ম। একের পর এক রাষ্ট্র ও শিল্প বেসরকারিকরণ। আর দেশ জুড়ে বাজছে ধর্মের দামামা।  পুঁজির রক্তচক্ষুর কাছে শ্রমিক মেহনতী মানুষের আন্দোলন ও তাদের স্বাধীনতা অর্ধমৃত। শোষণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। প্রতিরোধ প্রতিবাদের সংগঠন দুর্বল। যারা প্রতিবাদ করবে, তাদের সামনে শোষকর দয়ার দান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। আর ধর্মের দোহায় দিয়ে ভাবানো হচ্ছে পরকালের ভাবনা। আর মানুষ সেই ভাবনায় বুঁদ। মানুষ আজ মানুষ নেই- প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান দ্বারা চালিত মানবযন্ত্র। প্রতিষ্ঠান যা বলছে সে তাই করছে। এক ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি,  আমার এক নিজের ভাইপো আমি তার রাজনীতি দলকে সমর্থন করি না বলে, সে আমার সঙ্গে কথা বলে না। অতি সহজে ভুলে গেছে রক্তের সম্পর্ক। তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠান। প্রতিদানে তাকে দিয়েছে দান খয়রাতির আরামের জীবন এবং প্রভূত ক্ষমতা। যার দ্বারা সে পাচ্ছে বিনা পরিশ্রমে আয়াসের জীবন। কিন্তু যেদিন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে, এতদিন ফোকটিয়া ভেবে আমি আমার রক্ত খেয়েছি, তাই কঙ্কালসার। সে দিন উঠবে প্রতিষ্ঠান ভাঙার শব্দ। এই বিশ্বাসে আমাদের অটুট থাকতেই হবে। এই বিশ্বাসই তো জীবন। এই বিশ্বাসের শপথ নেওয়ার দিন 'মে দিবস'। ইতিহাস মানুষের মতো কখনো কখনো পেছনের দিকে হাঁটে, কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ -এর জন্য নয়। ইতিহাস নিজের ভুল সংশোধনের দায়িত্ব, সে নিজেই তার কাঁধে তুলে নেবে। সেদিন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মত সে নিজেই বলবে- "তৎপর কর্ণিকা হাতে নিয়ে/ সংস্কারপান্থ হে বন্ধু, ভেঙে যাচ্ছ পুরনো কলকাতা"।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
সত্যজিৎ রায়। শ্রদ্ধা ও স্মরণ 

Post a Comment

0 Comments