জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -পর্ব-৫/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -পর্ব-৫
সন্দীপ কাঞ্জিলাল

প্রাচীনকালে ধর্ম 

ঈশ্বরে বিশ্বাস, প্রার্থনা অনুষ্ঠান বা বলিদান ধর্মানুষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য আদিমতম যে সমস্ত মানুষের কথা আমরা জানি তাদের কোনও ঈশ্বর নেই, কোনও প্রার্থনা বা বলিদান প্রথাও নেই। এই সময় আমরা যা জানতে পারি, তা হল মায়াজাল। 
পৃথিবীতে মানুষ আবির্ভাবের পরে তারা প্রকৃতিতে ছিল বড্ড বেশি অসহায়। অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী মানুষ নানা আচার অনুষ্ঠান রূপকথা উপকথা কেন্দ্রিক মায়াজাল রচনা করে মানুষের মনে ধর্মের অলৌকিকত্বকে দৃঢ়মূল করতে পেরেছিল। প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার সঙ্গে টিকে থাকত যুদ্ধ করে, সামান্য রোগ-শোকেই তাদের মৃত্যু হয়েছে, কখনো হতে হয়েছে হিংস্র পশুর শিকার, বাস করতে হয়েছে গাছের ডালে, নয়তো পাহাড়ের গুহায়। প্রাকৃতিক ঝড়-বৃষ্টি সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিচ্ছিল, তখন তারা প্রকৃতির ভয়ংকর রুপের কাছে ছিল অসহায়। সেই ভয়ানক শক্তির হাত থেকে নিস্তার পেতে তাদেরকে ঐ সব প্রাকৃতিক শক্তির পূজা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। দিনশেষে সূর্য যখন হারিয়ে যায়, তখন রাতের ভয়ঙ্কর কালো অন্ধকার তাদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করতো। এরপর ভোরে যখন সূর্য উঠতো তখন চারদিক আলোয় ঝলমল করলে তারা বুকে সাহস ফিরে পেতো। তাদের মনে আতঙ্ক ছিল সূর্য ডুবে যাওয়ার পর আর যদি কোনদিন না ওঠে? সেই আতঙ্ক থেকে সূর্যকে সন্তুষ্ট রাখতে তারা সূর্যের পূজা করা শুরু করল যাতে সে নিয়মিত উদয় হয় এই ভাবে শুরু হলো প্রকৃতি পূজার।
 ইন্দ্রজালের কৌশল হচ্ছে এই যে বাস্তব ঘটনাকে বশ করার ধোঁকা সৃষ্টি করেই যেন প্রকৃতপক্ষে বাস্তবকে বশ করা যায়। প্রাথমিক স্তরে ইন্দ্রজালের প্রায় সবটাই ছিল অনুকরণ। বৃষ্টির প্রয়োজন হলে ঘনয়মান মেঘ, বিদ্যুৎ চমক ও বৃষ্টিধারার অনুকরণে নাচের অনুষ্ঠান করো। কল্পনায় ঈপ্সিত বস্তুর কামনা পুরণের অনুষ্ঠান করো। এই অনুকরণ অনুষ্ঠানের শেষ দিকে হয়তো থাকবে এক নির্দেশ- বৃষ্টির আদেশ। কিন্তু এটি অনুনয় নয়- আদেশ। এই যৌথ আদেশ অনুষ্ঠান সেই যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যে যুগের সমাজ ছিল অবিভক্ত- প্রত্যেকটি ব্যক্তির উপর  সমষ্টি-সমাজই যেখানে সর্বপ্রধান- সে সময় মানবসমাজ দুর্বলভাবে হলেও যৌথভাবে বিরুপ প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করত। 
কোন ঈশ্বর বা ধর্মের আবির্ভাব তখনো হয়নি, কারণ ভাষা তখনও আবিষ্কার হয়নি। মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করত শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে এবং চিৎকার চেঁচামেচি করে। এরপর সময়ের ধারাবাহিকতায় বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের জ্ঞান বুদ্ধি এবং চিন্তার পরিসর। সেই পরিসরের ভিত্তিতেই তাদের মগজে ঠাঁই নিল যে, এসব খন্ড খন্ড শক্তি নিয়ন্ত্রণের জন্য কেউ না কেউ নিশ্চয়ই রয়েছে। এর ভিত্তিতে জন্ম নিল দেব-দেবতার। এখন থেকেই শুরু হলো প্রকৃতি পূজা বাদ দিয়ে প্রকৃতির সেই সব শক্তির নিয়ন্ত্রক দেব দেবতা পূজার। দেবতাদের তুষ্ট করতে পারলেই তারা সকল প্রকার বিপদ আপদ হতে তাদের রক্ষা করবে এবং অনেক রকম সুযোগ সুবিধা দেবে। ঈশ্বর বা ধর্ম চিন্তা তখনো তাদের মগজে আসন পেতে বসতে পারেনি। কারণ, তাদের মগজ তখনো এতটা বেশি প্রস্ফুটিত হয়নি। কিন্তু ততদিনে মানুষ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যাপার চিন্তা করে দলবদ্ধ হয়ে একত্রে বসবাস করা শুরু করেছে এবং যাযাবর জীবন ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে বসত গড়ে তুলেছে। ভাষা তখনও আবিষ্কার হয়নি। মনের ভাব প্রকাশে এখন শরীরের অঙ্গ ভঙ্গিমার মাধ্যমে যোগ হলো চিত্রাঙ্কন। চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ পেতে শুরু করলো পূর্বের থেকেও অনেক বেশি, যার প্রমাণ মেলে প্রাচীন শিলা লিপিতে। প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন সমাজ বা গোত্রেই তাদের নিজের মত করে দেব-দেবীর সৃষ্টি করে পূজার্চনা শুরু করেছে এবার। ঠিক এরই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর সমস্ত গোত্রের দেব-দেবীর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় তেত্রিশ কোটিতে। 
ধর্মের মত বিজ্ঞানেরও জন্ম এই ইন্দ্রজাল থেকে। কিন্তু ধর্ম বাড়িয়ে তুলল নেতিবাচক দিকটাই- অজ্ঞাতের সামনে মানুষের অক্ষমতার প্রকাশ হলো ধর্মবিশ্বাস। ঠিক অপরদিকে তেমনি বিজ্ঞান ইন্দ্রজালের ইতিবাচক দিকটাকেই বিকশিত করল- যা কিছু জানা গেছে তার ওপর মানুষের ক্ষমতার প্রকাশ হলো বিজ্ঞানে। মানুষের চিন্তাধারায় অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে এই দুই ধারনা অভিন্নভাবেই ছিল। আদি বিজ্ঞানীরা ছিলেন সবাই ধর্মযাজক- তাদের বৈজ্ঞানিক ঐন্দ্রজালিক চিন্তাধারাতেই আচ্ছন্ন ছিল, তাদের পূর্বগামীরা অর্থাৎ আদি ধর্মযাজকরা ইন্দ্রজালের উপর তাদের দখলের জোরেই বিশেষ করে বর্ষা সৃষ্টির ইন্দ্রজালের জোরেই, তাদের ক্ষমতা বজায় রাখত। বর্ষা সৃষ্টিকারী হিসাবেই পুরোহিতের হাতে সমস্ত অধিবাসীর মঙ্গলের দায়িত্ব থাকতো, অধিবাসীরা সবাই তাকে পূজা করত। প্রথম যুগে পুরোহিত এবং ভগবানকে চিন্তা করা হতো অভিন্ন, পরবর্তী যুগে পুরোহিতেরা ভগবানের অবতার বা পৃথিবীতে ভগবানের প্রতিনিধি হিসেবেই পূজিত হতেন। পুরাণে পুরোহিতের যে সমস্ত গুণাবলী বর্ণনা ছিল ঈশ্বর সেই সমস্ত গুণাবলীর অধিকারী হিসেবে পূজিত হতেন, পুরোহিতের অনুরূপেই ঈশ্বরের পূজা ও বলি ইত্যাদির অনুষ্ঠান হতো। ঠিক যেমন পুরোহিতের কাছে আবেদন করা হতো, নানা উপকরণ, খাদ্য দিয়ে তাদের সম্মান দেখানো হতো, ঠিক সেইভাবেই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা ও বলিদানের ব্যবস্থা শুরু হল। ঈশ্বরের সম্বন্ধে এই ধারণার জন্ম হয়েছিল গোষ্ঠীপতি সম্বন্ধে কল্পনা থেকেই। কিন্তু মানুষের মনে এই ধারণাটা দাঁড়ালো উল্টোভাবে। গোষ্ঠীপতিদের ক্ষমতার উৎস ছিলেন ঈশ্বর এবং তার কথাই ছিল ঈশ্বরের কথা। এর থেকে যে ধারণার উদ্ভব হলো বাস্তব চিন্তাধারা তাতে আরও প্রভাবিত হলো। বন্যজীবন থেকে সভ্যজীবনের চূড়ান্ত পদক্ষেপ হলো কৃষিবিদ্যার আবিষ্কার, এর ফলেই শিকারীর বা পশুপালকের যাযাবর জীবন পরিত্যাগ করে মানুষের পক্ষে গ্রামে ও শহরে বসবাস গড়ে তোলা সম্ভব হল। শিকার বা পশুপালনের তুলনায় কৃষিকার্য অনেক বেশি কঠিন কাজ, তার ফলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়া-কলাপ ব্যাপ্ত হল। প্রথম যুগে এ কাজটা প্রধানত ছিল মেয়েদের। পুরুষেরা শিকার ও পশুপালনের কাজ করতো এবং মেয়েরা জমি চাষের কাজ করতো। জমির উর্বরতা বৃদ্ধির উপলক্ষে যে সমস্ত ক্রিয়াকলাপের অনুষ্ঠান হতো সেগুলো ছিল মানুষের বংশবৃদ্ধির অর্থাৎ নবজাতকের উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ক্রিয়াকলাপের অনুকৃতি। অর্থনৈতিক জীবনে স্ত্রী জাতির স্থান অনুসারেই সমাজে তাদের স্থান নির্ণয় হতো। স্ত্রী প্রধানেরা সমাজকে শাসন করত, তাদের যৌন-জীবনকে দেখা হতো ঐন্দ্রজালিক আচার অনুষ্ঠান হিসাবে। পৃথিবী যাতে শস্যশালিনী হয় তার জন্যই যেন রানী অর্থাৎ স্ত্রী-প্রধান গর্ভধারণ করতেন। পুরুষ-প্রধান ছিল যেন নারীর গর্ভধারণের মাধ্যম মাত্র। 
এর থেকেই আমরা পাই নিকট প্রাচ্যদেশের পৌরাণিক মাতৃপ্রধান ধর্ম তন্ত্রের বিশেষ পদ্ধতির পরিচয়। যেমন কোন দেবীর পূজায় তার মূর্তির সঙ্গে কোনো অপ্রধান পুরুষ দেবতার মূর্তি পুত্র বা স্বামী হিসেবে বর্তমান থাকত এবং সে পূজার ক্রিয়াকলাপে প্রজননের ইন্দ্রজালের অনুকৃতিই থাকত প্রধান। কালক্রমে অবশ্য স্ত্রী জাতিরই প্রাধান্য কমে এল, তার কারণ যুদ্ধ-বিগ্রহ ক্রমেই বেড়ে গেল এবং এগুলো প্রধানত ছিল পুরুষের কাজ যার ফলে পুরুষদের হাতেই ধনসম্পত্তি সব জমা হতে থাকলো। এইভাবে ধর্ম জগতেও পুরুষ দেবতার প্রাধান্য বাড়লো এবং দেবী পূজা পিছনে পড়ে গেল। ধারাবাহিকভাবে এ বিষয়ে আলোচনা করলে এটা দেখানো সম্ভব যে খ্রিস্টীয় ধর্মমত এবং তার অনুষ্ঠানের মূলেও রয়েছে আদিম ইন্দ্রজাল। একটা উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট হবে, যেমন খ্রিষ্টমতে ধর্মীয় দীক্ষাদানের (ব্যাপটিজম) ব্যাপার। পূর্বকালীন চিন্তায় সমস্ত পরিবর্তনকেই দেখা হতো মৃত্যু এবং পুনর্জন্ম হিসেবে। জন্ম এবং মৃত্যুকেও দেখা হতো পরিবর্তনের এবং শাশ্বত ধারার দ্বৈত অবিচ্ছেদ্য প্রকাশ হিসাবে। কোন শিশুর জন্ম হলে বলা হত তার কোন মৃত পূর্বপুরুষের আত্মা পুনর্জন্ম নিচ্ছে। শিশু যখন যৌবন অবস্থা পেত তখন যেন তার শিশু জীবনের মৃত্যু হত এবং সে পুরুষ বা নারী হিসেবে পুনর্জন্ম নিত। বয়স্কলোকের মৃত্যু হলে পূর্বপুরুষের আত্মা হিসাবে তার নবজন্ম হত এবং কালক্রমে সে কোন নবজাতক শিশুর কলেবরে পুনর্জন্ম নেবার জন্য অপেক্ষা করতো। আদিম মানুষেরা এইভাবে অমরতায় বিশ্বাস করত। কিন্তু এই মৃত্যুহীনতা খ্রিষ্টমতে ব্যক্তিগত অমরতা ছিল না। তাদের এই ধারণা কোন বিশেষ প্রজাতির ধারাবাহিকতার বৈজ্ঞানিক ধারণা থেকে খুব পৃথক ছিল না। 
খ্রিস্টীয় দীক্ষাদানের লক্ষ্য হচ্ছে দীক্ষা গ্রহণকারীকে এ পৃথিবীর জন্য নয় পরলোকের জন্য প্রস্তুত করা, জীবদ্দশার জন্য নয়, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করা। শ্রেণিসংগ্রাম যাদের প্রধানত পদানত ও নিপীড়িতে পরিণত করেছে, এই পৃথিবীর সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে জন্মগত অধিকার যাদের লুণ্ঠন করা হয়েছে তাদের আর্ত ও ভারাক্রান্ত জীবনের সব আকাঙ্ক্ষা এই বাস্তব দুনিয়া থেকে সরিয়ে এক কাল্পনিক পরজগতে হারানো অধিকার ফিরে পাবার ব্যর্থ আশার দিকে ঘোরানো হয়েছে। জন্মগত অধিকারকে মৃত্যুপরবর্তী অধিকারে পরিণত করা হয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে সম্মুখ সংগ্রামে মানুষের দুর্বলতা যেমন রূপায়িত হয়েছে ইন্দ্রজালে তেমনি সমাজের সঙ্গে মুখোমুখি সংগ্রামে মানুষের দুর্বলতা রূপ পেয়েছে ধর্মে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments