জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৪১/ শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৪১

শ্যামল জানা

দাদাইজম্ শেষ পর্যায়

১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে দুশাম্প, পিকাবিয়া, ম্যান রে, এবং তাঁদের সঙ্গে আর যে সব শিল্পীরা ছিলেন, তাঁরা পরীক্ষামূলকভাবে যে শিল্পকর্মগুলি সৃষ্টি করেছিলেন, সেগুলি থেকেই দাদাইজম্-এর সূত্রপাত হলেও তখনও ওই শিল্পকর্মগুলিকে দাদাইজম্ হিসেবে চিহ্নিতকরণ করা হয়নি৷ ওই প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর মতো ছিল ওই শিল্পকর্মগুলি৷ তবে, আরও নির্দিষ্ট করে সলতে পাকানোর কথা বলতে গেলে বলতে হয়— ‘নিউ ইয়র্ক দাদা’-তে মার্শেল দুশাম্প-এর(দুশাম্প তখন নিউ ইয়র্ক-এ থাকতেন) শিল্পকর্ম থেকেই সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল ১৯১৩ থেকে ১৯১৫ সালে৷ আর, ১৯১৬ সালে, সুইজারল্যান্ড-এর জুরিখ প্রদেশের ‘ক্যাবারে ভোলতেয়ার’-এর ঘরে নামকরণ হয়েছিল, এবং ইয়োরোপে ছড়িয়েছিল ১৯২০ সালে, মার্শেল দুশাম্প ও পিকাবিয়ার হাত ধরে৷ কারণ, তাঁরা তখন নিউ ইয়র্ক থেকে ইয়োরোপ-এ এলেন সূত্রপাতের পর দাদাইজম্-কে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য৷

  কিন্তু, ইয়োরোপিয়ান দাদাইস্টরা, যেমন ত্রিস্তান জারা এবং হানস রিখটার প্রমুখরা মার্শেল দুশাম্প ও পিকাবিয়াকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনলেন না৷ তাঁরা দাবী করলেন, ইয়োরোপ থেকেই দাদাইজম্-এর সূত্রপাত হয়েছে, এবং সেটা আমরাই করেছি৷ এবং এই দাবীর পক্ষে স্বাভাবিকভাবেই সায় দিলেন তৎকালীন বিখ্যাত ইয়োরোপিয়ান শিল্প-ইতিহাসবিদ গ্লাসগো ইউিনিভার্সিটির আর্ট হিস্ট্রির প্রফেসর ডেভিড হপকিন্স৷

  অত্যন্ত বিস্ময়ের ব্যাপার হল এই, যে, দাদাইজম্ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সর্ব অর্থে বিতর্কিত৷ তাদের শিল্প আদৌ শিল্প কিনা? প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শাসকেরা তাদের বিরুদ্ধে সাংঘাতিকভাবে বিতর্ক তৈরি করে গেছে, যেহেতু তারা সর্বদা শাসকের বিরুদ্ধে ছিল৷ আর, নিজেদের মধ্যেও বিতর্ক তৈরি হল নিউ ইয়র্ক থেকে, না ইয়োরোপ থেকে, কোথা থেকে দাদাইজম্-এর সূত্রপাত ঘটেছিল? আর, বিস্ময়ের ব্যাপার হল, এই বিতর্কগুলির কোনোটিরই এতটুকুও সমাধান কোনো শিল্প-ইতিহাসবিদ আজও করতে পারেননি(ছবি-১)৷
  এই যে নিউ ইয়র্ক বনাম ইয়োরোপ, কোথা থেকে এর সূত্রপাত? আসলে, ধারণাগত দিক থেকে ধরলে নিউ ইয়র্ককে ধরতে হয়৷ আবার নামকরণের দিক থেকে ধরলে ইয়োরোপকে ধরতে হয়৷ একটি ছোট্ট ঘটনা বললে বিষয়টা স্পষ্ট হবে৷ আমার মাসতুতো বোন যখন জন্মাল, তার পিঠোপিঠি দাদা, সেও ছোট্ট, সবে কথা বলতে শিখেছে, সে সদ্যজাত বোনকে বনু বলে ডাকতে শুরু করল৷ সেই থেকে ওর নামই হয়ে গেল বনু৷ সবাই বনু বলে ডাকে৷ ছয় বছর বাদে সে যখন ইস্কুলে ভর্তি হবে, তখন ওর বাবা-মায়ের খেয়াল হল, এতদিন ওর আসল নামকরণই করা হয়নি৷ ফলে, ছয় বছর বাদে ইস্কুলে ভর্তির সময় ওর নামকরণ হল ‘শাকি’৷ 

  ‘নিউ ইয়র্ক দাদা’-র ক্ষেত্রে ঠিক এ রকমটাই ঘটেছিল! ১৯১৩-১৪ সালে যে শিল্পকর্মগুলি দিয়ে দাদাইজম্-এর সূত্রপাত ঘটেছিল, সেই শিল্পকর্মগুলি তখন ছিল ‘অ্যন্টি আর্ট’-এর শিরোনামে৷ আবার ‘অ্যন্টি আর্ট’-এর একেবারে প্রথম দিকের কাজগুলিকে বলা হত ‘রেডিমেডস’৷ যেমন ‘বাই সাইকেল হুইল’, ‘ফাউন্টেন’ ইত্যাদি৷ এই কাজগুলি থেকে ধারণাগতভাবে দাদাইজম্-এর সূত্রপাত হলেও এদের ‘অ্যান্টি আর্ট’ বা ‘রেডিমেডস’ হিসেবেই চিহ্নিতকরণ করা হয়েছিল, দাদাইজম্ নয়৷ দুশাম্প-এর এই ‘ফাউন্টেন’ শিল্পকর্মটি যখনই প্রস্তুত হোক না কেন, প্রদর্শিত হয়েছিল ১৯১৭ সালে, ‘সোসাইটি অফ ইনডিপেন্ডেন্ট আর্টিস্ট’ গ্যালারিতে৷ পাশাপাশি ইয়োরোপে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ প্রদেশে ‘ক্যাবারে ভোলতেয়ার’-এর ঘরে বসে হুগো বল বা ত্রিস্তান জারা-রা মিলে যে নাটকীয়ভাবে ‘দাদা’ নামকরণটি করলেন, সে ঘটনাটি কিন্তু ১৯১৬ সালে ঘটেছিল(ছবি-২)৷ 

  স্বাভাবিকভাবে তারা দাবী করতেই পারে— আমরা আগে, এবং নামকরণও আমরাই করেছি৷
তবে, বিতর্ক থাকলেও এটা ঠিক যে, অধিকাংশ শিল্প-ইতিহাসবিদরা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, নিউ ইয়র্ক থেকেই দাদাইজম্-এর সূত্রপাত, এবং দুশাম্পই এর পথিকৃত(Pioneer)ও তাঁর ‘ফাউন্টেন’ শিল্পকর্মটি থেকেই দাদার যাত্রা শুরু৷

  এবং প্রথম থেকেই এই আন্দোলন একই সঙ্গে শিল্প ও সাহিত্য থেকে শুরু হয়৷ মূলত ইতালি থেকে শুরু হয়ে পর্যায়ক্রমে ফ্রান্স, জার্মানি হয়ে প্রায় গোটা ইয়োরোপে ছড়িয়ে যায়৷ প্রাথমিকভাবে এই আন্দোলন ঠিকমতো দানা না বাঁধলেও, কিছু দিনের মধ্যে শুধু ইয়োরোপ নয়, সারা পৃথিবীতে দেশ হিসেবে, এবং মাধ্যম হিসেবও দাবানলের মতো ছড়িয়ে যায়৷
নিউ ইয়র্ক, জুরিখ, ফ্রান্স, জার্মানির পরে পরে বার্লিন, কোলন, প্যারিস, নেদারল্যান্ডস, জর্জিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, জাপান, রাশিয়া, এই সব জায়গায় তো ছড়িয়ে গেছিলই, আর, শিল্প-সাহিত্যের পাশাপাশি সংগীতেও এই আন্দোলনের সুত্রপাত হয়েছিল৷ আর, যেহেতু এই আন্দোলন গতানুগতিকতাকে সম্পূর্ণ বর্জন করে একেবারে নতুন ধারণার আন্দোলন, তাই দৃশ্যশিল্পে অনেক নতুন টেকনিক যুক্ত হল৷ যেমন— কোলাজ, কাট-আপ টেকনিক, ফোটোমন্তাজ, অ্যাসেমব্লজ, রেডিমেড ইত্যাদি।

  পাশাপাশি, আরও একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে লক্ষ করা গেল— এই যে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দাদাইজম্-এর উত্থান, তা কিন্তু সব ক্ষেত্রে এক রকম ছিল না৷ এক-এক জায়গায় আন্দোলনের ধারা বা চরিত্র এক-এক রকম ছিল৷ যেমন— জুরিখ-এর দাদাইস্টরা সাহিত্যের ওপর জোর দিয়েছিল৷ আবার বার্লিন-এর দাদাইস্টরা রাজনৈতিক প্রতিবাদের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিল৷

  বিশিষ্ট দাদাইস্টরা একটি ইস্তাহার প্রকাশ করেছিল বটে, কিন্তু তাঁদের এই আন্দোলন অত্যন্ত ঢিলেঢালাভাবে চলত৷ এই যে বিভিন্ন জায়গায় বা দেশে দাদাদের এতগুলি সংগঠন, কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল, তাদের কোনো কেন্দ্রীয় দপ্তর ছিল না! তাদের প্রথম কার্যকরী ইস্তাহার ১৯১৬ সালের ১৪ জুলাই লিখেছিলেন হুগো বল৷ ত্রিস্তান জারা লিখিত দ্বিতীয় যে ইস্তাহার, দাদাদের সম্পর্কে জানা বা বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেটি প্রকাশ পেয়েছিল ১৯১৮ সালে৷ জারার এই ইস্তাহারে খুব স্পষ্টভাবে ‘ন্যাক্ক্যারজনক দাদা’ এইভাবে ব্যাঙ্গার্থে দাদাদের সম্পর্কে ধারণা দেওয়া আছে, যে— তাদের এই আভাঁ গার্দ আন্দোলনের ভেতরে সমালোচনা ও আধুনিক বাস্তবতার মাঝখানে বেশ কিছু অন্তর্নিহিত অসঙ্গতি আছে৷ আর, বলা হল— তৎকালীন যে আধুনিক শিল্প-সংস্কৃতি, দাদাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সেগুলি যেন ভক্তি-গদগদ ব্যাপার৷ ফলে শিল্প-সংস্কৃতির জন্য যে সব লক্ষ্যবস্তু(Object) বাছা হত,(যার মধ্যে দর্শন ও নীতি-নৈতিকতাও যুক্ত হত), সেগুলি ছিল অত্যন্ত নজরকাড়া কিন্তু খুব মোটা দাগের ও অকার্যকর, তাই অত জনপ্রিয়!

  সব মিলিয়ে দাদাইস্টদের এই যে প্রশাসনের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর প্রতিবাদ, গতানুগতিকতার বাইরে এগিয়ে থাকা আধুনিকতা, চিন্তা-ভাবনা, চরম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এগুলিই কাল হল! সাধারণ মানুষেরা তাঁদের পক্ষে থাকলেও সমাজের মাথারা, প্রশাসন, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে তাঁদের বিপক্ষে থাকল৷ ফলে, ছুতোনাতায় ইচ্ছাকৃতভাবে দাদাইস্টদের কপালে জুটত প্রতিঘাত, কলঙ্ক৷ শুধু তাইই নয়, তাঁদের নিজস্ব ম্যাগাজিন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল৷ প্রদর্শনীও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল৷ অধিকাংশকে জেলখানায় ভরে দেওয়া হয়েছিল৷

  আসলে, ১৯১৬ সালে দাদাইজম্-এর যখন রমরমা, তখন তারা সাধারণ মানুষদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করলেও রাজনৈতিক ডামাডোল এত বেশি ছিল, যে, ইয়োরোপীয় দেশগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অত্যন্ত ব্যস্ত ছিল৷ তাই তাদের দাদাদের দিকে নজর দেওয়ার সময় ছিল না৷ কিন্তু ১৯১৮-র পরে যখন রাজনৈতিক পালাবদল ঘটল, তখনই তাদের দিকে প্রশাসনের কড়া দৃষ্টি পড়ল৷ সারা পৃথিবীব্যাপী তাদের বিস্তৃতি থাকলেও প্রশাসনের প্রত্যাঘাতে তাদের আন্দোলনের ভিত নড়বড়ে হয়ে গেল৷ দলের মধ্যে যে উপদল(Faction)ছিল তারা সব মাথা চাড়া দিয়ে উঠল৷ ১৯২১-২২ সাল নাগাদ অধিকাংশ দাদাইস্ট উপদলে যোগদান করল৷ এই উপদলের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল আঁদ্রে ব্রেতোঁ-র সাররিয়েলিজম্৷ আর একটি উপদল ছিল ‘সোসালিস্ট রিয়েলিজম্’৷

  ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি হয়ে গেছে৷ স্ব-মহিমায় হিটলার৷ তার ভয়ঙ্কর কু-নজরে পড়ল দাদাইস্টরা৷ ফলে, তাদের কেউ কেউ আত্মগোপন করল, কেউ কেউ নির্বাসনে গেল, কেউ কেউ পালিয়ে গেল৷ বাকি যারা থাকল যোগ দিল অন্য দলে, বিশেষত সাররিয়েলিজম্-এ৷ আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে দেখা গেল দাদাইজম্-এর অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়েছে৷ শুধু একা দাঁড়িয়ে আছে ক্যাবারে ভোলতেয়ারের বাড়িটি৷ যেটি আজও আছে পুরোনো স্মৃতি আঁকড়ে মিউজিয়াম হয়ে৷                                     (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments