জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প-- আফ্রিকা(শূকর কেন হাঁটু গাড়ে)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প-- আফ্রিকা
চিন্ময় দাশ
শূকর কেন হাঁটু গাড়ে

এক বুড়ি খেঁকশিয়ালি শুয়েছে তার বাসায়। পাশে এক পাল নাতি-নাতনি। ছোট নাতিটা আবদার ধরল-- ঠাকুমা,  সেই চালাক শেয়ালের গল্পটা বলো না।
ঠাকুমা পড়ল ঝামেলায়। কারণ ? কারণ হোল, অন্য নাতি-নাতনিদের বিরক্তি। তারা এই পুরানো গল্পটা আর শুনতে চায় না।  কতবার যে এই গল্পটা তাদের শুনিয়েছে, তার নাই ঠিক। শুনে শুনে কান পচে গেছে সকলের।ছোট নাতিটার আবার এই গল্পটাই পছন্দ। সব সময় এই গল্পটাই শুনতে চায় সে। 
   গল্পটা হল এরকম--  একবার এক সিংহের মুখ পড়ে গেছল একটা শেয়াল। শেয়াল তো ভারী চালাক জীব। প্রাণ বাঁচাতে,  একটা ফন্দি করেছিল সে। পাশেই পাহাড়টা ঝুঁকে ছিল রাস্তার দিকে। সিংহ তাকে দেখবার আগে, শেয়াল করেছিল কী,  ঝট করে সামনের দুটো পা পাহাড়ে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সিংহকে বলেছিল, এক্ষুনি পাহাড়টা পড়ে যেতে পারে।  রাজামশাই যদি দয়া করে একটু সময় এটাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে, তাহলে একটা সুরাহা করে ফেলতে পারবে সে। দৌড়ে 
 গিয়ে শক্ত দেখে একটা লগি এনে ঠেকনা দিয়ে দেবে। বেশিক্ষণ ধরে রাখতে হবে না। সে যাবে আর আসবে। তো,  সিংহ অতশত না ভেবে রাজি হয়ে গিয়েছিল। বেশ দেমাকি চালে কয়েক পা এগিয়ে, পাথরে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। শেয়াল তো এটাই চাইছিল। সাথে সাথেই এক দৌড়। রাজামশাই কতক্ষণ পাহাড়ে পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছিল,  সেটা কেউ জানে না। তবে, শেয়াল যে ফিরে আসেনি, এ কথা বন আর পাহাড়ের সবাই জানে। মানে,  বুক ফুলিয়ে সবাইকে শুনিয়েছিল শেয়াল। রাজাকে বোকা বানানো তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। এমন গর্বের কথা সবাইকে না শুনিয়ে কি থাকা যায়? এইটা হল সেই গল্প।
   যাকগে, ঠাকুমাকে কিছু বলতে হল না। বাকি বাচ্চাগুলো সবাই চেঁচিয়ে উঠল-- তুই কি পাগল করে দিবি আমাদের?  এই একটা গল্প শুনে শুনে, কান পচে গেছে আমাদের। না ঠাকুমা, তুমি এই গল্পটা বলবে না কোনদিন। ভাল্লাগে না আমাদের। 
   শুনে বুড়ি শেয়াল হেসে উঠল। অমনি বাকিরাও সবাই যোগ দিল সেই হাসিতে।হাসির চোটে ঘর ফেটে যাওয়ার যোগাড়।  কিন্তু হলে কী হবে? ছোটর আব্দার তাতেও থামে না-- ঠাকুমা, তোমারও ভালো লাগে না গল্পটা? 
ঠাকুমা বলল-- লাগে না মানে? খুব ভালো লাগে। আমাদেরই তো পূর্বপুরুষের গল্প। ভালো লাগবে না কেন? কত গর্ব করে বলবার মত ঘটনা।
-- তাহলে, বলো তুমি। ছোট বেশ খুশি। 
   ঠাকুমা বলল-- কিন্তু ভাই, তোমার ভাই-বোনেরা কালা হয়ে যাক, এটা কি ভালো কথা? তুমিও নিশ্চয়ই সেটা চাও না।  তার চেয়ে অন্য একটা গল্প বলি, শোন সবাই। একেবারে একই রকম ঘটনা। কিন্তু সবাই কি আর একই রকম চালাক হতে পারে? 
 শোন সকলে, ভারী মজার ঘটনা একটা।
ঠাকুমা গল্প বলতে শুরু করল।
আমাদের এই আফ্রিকায় তো পাহাড় আর বন-- এই নিয়ে গোটা এলাকাটা ঘেরা। আর,  আফ্রিকা মানেই সব রকমের 
  জীবই বাস করে এই এলাকায়। এক বার হয়েছে কী, সুন্দর একখানা ঘর বানিয়েছে একটা বুনো শূকর।
 এক নাতনি বলে উঠল-- সে কিগো, ঠাকুমা? শূকর ঘর বানিয়েছে?
-- আসলে সেটা ছিল বিশাল একটা উইয়ের ঢিবি, বুঝলে। ঠাকুমা বলল-- কত কালের ঢিবি, কে জানে। 
আমাদের এই দেশে তো পিঁপড়ে-ভালুক আছে। পিঁপড়ে আর উইপোকা খেয়েই বেঁচে থাকে তারা। মুখখানা যেমন লম্বা,  জিভখানা তার চেয়েও বড়। জিভটাকে একবার গর্তে সেঁধিয়ে দিতে পারলে হোল। উইপোকার গোটা বংশ সাবাড় করে দেয় তারা। তখন শুন্য বাসাটা পড়ে থাকে। রোদে পুড়ে পুড়ে, জমে একেবারে পাথরের মত হয়ে যায় ঢিবিগুলো। তেমনই একটা বিশাল ঢিবি পেয়ে গিয়েছিল একটা শূকর। ঘষে-মেজে সেটাকেই সে নিজের ঘর বানিয়ে নিয়েছিল।
   এসব কথা থাক। আসল গল্পটা বলি, শোন। ঠাকুমা বলে চলল-- বেশ বড়সড় ঢিবি।  সেটাকেই নিজের বাড়ি বানিয়ে নিয়েছে শূকরটা। তোমরা তো জানো, বড়বড় ধারালো দাঁত আছে বুনো শুকরদের।  তাই দিয়ে ঢিবিটাতে ইয়াব্বড় একখানা দরজা বানিয়েছে সে। সেই দরজা নিয়ে ভারী দেমাক শূকরের। এমন চমৎকার বাড়ি গোটা দেশে আর কারোও নাই। এমনটাই সবাইকে বলে বেড়ায় শুকর। একটা জিরাফও মাথা উঁচিয়ে ঢুকে পড়তে পারে তার বাড়িতে। এতোখানি বড় তার দরজা।  আর জেব্রাদের তো কথাই নাই। দৌড়তে দৌড়তে ঢুকতে পারবে তারা। কোন অসুবিধাই হবে না। 
কথায় বলে না, কোন বিষয়ের বাড়াবাড়ি ভালো নয়। যে বড় দরজা নিয়ে তার দেমাক,  সেটাই একদিন বিপদ ডেকে আনল শুকরের।
  হয়েছে কী, একদিন ভর পেট খেয়ে, ঘরে এসে বিশ্রাম করছে শূকরটা ।হঠাৎ চোখে পড়ল,  হেলতে দুলতে একটা সিংহ এগিয়ে আসছে তার বাড়িটার দিকে। সর্বনাশ! কী হবে এখন? ভয়ের চোটে মাথা ঘুরতে লাগল তার। 
   একটাই দরজা বানিয়েছে শূকর। পিছনে ছোট মতো কোন দরজাও নাই যে সটকে পড়বে।  সামনের বড় দরজাটাই হয়েছে বিপদ। সিংহের কোন অসুবিধাই হবে না ঢুকে পড়তে। ভয়ে হাত-পা কাঁপতে লাগলো তার।এই বড় দরজাটার জন্য আজ সিংহের পেটে যেতে হবে তাকে।
   হঠাৎই শেয়ালের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল শুকরের। দারুণ একটা ফন্দি করেছিল বটে শেয়াল।  বোকা বানিয়ে দিয়েছিল রাজাকে। 
   শূকরটা ভাবল, আমিই বা শেয়ালের চেয়ে কম যাই কিসে? সিংহকে বোকা বানানো কী এমন কঠিন! অতি সহজ কাজ।এই না ভেবে,সাথে সাথে দেয়ালের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে চেঁচাতে লাগল শুকরটা-- বাঁচাও, বাঁচাও। মরে গেলাম।
   সিংহ ততক্ষণে সামনে চলে এসেছে। ধমক দিয়ে বলল-- চুপ কর, ব্যাটা। চেঁচাচ্ছিস কেন? হয়েছেটা কী?
শূকর কাঁদো কাঁদো গলা করে বলল-- দেখতে পাচ্ছেন না, ঘরটা ভেঙে পড়ছে। ঢুকবেন না। সরে পড়ুন, রাজামশাই। নইলে, দেওয়াল চাপা হয়ে মারা পড়বেন।
এক ঝলক দেখে নিল সিংহ। তারও মনে পড়ে গেল শেয়ালের ঘটনাটা। শেয়াল সে বার বড্ড বোকা বানিয়ে দিয়েছিল তাকে।এই হতভাগাও সেই ফন্দি এঁটেছে। গর্জন করে উঠল সিংহ-- চুপ কর, হতচ্ছাড়া। নইলে, এক ঝাপটে অক্কা পাইয়ে দেব।বোকা পেয়েছিস আমাকে? 
   এমন ভয়ানক গর্জন, ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল শূকরটা। দেওয়াল ছেড়ে, হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল সিংহের সামনে।  কোনও রকমে তোতলাতে তোতলাতে বলল-- মাফ করে দিন, রাজামশাই। বড্ড ভুল হয়ে গেছে। জীবনে আর এমনটা হবে না। 
   শূকরের  সেদিন কপালটাই ভালো ছিল, বলতে হবে। কেন না, সিংহেরও তখন পেট ভার। খাওয়া-দাওয়া সেরে,  ঘরে ফিরছিল ঐ পথ দিয়ে। আর ঝামেলা বাড়াবার ইচ্ছা নাই মনে। বলল-- এইভাবে হাঁটু মুড়েই বসে থাক, ব্যাটা। বুদ্ধু কোথাকার।
   নিজের মনে এক চোট হেসে নিল সিংহ। কেশরশুদ্ধ মাথাটা দোলাতে দোলাতে চলে গেল সেখান থেকে। 
ঠাকুমা বলতে লাগল-- ভেবে দ্যাখ একবার, অল্প-বুদ্ধি শূকর গিয়েছে কি না, শেয়াল-পন্ডিতের ফন্দি নকল করতে।এবার বোঝ মজাটা। সারা জীবন হাঁটুগেড়েই বসতে হচ্ছে বেচারাকে। কী বিচ্ছিরী একটা ভঙ্গী!  শরীরের পেছন দিকটা উঁচিয়ে থাকে। সামনের পা দুটো মুড়ে, মাটিতে মুখ গুঁজে গুঁজে খাবার খেতে হয় তাদের। কী লজ্জা, কী লজ্জা!

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments