জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -পর্ব-৮/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -পর্ব-(৮)
সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মে ঈশ্বরের প্রবেশ 

মানুষের চিন্তা জগত এক প্রাচীন ব্যাপার। গত সহস্রাব্দে বিষয়টা মাথাচাড়া দিয়েছে বারবার। দিয়েছে নানা উপলক্ষে। ব্রহ্মান্ডের চৌহদ্দি কতটা, স্বর্গে আর মর্তে এরকম নিয়ম চালু কিনা, মানুষের বাসস্থান পৃথিবীর চারপাশে সমস্ত গ্রহ তারা আবর্তনশীল কি না, মানুষ শিম্পাঞ্জির আত্মীয় কি না- এমন সব প্রশ্নে ধর্ম আর বিজ্ঞান মুখোমুখি বসেছে তর্কে। তবে, ইতিহাসের দিকে তাকালে এ কথা মানতে হয় যে, সপ্তদশ শতাব্দীতে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মপূর্বে ধর্মের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। নতুন বিজ্ঞানের সূত্রপাত যাদের পরিশ্রমে, তারা প্রায় সবাই ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান। যারা বিশ্বাস করতেন প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে তারা অবলোকন করছেন সৃষ্টিকর্তার লীলা খেলা। এরকম বিজ্ঞানীর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ সম্ভবত আইজ্যাক নিউটন। যিনি বুঝতে পেরেছিলেন এর গূঢ় সত্য। যে নিয়মে গাছের আপেল মাটিতে পড়ে, সেই নিয়মেই চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। অর্থাৎ স্বর্গে আর মর্তে একই নিয়মের অনুশাসন। 

  কিন্তু ওই যে আকর্ষণ বল, যা ক্রিয়াশীল গাছের আপেল কিংবা আকাশের চাঁদের ওপর, তার ব্যাখ্যা কি? নিউটনের কাছে ঈশ্বরের অভিপ্রায় ভিন্ন এর অন্য কোনও ব্যাখ্যা ছিল না। আকর্ষণ বেঁধে রেখেছে ব্রহ্মাণ্ডের বস্তুরাজিকে। আকর্ষণ বিনে কে কোথায় ছিটকে চলে যেত, তার ঠিক নেই। সবকিছু যাতে যথাযথ স্থানে থাকে, তাই সৃষ্টিকর্তার বিধান হিসেবে হাজির ওই আকর্ষণ বল। 

  দেখা যাচ্ছে, বিশ্বাসের প্রশ্নে নিউটন তার চেয়ে প্রায় দু হাজার বছরের প্রাচীন চিন্তাবিদ প্লেটোর সমমনোভাবাপন্ন। দেমোক্রিতোস কিংবা লিউসিপ্পাস- এর মতো দার্শনিকেরা ঈশ্বরের উল্লেখ না করে কেবল অণু-পরমাণুর ধারণায় বিশ্বের সব কিছু ব্যাখ্যার চেষ্টা করায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন প্লেটো। বলেছিলেন, যারা অস্বীকার করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব, বিশ্বাস করে না যে তিনি মানুষের হিতাকাঙ্খী, তাদের প্রথম শাস্তি হোক পাঁচ বছরের একাকী কারাবাস। আর ওই সময়ের মধ্যে মত না বদলালে প্রাণদণ্ড। নিউটন ও যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত এর বস্তুবাদী চিন্তায়, জগতের রহস্যাবলি ব্যাখ্যায় সৃষ্টিকর্তার ভূমিকা অগ্রাহ্য করায়। এই বিশ্বে কিছু বস্তু (সূর্য কিংবা অন্য নক্ষত্র) কেন জ্যোতিস্মান, আর কিছু (পৃথিবী বা অন্য গ্রহ) কেন তেমন নয়- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, ঈশ্বরের অভিরুচি ভিন্ন এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। 

  অষ্টাদশ শতাব্দীতেও এমন অনেক বিজ্ঞানী ছিলেন, যারা বিশ্বাস করতেন, মানুষের মঙ্গল-অমঙ্গল বিষয়ে উদ্বিগ্ন কেউ না থাকলেও, নীতি-নিয়মের অনুশাসনে ব্রহ্মাণ্ডকে চালনা করার মত একজন ঈশ্বর নিশ্চয়ই আছেন। মোটামুটি ভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানীদের ঈশ্বর বিশ্বাসে ভাটার টান। চার্লস ডারউইন প্রচারিত বিবর্তনবাদ এহেন পটপরিবর্তনের মূলে অনেকটা দায়ী। বিংশ শতাব্দি কিংবা তারপর এই একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় পৌঁছে পরিস্থিতিটা কিন্তু একটু জটিল। বিজ্ঞানে আর ধর্মে শুধু হ্যান্ডশেক, বা শুধু বক্সিং এর যুগ নয় এখন। তা হলে এটা কি রকম? এ প্রশ্নের উত্তরে আমেরিকার মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপিকা সুজান হাক বলেছেন, বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক কেমন হবে, সেটা পরের ব্যাপার। এ যুগে লক্ষণীয় যা, তা হল ও দুয়ের মধ্যেকার টেনশন। 

  ওয়েনবার্গের ব্যাখ্যা: 'ধর্ম একদা যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করত বিদঘুটে প্রাকৃতিক ঘটনাবলি- বজ্রপাত, ভূমিকম্প, মহামারী থেকে। ওসব এমন অস্বাভাবিক যে, ওদের পিছনে কোনও না কোনও ঐশ্বরিক শক্তি কল্পনা রীতিমতো সহজ। তারপর যত দিন গেল, তত ওরকম ঘটনাবলী বিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হলো। এমত পরিস্থিতিতে ধর্মের শক্তি ক্ষুণ্ন হতে বাধ্য। 

  ওয়েনবার্গের মতে টেনশনের দ্বিতীয় কারণ প্রথমটিরই সূত্রে। প্রকৃতি ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে ক্রমশ সন্দেহ গাঢ় হয়েছে এই ব্রহ্মান্ডে মানুষের গুরত্ব বিষয়ে। যদি জানা যায়, আমাদের বাসভূমি পৃথিবী আর পাঁচটা গ্রহের মধ্যে একটা, গ্যালাক্সি শত শত কোটির মাত্র একটা, অথবা দৃশ্যমান গ্যালাক্সিগুলো মহাব্রহ্মান্ডের সামান্য এক অংশবিশেষ, তা হলে আর আমরা মহার্ঘ কিসে? ওয়েনবার্গের বিচারে মানুষের গুরুত্বহানিতে সবচেয়ে বেশি ইন্ধন জুগিয়েছে চার্লস ডারউইন এবং আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস এর বিবর্তনবাদ। মানুষ হলো রূপান্তরিত পশু, যার আবির্ভাব দেবতার দান নয়, এরকম প্রত্যয় ধর্মবিশ্বাসে ঘুণ ধরাতে বাধ্য। ডারউইন নিজে খ্রিস্টধর্মে আস্থা হারিয়েছিলেন কালক্রমে। 

  প্রথাগত ধর্ম গুলি কোন ও না কোনও ক্ষমতার কাছে মাথা নত করে। সেই ক্ষমতাটি হতে পারে পয়গম্বর, পোপ কিংবা ইমাম, যারা সমস্ত ত্রুটির ঊর্ধ্বে। অথবা সেটি হতে পারে পবিত্র বাণী, যেমন কোরান বা বাইবেল। বিজ্ঞানীরা কি গুরুবাদী নন? নন হিরো-পূজারী? হ্যাঁ, ওয়েনবার্গ কবুল করেছেন, বিজ্ঞানীরাও কোনও না কোনও বড় ব্যক্তিত্বের বক্তব্যে আস্থাবান। তবে, ওয়েনবার্গ লিখেছেন, 'সেই আস্থার চরিত্রটা ভীষণ আলাদা। আমি যদি (আলবার্ট আইনস্টাইনের) জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি-র কোনও একটা গুঢ় দিক বুঝতে চাই, তাহলে আমি হয়তো ও ব্যাপারে আধুনিক কোনও বিশেষজ্ঞের পেপার পড়ে দেখব। তবে, পড়ার সময় আমি এটাও মনে রাখবো যে, ওই বিশেষজ্ঞের চিন্তা ভুলও হতে পারে। এ ব্যাপারে যে কাজটি আমি আদৌ করবো না, তা হলো, আইনস্টাইনের মূল পেপার গুলো পড়ে দেখা। ওটা আমি করব না, কারণ আমি জানি, আজকের একজন ভালো ছাত্র জেনারেল রিলেটিভিটিটা আইনস্টাইনের চেয়ে ভালো বোঝে।

 বিজ্ঞান এগিয়ে চলে। সত্যি, আজ আমরা এটা জানি যে, যে চেহারায় আইনস্টাইন তার তত্ত্বটি প্রণয়ন করেছিলেন, তাতে ওটা সম্পূর্ণ সত্য নয়, তার কাছাকাছি কিছু। ওটা খাটে বিশাল দূরত্বের চলমান বস্তুরাজির বেলায়; একরত্তি জায়গার মধ্যে পদার্থের গতিবিধি- বিগ ব্যাং এর সময়কালের অবস্থা- ওই তত্ত্ব দিতে পারে না। হ্যাঁ, বিজ্ঞানে হিরো আছে। যেমন কিনা আইনস্টাইন, যিনি নিঃসন্দেহে গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী। তবে, আমাদের কাছে ও রকম হিরোরা অভ্রান্ত পীর-পয়গম্বর নন। যেসব মানুষ দৈনন্দিন জীবনে মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী, ভীত নন জিজ্ঞাসা কিংবা বিতর্কে, তাদের পক্ষে, বিজ্ঞানের আদব-কায়দা দেখার পর, ধর্মের প্রশ্নহীন আনুগত্য মানা কঠিন।

  তাছাড়া একমেবাদ্বিতীয়ম পরমেশ্বরে বিশ্বাস করলেও শুধুমাত্র সেই বিশ্বাসকেই ধর্ম আখ্যা দেয়া যায় না। কারন সে পরমেশ্বরকে জেহোবা আল্লাহ গড ঈশ্বর বা ভগবান যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সে সত্তা এক ও অভিন্ন। অতএব শুধুমাত্র উপাসনা করলে তার কাছে আত্মসমর্পণ করলে কোন মানুষ ইহুদি খ্রিস্টান মুসলমান-হিন্দু এসব পরিচয় হতে পারে না।  বরঞ্চ যেহেতু সব মানুষের উপাস্য দেবতা এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বর, অতএব তাদের মধ্যে এ বিষয়ে বিভেদ ও সংঘাত না থাকায় প্রত্যাশিত। পরমেশ্বর সৃষ্টিকর্তা রুপে সৃষ্টির বাইরে থাকুন, অথবা মহাবিশ্বের ভিতরে এবং বাইরে সর্বত্র বিরাজমান থাকুন, বিশ্বাসীদের কাছে তিনি ভিন্ন আর কোন সর্বোত্তম, সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজিত সর্বজ্ঞ এবং সর্বদ্রষ্টা শক্তি নেই। তবে পৃথিবীর মানুষেরা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের নামে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে পরস্পর হানাহানি করবে কেন?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments