জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব-৯ /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব-৯
  
সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মে ঈশ্বরের প্রবেশ

তাহলে এবার প্রশ্ন জাগে আমরা যে এত কাল শুনে এসেছি 'ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা' তা কি ভুল? এমনকি অনেক বিদগ্ধ পণ্ডিত ও এই মত সমর্থন করেন। তাহলে আবার প্রশ্ন ব্রহ্ম কি? কেমন এই ব্রহ্ম? উপনিষদের দার্শনিক ঋষিগণ বলেন- ব্রহ্মা সারা বিশ্বব্যাপী এক প্রচ্ছন্ন সত্তা- মহাবিশ্বের প্রতি কণায় ব্রহ্ম উপস্থিত। ব্রহ্ম শব্দের ধ্বনিগত অর্থ হলো, যা সর্বব্যাপী, যা সকল বস্তুর মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে ব্যপ্ত। কঠোপনিষদের মন্ত্রে এইভাবে বলা হয়েছে- "একস্তথ সর্বভূতান্তরত্মা রুপং রুপং প্রতিরূপো বহিশ্চ।" অর্থাৎ একই আত্মা, মানে আদিসত্তা বা সৃষ্টির আদি উৎস বিভিন্ন জীবের রূপে প্রকাশিত হয়েছে। এই একই আদিসত্তার ও বহুরূপে প্রকাশ। সুতরাং উপনিষদ বলেছে একই অদ্বিতীয় ব্রহ্ম বিশ্বের সবকিছুর মধ্যে থেকেই বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই হল উপনিষদের সারাৎসার। 
   উপনিষদের ঋষিরা আরও বলেন- বিশ্ব হলো সৃষ্টি, ব্রহ্ম হল স্রষ্টা। এবং ব্রহ্ম যদিও এই জগতের স্রষ্টা। এই জগতের উপাদান ও ব্রহ্ম। অর্থাৎ একটাই সত্তা যে বিশ্বকে সৃষ্টি করেছে আবার বিশ্বকে ধরেও রেখেছে। তাই এই মহাবিশ্ব অখন্ড। এই মহাবিশ্বের সবকিছুই ব্রহ্ম। ব্রহ্মই তার জন্মের উৎস। ব্রহ্মের মধ্যেই তার ব্যাপ্তি। ব্রহ্মেই তার বিলয়। তাহলে এই বিশ্ব সৃষ্টির কারণ কী? উপনিষদের ঋষি তার ব্যাখ্যায় তাও বলেছেন, তাঁরা বলেন- রসের আস্বাদন। বিশ্বের আদিসত্তা ব্রহ্মা চেতনাহীন নয়। তাই তিনি সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি তার আনন্দ ও রস পেতে চাইলেন। তিনি একা একা আনন্দ পাচ্ছিলেন না। তাই আনন্দের জন্য সেই আদি ও একক সত্তা বহু হলেন, একাকী থেকে আনন্দ পেলেন না বলে বহু হলেন। ব্রহ্মের এই বহু প্রকাশকে উপনিষদ বর্ণনা করল 'মধুময়' বলে। 
   কিন্তু ব্রহ্মের এই 'মধুময়' প্রকাশকে আবার 'মায়াময়' বলে বর্ণনা করলেন শংকরাচার্য। উপনিষদের নতুন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি জন্ম দিলেন মায়াবাদের। তাই শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদের আরেকটি নাম মায়াবাদ। তিনিও বিশ্বকে একমেবাদ্বিতীয়ম ব্রহ্মের প্রকাশ হিসেবে দেখলেন। তিনি বললেন- আমরা ভুল করে ব্রহ্মকে বহু আকারে দেখছি, এই দেখা মিথ্যা, এই সবই মায়া। এই মায়াময় জগতকে ত্যাগ করে এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্মকেই সত্য বলে মেনে নিতে হবে। তিনি আরও বলেন- ব্রহ্মা কোনও অবস্থাতেই বহু হন না। অর্থাৎ এই জগৎ, যাকে আমরা ব্রহ্মের বহুরুপ ভাবছি, তা ভাবছি মায়ার ছলনায়, বিশ্বের মধ্যে আমরা ব্রহ্মের যে বহু সত্তা দেখেছি, বহুরূপে প্রকাশ দেখেছি, তা সম্পূর্ণ ভুল দেখা, আমরা জগতের মায়ার ফাঁদে পড়ে এই ভুল করছি। অতএব ব্রহ্মকে উপলব্ধি করতে, তাকেই একমাত্র সত্য  মেনে নিয়ে আমাদের জগতকে মিথ্যা বলে ত্যাগ করতে হবে। 
  তিনি সারা ভারত জুড়ে এই বাণী প্রচার করে আমাদের কর্মসংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাসকে পিছিয়ে দিলেন হাজার বছর। জগতকে মায়া ও মিথ্যা জ্ঞান করে আমরা কর্মবিমুখ হয়ে উঠলাম। জগতকে মিথ্যা ভাবতে পেরেছিলেন বলে তিনি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হতে পেরেছিলেন। তাই এই ভাবনায় ভাবিত হয়ে ভারতের সবাই যদি সন্ন্যাসী হয়ে যান, তা কি মঙ্গলের হবে? এই ভাবনা থেকে বিশ্ব যদি সন্ন্যাসের পথে যায়, জগতকে মিথ্যা জ্ঞান করে, তাহলে তো সৃষ্টির উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে, তাইতো রবীন্দ্রনাথের সত্যোপলব্ধি- 'বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়।' 
  বেদ বা উপনিষদ কোথাও বলেনি, এই জগৎ মিথ্যা। বরং উল্টো কথাই বলছে- এ জগৎ মায়া নয়, সত্য! শুধু বেদ বা উপনিষদ নয়, আধুনিক বিজ্ঞান ও বলছে একই কথা। আমরা যদি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে জগতকে বুঝি, তা হলে মন থেকে আমরা এই ধারণা উপড়ে ফেলতে বাধ্য হব যে এ জগৎ মিথ্যা। কারণ, বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, এক উৎস থেকে এই জগতের সব কিছুর সৃষ্টি, সেই 'উৎস' যেমন সত্য, তেমনি সত্য এই জগৎ। বেদ ও উপনিষদের মতে ও সমস্ত মহাবিশ্বের কণায় কণায় উপস্থিতি সেই 'উৎস', বিরাজমান সেই আদিসত্তা। সুতরাং উৎস বা আদিসত্তার মত এ জগত ও সত্য। 
  বহু ভারতীয়র কাছে এ কথা বলে তাদের এই ধারণা থেকে টলাতে পারবো না যে জগৎ মিথ্যা, জগত মায়া। তাদের বিশ্বাস জীবনে মোক্ষ লাভ করতে হলে, পুণ্য সঞ্চয় করতে হলে জগতকে মায়া ও মিথ্যা বলে ত্যাগ করে সত্যোপলব্ধির দিকে এগোতে হবে। 
   জগৎ সত্য এবং জগতকে উপভোগ করার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই- এ কথা আমাদের সমাজে প্রায় বলাই যায় না। বললেই, সমাজের প্রবীণরা চিৎকার করে উঠবেন এই বলে যে, সমাজকে আমি অন্যায় ভোগবাদের লোভ দেখাচ্ছি এবং পাপের পথে নিয়ে যাচ্ছি। অধিকাংশ ভারতীয়ের মনে যেন জগতকে উপভোগ করার ব্যাপারে একটি গভীর পাপ বা অন্যায়বোধ কাজ করে। এই পাপ বা অন্যায় বোধ তাদের মধ্যে ছোটবেলা থেকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, জগৎ হলো মায়া। এই মায়া ক্রমাগত আমাদের লোভ দেখাচ্ছে অন্যায় করার জন্য, কিন্তু আমরা যেন সেই মায়ার ফঁদে না পড়ি। মায়ার প্রলোভনে সাড়া দেওয়া হল পাপ। মায়ার বিচিত্র প্রলোভন থেকে মুখ ফিরিয়ে জগতকে মিথ্যা বলে ত্যাগ করলেই সত্যের পথে এগোনো যাবে, জীবনের উদ্দেশ্য সফল হবে। 
   এই পাপ বোধ এমনভাবে গেঁথে দেওয়া হয়েছে ভারতীয়র মনে যে বিপরীত চিন্তা করাটাও অন্যায়। কেন পাপ হবে জগতকে সত্য বলে মেনে তাকে উপভোগ করলে? যদি কেউ কখনও প্রশ্ন করেন, তাকে গম্ভীর ও কঠোর ভাষায় বলা হয়, ভারতের প্রাচীনতম ধর্মশাস্ত্র বেদ ও উপনিষদকে আপনি 'চ্যালেঞ্জ' করছেন? বেদ আর উপনিষদের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বাণীই হল, জগৎ মায়া, জগৎ মিথ্যা। হিন্দুধর্মের সারকথাও তো তা-ই! 
আসলে কিন্তু বেদ বা উপনিষদ একবার ও বলছে না জগৎ মিথ্যা! আসলে বলছে নিরাসক্ত ভোগের কথা।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments