জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস- ৪৫/শ্যামল জানা


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৪৫

শ্যামল জানা

সাররিয়েলিজম্ (চতুর্থ অংশ)

সাররিয়েলিস্টরা মূলত যেটা চেয়েছিলেন, তা হল— অসচেতন বা অবচেতন মনকে সচেতনভাবে ব্যবহার করা৷ সেটা করতে গেলে প্রথমেই কল্পনাকে মুক্ত করে দিতে হবে, একেবারে স্বাধীন করে দিতে হবে৷ তার শক্তিকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে৷ আর যুক্তি, সাধারণ বাস্তবতা, যা দিয়ে সাধারণত তথাকথিত যে সব শিল্প-সাহিত্য হয়, এসব সরিয়ে রাখতে হবে, এবং মনঃসমীক্ষণের দ্বারা যতদূর সম্ভব প্রভাবিত হতে হবে৷ কারণ সাররিয়েলিস্টরা বিশ্বাস করতেন— যুক্তিবাদী মন কল্পনাশক্তিকে অবদমন করে, যুক্তির নিষেধ দিয়ে জোর করে সৃষ্টির অবনমন ঘটায়৷

  তাঁরা দার্শনিক তথা সমাজ-বিজ্ঞানী কার্ল মার্কস-এর দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত ছিলেন৷ মনের(Psyche) এত শক্তি, যে, প্রত্যেকদিন পৃথিবীতে যে সব অসঙ্গতি ঘটে, সেই মনের শক্তিই পারে তাকে সেগুলিকে চিহ্নিত করতে, তাদের মুখোমুখি হতে৷ এবং তাঁরা আশা করতেন— একদিন এই মনের শক্তির দ্বারাই উদ্দীপনার সঙ্গে বিপ্লব সংঘঠিত হবে৷ তাঁরা ব্যক্তিগত কল্পনাশক্তির ওপর জোর দিতেন বলে রোমান্টিসিজম্-এর ঐতিহ্য বহন করতেন বটে, কিন্তু তাঁরা পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা ধরনের ছিলেন৷ তাঁরা বিশ্বাস করতেন— নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া সম্ভব শুধুমাত্র এই পথ-চলতি রাস্তা এবং প্রাত্যহিক জীবন থেকেই৷ তাঁদের সবচেয়ে বেশি ঝোঁক ছিল অসচেতন মনের দরজা খুলে দেওয়ার প্রতি৷ তাঁদের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল পৌরানিক কাহিনি(Myth)এবং প্রাচীনত্বের(Primitivism) প্রতি৷ যা, পরবর্তীকালে একাধিক আন্দোলনকে দানা বাঁধতে সাহায্য করেছিল৷ আর, তাঁদের শৈলী সেদিন থেকে আজও সমান প্রভাবশালী৷

    প্যারিসকে ভিত্তি করে যে সব লেখক-শিল্পীরা ছিলেন তাঁরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছিলেন, এবং অন্তর্বর্তী সময়ে অনেকেই দাদাইজম্-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন৷ এঁরা বিশ্বাস করতেন— অতিরিক্ত যুক্তিসম্মত চিন্তা-ভাবনা(Rational thought)এবং বুর্জোয়া মূল্যবোধই পৃথিবীতে যুদ্ধের দ্বন্দ্ব ডেকে এনেছিল৷ এর প্রতিবাদে দাদাইস্টরা ‘অ্যান্টি আর্ট’ সমাবেশ করা, প্রদর্শনী করা, নানা প্রতিবাদী লেখা, আর্ট-ওয়ার্ক, ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ড করেছিলেন৷ এবং তাঁরা এইসব চালিয়েও গেছিলেন৷ থামেননি৷

    সাহিত্যিক ও কবি আন্দ্রে ব্রেতোঁ ছিলেন মেডিসিন ও মনোরোগ-চিকিৎসার(Psychiatry)ডাক্তার৷ যখন রীতিমতো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে, তখন তিনি কোনো এক স্নায়বিক হাসপাতালের (Neurological hospital)ডাক্তার ছিলেন৷ সেখানে তিনি গোলা-বিস্ফোরণে স্নায়ু-বৈকল্য(Shell-shocked)জওয়ানদের চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন৷ তিনি তাদের চিকিৎসা করেছিলেন জার্মানির ডাক্তার সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতির(Psychoanalytic methods) সাহায্যে৷ সেখানে তাঁর জ্যকুয়েস ভাচে(Jacques Vaché)-র সঙ্গে আলাপ হয়৷ ভাচে ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান-বিরোধী দার্শনিক, এবং পরবর্তীকালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্যতম সাররিয়েলিস্ট প্রতিষ্ঠাতা৷ যিনি আন্দ্রে ব্রেতোঁকে সাররিয়েলিজম্-এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন৷ প্রথম আলাপে ভাচে-র সঙ্গে কথা বলে ব্রেতোঁ-র মনে হয়েছিল এই জ্যকুয়েস ভাচে যেন অ্যালফ্রেড জারি(Alfred Jarry)-র মানসপুত্র৷ কারণ, এই অ্যালফ্রেড জারি ছিলেন তৎকালীন একজন নামকরা লেখক এবং সেইসঙ্গে জটিল এক বিজ্ঞান, যার নাম—Pataphysics(প্যারডি-বিজ্ঞান)-এর জন্মদাতা৷ জ্যকুয়েস ভাচের অত্যন্ত অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন ব্রেতোঁ৷ তিনি এই তরুণ অল্পবয়েসী ফরাসি লেখক ভাচে-র সর্বতো প্রশংসা করতেন তাঁর তৎকালীন সমাজ-বিরোধী মনোভাব(Attitude) এবং গতানুগতিক শিল্প-ঐতিহ্যকে অবজ্ঞা করতেন বলে৷
ব্রেতোঁ— সাররিয়েলিজম্-এর আগেই সার্থক সরারিয়েলিস্ট কবিতা লিখে ফেলা ও সিম্বলিস্ট কবি আর্তুর রাঁবো(Arthur Rimbaud)-র দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন৷ তৎকালীন উল্লেখযোগ্য লেখক ও প্যারডি-বিজ্ঞান-এর আবিস্কর্তা অ্যালফ্রেড জারি(Alfred Jarry)-র দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন৷ আমরা গিয়োম অ্যাপোলোনীয়ার(Guillaume Apollinaire)-এর কথা আলোচনা করেছি, যিনি ‘সাররিয়েলিজম্’ টার্মটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন, তাঁর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন৷ ফরাসি কবি ও সিম্বলিজম্ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ‘জারমেইন নৌভেউ’(Germain Nouveau)-র দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন৷ ‘কমতে দে লত্রেমঁ’(Comte de Lautréamont), ফরাসি কবি, যাঁর একমাত্র লেখা— দীর্ঘ গদ্যকবিতা  Les Chants de Maldoro, যা সাররিয়েলিজম্ ও সিচুয়েশনিজম্-এর আকরগ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত, তাঁর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন৷ কিন্তু এই সব ছাপিয়ে সবচেয়ে বেশি যার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন তিনি হলেন এই জ্যকুয়েস ভাচে৷ এ প্রসঙ্গে সরাসরি ব্রেতোঁ-র একটি উক্তি ব্যবহার করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়— "In literature, I was successively taken with Rimbaud, with Jarry, with Apollinaire, with Nouveau, with Lautréamont, but it is Jacques Vaché to whom I owe the most."

   ১৯১৯ সাল নাগাদ প্যারিস-এ ফিরে এলেন আন্দ্রে ব্রেতোঁ৷ তিনি লুই আরাগঁ(Louis Aragon) ও ফিলিপ্পে সৌপাল্ট(Philippe Soupault)-কে নিয়ে শুরু করলেন বিশেষ একটি সাহিত্য পত্রিকা(Journal)৷ নাম দিলেন ‘লিটারেচার(Littérature)’৷ সেখানে তাঁরা পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করলেন ‘স্বয়ংক্রিয় লেখা(Automatic writings)’৷ পাশাপাশি তাঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য শিল্পী আন্দ্রে ম্যাশোঁ(André Masson) এঁকে ফেললেন ‘অটোমেটিক ড্রইং’(ছবি-১)৷
এই অটোমেটিক রাইটিংস বা ড্রইং-কে এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়— সচেতন অবস্থায় কোনো চিন্তা বা ভাবনা, যুক্তির সাহায্যে মাথায় রান্না হয়ে, তারপর কলম বা তুলির সাহায্যে প্রয়োগ করা নয়৷ কলম বা তুলি যদি অবচেতনের বিশুদ্ধ মনের ক্রিয়াকে সরাসরি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়, তাহলেই তাকে অটোমেটিক রাইটিংস বা ড্রইং বলা যাবে৷ আমরা যখনই কোনো কিছু লিখি, বা আঁকি, আমাদের অজান্তে(Reflex-এ)আমাদের সচেতন মন যুক্তি-চিন্তা-ভাবনা দিয়ে তাকে গুছিয়ে দেয়(Censoring the thoughts)৷ তারপর আমরা লিখি বা আঁকি৷ সেজন্য, ওই লেখাগুলি বা আঁকাগুলি খাঁটি(Pure)হয় না৷ তাই, সাররিয়েলিস্টরা বলছেন— ওই অ-খাঁটি চিন্তা-ভাবনাগুলিই(Censoring the thoughts) যত নষ্টের গোড়া৷ তাই দিয়ে কোনো সৎ সৃষ্টি হতে পারে না৷ “আপনা থেকে অবচেতন মনের বিশুদ্ধ ক্রিয়া("pure psychic automatism")” হিসেবে যে চিন্তা-ভাবনা বা দৃশ্য তৈরি হয়, সেইগুলোই আমাদের সৃষ্টির মূল উপাদান৷ এবং ওই উপাদানগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আসে স্বপ্নের মাধ্যমে৷ আন্দ্রে ব্রেতোঁ “সাররিয়েলিস্ট ম্যানিফেস্টো”-তে খুব স্পষ্ট করেই লিখলেন— “Surrealism is based on the belief ... in the omnipotence of dreams, in the undirected play of thought ... pure psychic automatism, by which it is intended to express … the real process of thought. It is the dictation of thought, free from any control by the reason and of any aesthetic or moral preoccupation.”
ওই ‘লিটারেচার(Littérature)’ নামের জার্নাল-এ আন্দ্রে ব্রেতোঁ ও ফিলিপ্পে সৌপাল্ট মিলে বেশ কটি অটোমেটিক রাইটিংস লিখে ফেললেন ফরাসি ভাষায়৷ যেগুলি অধিকাংশই স্বপ্নের প্রেক্ষিতে লেখা৷ এবং ১৯১৯-১৯২০ সালে সেই লেখাগুলি দিয়ে একটি স্বতন্ত্র বইও তাঁরা প্রকাশ করলেন, যেটি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম অটোমেটিক রাইটিংস-এর বই, ফরাসি ভাষায়(ছবি-২)৷
 যার মূল নাম—  Les Champs Magnétiques, ইংরাজিতে—The Magnetic Fields, বাংলায়— চৌম্বকক্ষেত্র৷  (ক্রমশ)


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments