জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৪৭/ শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৪৭

শ্যামল জানা

সাররিয়েলিজম্ (ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব)


সাররিয়েলিস্টরা তাদের সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে দ্বান্দিকতার দর্শন(Dialectic) অনুসরণ করেছিল, তার মধ্যে প্রাথমিক অবস্থায় হেগেল ও পরবর্তীকালে কার্ল মার্কস-এর ডায়লেক্টই তাদেরকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল৷ এ আলোচনা আমরা করেছি৷ কিন্তু আরও দুজনের কথা না বললে তথ্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে৷ এঁরা হলেন— ওয়াল্টার বেঞ্জামিন(Walter Benjamin) এবং হারবার্ট মার্কাস  (Herbert Marcuse)৷

  সাধারণভাবে বললে, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ছিলেন ইহুদি দার্শনিক, সাংস্কৃতিক সমালোচক(Cultural critic) এবং প্রাবন্ধিক৷ কিন্তু তিনি এমন একটি কাজ করেছিলেন, যে, পরবর্তীকালে দার্শনিকদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নতুন অ্যাভিনিউ খুলে দিয়েছিলেন৷ তাকে এক কথায় বলা হয়— সর্বদর্শন সমন্বয়কারী(Eclectic thinker)৷ অর্থাৎ, এতদিন যেটা চালু ছিল— প্রত্যেক বিষয়ের যে নিজস্ব দর্শন থাকে, তা একমাত্র সেই বিষয়ের ক্ষেত্রেই প্রজোয্য, অন্য বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রজোয্য নয়৷ যেমন, সমাজ বিষয়ক কোনো দর্শন কখনই শিল্প বিষয়ক দর্শন হিসেবে প্রজোয্য হবে না৷ ওয়াল্টার বেঞ্জামিন এসে এই এতদিনকার গেড়ে বসা ধারণাকে ভেঙে তছনছ করে দিলেন৷ তিনি বললেন যে কোনো বিষয়ের দর্শন অন্য কোনো বিষয়ের দর্শন অবশ্যই হতে পারে, যদি তোমার বিশ্লেষণ-ক্ষমতা থাকে৷ যাকে আমরা বলছি ‘সর্বদর্শন সমন্বয়কারী(Eclectic thinker)’৷ তিনি জার্মান আদর্শবাদ(German idealism), কল্পনাপ্রবণতাবাদ(Romanticism), পশ্চিমা মার্কসবাদ( যা ১৯১৭-তে রাশিয়ার বিপ্লব ঘটে যাওয়ার পর কার্ল মার্কস-এর তত্ত্বকে আপডেট করে Western Marxism বলা হয়েছিল), ও ইহুদি অতীন্দ্রিয়বাদ(Jewish mysticism)এই চারটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের দর্শনকে মিশ্রিত বা সমন্বয় করেছিলেন৷ এইভাবে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী অবদান রাখলেন নন্দনতত্ত্ব, সাহিত্য সমালোচনা এবং ঐতিহাসি বস্তুবাদ-এর ক্ষেত্রে, যা অত্যন্ত টেকসই দর্শন হিসেবে দীর্ঘদিন টিকে আছে৷ এই কারণেই হেগেল বা মার্কস-এর দ্বান্দ্বিকতার তত্ত্ব সমাজের ক্ষেত্রে প্রজোয্য হলেও সাররিয়েলিস্টরা শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও কাজে লাগাতে পেরেছিলেন৷

    আর একজন হলেন— হারবার্ট মার্কাস৷ ইনি ছিলেন একাধারে জার্মান-আমেরিকান দার্শনিক(philosopher), সমাজবিজ্ঞানী(sociologist) ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক(political theorist)৷ সর্বোপরি ইনি ছিলেন কঠোর সমালোচক৷ কাউকেই ছেড়ে কথা বলতেন না! তিনি যেমন পুঁজিবাদ-এর সমালোচনা করতেন, তেমনি আধুনিক প্রযুক্তির সমালোচনা করতেন, আবার সেভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিরও সমালোচনা করতেন৷ তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটির নাম—  Eros and Civilization(ছবি-১)৷ 

  যেখানে তিনি কার্ল মার্কস-এর তত্ত্ব এবং সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর তত্ত্বের সংশ্লেষণ বা সমন্বয়(Synthesis)ঘটিয়েছিলেন! যা পরবর্তীকালে সাররিয়েলিস্টদের অত্যন্ত কাজে লেগেছিল৷
    এই সূত্রে লেখার প্রথম থেকেই আমরা জেনেছি সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর ‘মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব(Psychoanalytic theory)’ সাররিয়েলিস্টদের ক্ষেত্রে অপরিহার্য দর্শন হিসেবে কাজ করেছে৷ এই দর্শনের কিছু আলোচনা আমরা করেছি৷ অতি সংক্ষেপে হলেও সামগ্রিকভাবে একটি আলোচনার প্রয়োজন আছে এখানে৷ আমরা জেনেছি— সচেতন, প্রাক-সচেতন, অসচেতন, অবচেতন ইত্যাদি কথাগুলি৷ আমরা সাধারণভাবে এগুলির মধ্যে যে পার্থক্য, তা বুঝে উঠতে পারি না৷ অথচ এগুলির প্রত্যেকটিই একেবারে স্বতন্ত্র বিষয়৷ তাদের কাজও একেবারে আলাদা৷ তাই, এগুলি সম্পর্কে, তারা কীভাবে কাজ করে, আলোকপাত হওয়ার জরুরি৷ না হলে সাররিয়েলিস্টরা এই ‘মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব’কে কীভাবে কাজে লাগাচ্ছে বোঝা যাবে না৷
    খুব সংক্ষেপে যদি বলি— মানুষের মনকে সিগমুন্ড ফ্রয়েড চার ভাগে ভাগ করেছেন৷ 
১. সচেতন(Conscious)৷ 
২. প্রাক-সচেতন(Preconscious)৷ 
৩. অসচেতন(Unconscious)৷ ৪.অবচেতন(Subconscious)৷
    জন্মাবার পর, জ্ঞান হওয়া থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যতদিনই আমরা বাঁচি না কেন, সারাক্ষণই আমরা কিছু না কিছু করি৷ অর্থাৎ শরীর এবং মন সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকে৷ আমাদের শরীর— হয় খায়, না হলে কাজ করে, না হলে হাঁটে, কিংবা বিশ্রাম নেয় বা বসে থাকে, বা ঘুমোয় ইত্যাদি ইত্যাদি৷ আর শরীর যখন এই কাজগুলো করে, তখন তাকে মনের সাহায্য নিতেই হয়, না হলে সে কিছু করতেই পারবে না৷ এ ক্ষেত্রে শরীরকে সাহায্য করে সচেতন মন(Conscious mind) চারটে বিষয়ের মাধ্যমে৷ চিন্তা, স্মৃতি, অনুভব ও ইচ্ছা৷

    ধরা যাক আমি অফিস যাব৷ ‘কটায় বেরুব?’— এই চিন্তাটা করতেই হবে যেখানেই যাই না কেন৷ না হলে বেরনো যাবে না! ধরা যাক আমি ১০টায় বেরব৷ কেন? কারণ, অফিসে ১১টার মধ্যে না গেলে অ্যাবসেন্ট করে দেয়৷ আর, আমার অফিস যেতে সময় লাগে একঘন্টা৷ এই হিসেবটা আমি করতে পারছি, তথ্যগুলি আমার স্মৃতিতে আছে বলে৷ এতৎ সত্ত্বেও রাস্তায় জ্যাম ছিল বলে লেট হয়ে গেল৷ অফিসের বড়বাবু কথা শোনালেন৷ আমার মুখচোখ লাল হয়ে গেল৷ কেন? আমি অপমান অনুভব করলাম বলে! তাই, অফিস ছুটির সময়ের একটু আগেই অভ্যাসবশত সবাই যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, আমি যাচ্ছি না৷ কারণ, সকালের ঘটনার পর আমার আর আগে যেতে ইচ্ছে করছে না৷

    এই অফিস যাওয়া থেকে বেরোনো পর্যন্ত যে যে ঘটনা ঘটল, সেগুলি সবই ঘটাল সচেতন মন(Conscious mind)৷

    এবার, আমরা যদি উল্টো করে ভাবি?— এই ঘটনাগুলো কেন ঘটল? ‘কটায় বেরব?’ এই ভাবনাটা বা চিন্তাটা যদি আমি না করতে পারতাম, অফিস বেরতে পারতাম? তাহলে, এই চিন্তাটা করতে সাহায্য করল কে? যে দিন আমি অফিসে জয়েন করেছিলাম, আমাকে বলে দেওয়া হয়েছিল— ১০.৩০-টায় অফিস৷ ১১টার পর এলে অ্যাবসেন্ট— এই কথাটা রোজ সময়মতো মনে পড়ায় কে? এই যে বড়বাবুর কথায় আমি অপমানিত হলাম, অন্য সময়ে তো অপমানিত হই না! তাহলে ঠিক সময়ে এই অপমানের বোধটা সাপ্লাই দিল কে? আর, অপমানিত হলাম বলেই তো মুড অফ হল৷ তাই তো ইচ্ছাই করল না অফিস থেকে আগে বেরতে৷ এই যে ভেতরে ভেতরে এটা ঘটল বলে পরেরটা ঘটল, এই হিসেবটা করল কে?

    এই সবগুলো যে করল, তার নাম প্রাক্-সচেতন মন (Preconscious mind)৷ অর্থাৎ, সচেতনভাবে আমরা যে কাজগুলো করি, সেগুলো করতেই পারতাম না, যদি না প্রাকসচেতনতা গিন্নির মতো আমাদের আগে গুছিয়ে না দিত৷ আর, আশ্চর্য! প্রাকসচেতনতার এই কাজটা আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাই না কেউ৷ একেবারেই বুঝতে পারি না, সারাক্ষণ এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আমাদের ভেতরে ভেতরে ঘটে চলেছে!
    আর, এই চিন্তা, স্মৃতি, অনুভব ও ইচ্ছা, এদের আপাতভাবে একটা মনে হলেও, প্রত্যেকের কিন্তু প্রচুর ভাগ আছে— দুর্বল, শক্তিশালী, খারাপ, ভালো ইত্যাদি ইত্যাদি৷ আর, কত রকমের যে অনুভব হয়— রাগ, দুঃখ, আনন্দ, যন্ত্রণা, বিষাদ ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এরা থাকে কোথায়? মনের একটি অফুরন্ত স্মৃতির ভাঁড়ার আছে, সেখানে থকে এরা৷ তার নাম— অসচেতন মন(Unconscious mind)৷

    আর, এতক্ষণ ধরে যা বললাম— সচেতন মন, প্রাক-সচেতন মন ও অসচেতন মন— এই তিনটির কাজগুলিকে সামগ্রিকভাবে ক্যাপ্টেনের মতো পরিচালনা করে দেয় যে, সে হল— অবচেতন মন(Subconscious mind)(ছবি-২)৷


    আর একটু ভালো করে বললে বলতে হয়, অবচেতন মনের কাজ হল— আমরা যাইই করি বা বলি না কেন, সব কিছুর সমস্ত ডেটাগুলিকে অসচেতন মনের স্মৃতির ভাঁড়ারে ঠিকমতো জমা করা, এবং কাজের প্রয়োজনে নিমেষে ওই স্মৃতির ভাঁড়ার থেকে সঠিক ডেটাকে পেড়ে আনা৷ অর্থাৎ, আমরা এই যে সারাদিন যতক্ষণ জেগে থাকি সারাক্ষণ কিছু না কিছু করি বা বলি— এই কাজগুলিকে আমরা প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট উপায়ে সম্পাদনা করি৷ এটা করতে গিয়ে আমাদের কখনো উল্টোপাল্টা হয় না! কারণ, আমাদের অজান্তে পুরোটা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে দেয় আমাদের অবচেতন মন৷ যেমন, এই যে আমরা অফিস যাই, এর পিছনে বিভিন্ন মনের ভূমিকা নিয়ে আমরা একটু আগে আলোচনা করেছি৷ আমরা প্রত্যেকদিন অফিস যাই, আর, প্রত্যেকদিনই পুরো ব্যাপারটা পরিচালনা করে দেয় অবচেতন মন৷ অধিকাংশ মানুষ তাদের সচেতন মনটিকেই বুঝতে পারে, কিন্তু অবচেতন মনটিকে তারা একেবারেই টের পায় না! (ক্রমশ)

 জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments

  1. পড়তে গিয়ে আলাপ হবে গেল ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ও হারবার্ট মার্কাসের সাথে। জানতাম না এদের দ্বারা কি ভাবে শিল্প জগতের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। সত্যিই তো এঁদের চিনতাম না। কোনও পরিচিতিই ছিল না এদেরই শ্রম সাধিত কর্মকাণ্ডের সাথে। বিনয়ের সাথে স্বীকার করি যে এই একটি প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে শ্যামল যেন পরম যত্নে ও মমতায় সখ্য গড়ে দিচ্ছে আবিশ্ব শিল্প চর্চার একটা মহাদিগন্তের সাথে। পাশাপাশি
    তৎকালীন সমাজ,রাষ্ট্র, নীতি,আদর্শ এই সবেরও আনুপূর্বিক পরিচিতি ঘটিয়ে চলেছে। যে কারণে এটি আর সেই আবহমানের রীতি মানা প্রবন্ধ না হয়ে একটি বিশ্বজয়ী আখ্যানের মতো লাগছে। ফলে পাঠের মধ্যে অনুসন্ধিৎসু পাঠক কেবল তথ্য
    পাবেন না। পাবেন পাঠের গভীর মজা।এটি শ্যামলের---অনুধ্যান বটে।

    ReplyDelete