জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা― (নবম পর্ব)/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ২৮

মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা― (নবম পর্ব)

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

'যাঁরা সুন্দর নিসর্গ দৃশ্য ভালোবাসেন, যাঁরা সৌন্দর্যের পূজারী, সূর্যাস্তের রক্তরাগ যাঁদের বিহ্বল করে, নির্ঝরিণীর জলপতনধ্বনি অথবা গিরি নদীর কলকল্লোল শুনতে যাঁরা ভালোবাসেন, রামধনুর বর্ণচ্ছটা অথবা শীতের সকালে শিশিরের দানা মাখা মাকড়সার জাল যাঁদের মুগ্ধ দৃষ্টি কেড়ে নেয়, সংক্ষেপে যাঁরা তাঁদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং প্রকৃতির বৈচিত্র্য সম্বন্ধে সচেতন, তাঁদের পক্ষে সূর্যগ্রহণের মত অতি বিরল ঘটনায় দেখার অনেক কিছু আছে এবং এর জন্য প্রকৃতিদত্ত দুটি চোখ ছাড়া আর কোন যন্ত্রেরই তাঁদের প্রয়োজন হবে না'―এ হেন মত ড. বাপ্পুর। পুরো নাম মানালি কল্লাট ভেইনু বাপ্পু (১৯২৭―১৯৮২); একজন প্রথিতযশা ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী।

  কাল চব্বিশে অক্টোবর ১৯৯৫ সাল। রাত পোহালেই রহস্য রোমাঞ্চ। হাত বাড়ালেই আকাশ-ভরা সূর্য তারা আর কোজাগরী চাঁদ একই রেখায়। দিনের আলোকে। একই সঙ্গে বোধন হবে দুজনের। ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে চাঁদমামা আস্ত গিলে খাবে টকটকে লাল সূর্য-ফল। তবে এ হয়তো ঠিক গিলে খাওয়া নয়। বরং উৎসবের শেষ পাতে গলায় গলা লাগিয়ে আলিঙ্গন সারা। পারস্পরিক কুশল বিনিময়। বাঙালির দূর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা আর কালীপূজা পেরিয়ে এ যেন গ্রহণ পুজো। ছেলে-বুড়ো সবাই মেতে উঠেছে। এক অনন্য অনুভূতির হাতছানি। ইতিহাসের সাক্ষী থাকার অনন্য নজির। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। শিরায় শিরায়, রক্তকোষে শিহরণের ঢেউ তোলে। এ ঘটনা জীবনে এক-আধবারই ঘটবে। বেঁচে থাকার ষোলআনা রসদ প্রাপ্তি হবে। চেটেপুটে নিতে হবে প্রকৃতির রস-রূপ-গন্ধ-বর্ণ। আস্বাদন করতে হবে তার অপূর্ব দৃশ্য-বৈভব। এটাই বেঁচে থাকার সার্থকতা। চার দেওয়ালের মধ্যে বাঁধা থাকতে অপারগ উদাসী মন। যেন এক ছুটে হাজির হই পাহাড় চূড়ায়। অথবা নির্জন ভূমিতে। সেথায় নির্দ্বিধায় ইতিহাসের সাক্ষী থাকা যাবে। 

  চূড়ান্ত ঘটনার সাক্ষী থাকতে প্রস্তুতি তুঙ্গে। ভোরের শিউলী এখনও ঝরে পড়েনি। চাঁপা ফুলের সৌরভ ম ম করছে। রাত্রির অন্ধকার থাকতে থাকতেই দিতে হবে পাড়ি। পার হতে হবে বহু পথ, নদী, ঘাট। সাউরি'র বকুল, সরঞ্জা, কইঞ্জ্যা, অর্জুন, নিম, জাম―সবাই ডুবে আছে ভোরঘুমে। চরাচর নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ। ঝিঁঝিঁ ডাকছে শুধু। আর কোনও সাড়া শব্দ নেই। শুধু সাউরি ভোলানাথ বিদ্যায়তন দাঁড়িয়ে আছে। নীরবে, নিঃশব্দে প্রত্যক্ষ করছে সবকিছু। ইতিমধ্যে স্কুলের মাঠে হাজির হয়েছে একটি ধুম্রযুক্ত ছয় চক্র যান―বাস। সাউরি থেকে পুরুলিয়া পাড়ি দেবে গাড়িটি। বিস্তর পথ। অনেক ধকল।

  সাউরি থেকে দুটো দল পাড়ি দেবে পুরুলিয়া। প্রথম দল যাবে অযোধ্যা পাহাড়। কলকাতার স্কাই ওয়াচার্স অ্যাসোসিয়েসনের লোকদের সঙ্গে সাউরি থেকে পুরুলিয়া যাচ্ছেন বেলদা গার্লস-এর সম্মাননীয়া শিক্ষিকা বাসন্তী দাস। স্পোর্টস মেকানিক্স বিষয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছেন। ও বিষয়ে এক্সপার্ট তিনি। আদপে পদার্থবিদ্যার টিচার। মহাকাশ নিয়ে অসীম কৌতূহল তাঁর। বিজ্ঞানের প্রেমে মশগুল প্রিয় শিক্ষিকা প্রকৃতির বিরলতম ঘটনা স্বচক্ষে দর্শন করতে যাচ্ছেন অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায়।
     
  দ্বিতীয় দলের সওয়ারী অনেক মানুষ। আট থেকে আশি! কে নেই সেই দলে? স্কুলের গণ্ডি না-পেরনো কৃষক। স্বল্প শিক্ষিত বেকার। উচ্চ শিক্ষিত মাস্টার মশাই। পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ী। দিন আনি দিন খাই―গ্রামের গরীব প্রান্তিক মানুষ। সে-দলে আছেন হেডমাস্টার মশাই শ্রীনিবাস নন্দ, শ্রী চিত্তরঞ্জন দাস, শ্রী নারায়ণচন্দ্র মাইতি, শ্রী বঙ্কিমবিহারী মাইতি, শ্রী অশোক ভৌমিক, শ্রী সুজন রানা, শ্রী বাদল চন্দ্র দে, শ্রী বিনোদ পাত্র, শ্রী হিমাঙ্ক পাল, শ্রী দূর্গাপদ পণ্ডা প্রমুখ বিশিষ্টবর্গ। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের টানে প্রত্যেকে নেশাগ্রস্ত। বাস ছাড়বে আগের দিন রাত্রি থাকতে। পুরুলিয়ার বলরামপুরে পৌঁছবে সেদিন বিকেলে। সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাবে পূর্ণগ্রহণ। বাসের মধ্যে জনা সত্তর-আশি যাত্রী। অথচ বাসে সর্ব সাকুল্যে বসবার সিট মাত্র বাহান্নটি। আর সওয়ারী তার চাইতে বেশি। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এতটুকু কষ্ট নেই। অনুযোগ-অভিযোগের বালাই নেই। সকলে উত্তেজনায় টগবগ টগবগ ফুটছে। যারা গ্রহণ সম্পর্কে কম জানে, তারা বয়স্ক শিক্ষিত জনের কাছ থেকে জেনে নিচ্ছে; গ্রহণ দেখতে গিয়ে পাছে কিছু বাদ না পড়ে। সময় মেপে সবকিছু ঠিকঠাক এগোচ্ছে।

  দ্বিতীয় দলের গন্তব্য পুরুলিয়ার মাথাবুরু পাহাড়। মেদিনীপুরের সাউরি থেকে পুরুলিয়া দীর্ঘ পথ। একটানা দীর্ঘ পথের জার্নির ধকল সহ্য করা মুসকিল। এক্ষেত্রে মুসকিল আসান ব্রেক জার্নি। যাত্রাপথের মাঝে পড়বে বাঁকুড়া জেলা। বাঁকুড়ায় বহু দর্শনীয় স্থান। প্রথমে চোখের সামনে ছবি ভেসে ওঠে সুন্দরী মুকুটমণিপুর। ছবির মতো জায়গা। যেন শিল্পী তার তুলির টানে অপরূপা করে গড়েছে তাকে। তিনদিক ঘেরা শালের বন। মধ্যিখানে বিশালাকার ড্যাম। ড্যামের এক পাড়ে দাঁড়িয়ে অপর পাড়ের দিশা পাওয়া শক্ত। চারিদিকে জল থই থই করছে। আর আছে জলের মধ্যে বিচ্ছিন্ন একেকটা দ্বীপ। দ্বীপের ভেতরে জনবসতি গড়ে উঠেছে। পারাপার কিংবা যাতায়াত― যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা বা ভুটভুটি। এ হেন রূপসী মুকুটমণিপুরে থামল দ্বিতীয় দলের গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে ড্যামের অনিন্দ্য সুন্দর রূপ অবলোকন করে মন ভরে গেল। মধ্যাহ্নকালীন আহারের ব্যবস্থা হয়েছে এখানে। লাঞ্চের পরে গাড়িতে সোজা বলরামপুর।

  কোথাও না থেমে বলরামপুরে পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। স্থানীয় একটি স্কুলে রাত্রি যাপনের বন্দোবস্ত। এত রাস্তা জার্নি করে এসে সকলে বেশ ক্লান্ত। বিশ্রামের প্রয়োজন। আর তাছাড়া রাতের খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে পারলে মঙ্গল। আগামীকাল ভোর ভোর বিছানা ত্যাগ করতে হবে। প্রভাতে বহু প্রতিক্ষীত সূর্যগ্রহণ। মাথাবুরু পাহাড়ের শীর্ষদেশে। মাথাবুরু পাহাড় এখান থেকে সামান্য পথ। ভোর ভোর রওনা দিতে হবে। গ্রহণের টানেই এত দূরে আসা! সেটা যদি ঠিকঠাক না দেখা যায়, তবে সব বিফল। 

  রান্না বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেনু মাংসের ঝোল আর গরম ভাত। পাথর দিয়ে তৈরি উনুন। তার উপর লোহার কড়াইয়ে কাঠের আগুনে সেদ্ধ হচ্ছে দেশী মুরগির মাংস। উনুনের চারপাশে গোল জটলা। এদিকে মাংস ফুটছে তো ফুটছেই। সেদ্ধ হবার নামগন্ধ নেই। এত সময় তো লাগার কথা নয়! খাওয়ার সময় সমস্যা টের পেল সবাই। নামমাত্র সেদ্ধ হয়েছে মাংস। খেতে বসে মুরগির হাড় থেকে মাংসপেশী পৃথক করতে বিস্তর বেগ পেতে হচ্ছে। ছেঁড়া যাচ্ছে না। এ যে মহা ঝামেলা! কী এমন ঘটনা ঘটল যে, দাঁত দিয়েও ছেঁড়া যাচ্ছে না? এর কারণ পাহাড় চূড়ায় নিম্ন বায়ুচাপ। আস্তানা যে-জায়গায়, সেটি সমতল ভূমি থেকে বেশ উঁচুতে; বলতে গেলে পাহাড়ের উপরে। পাহাড়ের উপরে বায়ুর চাপ কম। কম চাপে রান্না করা খাবার সুসেদ্ধ হতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। এক্ষেত্রে ঠিক তা-ই ঘটেছে। তাড়াহুড়োয় সেদ্ধ কম হয়েছে। চোখে-মুখে যা-হোক কিছু গুঁজে রাতের বিশ্রাম নিতে চলে গেল সকলে।

(দুই)
রাজধানী দিল্লী থেকে দেড়শ কিলোমিটার দূরের একটি অখ্যাত মফস্বল শহর কোটপুটলি। রাজস্থানের জয়পুর জেলার মধ্যে। দিল্লী-জয়পুর জাতীয় সড়ক এন এইচ - ৪৮ (NH-48)-এর ধারে। এখানে কোট নামে একটা ছোট্ট টাউন ছিল। আর ছিল স্থানীয় একটি গ্রাম― পুটলি। একসময় এই দুই― গ্রাম আর শহর মিলে গেল। নাম হল কোটপুটলি। কোটপুটলি এখন একটি মিউনিসিপ্যালিটি টাউন এলাকা। এই এলাকায় জাতীয় সড়কের ধারে দীর্ঘ আট কিলোমিটার জায়গা জুড়ে তাঁবু ফেলেছেন বৈজ্ঞানিক নারায়ণ চন্দ্র রানা। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ায়। একটা দুটো নয়, বেশ কয়েকটি তাঁবু। হাইওয়ের সমান্তরালে; সামান্য দূরত্ব ছেড়ে ছেড়ে। সেই তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছেন বৈজ্ঞানিক। সঙ্গী জনা কুড়ি বিশ্বস্ত ছাত্র। নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। এ স্থান বেছে নেওয়ার কারণ, চাঁদের প্রচ্ছায়াশঙ্কু এখানে বেশ চওড়া। চব্বিশে অক্টোবর গ্রহণ আসন্ন। তার আগে সারতে হবে সমস্ত কাজ। সূর্যের সঠিক ব্যাস পরিমাপের কাজ। আসলে এর আগে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দুজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী মি. এস্পেনাক আর মি. ফিয়ালা সূর্যের যে ব্যাস মেপেছেন, তা সঠিক নয়। পরিমাপে বিস্তর গোলযোগের হদিস পেয়েছেন ড. রানা। আর তাই এবার তিনি মাঠে অবতীর্ণ হয়েছেন সূর্যের নিঁখুত ব্যাস মাপতে। যে কাজে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে সঙ্গে আছেন প্রফেসর জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার স্যার, ড. রানা'র পি এইচ ডি গাইড।
      
  খালি চোখে সূর্যের দিকে ভালো করে তাকানো যায় না। চোখ ঝলসে যায়। এতটাই তার তেজ। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে সূর্যের ব্যাস মাপায় হাজারো ঝক্কি। সেজন্য সূর্যের ব্যাস মাপার আদর্শ সময় পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। পূর্ণগ্রাস গ্রহণের দিন চাঁদ সূর্যকে সম্পূর্ণ ঢেকে রাখে। সূর্যের উজ্জ্বল আলো সরাসরি পৃথিবীতে আসতে পারে না। কিন্তু গ্রহণের সময় সূর্যের আলোকে চাঁদের ধারগুলো ভাস্বর হয়ে ওঠে। তখন পৃথিবী থেকে স্পষ্ট রূপে প্রতীয়মান হয় সূর্যের আকার। ফলে এর ব্যাস মাপা তুলনামূলক সহজ হবে। যেই ভাবা, অমনি কাজ। মাঠে নেমে পড়লেন তিনি।

  এ হেন প্রোজেক্টের মস্ত বড় বাজেট। বড় বড় ফটো-ডিটেক্টর বসাতে হবে, যারা সূর্যের আলো ধরে ধরে তথ্য জমা রাখবে। পরে সে-সব তথ্য মিলিয়ে, যাচাই করে বৈজ্ঞানিক রানা সূর্যের ব্যাস গণনা করবেন। তা, সব মিলিয়ে ৩৫০ টি ফটো-ডিটেক্টর সেট করতে হবে। এর সঙ্গে রয়েছে আনুসঙ্গিক যন্ত্রপাতি। সব আধুনিক প্রযুক্তির। শিবিরে যোগ দেবেন অনেক প্রথিতযশা সায়েন্টিস্ট। গ্রহণের দিন উপস্থিত থাকবেন আমেরিকার জ্যোতির্বিজ্ঞানী মি. ফিয়ালা, মি. ডেভিড ডানহাম, মি. এইচ. জুয়াচিম সহ দেশ বিদেশের আরও একঝাঁক পণ্ডিত মানুষ।

  সবমিলিয়ে খরচের বহর আকাশ ছোঁয়া। বাজেট আনুমানিক প্রায় দশ লক্ষ ভারতীয় টাকা। অথচ ভারত সরকারের অর্থ দপ্তর বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ অর্থ (প্রায় তিন লক্ষ টাকা) মঞ্জুর করেছে। মাথায় হাত বৈজ্ঞানিকের। কী করবেন তিনি এই স্বল্প টাকা দিয়ে? কীভাবে সম্ভব হবে এই শিবির চালু রাখা? এতদূর এগিয়ে এসে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ফেললে লোকে হাসাহাসি করবে তো! আর মাথা কাজ করছে না। চোখের সম্মুখে অন্ধকার দেখছেন যেন। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। তবে এটুকু পরিস্কার বুঝে গেছেন― এ দিয়েই কাজ হাসিল করতে হবে। দ্বিতীয় পথ খোলা নেই। ভেঙে পড়লে চলবে না। মন শক্ত করতে হবে।
     
  ব্যস্ততা চরমে। প্রস্তুতিও তুঙ্গে। শিবিরে অনেক লোহার লম্বা রড (স্টিক) প্রয়োজন। কিন্তু বাজেট একদম কম। তাই বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। হঠাৎ বুদ্ধি খেলে গেল বৈজ্ঞানিকের। তখন বাজারে ঢাউস সাইজের বিদ্যাসাগর ছাতার খুব প্রচলন ছিল। সে-ছাতায় একটি লোহার স্টিক লাগানো থাকে। স্টিকের ভেতরটা ফাঁপা। তাই দাম কম। বেশ সস্তা। লোহার রডের পরিবর্তে ছাতার স্টিকের বিকল্প ব্যবস্থা দিয়ে স্বচ্ছন্দে কাজ চালানো যায়।

  এদিকে ২,৫৩,০০০ টি 'গুলো' আনানো হয়েছে। সেগুলো সব ঝালাইয়ের বন্দোবস্ত করতে হয়। ঝালাইয়ের পরে 'গুলো'গুলো সংযোজিত হয়ে প্রায় ৪৮,০০০ ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির জন্ম দেয়। এই ইলেকট্রনিক যন্ত্রগুলি সংযুক্ত করতে অনেক বোর্ডের দরকার। প্রায় ৭০০ PCBS  (Printed Circuit Board) আনানো হয়। এই PCBS গুলোর সঙ্গে যুক্ত করা হয় ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি। দীর্ঘ মাস দেড়েকের অক্লান্ত পরিশ্রমে মোটামুটি সূর্যের ব্যাস মাপার সব রকম প্রস্তুতি সারা। এবার শুধু অন্তিম ক্ষণের প্রতীক্ষা।

(তিন)
গ্রহণের আগের দিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার মুখে পাহাড় চূড়ায় পৌঁছে গেছিল বাস। আর আজ সকালে মাথাবুরু পাহাড়ের মাথায়। আহা! কী প্রশান্তি! কী মনোরম সিনারিও! পাহাড় চূড়ায় সকালের মৃদুমন্দ বাতাসে হালকা হিমের ছোঁয়া। হিমেল বায়ুর আন্তরিকতায় আপ্লুত সবাই। আর চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য। যতদূর দৃষ্টি যায়, দিকচক্রবাল জুড়ে শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজের সমারোহে হারিয়ে যাচ্ছে চির সবুজ মন। আর সন্ধানী নয়নের দৃষ্টি আকাশে নিক্ষিপ্ত। বড় বড় শাল-সেগুন-মহুলের আপ্যায়নে হৃদয় জুড়ে প্রশান্তি। শুধু ওরা একা নয়, বহু লোকের সমাগমে গমগম করছে মাথাবুরু পাহাড়ের মাথা। কলকাতা থেকে স্যুট-বুট পরিহিত একগুচ্ছ মানুষ এসেছে। গ্রামের মানুষ দেখে তাদের চোখে-মুখে কেমন যেন অবজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট। ভাবখানা এমন―গ্রামের চাষাবাসা লোক গ্রহণের কী বুঝবে? 

   চাদর মুড়ি দিয়েও উত্তেজনায় কাঁপছে সকলে। খানিক পরে অভীষ্ট সিদ্ধিলাভ হবে। শতাব্দীর সেরা পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের আর বেশি দেরি নেই। ইতিহাস প্রতীক্ষা করে আছে। কাউন্টডাউন শুরু হল বলে। প্রত্যেকে নিজের সুবিধামত জায়গায় দাঁড়িয়ে। তখন সকাল সাতটা সবে অতিক্রান্ত। গ্রহণ শুরু হতে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট বাকি। সকলের দৃষ্টি আকাশে নিবদ্ধ। এমন সময় একটা আশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী থাকা গেল। অনেক দূরে নিচে পশ্চিম দিক থেকে পার্বত্য মালভূমির উপর দিয়ে ঢেউয়ের মতো কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে ছুটে আসছে ছায়ালহরী। সে কী অপরূপ দৃশ্য! ভাষায় প্রকাশিতব্য নয়। শুধু উপলব্ধি করে নিতে হয়।

   একজন ব্যাগ খুলে চৌকা সাদা থান কাপড় একটা টেনে বের করল। ইঙ্গিতে তিনজনকে ডেকে নিল। চারজনে মিলে সাদা কাপড়ের চারটি প্রান্ত টানটান করে মেলে ধরল। যাতে থানটা আনুভূমিক হয়। ওরা চারজন এবং আরও অনেকে দাঁড়িয়ে ছিল একটা গাছের ডালের নিচে। পাতার স্থির ছায়া পড়েছে সাদা কাপড়ে। যে-মূহুর্তে ছায়ালহরী ওদের অতিক্রম করছে, সে-ক্ষণে পাতার ছায়া সাদা কাপড়ের উপরে কেঁপে উঠল, আন্দোলিত হল। থরথর কাঁপছে ছায়া। অথচ গাছের পাতা এতটুকু নড়ছে। অভিনব অভিজ্ঞতা। সে-দৃশ্য দেখে ছেলে বুড়ো সকলের সে কী আনন্দ! ছোটরা নাচছে, বড়রা হাততালি দিচ্ছে। যেন হাতে সোনার চাঁদ পেয়েছে! কলকাতার তথাকথিত স্যুটেড-বুটেড ভদ্রলোকের দল এতক্ষণ যাদের গেঁয়ো, চাষা বলে অবজ্ঞা, অবহেলা করছিল, বাঁকা নজরে দেখছিল; তারা তো বেজায় অবাক! অবাক এ কারণে যে, গ্রাম্য চাষার দল কোথা থেকে শিখল এত সব তথ্য? আশ্চর্য! ঘটনার পূর্বাভাস জানা না থাকলে ছায়ালহরী ধরার এমন সহজ, অভিনব, প্রানবন্ত কৌশল চটজলদি আয়োজন করা সম্ভবপর হতো না।

   এমন আনন্দের পরিবেশের মধ্যে সূর্যের আলো ধীরে ধীরে কমে আসছে। গোধূলি দশা পেরিয়ে সন্ধ্যার ঘনঘটা নেমে এল। রাত্রির পরিবেশ গাঢ় হচ্ছে। আঁধার ঢেকে ফেলছে চরাচর। আকাশে, বৃক্ষে পাখির দল এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। বক বাসায় ফিরে যাচ্ছে। ডাহুক ডাকছে। বন্যজন্তুর দল নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ধাবিত। জঙ্গলের মোষগুলো থতমত। আকাশে তারা ফুটে উঠেছে। চাঁদ উঠেছে। চাঁদ আজ কিছুটা ম্লান। কেমন কালো কালো চেহারা তার। দূরের কোনও আদিবাসী গ্রাম থেকে শঙ্খধ্বণি শোনা যাচ্ছে। জঙ্গলে গাছেরা খাদ্য উৎপাদন সাময়িক বন্ধ রেখেছে। ছেলে-বুড়ো সকলে চোখে গগলস আঁটিয়ে গগনমুখো। এ যে নির্ঘাত প্রকৃতির মনোরম জাদু! তার সম্মোহনের নেশায় আচ্ছন্ন আট আর আশি। প্রায় এক মিনিট সময়ের নীরবতা। তার মধ্যেই হীরার আংটি, মুক্তার মালা, বর্ণমণ্ডল আর সৌরশিখা একে একে হাজির। এর পাঁচ-দশ সেকেন্ডের মধ্যে ছটামণ্ডল উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কালের ব্যবধান ঘুচে যেতেই চাঁদের আড়াল থেকে ধীরে সুস্থে প্রকট হচ্ছেন সূর্যদেব। সবকিছু স্বাভাবিক হচ্ছে পূর্বের মতো।

   তৎকালীন সাউরি'র একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি শ্রী বিনোদ পাত্র। বিলকুল চাষা। অক্ষর জ্ঞান নামমাত্র। হেডমাস্টার মশাই শ্রী শ্রীনিবাস নন্দের বিশেষ পরিচিত। তিনিও গেছেন মাথাবুরু পাহাড়। বাসে উঠা ইস্তক অনেকে নাক কুঁচকেছিল―গ্রহণের সে কী বুঝবে? কিন্তু নাহ! গ্রহণ দেখে ফেরার সময় সকলের চোখে তখন অপার বিস্ময়। বাসের মধ্যে হালকা গুঞ্জন। সে কোলাহলের মধ্যে হেডমাস্টার মশায়ের কাছে শ্রী বিনোদ পাত্র তার মনের ভাব ব্যক্ত করছেন―
'বাবুদা, এ যে জিনিসটা দেখলি; আর কভু এরকম জিনিস জীবনে দেখতে পাবানি। আহা, কী সোন্দর জিনিস!'

(চার)
ওদিকে কোটপুটলি'তে যেন চাঁদের হাট। কথা রেখেছেন মি. ফিয়ালা, মি. ডানহাম, মি. জুয়াচিম। আরও অনেক বিদেশি বৈজ্ঞানিক কোটপুটলি'তে হাজির। দুই শত ছাত্রছাত্রী ইতিমধ্যে উপস্থিত। শত শত লোকের ভীড়। গ্রহণ দিনের তৎপরতা তুঙ্গে। খুব ব্যস্ত বৈজ্ঞানিক রানা। সমস্ত ডিটেক্টর নিজেদের হাতে গড়া। সে-সব ডিটেক্টর-এর কাছে একেকজন স্টুডেন্ট বসে আছে। অধ্যাপক রানা তাদের পাখি পড়া করে বুঝিয়ে দিয়েছেন গ্রহণ কালে কী কী করতে হবে। একচুল তথ্য বিচ্যুতি বরদাস্ত করা চলবে না। সবকিছু নিঁখুত ভাবে সম্পন্ন করতে হবে।
       
   ক'দিন ধরে তাঁর নিজের শরীর খুব খারাপ যাচ্ছে। পেসমেকার গন্ডগোল করছে। শরীরে ধুম জ্বর। জ্বর গায়ে চারপাশ ছুটে বেড়াচ্ছেন। একা হাতে সবকিছু তদারকি করছেন। গ্রহণ শুরুর ক'মিনিট আগে একটি ডিটেক্টর-এর কাছে বসে গেলেন তিনি। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ কালে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজে তিনি সদা ব্যস্ত। বিজ্ঞানীদের কাছে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের ওই সামান্য সময়টুকু যে কত মূল্যবান, তা বলে বোঝানো যাবে না। এসময় তারা গভীরভাবে ডুবে থাকেন সূর্য নিয়ে তাদের গবেষণায়। গ্রহণ খুব তাড়াতাড়ি ঘটে। অতি দ্রুত ঘটে বলে এর বৈচিত্র্য আরও বাড়ে। যদিও গ্রহণ কালে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে পণ্ডিতগণ এত ব্যস্ত থাকেন যে, তাঁদের পক্ষে তখনকার অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে নজর দেওয়ার অবকাশ থাকে না। ক্যামেরায় ছবি তোলার ফাঁকে এক আধটুকু দেখতে পান মাত্র। এ হেন সূর্যগ্রহণের দৃশ্যটি তার চমৎকারিত্বে বাস্তববাদী বিজ্ঞানীকেও কেমন বিহ্বল করে তোলে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ভট্টাচার্যের উদ্ধৃতি সবিশেষ উল্লেখ্য―

   'সূর্য যখন একফালি চাঁদের মত, আকাশে বাতাসে আলোছায়ার ঢেউ-এর খেলা দর্শককে এক অবাস্তব স্বপ্নজগতে নিয়ে যায়। দিনের আলো বেশ দ্রুত কমতে থাকে, সূর্যের কলা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায়। মহাশূন্যে হীরকখচিত কণ্ঠহারের মত কয়েক সেকেন্ড থেকে যেই মিলিয়ে যায়, অমনি বর্ণমণ্ডলের গোলাপি আভা ঝলসে ওঠে। গগনের রঙ্গমঞ্চে তখন ঘন ঘন পট পরিবর্তন। পূর্ণগ্রাসের সময় দেখা যায় যে, একটা লালচে ফ্যাকাশে আলো চারপাশে ছড়িয়ে আছে আর অকালরাত্রির আকাশে অগণ্য তারার মাঝখানে ছটাবেষ্টিত তমসাচ্ছন্ন সূর্য এক অপরূপ সৌন্দর্যে বিরাজমান।  এরপর পূর্ণগ্রাসের মেয়াদ ফুরিয়ে আসে, বর্ণমণ্ডলের গোলাপি রঙ আর একবার ঝলমল করে ওঠে এবং চাঁদের কোনও উপত্যকার মাঝখানে সূর্যের অংশুমণ্ডলের প্রথম প্রকাশ হয়, ঠিক মনে হয় মহাশূন্যে যেন একটি হীরার আংটি ভাসছে। এরপরেই দিনের আলোর দ্রুত প্রকাশ এবং আকাশের রঙ্গমঞ্চে ক্ষণিক ইন্দ্রজাল প্রদর্শনীর উপর যবনিকা পতন।'
  
  গ্রহণকালে প্রকৃতির আর একটি প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মত। পৃথিবীর প্রাণীজগৎ, এমনকি উদ্ভিদজগৎও পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণে দারুণ প্রভাবিত হয়। এক একটি অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির তারতম্য অনুসারে সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল গ্রহণের সময় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সাড়া দেয়। পূর্ণগ্রাসের সময় গরু, বাছুর ঘরে ফিরতে শুরু করে। হাঁস, মুরগি সচকিত হয়ে চুপচাপ বসে থাকে। মোরগ ডাকতে শুরু করে। বাদুড়, পেঁচা, চামচিকা প্রভৃতি নিশাচর প্রাণীরা বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। পদ্ম, শালুক প্রভৃতি ফুল তাদের পাপড়ি গুটিয়ে ফেলে। যে সব ফুল কেবল রাতে গন্ধ ছড়ায়, গ্রহণের সময় তাদেরও ঘ্রাণ পাওয়া যায়। আরও কত কী টুকরো ঘটনা!

  গ্রহণকালে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বৈজ্ঞানিক রানা সূর্যের নিঁখুত ব্যাস পরিমাপ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর পরিমাপলব্ধ সূর্যের ব্যাস ৯৯.৬ শতাংশ সঠিক। ড. রানা'র নিজের কথায়―
'Our tentative value for the measurement of the physical radius of the sun at 3:02 hour UTC on October 24, 1995 may be placed as 6,96,650 km.'
তিনি আরও বলেছেন―
'এই সূর্যগ্রহণে চাঁদের ছায়া ভারতের উপর দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় ৫৫০০ কিলোমিটার বেগে চলে গেছে।' 
বহু বিদেশী বিজ্ঞানী তাঁর সঙ্গে এই প্রোজেক্টে কাজ করেছেন। তারা সকলে ড. রানা'র সূর্যের ব্যাস নির্ণয়ের সাক্ষী। পাশে থেকে সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে লক্ষ্য করেছিলেন। এ অভিজ্ঞতা বহুদিন স্মরণে থাকবে অংশগ্রহণকারী মানুষজনের। (চলবে)

তথ্য সহায়তা :
'নিউটনের আপেল ও নারায়ণ'― ড. সন্তোষ কুমার ঘোড়াই,
'মেদিনীপুরের বিশ্বজয়ী ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞানী'― বাদল চন্দ্র দে
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক-শিক্ষক শ্রী অতনু মিত্র
বিশিষ্ট শিক্ষক শ্রী অশোক ভৌমিক
মণিস্যারের ভাইপো শ্রী গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী
'বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানা'― নন্দগোপাল পাত্র,
'N C Rana : Life and His Contribution on Astrophysics Science'― Utpal Mukhopadhyay and Saibal Ray,
'মেদিনীপুরের বিজ্ঞানীদের কথা'― ভাষ্করব্রত পতি,
উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন ব্লগ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. অভাবনীয় সাফল্য !
    মননে চিন্তনে বেঁচে থাকুক মেদিনীপুরের নারায়ণ ۔۔

    ReplyDelete