জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-২৮/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-২৮
শুভদীপ বসু
এ সময়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর সুমন্ত্র সেনগুপ্তের সাথে একটি টেলিফোনে সাক্ষাৎকার

(জ্যৈষ্ঠের দুপুর।আমার গ্রামের বাড়ি খড়গপুর এর বলরামপুর। আমি পুকুর পাড়ে বসে।একটা পানকৌড়ি হাঁসের মতো চরতে চরতে মাছ মুখে নিয়ে আকাশে উড়ে চলে গেল।চারিদিকে অজানা সব পাখির ডাক।ঝিঁঝিঁর শব্দ। সুমন্ত্রদাকে ওয়াটসঅ্যাপ করলাম)

শুভদীপ:দাদা পাঁচ মিনিট সময় হবে একটা কাজের জন্য কিছু তথ্য আপনার কাছে নিয়ে নিতাম।
সুমন্ত্র: হাঁ হাঁ,এখন করো।
(সেই পাঁচ মিনিটের কথোপকথন গিয়ে পৌঁছলাম ২৯এ।)
সুমন্ত্র:সরি,সেদিনের কথা হয়ে উঠলো না।
শুভদীপ:না দাদা আপনি প্রচন্ড ব্যস্ত থাকেন জানি।আজ একটু আপনার সাথে কথা বলতাম। বর্তমান সময়ে  আপনি এসময়ের দৃঢ়চেতা আবৃত্তিশিল্পী।আমরা আপনার প্রত্যক্ষ না হলেও অনেকেই আপনার পরোক্ষ ছাত্র। আপনার ছোটবেলার কথা একটু শুনবো।
 সুমন্ত্র:আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা বেলঘরিয়াতেই।বাবা-স্বর্গীয় ফণীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত,মা-আরতি সেনগুপ্ত।ওনারা অধুনা বাংলাদেশের মানুষ।বাবা কমিউনিস্ট ছিলেন।পার্টি করার জন্য দুবার চাকরি গেছে। দারিদ্রতার সাথে লড়াই করেই আমাদের বেড়ে ওঠা।আমাকেও চাকরি করতে হয়েছে অত্যন্ত কম বয়স থেকে।আঠারোর পরেই চাকরি।নাইটে পড়াশোনা করে স্নাতকোত্তর করি।
শুভদীপ:কবিতা,আবৃত্তি এসব কি ছোট থেকেই ভালো লাগতো?
সুমন্ত্র:হ্যাঁ,মায়ের কাছ থেকে এই ভালোলাগাটা আমি পেয়েছি।ছোটমামা ও উৎসাহ দিতেন আমায়।স্কুলের মাস্টারমশাইরা রবীন্দ্রজয়ন্তী থেকে অন্যান্য সব অনুষ্ঠানেই আমাকে ডেকে নিতেন।
শুভদীপ:ওই আঠারোর পরেই তো আপনি যুববাণী তে জয়েন করলেন।আচ্ছা এই সময় আপনাকে পথ দেখালেন কারা?
সুমন্ত্র:পরিচয় বসু,অঞ্জন বিশ্বাস এনারা আমাকে পথ দেখিয়েছেন। এরপর সারথি তে আমি যাই।
শুভদীপ:শঙ্খমালার কথা একটু বলুন দাদা।
সুমন্ত্র:১৯৮৯ সালে শঙ্খমালার যাত্রা শুরু।আমরা চেয়েছি আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে কবিতা ও কবিতার মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছব।আমি ছাড়াও আমার স্ত্রী রঞ্জনা সেনগুপ্ত,বোন শাশ্বতী দাশগুপ্ত পুরো ব্যাপারটা দেখেন।
শুভদীপ: এত মানুষ নিয়ে কিভাবে কাজটা করেন আপনি?
সুমন্ত্র:ছোটবেলা থেকেই বুঝলে আমি খুব লোক দেখেছি।দারিদ্রতা থাকলেও,বাড়িতে কেউ এলে খাওয়া-দাওয়া না করে যেতেন না। আমি যখন'শেষের কবিতার'পাঠাভিনয় দেখেছিলাম সৌমিত্র চ্যাটার্জী,লিলি চক্রবর্তীর অসাধারণ পাঠ আমায় মুগ্ধ করেছিল।পরবর্তী সময় নীলাদ্রি শেখর বসুর- ছড়া,তোতাকাহিনী নিয়ে কিছু প্রযোজনা আমায় ভাবতে সাহায্য করেছে।আসলে শিল্প তো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় উত্তীর্ণ হওয়া।
  শুভদীপ:'আগুন ফলবান','বীরেশ্বর','জাগরণের পালা','জলশ্রোত কথা কয়' 'অন্ধকার লেখাগুচ্ছ','মেঘনাদবধ কাব্য'-এসব আবৃত্তি নিয়ে দলগত সফল মঞ্চায়ন এর ইতিহাস?
সুমন্ত্র: ৪৩জন নিয়ে'জলস্রোত কথা কয়'করার সময় আমার অনেক স্বজনেরা প্রশংসা করলেও ব্যাপারটা কি ঠিক স্বীকার করেননি।কিন্তু আমার মনে হয়েছে, কোথায় লেখা আছে দাঁড়িয়ে কবিতা বলতে হবে?জানালার পাশে‌ বসে বলা যাবে না?বাচিক যা বলে না থিয়েটার তা বলে।বাচিক ও থিয়েটারের যে দ্বন্দ্ব এখান থেকে নতুন কিছু সৃষ্টি হবে।কারণ যেকোন ঘর্ষণেই তো নতুন কিছু তৈরি হয়।যেমন আদিম যুগে পাথরে পাথরে ঘষা লেগে আগুন তৈরি হয়েছিল।সেই complimentওcontradiction বজায় রাখার চেষ্টা আমি করেছি। তাই থিয়েটারের মানুষের সাহায্য নিয়েছি।আমি আমার সীমাবদ্ধতা জানি।থিয়েটার শিক্ষা আমার নেই। সেজন্য দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম হালদার,বিমল চক্রবর্তীর মত মানুষ আমাদের সাথে কাজ করেছেন।
শুভদীপ:আচ্ছা দাদা আপনার কাছে শিল্পের সংজ্ঞা কি?
সুমন্ত্র:আমার আসলে সব সময় মনে হয় মঞ্চ প্রস্তুত থাকবে,আমি গিয়ে কবিতা বলব-এটা আমার কাছে শিল্প নয়।আমার কাছে শিল্প হোল- মঞ্চটা কে ঝাঁট দেওয়া, আলোটা কোথায় লাগানো হবে? সেট ডিজাইনিং কি হবে?কে জল দেবে?কে খাবার দেবে?কে প্রপস গুলো ঠিক করে রাখবে?এসমস্তকিছু আমার শিল্পের অন্তর্ভুক্ত।আমি একটা ভালো পাঞ্জাবী পরে,মেকআপ নিয়ে, চারটে কবিতা বললাম-এটা যে শিল্প নয়,তা নয়।কিন্তু আমার কাছে কোর্ডিনেশনটাই আসল।আমি তোমাদের ওখানে গিয়েও দেখেছি তুমিও এরকম কাজ করছো।তুমিও দেখেছো,এই কোর্ডিনেশনে শ্রম আছে কিন্তু অদ্ভুত আনন্দ আছে।
শুভদীপ: সব সময় দলের কথা ভাবতে গিয়ে নিজের কথা ভাবতে ইচ্ছা হয়নি?
সুমন্ত্র: আমার একা একা নাম করার ইচ্ছে কোনদিনই ছিল না। তুমি যদি বেলঘরিয়ায় নেমে পূর্ব পাড়ে এসে সুমন্ত্র সেনগুপ্ত বলো- হয়তো ১০০ জনের মধ্যে ১০ জন চিনতে পারে।কিন্তু শঙ্খমালা বললে,১০০জনের মধ্যে ৯৫ জন চিনবে।আমি ছোটবেলা থেকে এটাই চেয়েছি।আমি নই আমরা। এইভাবে বড় হয়ে উঠতে পারি কিনা।কিন্তু আমার কাছে এমন উদাহরন পূর্বে ছিল না।আমরা যেভাবে'মেঘনাদবধ কাব্য'করেছি, আমি গ্যারান্টি দিয়ে অহংকারের সাথে বলতে পারি সম্পূর্ণ 'মেঘনাদবধ কাব্য' আমাদের দলের ছেলেমেয়েরা মুখস্থ করেছে ও পারফর্ম করেছে।থিয়েটারের বাইরে এই ঘটনা ঘটেনি।কোন বাচিক দলকে আজ পর্যন্ত দেখিনি টানা ২ঘণ্টা ১০ মিনিট ধরে এরকম প্রযোজনা করতে।আমাদের এই প্রযোজনা যখন বিভাস চক্রবর্তী দেখেছেন তখন উনি আপ্লুত হয়েছিলেন।
  শুভদীপ:এই করোনা আবহাওয়ায় আগামী দিনে এরকম প্রযোজনায় প্রতিবন্ধকতাতো রয়েছে?
সুমন্ত্র: হ্যাঁ এখন তো আমরা isolationএ চলে যাচ্ছি।social distance কথাটা চলে আসছে। সেখানে দাঁড়িয়ে একা কাজ করাটা যতটা সহজ,একসাথে কাজ করাটা ততটাই কঠিন।লকডাউনে আমরা সমবেত চর্চা করতে পারছিনা।কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা একটা বড় কাজে এগোতে চাইছি।
  শুভদীপ:আগামী প্রজন্মকে কি বার্তা দেবেন?
সুমন্ত্র:আবৃত্তি শিল্পের ইতিহাস পুরোনো নয়।তাই এর গ্রহণযোগ্যতা নাটক বা গানের থেকে কম।তাই এটা করে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা হবে,এই ধারণাটা লোকের মনে তৈরি হয়নি।এই প্রবল জীবন যুদ্ধে এখন ৮ঘন্টা নয়,একটা ছেলেকে সকাল ৮টায় বেরিয়ে  রাত্রি১০টায় বাড়ি ঢুকতে হয়।তাই শুধু সখের টানে কতদিন চর্চা করবে?আমাদের বেশিরভাগ ভালোবাসা শর্তাধীন।আবৃত্তি তো কেরিয়ার দেবে না।কিন্তু শিল্প শর্তহীন ভালোবাসা দাবি করে।আমি শুধু পরবর্তী প্রজন্মকে এটা বলতে চাইব শর্তহীন,স্থাবর সম্পত্তির প্রত্যাশাহীন ভালোবাসা যদি এই শিল্পের জন্য থাকে,তাহলেই এই শিল্পকে নিয়ে অনেক দূর যাওয়া যেতে পারে।আমি এই শিল্পটা ভালোবেসে যে আনন্দ পাই তা হয়তো দিনের শেষে চারটি রুটি দেয় না।কিন্তু মনে অদ্ভুত প্রশান্তি দেয়।সৃষ্টির আনন্দের এই প্রশান্তি লাভ করতে যারা চাইবেন তারা এই আবৃত্তিটা করুক।এরকম করতে করতে একদিন আসবে যখন মানুষ বেশি আগ্রহ দেখাবে,আর যত বেশি আগ্রহ দেখাবে ততবেশি উপার্জনের রাস্তা খুলে যাবে।
শুভদীপ:এই শিল্পে সম্ভাব্য নবীন শিল্পীদের কেমন দেখছেন?
সুমন্ত্র:এক ঝাঁক ছেলে মেয়েদের মুখ মনে পড়ছে।কোন একজনের কথা বললে অন্যজন বাদ পড়ে যেতে পারে।আমি তোমাদের মেদিনীপুরে স্বর-আবৃত্তির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখেছিলাম। অসাধারণ লেগেছিল।আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে সে কথা বলেছিলাম।ঠিক একই রকম কৃষ্ণনগরের আকাশ দত্ত,শিলিগুড়ির অমিতাভ কাঞ্জিলালের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।আমার ও ব্রততীর দলের অনেক ছেলেমেয়ে ভালো আবৃত্তি করে যাদেরকে আমি চিনি।তেমন হয়তো অন্য দলেও আছে।
শুভদীপ: আপনার প্রিয় কবি?
সুমন্ত্র: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শুভদীপ:বর্তমানে যারা লিখছেন?
সুমন্ত্র: তুমি একজনের কথা বলতে বললে,আমি বলব জয় গোস্বামী।
শুভদীপ: প্রিয় কবিতার লাইন?
সুমন্ত্র: "ওরে ভাই কার নিন্দা করো তুমি?
মাথা করো নত।
এ আমার,এ তোমার পাপ।"
শুভদীপ: প্রিয় রঙ?
সুমন্ত্র: প্রিয় রঙ অনেক।কিন্তু প্রিয়তম রঙ লাল।
শুভদীপ: আপনি খাদ্য রসিক?
সুমন্ত্র:আমি খেতে খুব ভালোবাসি কিন্তু পরিমাণে।
শুভদীপ:তাহলে প্রিয় খাবার?
সুমন্ত্র:লুচি ও খাসির মাংস (বলে দিলাম তোমাদের ওখানে এরপরের বার গেলে খাইও)
  শুভদীপ:নিশ্চয়ই দাদা। অনেক কিছু শিখলাম ও জানলাম। আজকের মত আপনার কাছে শেষ প্রশ্ন-কি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে সুমন্ত্র সেনগুপ্ত?
সুমন্ত্র:যেদিন আমার রাষ্ট্র থেকে ফ্যাসিজম দূর হয়ে যাবে,সেদিন আমি সবথেকে বেশি খুশি হব। আমার রাষ্ট্র ফ্যাসিস্ট শক্তির হাতে না থাকলে শিল্পের প্রসারতা হবে।ধরো,আমি যদি কবিতা লিখি,তা যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হয় তবে আমায় জেলে যেতে হবে?এই দেশ আমার নয়।এটাই আমার স্বপ্ন। ভালো থেকো শুভদীপ।
শুভদীপ:আপনিও ভালো থাকুন সুমন্ত্র দা।

(কথোপকথন শেষ হলো।আকাশ কালো করে এসেছে। এবার বুঝি বৃষ্টি আসবে।)

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments