জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-৩১/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-৩১
শুভদীপ বসু

বিষয়: বাংলার বিশিষ্ট আবৃত্তিকার-(ষষ্ঠ পর্ব)

রত্না মিত্র
কবিতা মানুষের মন ও মননকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।কবিতা পারে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখতে।এই কবিতা দিয়ে মানুষের মনকে সুস্থ রাখার কাজ যিনি দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন তিনি বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবৃত্তিশিল্পী শ্রীমতী রত্না মিত্র।
ছোটবেলা: উত্তর কলকাতায় মানিকতলায় ছোট থেকে বড় হয়েছিলেন রত্না মিত্র।বাবা স্বর্গীয় বিনয় কুমার পাল,মা ভবানী পাল।এখন আমরা যাকে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি বলি ঠিক সেরকমই গল্প বলা,কবিতা বলার একটা আবহ ছিল বাড়িতে।বড় ফ্ল্যাট বাড়ির মত ছিল ওনাদের বাড়ি।প্রত্যেক ফ্লোরে দুটো ভাগ।দশটা পরিবার একটা বাড়িতে কিন্তু সেই দশটা পরিবারের বাচ্চারা একটা পরিবারের বাচ্চার মতোই বড় হয়েছিল।প্রথমে জিতেন্দ্র নারায়ান নার্সারি স্কুল তারপর ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়।বিদ্যালয়ের প্রার্থনার গান ছিল বেদ গান।ইংরেজি,বাংলা সংস্কৃত সব সমান জোর দিয়ে শেখানো হতো।স্কুলে দু'বছর অন্তর অনুষ্ঠান হত।সে সময়ে প্রায় সব অনুষ্ঠানেই অংশগ্রহণ করতেন উনি।তাই আবৃত্তি গানের বোনেদ তৈরি হয়ে গেছে সেই স্কুল জীবন থেকেই।

উচ্চতর বিদ্যা ও কর্মজীবন: বিদ্যালয় জীবন শেষে লেডি ব্রেবোন কলেজ এ সংস্কৃত বিষয়ে স্নাতক হন শিল্পী।এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত নিয়ে স্নাতকোত্তর করেন।স্পেশাল পেপার ছিল ভারতীয় দর্শন।পরে উক্ত বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন উনি।দীর্ঘ পাঁচ বছর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ানোর পর সাংবাদিকতার জগতে ও পরবর্তীকালে গণমাধ্যম এর জগতে চলে এলেন শিল্পী রত্না মিত্র।
একটি তেঁতুল গাছের কথা: খুব কম বয়সে কলেজে পড়াকালীন বিয়ে হয়ে যায় ওনার।ছোটবেলায় শিল্পীর ঠাকুমা ছিল প্রাণের বন্ধু। শ্বশুর বাড়িতে আসার পর তিনি দেখলেন বাড়ির বাগানে একটা মস্ত বড় তেঁতুল গাছ।তার কাছে সেই গাছটি হলো তার ছোটবেলার ফেলে আসা ঠাকুমা।যে সমস্ত কথা কাউকে বলা যায় না সে কথা বলতেন তিনি তেঁতুল গাছকে।এক দিন ঝড়ে সেই তেঁতুল গাছ শুয়ে পড়েছিল।এই খবর তার কাছে যাওয়ার পর তিনি প্রাণের বন্ধুর বিয়োগ ব্যথায় অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন।কিন্তু তার ঠিক পরমুহুর্তেই দেখলেন শুয়ে যাওয়া তেঁতুল গাছ সামনের বিস্তৃত আকাশকে তার চোখের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে।সেখানে অজস্র রাধাচূড়া কৃষ্ণচূড়া আর পাখপাখালির গান। তিনি মনে মনে উচ্চারণ করলেন-'যাহার লাগি চক্ষু বুজি বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর/ তাহারে বাদ দিয়েও দেখি বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।'

কবিতার মঞ্চে:ছোট থেকেই শিল্পীর স্ক্রিপ্ট লেখায় দক্ষতা ছিল।শ্রদ্ধেয় পঙ্কজ কুমার মাইতিকে তিনি একটি স্ক্রিপ্ট লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠানের দিন যার পড়ার কথা ছিল সেই মেয়েটি অসুস্থ হওয়ার দরুন পঙ্কজ বাবু অনুরোধ করেন রত্না দিকে।১৯৭৭সালে রবীন্দ্র সদনে ঐ অনুষ্ঠান।এই ঘটনাটি হয়তো ছিল প্রদীপ জ্বলার আগে সলতে পাকানোর মুহূর্ত। এরপর ১৯৭৮ সালে ও কবিপক্ষে আমন্ত্রণ জানানো হয় শিল্পীকে কিন্তু তখনও বাড়ি থেকে যাওয়ার অনুমতি ছিল না।১৯৭৯ সালে সেই প্রথম স্কুল কলেজের বাইরে সরাসরি মঞ্চে রবীন্দ্র সদনে কবি পক্ষের অনুষ্ঠানে কবিতার জগতে আলোময় প্রবেশ হলো শিল্পী রত্না মিত্রের।৭০থেকে ৮০দশকে প্রায় বেশিরভাগ সরকারি অনুষ্ঠানে পরিচিত মুখ হয়ে উঠলেন তিনি।৯০ এর দশকে প্রফেশনালি কবিতা আবৃত্তির জগতে চলে এলেন শিল্পী।

আবৃত্তি ও শ্রুতি নাটকের প্রতিষ্ঠান 'বাক্'-90 দশক থেকেই কিছু ছেলে মেয়ে তার কাছে শিখতে আসে কবিতা শেখাবেন এরকম ভাবনা প্রথমে তার ছিল না।অবশেষে ২০০১ সালে তৈরি করলেন আবৃত্তি ও শ্রুতি নাটকের প্রতিষ্ঠান বাক্।এই প্রতিষ্ঠান আবৃত্তি বিভাগটি দেখেন স্বয়ং শিল্পী রত্না মিত্র আর শ্রুতি নাটকের বিভাগটি দেখেন শ্রী অমিত রায়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪৫। প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সংখ্যার ওপরে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয় না।সেজন্যই হয়তো বহুজনকে অপেক্ষায় থাকতে হয় কারণ সমগ্র ব্যাপারটি তত্ত্বাবধানে থাকেন স্বয়ং শ্রীমতী রত্না মিত্র।

সাধনার ফসল:
আগুনের ফুল-১৯৮৫তে School of people's Art নামে কিছু কম বয়সী ছেলেমেয়েরা একত্রিত হয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে। গান ও কবিতার অ্যালবাম 'আগুনের ফুল'এ শিল্পীর আবৃত্তি সকলের নজর কাড়ে।
'ছন্দে ভাঙে অন্ধকার'-অশোক পালিতের সাথে শিল্পীর এই অ্যালবামটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
আকাশবাণী কলকাতা-নব্বইয়ের দশক থেকে আকাশবাণীর পরিচিত কণ্ঠস্বর শিল্পী রত্না মিত্র। প্রাত্যহিকীর উপস্থাপক হিসেবে জনপ্রিয়তা পান তিনি।এ সময় ডক্টর অমিত চক্রবর্তী সাথে মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ রাখার একটি অনুষ্ঠান 'মনের কাছাকাছি'জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যা পরবর্তী সময়ে বেতার থেকে দূরদর্শনের পর্দাতেও সম্প্রচারিত হয়েছিল।আকাশবাণীর বহু স্ক্রিপ্ট বহু নাটকের অনুবাদ সাফল্যতার সাথে করেছেন শিল্পী রত্না মিত্র।
ভিতর মহলের ব্যথা-শিল্পী রত্না মিত্রের আরেকটি পছন্দের জায়গা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর গান। রত্না মিত্রের স্ক্রিপ্ট,শ্রীকান্ত আচার্যের পাঠ ও শ্রাবণী সেন এর গানের এই অ্যালবামটি মানুষের মনে দাগ কেটেছিল।
আটপৌরে রবীন্দ্রনাথ- অমিত রায়ের সাথে আধুনিক সময়ের গল্প ও রবি ঠাকুরকে নিয়ে এই অ্যালবামটি ছিল অসাধারণ।
পাড়ি-রবি ঠাকুরের মৃত্যু ভাবনা নিয়ে রত্না মিত্রের লেখা ও পাঠের সাথে রাজর্ষি ভট্টাচার্য ও অচিন্ত্য নারায়ন বিশ্বাসের গান অন্যরূপ স্বাদ এনেছিল।
বাংলার কতকথা-২০০১ সালে প্রকাশিত এটি ছিল শ্রীমতি রত্না মিত্রের প্রথম একক কবিতার অ্যালবাম, যা জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিল।
ভুবনমনমোহিনী-রত্না মিত্রের ভাবনায়ও গ্রন্থনায় শ্রাবণী সেনের গানের অ্যালবামটি একটি অন্যমাত্রা আনে।
চির সখা-২০০৩ সালে প্রকাশ পায় একক আবৃত্তির অ্যালবাম।
মেঘ রোদ্দুর -রবীন্দ্র কবিতার একক আবৃত্তির এই অ্যালবামটি২০১৫সালে প্রকাশ পায়।
শ্রীমতী রত্না মিত্র বাংলা আবৃত্তির ইতিহাসে এক জ্যোতিষ্ক।এই সময় তার আবৃত্তি ও মনের কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে বহু মানুষ কবিতার মধ্য দিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন।আসলে কবিতাইতো সেই রূপসাগরে অরূপরতন যাকে কেন্দ্র করে ঘর গেরস্থালি বেঁধেছেন শিল্পী।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments