জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম --১৩/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম --পর্ব--(১৩)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মে ঈশ্বরের প্রবেশ 

কোবি আর  WMAP স্যাটেলাইটের তথ্য থেকে আমরা জানতে পেরেছি মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে কি কি উপাদান দিয়ে। মহাবিশ্বের ৪ শতাংশ তৈরি হয়েছে সাধারণ পদার্থ দিয়ে। যা থেকে আমরাও তৈরি। মহাবিশ্বের ২৩ শতাংশ 'ডার্ক' ম্যাটার বা কৃষ্ণ পদার্থ। এর গঠন সম্পর্কে আজও আমাদের স্পষ্ট ধারণা নেই। আর মহাবিশ্বের ৭৩ শতাংশ হল এক রহস্যময় উপাদান, যার নাম 'ডার্ক এনার্জি'। এই ডার্ক এনার্জির উৎস সম্পর্কে আজও সঠিক কোনো ধারণা নেই আমাদের। আজকের সৃষ্টিতত্ত্বের পরম সন্ধানের বিষয়- ডার্ক এনার্জির উৎসকে স্পষ্টভাবে বোঝা। এই রহস্যময় শক্তি আজও আঁধারে।  
  
 বিগব্যাংয়ের আদি পজিটিভ এনার্জির সবটাই তৈরি হয় মহাস্ফীতির সময়ে। সেই সঙ্গে সমপরিমাণ নেগেটিভ এনার্জি ও তৈরি হল। মনে রাখতে হবে, মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা একে অন্যকে টানছে। গণিতের বিশ্লেষন দেখিয়েছে, মহাবিশ্বে পজিটিভ এনার্জির এবং নেগেটিভ এনার্জির যোগফল সমান। ফলে পজেটিভ নেগেটিভ কাটাকুটি হয়ে মহাবিশ্বে মোট এনার্জীর পরিমাণ দাঁড়ালো শূন্য। এত বিশাল এক মহাবিশ্ব। অথচ সেখানে শূন্য এনার্জি? কি করে সম্ভব? সম্ভব হতে পারে- যদি মহাবিশ্বের স্ফীতি ও প্রসারের এনার্জির উৎস হয়ে থাকে এমন কিছু যার মূল্য 'শূন্য'। 

  এই মহাবিশ্বের জন্মের মুহূর্তেই কী ঘটেছিল, তা আমরা জানি না। মহাবিশ্ব সৃষ্টির একেবারে প্রথম মুহূর্তটিকে ইনফ্লেশন এক বিপুল জলপ্রপাতের মত আমাদের চোখের সামনে থেকে সব মুছে দিয়েছে। তার মধ্যে থেকে আমরা আমাদের সুপার মডেল মহাবিশ্বের 'ভ্রুণ' টিকে শনাক্ত করব কি করে? মনে পড়ে যায় মৃত্যুর কদিন আগে লেখা রবীন্দ্রনাথের 'প্রথম দিনের সূর্য' কবিতাটি: "প্রথম দিনের সূর্য/ প্রশ্ন করেছিল/ সত্তার নতুন আবির্ভাবে-/ কে তুমি,/ মেলেনি উত্তর।" 

  আমরা জানি না, কোনওদিন বিজ্ঞান সব আড়াল কাটিয়ে, সব আঁধার পেরিয়ে, সব রহস্যের পর্দা সরিয়ে মহাবিশ্বের জন্মমুহূর্তের একেবারে শুরুতে, ওই এক সেকেন্ডের অন্তিম ভগ্নাংশে পৌঁছাতে পারবে কি না। গণিতজ্ঞ রজার পেনরোজ এবং বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, স্পেস-টাইম শেষ পর্যন্ত কোল্যাপস করে বা ভেঙে পড়ে এমন এক বিন্দুতে যার 'ডাইমেনশন' বা দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-বেধের মাপ একত্রে শূন্য! কিন্তু এই জিরো ডাইমেনশনে পৌঁছনোর আগে প্লাঙ্ক'স ডাইমেনশনের  কাছাকাছি এলেই তো কাজে লেগে যাবে 'কোয়ান্টাম এফেক্টস' উদ্ধারের। পদার্থবিজ্ঞানী এবং সৃষ্টিতাত্ত্বিকরা  একসঙ্গে বলেছেন- যতই আমরা সৃষ্টির রহস্য ভেদ করতে পিছনের দিকে যাব, যতই কাছাকাছি যাব সৃষ্টির জন্মলগ্নের, ততই দেখব এককরণ বা ইউনিফিকেশনের বিভিন্ন পর্যায়। 

  মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল সমস্ত ক্ষেত্রের মহামিলন থেকে। নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী মুরে গেলম্যানের মতে, এই পর্যায়ে মৌলকণা এবং মহাবিশ্ব প্রসঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানের দুটি মৌলিক মনন মিশে গিয়ে হয়ে ওঠে এক সূত্র। একদিকে ক্ষুদ্রতম কণিকার বিজ্ঞান। অন্যদিকে মহাশূন্যের জন্মলগ্নের বিজ্ঞান। তারা এই পর্যায়ে এসে হয়ে ওঠে একই বিজ্ঞান। সন্ধান দেয় এই মূল সত্যের যে মহাবিশ্বের একই উৎস। একমেবাদ্বিতীয়ম্। এক এবং অদ্বিতীয়।

  তাছাড়া আধুনিক বিজ্ঞান মহাবিশ্বে মহাকালে কোন অন্তহীন সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের লীলা আবিষ্কার করতে পারেনি। মহাবিশ্বের অভ্যন্তরে অবিরত নতুন তারকার জন্ম হচ্ছে, পুরনো তারকারা বিস্ফোরণে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে অথবা মরে গিয়ে কৃষ্ণবিবরে পরিণত হচ্ছে, প্রতিনিয়ত নব নব সৃষ্টি এবং ধ্বংস ঘটে চলেছে, একথা বৈজ্ঞানিক সত্য। কিন্তু সমস্ত মহাবিশ্বই চক্রাকারে বারে বারে সৃষ্টি এবং ধ্বংস হচ্ছে, এ তত্ত্বের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। প্রকৃতপক্ষে এই চক্রাকারে সৃষ্টি ও প্রলয়ের তত্ত্ব ও অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন প্রাচীন মানুষের উদ্দাম কল্পনা মাত্র। যার উৎপত্তি হয়েছিল পৃথিবীতে জীবজগতের জন্মমৃত্যু, দিনরাত্রির চক্রাকার আবর্তন, চক্রাকার ঋতু পরিবর্তন, বীজ থেকে শস্য আবার শস্য থেকে বীজ ইত্যাদি চক্রাকার আবির্ভাব-অস্তিত্ব-লয়ের অভিজ্ঞতা থেকে। 

  ধর্মগ্রন্থের বাণীর মাধ্যমে মহাবিশ্বের উৎস অথবা কারণ সন্ধান নিরর্থক। এভাবে মহাবিশ্বের আদি-অন্ত বা বিবর্তন সম্বন্ধে 'পূর্ণ জ্ঞান' লাভ করা একেবারেই অবাস্তব এবং অসম্ভব। বিশ্বচরাচরের উৎস যদি আদৌ কোনদিন জানা সম্ভব হয়, তবে তা বিজ্ঞানের সাহায্যেই হবে, কল্পনার সাহায্যে নয়। পৃথিবীর মানুষের সামনে মহাবিশ্ব সম্বন্ধে জ্ঞান লাভের আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই। আর অনেক বিজ্ঞানীর এই মত যদি সত্য হয় যে মহাবিশ্ব প্রকৃতপক্ষে আদি-অন্তহীন, তবে সৃষ্টি ও স্রষ্টার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ যা আদি-অন্তহীন তার সৃষ্টি অথবা ধ্বংস নেই, অতএব তার স্রষ্টা ও নেই। তা এক স্বয়ম্ভু সত্তা, যার কোন স্রষ্টা থাকতে পারে না, কারণ তার কোন আরম্ভ নেই। বিজ্ঞানের বিলম্বিত এবং কষ্টসাধ্য পথে মানুষ ধীরে ধীরে মহাবিশ্বের বিবর্তনের ধারা ও নিয়মগুলো বুঝতে শিখেছে, এবং ক্রমশ তার জাগতিক প্রয়োজনে এবং জ্ঞান বৃদ্ধির উদ্দেশ্য কাজে লাগাচ্ছে। মানুষের ধীশক্তির এই ভবিষ্যৎমুখী অভিযানে ধর্ম তাকে কোন সাহায্য করতে পারবে বলে মনে হয় না। হয়তো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments