জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৪০

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৪০


সম্পাদকীয়,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ' ইচ্ছেপুরণ ' গল্পটার কথা আজ আমার খুব মনে পড়ছে। কেন? আরে এবারের ছোটোবেলা পড়লে তোমাদেরও মনে পরে যাবে। ছোটো দুই বন্ধু শতভিষা আর প্রীতি লিখেছে দুটো বড়দের গল্প। এদিকে সাহিত্যিক বিশ্বজিৎ অধিকারী লিখেছেন একটা মুরগীর গল্প যার  নাম শুনে আমি তো হেসেই মরি। কবি বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় এক পিসিকে নিয়ে ছড়া লিখেছেন যার হবি শুনলে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে। মজার কথা কি জানো কবি অমিত মজুমদার আর বিশ্বনাথ চৌধুরী দুজনেই একদম ছোটো হয়ে গেছেন। আবার জয়ন্তী মন্ডলের গল্পে হরিসাধন কাকা অত বড় মানুষ হয়েও কানাই বলাই দুটো বাচ্চাকে আটকে কি করেছেন জানো? না এখানে বলা যাবে না, তাহলেই সুদর্শন নন্দীর মীর দারোগা ছুটে চলে আসবে হরিসাধন কাকাকে লক আপে নিয়ে যাবার জন্য। শুধু কি তাই রতনতনু ঘাটী মহাশয় তার উপন্যাসে এবার সুকুমার রায়ের বিখ্যাত ছড়ার  বই হযবরল'র কথা বলেছেন। লেখার কথা অনেক হল এবার আসি আঁকায়, খুকু পদ্মদিঘিতে জল আনতে গেছে চুল এলো করে, ক্লিওপেট্রার সাজ,  এসব যতই আঁকো না কেন বেলুন ওলাকে দেখলেই তোমরা আবার ছোটো  হয়ে যেতে চাইবে। এছাড়াও অপু পালের তোলা প্রচ্ছদের ছবি দেখে আবার জলে কাদায় খেলা করতে চাইবেই চাইবে। কি কেমন মজা!  হল কিনা এবারের ছোটোবেলার লেখা আঁকা জুড়ে ইচ্ছেপূরণের গল্প? এবার লেখা আঁকা আর পাঠ প্রতিক্রিয়া পাঠিয়ে দাও তাহলে আমারও ইচ্ছেপূরণ হয়ে যাবে। - মৌসুমী ঘোষ


বাঘিনি
বিশ্বজিৎ অধিকারী

আজকেও বাঘিনি বেড়ার ফাঁক গলে এদিকে এসে গোয়ালঘরে ঢুকল। সকালে দাওয়ায় পড়তে বসে গত চার-পাঁচ দিন নিয়ম করে এই দৃশ্য দেখছে রাজু।
ঝুনুদিদির বাবা, মানে তমাল-জেঠু গেল শীতে পশ্চিমের এক হাট থেকে কিনে এনেছিলেন বাঘিনিকে। দাম পড়েছিল একটু বেশিই। দাম এত বেশি কেন জিজ্ঞেস করায় নিজের ফুরফুরে সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে ব্যাপারী বলেছিল “এ কি যেমন-তেমন জিনিস পেয়েছেন? এ হল একেবারে বাঘের বাচ্চা”। সেই থেকে এই নাম। যেমন নাম তার তেমনই কাজ। লালকালো পালকে ঢাকা ভারিক্কি চেহারা, মাথায় লাল ঝুঁটি, দেখলেই কেমন ভয় করে। তাকে পোষ মানাতে কম বেগ পেতে হয়নি। সারাক্ষণ যেন রাগে গরগর করছে। অচেনা মানুষ দেখলে ঘাড়ের পালক ফুলিয়ে তেড়ে যায়। মেজাজ গরম থাকলে চেনা মানুষকেও রেয়াত করে না। এসব কথা অবশ্য পাড়ার অন্যদের মুখে শুনেছে রাজু। কেননা ঝুনুদিদির সঙ্গে যে তার কথা বলা বারণ। এতদিন ওবাড়িতে জ্যাঠাইমার রাগই ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু বাঘিনির মেজাজ যেন আরও এক কাঠি ওপরে। তাই জ্যাঠাইমাও বাঘিনিকে খুব একটা ঘাঁটায় না। অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে খাবার দিয়ে খুব নরম করে ডাক দেয়, আয়, আয়, তি-তি-তি-তি-তি-তি। ডাকটা বাড়িতে বসেই শুনতে পায় রাজু।
সেই যেদিন এবাড়ির ছাগল ওবাড়ির লাউগাছ মুড়িয়ে খেয়ে এল সেই থেকে রাজুর মায়ের সঙ্গে ঝুনুদিদির মায়ের ঝগড়া। কথা বন্ধ, যাওয়াআসা বন্ধ, দু-বাড়ির কেউ কারুর মুখের দিকে তাকায় না। আজ কতদিন হয়ে গেল। দুটো বাড়ির মধ্যিখানে এখন বাঁশকঞ্চির বেড়া। 
দুই বাড়ির বাঁশবন গায়ে গা লাগানো। ডালপালা দিয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে রেখেছে দুদিকের আমগাছ জামগাছ শিরীষগাছ হিজলগাছ। গাছে-গাছে পাখিদের ওড়াউড়ি, কাঠবেড়ালিদের আসাযাওয়া। কিন্তু বাড়িতে পোষা গরুছাগল বা হাঁসমুরগির এদিক থেকে ওদিকে যাওয়ার জো নেই। তাদের ওপর দুই গিন্নির কড়া নজর। তবে ওসব আইনকানুনকে পাত্তা দেয় না বাঘিনি। সে খুশিমতো এদিকে আসে, খড়ের গাদার চারপাশে ঘুরে ঘুরে পোকামাকড় খুঁটে খায়। রাজু একবার ‘যা, পালা’ বলে তাড়াতে গিয়েছিল। জবাবে একদিকের ডানা ঝুলিয়ে এমন তেড়ে এসেছিল বাঘিনি যে দৌড়ে ঘরের ভেতর লুকিয়ে পড়তে হয়েছিল রাজুকে। সেই থেকে রাজু বাঘিনিকে সমঝে চলে।  
কিন্তু বাঘিনি রোজ গোয়ালঘরে কী কারণে ঢোকে? মাকে কথাটা না বলে পারল না রাজু।
মা শুনে বলল, সর্বনাশ! ও আমাদের গোয়ালে ডিম দিতে আসে না তো? চল তো দেখি।
সত্যি, মা যা ভেবেছিল তাইই। গোয়ালঘরের এককোণে ডাঁই করে রাখা পতলি-খড়ের ভেতর সাতখানা ডিম।
মা নিজের মনেই বলল, এ তো আচ্ছা শয়তান মুরগি। দু-বাড়িতে আবার ঝগড়া লাগানোর তাল করছে।
তারপর রান্নাঘর থেকে একটা ঝুড়ি এনে তাতে ডিমগুলো তুলে নিয়ে রাজুকে বলল, যা তো বাবা, এগুলো ঝুনুর মাকে দিয়ে আয়। বলবি, ‘তোমাদের মুরগি আমাদের গোয়ালঘরে ডিম দিয়েছিল’। 
রাজু অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি যাব মা? জ্যাঠাইমা বকবে না? তোমার সঙ্গে যে ঝগড়া। 
না, না, তুই বাচ্চা ছেলে, তোকে বকবে কেন? ঝগড়া হয়েছে তো আমার সঙ্গে।
রাজু মায়ের কথামতো ডিমের ঝুড়ি নিয়ে ধীর পায়ে ওবাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। একটু একটু ভয়ের সঙ্গে একটু একটু আনন্দও হচ্ছে তার। কতদিন বাদে সে ঝুনুদিদিদের বাড়ি যাচ্ছে।
রাজুকে বাড়ির আগল ঠেলে ঢুকতে দেখে জ্যাঠাইমা বলল, কী রে বাবা, কিছু বলবি?
রাজু ভয়ে ভয়ে বলল, তোমাদের মুরগি আমাদের গোয়ালঘরে ডিম দিয়েছিল। মা পাঠিয়ে দিল।
ও তাই বলি, এত দিন হয়ে গেল বাঘিনি ডিম দেয় না কেন! ও যে এমন বজ্জাত তা বুঝবো কী করে বল। আয় বাবা, আয়, বস। 
রাজু দেখল, ঝুনুদিদিও জানালা দিয়ে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। 
জ্যাঠাইমা মাটির তুলসীমঞ্চে নাতা বোলাচ্ছিল, হাতে জলকাদা মাখা। বলল, আমার হাত-জোড়া বাবা, যা, রান্নাঘরে গিয়ে উনুনের পাশে দুটো ডিম রেখে দিয়ে বাকিগুলো তুই নিয়ে যা।
রাজু বলল, আমাকে মা বকবে।
জ্যাঠাইমা বলল, মাকে বলবি আমি দিয়েছি। আর মাকে এও বলবি, তার এত দেমাক কীসের? আমি তার চেয়ে বড়, রাগের মাথায় কবে দুটো কথা শুনিয়েছি বলে এত রাগ! আমার কাছে এসে দুটো কথা বলতে পারে না? আমার সঙ্গে কথা বললে কি তার মান যায়?
ঝুনুদিদি দৌড়ে এসে রাজুর হাতে একটা ডাঁসা পেয়ারা ধরিয়ে দিয়ে গেল।
রাজুর মনটা খুশিতে ডগমগ করছে। দুবড়ির ঝগড়া এবার ঠিক মিটে যাবে।
রাজু যখন ওবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে তখন দেখল ধারালো ঠোঁট দিয়ে ঘাসের ভেতর থেকে কী একটা পোকা বের করবার চেষ্টা করছে বাঘিনি। রাগি চোখে রাজুকে একবার দেখে নিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিল সে।


স্বপ্ন ভরা শিশি
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


শিশি নিয়ে পিসির ছিল ভীষণ রকম হবি

শিশির ভেতর রাখত ভরে স্বপ্নসতেজ ছবি।  

এমন ছবির নাম শোনেনি চোদ্দ পুরুষ কেউ

আঁধার রাতে তার মাথাতে জাগত হঠাৎ ঢেউ।

 
ভাসিয়ে নিয়ে যেত সে ঢেউ কোন অজানার দেশে

রোদকুড়ানি একটি মেয়ে আনন্দে অক্লেশে

কুড়চ্ছে রোদ, রোদের মতো টাটকা সতেজ হাসি

শিশির ভেতর রাখছে ভরে হয় না যাতে বাসি।

 

এই হাসিটির ছোট্ট কুঁড়ি কালকে বড় হবে

আনন্দগান গাইবে পাখি উৎসবে উৎসবে।

কীভাবে পথ সাঁতরাতে হয় ওই পাখিদের ডাকে  

তারাই জানে শিশির ভেতর স্বপ্ন যাদের থাকে।


মীরদারোগার তবলাবাদন 
সুদর্শন নন্দী

আজ কাজের চাপ অতটা নেই মীরদারোগার। বোশেখের অলস দুপুর। থানার বাইরে কটকটে রোদ। দূরে অশ্বত্থ গাছের নিচে একটা আইস্ক্রিমওয়ালা ঘুমুচ্ছে তার  ঠেলার পাশে। একটা কাক খুনসুটি করছে আরেক বব্ধুর সাথে। থানার পাশে ঘুরঘুর করা কুকুরটাও আইশক্রিমের ঠেলার গায়ে গা লাগিয়ে ঝিমোচ্ছে জিভ বের করে । এই দুপুরে কনস্টেবল ফেলারাম খেতে গেছে ঘরে । ফাইফরমাস খাটার ছেলে ধনাকে  পাঠানো হয়েছে সদরে এসডিপিও অফিসের  কিছু কাগজপত্র আনতে।   মানে একঘণ্টা  থানা জনমানবশুন্য । অর্থাৎ একঘণ্টা  দারোগাবাবুর নিশ্চিন্দি। তাই  ভাবলেন এ সময়টা তাঁর সাধের তবলার বোল কটা একটু ঝালিয়ে নিলে মন্দ কি? কিন্তু অফিসের টেবিলে তো আর তবলা নিয়ে বসা যায় না। থানা বলে কথা, কোন জলসাঘর নয়। তারপর পুরানো অভ্যেস মতো টেবিলের  উপরের পাটাতনে একটু পাউডার বুলোলেন যেমন তবলচিরা ডুগি তবলার মাথায়  মাখায় আর কি। মীরদারোগা  আরেকবার চারদিকে দেখে নিলেন কেউ দেখছে কিনা। না কেউ এসময় নেই। চারদিক শুনশান। শুরু হল দাদরার বোল- ধা ধিনা, না তিনা। মাঝে মাঝে চেষ্টা করেন তিন তালে যাবার। আহ কি সুন্দর এ বোল- ধা ধিন ধিন না, তা ধিন ধিন না, না তিন তিন না, তেটে ধিন ধিন না । একদিকে হাত চলছে অন্যদিকে মাথা ঢলছে। শুনতে পাচ্ছে কিনা কে জানে , তবুও এতো গরমে দুরের ঐ কুকুরটাও নেজ নাড়ছে তালে বোলে।  দেখতে দেখতে দশ পনের মিনিট কেটে গেল। তেরে কেটে ধা মেরে ফেরে তাঁর সম্বিৎ। আর ফিরতেই যেন অজ্ঞানের দশা । মনে হল একটা পাহাড় তাঁর সামনে। বিশাল পাথর গড়িয়ে পড়বে এবার। নিঘ্যাত তাতে চাপা পড়বে বিশিষ্ট এই তবলাবাদক মীরদারোগা। ভালো করে চোখ খুললেন তিনি। সামনে দাঁড়িয়ে সার্কেল ইনস্পেক্টর দিগম্বরবাবু। হাতে রুল ঠুকছেন তবলার তাল ঠোকার মতোই । খুব রাশভারি লোক। অফিস স্টাফ থেকে চোর ছ্যাঁচড়,  আত্মীয়স্বজন  থেকে থানার কুকুর বেড়াল খুব সাবধানে থাকে। কথায় কথায় একটি বাক্যই প্রয়োগ  করেন তিনি। দেব পুরে লকাপে? সেই ভয়ে সবাই স্পিকটি নট। এমনকি ঘেউ ঘেউ , মিউ মিউ বন্ধ থাকে তিনি থানা চত্বরে এলে। মীরদারোগা বুঝতে পারলেন এবার তবলার বোল যে তারই মাথায় পড়বে তিনি নিশ্চিত। অথচ এসময় তো তার আসার কথা নয়, তাছাড়া কোন ঝামেলার কেসও নেই থানায়, তবে ?

 মীরদারোগার দীর্ঘদিনের সখ পুলিশের কাজ  বাদ দিয়ে বাড়তি কিছু শেখা। সাধারণ কথায় ইংরিজি মাখিয়ে যাকে বলে এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটি । এই যে লোক গান গায়,  কবিতা লেখে, নাচে, আঁকে, ভাল খেলে এদের তো বেশ পরিচিতি সমাজে। অথচ সারা জীবন পুলিশগিরি করে সেসবের ধারে কাছে যাওয়া গেল না তাঁর । সারা জীবন শুধু চোর ডাকাত পকেটমার আর মারামারি লাঠালাঠি ঠেকাতেই জীবনের শেষ প্রান্তে  তিনি। এই একটি বছর কাটিয়ে দিতে পারলে অবসর। তখন অঢেল সময়। সব নতুন করে শুরু করা যাবে।  তবে  আগেও  তিনি কবিতা লেখা চেষ্টা করেছিলেন একবার । সে শখ লকাপে থাকা কটা ফিচকে কলেজ পড়ুয়ার জন্য শেষ হয়ে  গেছে। আবার  নাচও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু  শিখতে গিয়ে লকাপের এক আসামীকে গুরুবরণ করে গুরুদক্ষিণা  হিসাবে সে  প্রায় পালিয়েই যাচ্ছিল। কপাল জোরে চাকরি বেঁচেছে সেবার।  তাই ঠিক করেছেন তবলা শিখতে এবার আর নয়। শিখবেন বাড়িতে,   প্র্যাকটিস  করবেন থানায়। টেবিলে, বালতিতে। সুযোগ হলে তবলা থানায় নিয়ে যাবেন ।  কারো উপর নির্ভর করবেন না। একা একা শিখবেন। আর সেই প্র্যাকটিস করতে গিয়েই আজ এই হাল। ভাবলেন কার মুখ দেখে যে বেরিয়েছিলেন ঘর থেকে !

  দিগম্বরবাবু ঘাড় নাড়লেন গুরু গম্ভীর মেজাজে। বললেন, বেশ জমিয়ে গানবাজনা চলছে তাহলে। আপনার যে এতো  গুন তা তো জানতাম না ?

মীরদারোগা বুঝতে পারলেন না ইনস্পেক্টর সাহেব তাঁর প্রশংসা করছেন না ব্যঙ্গ  করছেন। নাকি অনেক বেড়াল  যেমন ইঁদুরকে মারার আগে তাঁর সাথে খেলা করে সেরকম কিছু করছেন দিগম্বর বাবু? আমতা আমতা করে বললেন না স্যার, আজ কাজের চাপ একটু কম তাই, কি মনে হল ছেলেবেলার নেশাটা একটু ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম টেবিলেই, এই আর কি। 

ভেরি গুড, দিগম্বর বাবু শুরু করলেন- কিন্তু এ কাণ্ড তো প্রায়ই চলছে দেখছি থানায়,  কোনদিন না আপনার তবলার ঘোরে পুরো থানাটাই  চুরি হয়ে যায়। সেজন্য খোদ এস পি সাহেব পাঠালেন নিজের চোখে দেখে আসতে।

দারোগা বাবুর বুকে তবলার বোল বেজে গেল ভয়ে। এস পি সাহেব জানবেন  কি ভাবে? আর যে ভাবেই যদি সত্যি জানেন তবে তো চাকরিও এককথায় ঘচাং। সত্যি সত্যি তখন বগলে তবলা  বাজিয়ে তাঁকে ভিক্ষা করতেই হবে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়তে  লাগল মীরদারোগার। হাত দুটি কচলাতে কচলাতে  তিনি  বললেন- না স্যার আজ প্রথম শুরু হল, তবে আজই শেষ টেবিলে চাটি মারা ।

-পরশু আপনি, ভেতরের ঘরে তবলা বাজাচ্ছিলেন দুটো বালতি উপুড় করে,  ঠিক কথা?

ঢোক গিললেন মীরদারোগা। জানলেন কি করে দিগম্বরবাবু? কাকপক্ষীরও জানার কথা নয়, তাহলে? সাহস করে এবার  বললেন , না স্যার কেউ ভুল রিপোর্ট দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে। হিংসুটে লোক তো আর কম  ঘুরঘুর করে না থানায়। পুরো এলাকা ঠাণ্ডা করে রেখেছি তো তাই শত্রুরা একটু গরম হয়ে এ কাজ করেছে মনে হয়। ঠাণ্ডার জবাব ধান্দাবাজরা গরমে দিচ্ছে আর কি !

   এলাকা তো এমনি ঠাণ্ডা আপনার তবলার চোটে। । এই বলে পকেট থেকে ইনস্পেক্টর বাবু নিজের স্মার্টফোন বের করে দেখিয়ে বললেন- এই দেখুন আপনার তবলা বাদনের ছবি। আপনি থানার সদর দরজা বন্ধ করে পাশের ঘরে কেমন তবলার বোল  ফোটাচ্ছেন বালতি উপুড় করে। বলি, এটা থানা না আপনার  বৈঠক খানা? কে আপনার কুকীর্তি বা সুকীর্তির ছবি তুলে  ফেসবুকে আমাদের পুলিশের সাইটে আপলোড করেছে দেখুন ।

  অবিশ্বাস্য !  এই ছবি দেখে থমকে গেলেন মীর দারোগা। বন্ধ ঘরে জানালার ফাঁকফোকর থেকে এই  ছবি কেউ তুলেছে নিশ্চয়ই।  আমতা আমতা করছেন  মীরদারোগা  । এমন সময় দিগম্বর বাবু বললেন কি লিখেছেন সেটাও  শুনুন। লিখেছে রোম যখন পুড়ছিল সম্রাট নীরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল, আর বীরপুরও যখন চুরি ছিনতাই –এ জেরবার তখন এখানকার   নীরো মানে মীরও নীরোর মতোই তবলায় তাল দিচ্ছেন খোশ মেজাজে। কিছু বুঝলেন?

  মীরদারোগার চোখ ছানি পড়া রোগীর মতো সব ঝাপসা হতে লাগল। কিছু বলবেন, তখন দিগম্বর বাবু বললেন- এস পি সাহেব এখনি আপনাকে কৈফিয়ত দিতে বলেছে। দেখুন চাকরি থাকে কিনা !

  এর থেকে মাথায় বাজ পড়লে কম লাগে । বিভ্রান্ত আর আতঙ্কে দারোগাবাবু একপ্রকার কেঁদেই ফেললেন চিৎকার করে। আমাকে বাঁচান ইনস্পেক্টর সাহেব। আর কখনো - -

   সেই কান্না জড়ানো চিৎকার শুনে রান্না ঘর থেকে মীরদারোগার  গিন্নি এলেন দৌড়ে। এসেই চেঁচালেন আজ কি হয়েছে বল  দেখি? ঘুমুতে ঘুমুতে দুবার পাউডার চাইলে। তোষক উঠিয়ে পালঙ্কের তক্তা বের করে   খানিক ধা ধিন ধা ধিন করলে বাচ্চা ছেলের মতো। তার উপর কবার মাথার চুল ছিঁড়লে। তিনবার কাঁদলে।  কি সব  স্বপ্ন দেখলে ?

  মীরদারোগার গা ভিজে গেছে আতঙ্কে। বাপরে ভাগ্যিস  স্বপ্ন !  সত্যি হলে চাকরিটা নিঘ্যাত ঘচাং হয়ে যেত আজ।  

  স্ত্রী তা শুনে বললে বুড়ো  বয়সে যত সব ভীমরতি। ! দুগগা দুগগা করে ভালোয় ভালোয় আর  একটা বছর কাটলে বাঁচি !



বেঁচে থাকার লড়াই 
অমিত মজুমদার 

গরম যেতেই আকাশ ভেঙে বর্ষা এলো মুষলধারায় 
জলের ঢেউয়ে রাস্তা ডুবে পুকুর হলো পাড়ায় পাড়ায় 
বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝমিয়ে মেঘের ডাকও আসছে কানে 
এই না হলে আষাঢ় মাসের নিম্নচাপে খেলার মানে ? 
প্রবল বেগে জল গড়াচ্ছে যাচ্ছে ভেসে শুকনো পাতা 
সেটা দেখেই খুঁজতে গেলাম পুরোনো এক অঙ্ক খাতা 
জল গড়ানোর দৃশ্যে যখন রাস্তা ভরে কানায় কানায় 
আমার মতো সব ছোটোরা কাগজ কেটে নৌকো বানায় 
আমিও অনেক নৌকো ছেড়ে দিলাম জলে আদর করে
কয়েকখানা ডুবলো তবে অনেকগুলোই ছুটলো জোরে 
নৌকো ছুটছে ভীষণ স্রোতে পৌঁছে যাবেই নতুন ডাঙায়
কিন্তু আর এক মজার ব্যাপার ঘটলো যেন ছন্দ ভাঙায় 
কেমন ছন্দে বাঁধবো তাকে বুঝতে বুঝতে বুকের মাঝে 
আঁধার নামা হাওয়াও যেনো ভীষণ ভাবে প্লাবন সাজে 
দেখতে পেলাম জলের ভেতর অবিশ্বাস্য ব্যাপারখানা 
এমন বর্ষা না নামলে আজ যেতো কি এই বিষয় জানা?  
বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই দেখছি শুধু চোখ পাকিয়ে 
সদলবলে ব্যাঙের মিছিল আমার নৌকো দখল নিয়ে 
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি শেষ হয়েছে খাতার পাতা 
নৌকো বেয়ে চলছে ওরাই মাথায় ধরে ব্যাঙের ছাতা।


রঙের খেলা
জয়ন্তী মন্ডল 

কানাই বলাই  দুই বন্ধু। দুই বন্ধুর খুব ভাব। একজনের নয় আর একজনের দশ ক্লাস। পরীক্ষা দিয়ে ইস্তক দুজনের মনে শান্তি নেই। কারণ দুজনেরই পকেট ফাঁকা গড়ের মাঠ। দুজনের কেবল চিন্তা কি করে দুটি পয়সা পাই। তাই দিয়ে একটা ফুটবল কিনি। আর ফুটবল খেলার একজোড়া করে জুতো।
সেদিন কানাই আর বলাই দুজনে ডাঙ্গার পথে হাঁটছে হরিসাধন দাদুর সঙ্গে দেখা। হরিসাধনের বাড়ি এ গাঁয়ে। শহরে চাকরি করে। শহরেই থাকে। মাঝে মাঝে  গাঁয়ে ভায়ের কাছে আসে।
  কানাই বলাইকে দেখে হরিসাধন বলল কি হল দাদু মুখখানা এমন শুকনো কেন? হরিসাধনের স্বভাবই এরকম। কারো সঙ্গে দেখা হলে মনে করে সে বুঝি খুব কষ্টে আছে। কানাই বলাই অবশ্য সেদিন মনোকষ্টেই ছিল। হরিসাধনের কথা শুনে কানাই দাদুকে ওদের দুঃখের কথা বলেই ফেলল।
  শুনে হরিসাধন একটু চিন্তিত হয়ে বলল আমি একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কিন্তু তোমরা কি একটা কাজ করতে পারবে?
  হরিসাধনের কথা শুনে কানাই একলাফে হরিসাধন দাদুকে একপাক খেয়ে বলে আমরা পারব। ফুটবলের জন্যে আমরা সব  কাজ করতে পারব। তুমি শুধু  বলো আমাদের কি করতে হবে।
হরিসাধন বলল, শহরে যেতে হবে। পারবে তো?
বলাই কি একটা বলতে গেলে কানাই ওকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বলে শহরে? খুব যেতে পারব। তুমি  যাবার রাস্তা বলে দিও।
  হরিসাধন বলল সে আমি বলে দেবো। তবে তোমরা বাড়ির অভিভবকদের মতামত নিয়ে আগামীকাল আমাকে জানিও।
পরদিন  সকালবেলায় দুজনে হরিসাধনের কাছে হাজির। দুজনেই বলল ওদের অভিভাবকদের শহরে যেতে  দিতে কোনো অমত নেই। 
  সে তো আজ সাতদিন আগের কথা। গেল সাতদিনে গাঁয়ে সাত নয় সত্তর অবস্থা হয়ে গেছে। কোথায় ছেলে গুলো কিভাবে নিখোঁজ হয়ে গেল কেউ যখন কোনো হদিস করতে পারেনি তখনই হরিসাধনের ফোন এসেছিল কানাই এর  বাবার কাছে।
  সাতদিন পর যখন ওরা ফিরল তখন গোটা গাঁ ভেঙে পড়েছে ওদের দেখতে। তা এরকম হবারই কথা। সাতদিন কানাই বলাইএর মা একবার চোখ মেলেনি। বিছানায় শয্যাশায়ী। 
  খবরেরে কাগজে  ওদের নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দেখে হরিসাধন নিজে থেকেই থানাই যোগাযোগ করে। তারপর কানাইএর বাবার ফোন নম্বর নিয়ে ফোন করে হরিসাধন জানাই যে ওরা হরিসাধনের বাড়িতে নিরাপদেই আছে।
বলাই যখন সকলকে বলল শহরে হরিসাধন দাদুর বাড়ি রঙ করতে গিয়েছিল ওরা, কথাটা সবাই শুনে থ। 
বলাই এর পিসে বলে তোরা আবার কবে বাড়ি রঙ করা শিখলি!
  কানাই বলে দাদু ইন্টারনেট থেকে রঙ করা দেখে আমাদের বলে দিয়েছে। আর আমরা দাদুর কথা মতো রঙ করে গেছি।
  এতক্ষণ  ভোমলা ওদের কথা গুলো ওবাক হয়ে শুনছিল। হঠাৎ ভোমলার  চোখ গেল ওদের বড় ঢাউস ব্যাগটার দিকে।
  বলাই ওর পাশে রাখা ব্যাগটা খুলে দুজোড়া ফুটবল খেলার জুতো আর একটা আস্ত চামড়ার ফুটবলটা সকলকে দেখাতে ,কানাই বলল দাদুর ঘরে রঙ করার জন্য দাদু আমাদের টাকা দিয়েছিল। আমরা সেই টাকা দিয়ে এসব কিনেছি। 
  কানাই এর বাবা বলল তোরা আমাদিকে জানিয়ে গেলি না কেন?  তাহলে আমাদের এত দুশ্চিন্তা হত না।
তখন কানাই বলাই দুজনেই  কান ধরে কাচু মাচু মুখে বলল আমরা আর কখনো  তোমাদের না জানিয়ে কোথাও যাবো না। আমাদের ভুল হয়ে গেছে।


ছোটো কাল
বিশ্বনাথ চৌধুরী

একটু যদি খেলি ঘরে, বারণ করো তুমি।
জিনিস কিছু ধরলে পরে, বলো এটা দামী।
সব কিছুতেই বাধা এত, ভাল্লাগে না আর।
বল নিয়ে মাঠে গেলে, বলো কি দরকার ?
অন লাইনে পড়বো শুধু ,খেলার কথা বলব না।
তাইতো সবাই পণ করি আজ, নিজের মতো চলব না।
বাইরে যাওয়া বারণ বলে, ছাদ থেকে মেঘ দেখি।
লাল নীল হলুদ ঘুড়ি, মারছে তারা উঁকি।
পার্কে যেতে না পেরে, মনটা কেঁদে ওঠে।
দোলনা, স্লিপ, ঢে কুচুকুচ একাই থাকে মাঠে।
বড়দের সঙ্গে ঘরে, থাকতে ভালো লাগে না
বন্ধুদের সঙ্গে দেখা, কতদিন যে হলো না !
টিফিন নিয়ে স্কুলে যাওয়া, বন্ধ অনেকদিন।
গান গাওয়া নাচ করা, নেই তো তা ধিন ধিন।
আকাশের পাখি আর, সমুদ্রের ঢেউ ।
আমাদের কথা, ভাবেনা যে কেউ ।
এখনকার ছোটো কাল, কাটছে এমনভাবে
জানিনা আর কতদিন, এমনি ভাবে যাবে ?


জুভেলির সাইক্লোন প্রিভেনশন
শতভিষা মিশ্র
অষ্টম শ্রেণী, জ্ঞানদীপ বিদ্যাপীঠ, এগরা, পূর্ব মেদিনীপুর

রোডেসিয়া দ্বীপপুঞ্জের একজন বিখ্যাত বৃষ্টি বিজ্ঞানী হলেন ডক্টর বার্মা। ওয়ার্ল্ড রেইন অ্যাসোসিয়েশন এর অন্যতম সদস্য তিনি। তিনি মেঘ থেকে ইচ্ছেমতো বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারেন। অবশ্য এই কাজ এখনকার দিনে কিছুই না। তবুও তিনি এই পন্থা প্রথম আবিষ্কার করেন বলে তাঁর এই খ্যাতি। ওয়ার্ল্ড রেইন অ্যাসোসিয়েশনের আরেকজন সদস্য হলেন জুভেলি। ইনি আবার বৃষ্টির নিয়ন্ত্রক বিজ্ঞানী। সালটা ৩০২০। সাইক্লোন প্রিভেনশন বিষয়ে ওয়ার্ল্ড রেইন অ্যাসোসিয়েশন একটি সভা ডাকে। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন জুভেলি, বার্মা সহ অন্যান্য সদস্যরা। প্রত্যেকের ক্ষুদ্র বক্তব্য শোনা হয়। বার্মার বক্তব্য সবার থেকে আলাদা হয়। তিনি বলেন "প্রকৃতির সমস্ত সৃষ্টিতে যদি আমরা হস্তক্ষেপ করি সেটা মোটেই আমাদের জন্য ভালো হবে না। তাই সাইক্লোন আটকানো তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় আমাদের তার কারণ গুলি যাতে না ঘটে তা দেখা উচিত।" জুভেলি কিন্তু বার্মার সঙ্গে একমত ছিলেন না। তিনি বলেন, "সাইক্লোনের মূল কারণ হল নিম্নচাপ। এই নিম্নচাপ সৃষ্টি হচ্ছে কখনো প্রাকৃতিক আবার কখনো মনুষ্যসৃষ্ট ভাবে। প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট নিম্নচাপ আমরা কখনোই বন্ধ করতে পারবোনা কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট নিম্নচাপ বন্ধ করা যাবে। তবে এই নিম্নচাপের কারন হল অধিক উষ্ণতা যা মূলত দূষণ থেকে । এবং দূষণের কারণ বিষাক্ত গ্যাসীয় পদার্থ। কিন্তু এই দূষণ রোধ করতে গিয়ে তো সভ্যতা কে পিছিয়ে দিলে চলবে না তাই উন্নয়নে যেমন দূষণ রোধ করার চেষ্টা চলবে তেমনি সাইক্লোন এর গতিবেগকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।" সভাশেষে অধিকাংশের সমর্থন নিয়ে ওয়ার্ল্ড রেইন অ্যাসোসিয়েশন সাইক্লোন প্রিভেনশন বিষয় ভাবতে শুরু করে। তারপরের দিন সাংবাদিকদের একটি ভিডিও কনফারেন্সিং এ বার্মা কে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি বলেন, "এটা ঠিক যে আমরা অনেক নতুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সভ্যতাকে অনেকটা এগিয়ে নিয়েছি। নিজেরাই বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছি আবার তাকে নিয়ন্ত্রণ ও করছি। রোবটদের গবেষণার কাজে নিযুক্ত করেছি। মঙ্গল গ্রহে বসবাস শুরু করেছি। চাঁদে গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু প্রকৃতির সব বিষয়ে এর নিয়ন্ত্রক আমরা কখনোই হতে পারব না তাই আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি যে ওয়ার্ল্ড রেইন অ্যাসোসিয়েশনের এই সাইক্লোন প্রিভেনশন এর উদ্যোগ বিফল হবে।"এদিকে জুভেলির নেতৃত্বে "ওয়ার্ল্ড রেইন অ্যাসোসিয়েশন" একটি টিম গঠন করে যা সাইক্লোন প্রিভেনশন এর উপায় আবিষ্কার করবে। অনেক ভাবনা চিন্তা গবেষণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর সেই টিম একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন যা সাইক্লোন এর সময় বায়ুর গতিবেগকে কমিয়ে দিবে। যন্ত্রটির পরীক্ষা করা দরকার ছিল কিন্তু সেই সময় কোন সাইক্লোন এর সম্ভাবনা না থাকায় যন্ত্রটিকে গবেষণাগারে রাখা হয়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই আবহাওয়া দপ্তর ঘোষণা করে যে খুব শীঘ্রই "মার্ফু"নামক সাইক্লোন রোডেশিয়া দ্বীপপুঞ্জ আছড়ে পড়বে। জুভেলি খুব খুশি হন এবং সরকার কর্তৃক অর্থ দিয়ে তিনি সেই যন্ত্র রোডেসিয়ার উপকূলবর্তী এলাকার ঘর গুলির ছাদে লাগানোর ব্যবস্থা করেন। তিনি খুব উৎসুক ছিলেন তাঁর সৃষ্ট যন্ত্রটির কার্যকলাপ দেখার জন্য। অবশেষে দিনটি আসে। সাইক্লোন "মার্ফু" রোডেশিয়ার উপকূলবর্তী এলাকাতে মিম্বাসাতে ল্যান্ডফল করে। ল্যান্ডফলের সময় এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৭৫-১৮৫ কিলোমিটার। ওই যন্ত্রটির প্রভাবে তা কমে ১৬৫ কিলোমিটার হয়। কিন্তু সেই গতিবেগেই গাছপালা, ঘরবাড়ি ভেঙে পড়তে থাকে এছাড়া অনেক জায়গায় ওই যন্ত্রটির ভেঙে পড়ার কারণে বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু ঘটে। তছনছ হয়ে যায় মিম্বাসা। যন্ত্রটি সাইক্লোন এর গতিবেগকে কিছুটা কমালেও সম্পূর্ণভাবে সফল হতে পারেনি তাই সেটিকে তার সীমাবদ্ধতার কারণে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। যন্ত্রটি বানিয়ে ছিলেন বিখ্যাত শহর গুলির বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা। তবুও বিফলতা মানতে পারছিলেননা জুভেলি। তবে শেষপর্যন্ত মানতেই হয় তাঁকে। পরের সপ্তাহে কাগজে বড় বড় হেডলাইনে ওয়ার্ল্ড রেইন অ্যাসোসিয়েশনের বার্তা "আমরা চেষ্টা করেও সম্পূর্ণ সফলতা পায়নি ।সত্যিই প্রকৃতির কিছু কিছু জিনিসে হস্তক্ষেপ করার অধিকার মানুষের নেই। তবে যে আংশিক সাফল্য আমরা পেয়েছি সেই সাফল্য থেকেই নতুন উদ্যমে আমরা এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যাব এবং এর সীমাবদ্ধতা গুলি কে মাথায় রেখে একটি সফল সাইক্লোন প্রিভেনশন যন্ত্র আবিষ্কার করার চেষ্টা করব। সেই দিনটির প্রতিক্ষাতেই রয়েছি আমরা সবাই।"

প্রীতি জ‍্যোতি
অষ্টম শ্রেণি
কোমধাড়া মথুরকুড় উচ্চ বিদ‍্যালয়, হুগলি


কিরে কেমন আছিস? অনেক দিন পর দেখা।
- আরে অপূর্ব যে কেমন আছিস? আমি ভালো আছি। তোর বাড়ির সবাই ভালো আছে তো? কাকা, কাকিমা, রিনি...। হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ সবাই ভালো আছে।
- এই তোর বিজনেস কেমন চলছে?
- আর বলিস না রে অপূর্ব.... আজকাল খুবই খারাপ অবস্থা।  কোম্পানির অবস্থা  খুবই খারাপ। চিন্তিত হয়ে সুশান্ত বলল।
- কেন রে আবার কী হলো? জিঞ্জেস করল অপূর্ব।
- চল আমার বাড়ি গিয়ে সব বলব।
                       রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দুজনে ছোটোবেলার কথা বলতে বলতে হাসি ঠাট্টায়  মশগুল  হয়ে কখন সুশান্তর বাড়ি চলে এসেছে তারা বুঝতেই পারেনি।
     সত‍্যি সুশান্ত!ছোটোবেলার কথা মনে পড়ায় খুবই ভালো লাগল।
               স্কুলে তোর আর আমার সঙ্গে যখন বিট্টুর ঝগড়া হত তখন সেটা দেখার মতো মনে পড়লে এখনও খুব হাসি পায় -সুশান্ত বলল।
- হ‍্যাঁরে বিট্টু কেমন আছে? অনেক দিনই হলো কারোর খোঁজখবর নিইনি।
                     এই কথা জিঞ্জেস করতেই অপূর্বর মনটা খারাপ হয়ে গেল ও কিছু বলতে পারল না। সুশান্ত আবার বলল - কি হল বিট্টু কেমন আছে কিছু বললি না। তখন অপূর্ব বলল - তুই তো জয়েন্টে পাশ করে আমেরিকায় চলে গেলি! আমরা ভালো মার্কস না পাওয়ায় কোনো কিছু কাজ করতে পারছিলাম না তখন আমি  কলকাতার একটা ফ‍্যাকটরিতে কাজে ঢুকে পরলাম কি করব কিছু তো একটা করতে হবে না হলে খাব কী?
                     বিট্টু পরীক্ষায় ফেল করাতে ওর বাবা ওর সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়ে ছিলেন  ওকে বাড়িতেও ঢুকতে দেননি।
       তারপর কী হল? সুশান্ত জিঞ্জাসা করল।
       -  তখন বিট্টু কি করবে আমার বাড়িতেই থাকতে  এল। তখন আমি ওকে বললাম - কি রে কি হয়েছে? তখন ও বলল- বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে কদিনের জন‍্য থাকতে দিবি?
   আমি বললাম - কেন দেব না আয় না তুই বরং আমার সঙ্গে ফ‍্যাক্টরিতে কাজে ঢুকে পড়।
   বিট্টু বলল- তাই হবে।
             কিছু দিন কাজে যাবার পর একদিন বিট্টু রাস্তা পার হচ্ছিল ওমনি হঠাৎ করে একটা লরি এসে বিট্টুকে.......
             আর বলতে পারল না অপূর্ব  দুজনের চোখই ছলছল করছে।
             সুশান্ত তখন জিঞ্জেস করল - বিট্টুর বাবা-মা...
      - বিট্টুর মৃত্যুর খবর শুনতেই ওর মা সহ‍্য করতে না পেরে হার্টফেল করেন। ওর বাবাও মুষড়ে পড়তে শুরু করে। গতবছর স্টোক হয়ে তিনিও  পরলোক গমন করেন।
      ছাড় এইসব কথা কি আর হবে যা হবার তা হয়ে গেছে তুই তোর বিজনেসে মন দে। হ‍্যাঁ তুই যেন কি সমস্যার কথা বলবি বলছিলি... অপূর্ব বলল।
      তখন সুশান্ত  বলল - থাক আমার  সমস্যার কথা শুনে কি হবে যেখানে আমি তোদের বন্ধু হয়েও তোদের পাশে দাঁড়াতে পারিনি....
      এই বলে তারা দুজন দুজনের গলা জড়িয়ে কাঁদতে লাগল।

ফুলকুসুমপুর খুব কাছে ১৩
রতনতনু ঘাটী

গল্পকাকার খুব সকালে ঘুম ভেঙে যায়। এর পর উনি পাড়ার ফুটবল মাঠে জগিং করতে যান। তখনই উনি কুয়াশামাসিকে দরজা খুলে দিয়ে যান। কুয়াশামাসি ত্রিপাঠীবাড়ির রান্নামাসি। আরো তিনটে বাড়িতে কাজ করতে যেতে হয় বলে কুয়াশামাসি ভোর-ভোর প্রথমে এই বাড়িতে আসে। কুয়াশামাসির নাম নাম আসলে জয়তীমাসি। এত ভোরে ভোরের কুয়াশা গায়ে মেশে আসে বলে ইচ্ছেদাদু প্রথম দিন থেকে ওর নাম রেখেছেন ‘কুয়াশামাসি’। এখন আর কেউ ‘রান্নামাসি’ বলে ডাকে না। ‘জয়তী’ নামে শুধু ডাকেন ইচ্ছেঠাকুরমা।
   গল্পকাকা বললেন, ‘কুয়াশামাসি, তুমি কাজ করো! আমি নিধিকাকুদের বাড়ি থেকে ‘বিংগো’কে নিয়ে আসি?’
   কুয়াশামাসি রান্নাগরের দিকে যেতে-যেতে জিজ্ঞেস করল, ‘বিংগোটা আবার কে? তোমাদের গাড়িতে এবার তো পা ফেলার জায়গা মিলবে না গো মেজোদাদাবাবু?’
   গল্পকাকা বললেন, ‘বিংগো আমার পোষা কুকুর গো। দোতলায় যে ফাঁকা খাঁচাটা পড়ে আছে, ওটাতেই বিংগো থাকবে?’

   ‘তুমি কাজ করো। আমি বিংগোকে নিয়ে আসছি।’ বাইরে বেরিয়ে যেতে গিয়ে পিছন ফিরে গল্পকাকা বললেন, ‘শোনো কুয়াশামাসি, তুমি কাজের ফাঁকে, খাঁচাটার তলায় পরিষ্কার কাপড় বিছিয়ে রেখো তো। না হলে বিংগো শোবে কী করে?’
   ততক্ষণে ঠাকুরমা উঠে পড়েছেন। বললেন, ‘জয়তী, আগে আমার ঠাকুরঘরটা পরিষ্কার করে দে তো!’
   ‘দিচ্ছি জেঠিমা! তুমি ফুল তুলে আনো! ততক্ষণে আমি তোমার ঠাকুরঘর পরিষ্কার করে রাখছি।’ কুয়াশামাসি যতক্ষণ এ বাড়িতে থাকে, সকলের সব কাজ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। কখনও ‘না’ বলে না।
   ইচ্ছেদাদুও ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। দোতলা থেকে গলা তুলে ঠাকুরমার উদ্দেশে বললেন, ‘তোমার গোবিন্দ তো আর মর্নিংওয়াকে যান না! এই নয় যে, ফিরে এলেই তাঁর পুজো চাইই চাই?’ ঠাকুরমার দিক থেকে এ কথার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা রলেন। কোনও উত্তর এল না দেখে দাদু চেঁচিয়ে বললেন, ‘ও কুয়াশামাসি, আমার চিরতা-জলটা দিয়ে যাও তো!’
   কুয়াশামাসির হাত থেকে চিরতা-জলটা নিয়ে খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন মর্নিংওয়াকে। ততক্ষণে তিন্নির মা-কাকিমারাও উঠে পড়েছেন। তিন্নি-বিন্নি আর বুম্বাদেরকেও ডেকে তোলা হল ঘুম থেকে। ব্রাশ করে ওরা পড়তে বসতে যাবে, এমন সময় নীচু স্বরে ‘ঘেউ-ঘেউ’ ডাকটা ভেসে এল। বুম্বা বলল, বিন্নিদি, মনে হয়, বিংগো এসে গেছে। সকলে পড়া ফেলে ছুটল নীচে। ততক্ষণে গল্পকাকা কোলে করে বিংগোকে উপরে আনছেন। 
   মাথায় উঠল আজকের সকালের পড়া। গল্পকাকার পিছন-পিছন ওরাও উপরে উঠে এল। খাঁচার ভিতরে বিংগোর জন্যে বিছানা পেতে রেখেছিল কুয়াশামাসি। খাঁচার দরজার সামনে ওকে ছেড়ে দিতে গটমট করে বিংগো ঢুকে গেল খাঁচার ভিতরে। 
   এমন সময় ইচ্ছেদাদু মর্নিংওয়াক সেরে ফিরে এসে দেখলেন, বিংগোর কাঁচার সামনে ছোটদের জটলা। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘যাও! সব পড়তে যাও! এখন কুকুর-বিড়াল নিয়ে সময় কাটানোর কথা নয়।’ তারপর গল্পকাকার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাড়িতে এখন পেট অ্যানিম্যাল আমদানির কোটা কমপ্লিট হয়ে গেছে যখন, এবার আমাকে ছোটদের জন্যে একটা রুটিন তৈরি করে দিতে হবে। ওরা সারাদিনে শুধু একবার স্কুল থেকে ফিরে কিছুক্ষণের জন্যে ‘হযবরল চিড়িয়াখানা’র সামনে যেতে পারবে। পশু-পাখিদের খাওয়ার দিতে পারবে। ইচ্ছে হলে রাধাগোবিন্দকে কথা-বলাও শেখাবে।’
   এইমাত্র ইচ্ছেদাদু চিড়িয়াখানার এই নতুন নামকরণ করলেন। 
   তিন্নি-বিন্নিরা সুড়সুড় করে চলে গেল পড়ার ঘরে। পড়ার ঘরে গিয়ে বসতে-বসতে বুম্বা তিন্নিদিকে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ রে তিন্নিদি, ‘হযবরল’ কবি সুকুমার রায়ের একটা বইয়ের নাম না রে?’
   ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস! এখন ওসব কথা রাখ! দাদু শুনলে বকবে।’ পড়া শেষ হতে ওরা রওনা দিল স্কুলে। যাওয়ার পথে চিকলুর সঙ্গে দেখা হতে বুম্বা বলল, ‘চিকলুদা, আমাদের বাড়ির চিড়িয়াখানার একটা নাম রাখা হয়েছে।’
   চিকলু জানতে চাইল, ‘কী নাম রে?’
   বুম্বা বলল, ‘হযবরল চিড়িয়াখানা! দাদু এই নামটা রেখেছে রে।’
   ততক্ষণে ওরা স্কুলে এসে গেছে। এ নিয়ে আর কথা এগোল না।
গল্পকাকা আজ অহেতুকপুর পঞ্চায়েত অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতেই থাকলেন। বিংগোর, খাওয়া, দেখাশোনা, সব করলেন। 
   বিকেলে ইচ্ছেদাদু চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পোষ্যদের দেখতে এলেন। বিংগোকে দেখলেন ভাল করে। গল্পকাকাকে বললেন, ‘বাঃ! তোর বিংগো তো বেশ দেখতে! লাল, কালো আর সাদা রঙে চমৎকার দেখতে!’
   গল্পকাকা বললেন, ‘বাবা, কুকুরের মতো প্রভুভক্ত প্রাণী আর ক’টাই বা আছে?  হোমারের লেখা ‘ওডিসি’ মহাকাব্যের কুকুরের কথা ভোলা যায় না। মহাকাব্যের নায়ক ওডিসিয়াস দীর্ঘ কুড়ি বছর পরে ছদ্মবেশে যখন বাড়িতে ফিরে এলেন, তখন তাঁকে চিনতে পেরেছিল তাঁর একমাত্র পোষা কুকুর আর্গোস। সে অপেক্ষা করেছিল মনিবের ফিরে আসার জন্যে!’
   ইচ্ছেদাদু ঘাড় নাড়লেন। গল্পকাকা বললেন, ‘জানো তো, আমি বিংগোকে পুষতে চেয়েছিলাম, একটা খবর পড়ে। সেখানে পড়লাম, জার্মানিতে প্রতি পাঁচটি পরিবারে অন্তত একটি করে পোষা কুকুরের দেখা পাওয়া যাবেই যাবে।’
   এ কথায় কী বুঝল বিংগো কে জানে? নিচু গলায় ঘেউ-ঘেউ করে মনে হয় গল্পকাকার কথায় সম্মতি জানাল।
(এর পরে আগামী রোববার)


গল্পে গল্পে ক্যুইজ 
রাজীব কুমার ঘোষ

পর্ব ৩ উত্তর নিয়ে গল্প

১।।  মহেন্দ্র সিং ধোনি পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুর জংশন স্টেশনে ট্রাভেলিং টিকিট এক্সামিনার হিসাবে কাজ করেছিলেন। রেল কোয়ার্টাসে একবার ধোনি আর তার বন্ধুরা গায়ে সাদা চাদর জড়িয়ে রাতপাহারাদারকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। সকাল হবার পর ভূতের কান্ড নিয়ে খুব হৈ চৈ হয়েছিল। 

২।। রাজশেখর বসু।  রাজশেখর বসু বললেই আমাদের মনে চলে আসে তার অনুবাদ করা রামায়ণ আর মহাভারতের কথা, তার চলন্তিকা অভিধানের কথা। আর অবশ্যই মনে পড়ে তার অভিনব ব্যঙ্গাত্মক, হাস্যরসাত্মক, ব্যতিক্রমী গল্পগুলির কথা। তোমাদের জন্য কয়েকটা গল্পের নাম করি যেগুলো তোমরা ইউ টিউবে খুঁজলে অডিও গল্প হিসাবেও পেয়ে যাবে। গল্পগুলি হল, মহেশের মহাযাত্রা, লম্বকর্ণ, বদন চৌধুরীর শোকসভা। এই তিনটি গল্প দিয়ে শুরু করো। যদি ঘোর লেগে যায় নিজেরাই অন্যগুলো খুঁজে নেবে। এবার আসি প্রশ্নের উত্তরে। ১৯০১ সালে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালে রাসায়নিক হিসাবে রাজশেখর বসু তার কর্মজীবন শুরু করেন। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই নিজের যোগ্যতায় তিনি পরিচালক পদ অর্জন করেছিলেন। অবসর নেবার পরেও উপদেষ্টা ও পরিচালক হিসাবে আমৃত্যু তিনি জড়িয়ে ছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যালের সঙ্গে। রাজশেখর বসুর লেখার প্রশংসা করে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের একটি আলোচনা প্রকাশিত হবার পর আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র একটি মজার চিঠি দেন রবীন্দ্রনাথকে, যার মোদ্দা কথা, আমি একটি বিজ্ঞানের ছাত্রকে কাজে লাগিয়েছিলাম। আপনি প্রশংসা করে তার মুন্ডু ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। ছোকরা এবার বোধহয় আমার হাতছাড়া হয়ে সাহিত্য সেবার নিজেকে নিয়োজিত করবে। প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ মজা করে লিখেছিলেন, সাহিত্যে যাদের প্রতিভা ছিল এমন বহু ছাত্রকে বিজ্ঞানের অধ্যাপকেরা ছিনিয়ে নিয়েছেন। সুতরাং প্রতিশোধ নিতে পেরে তিনি যারপরনাই আনন্দিত।  দু’জন পৃথিবী বিখ্যাত মানুষের মধ্যে যখন চিঠির আদান প্রদান হয় তখন সেইসব চিঠি অবশ্যপাঠ্য হয়ে ওঠে। এই চিঠিগুলিও কিন্তু সাহিত্য। সাহিত্য মানে শুধু গল্প, উপন্যাস বা কবিতা নয়।

৩।।মেদিনীপুরের নেগুয়াতে তিনি বদলি হয়েছিলেন। সেটা ১৮৬০ সাল। দিনটা ২১ জানুয়ারি। নেগুয়াতে বঙ্কিমচন্দ্র ৮ নভেম্বর অবধি ছিলেন। অনেক পরে, অবসরের কাছাকাছি এসে ১৮৮৭ সালে তিনি আবার মেদিনীপুরে বদলি হন। 
এই নেগুয়া বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমার অন্তর্গত। বঙ্কিমচন্দ্র যখন নেগুয়াতে এসেছিলেন তখন নেগুয়াতেই মহকুমার কার্যালয় ছিল যাকে নেগুয়ার কাছারি বলা হত। পরে এই কাছারি কাঁথিতে স্থানান্তরিত হয়।  বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুন্ডলা উপন্যাসে রসুলপুর নদীর ধারে অবস্থিত দৌলতপুর আর দরিয়াপুরের কথা আছে। কথিত আছে তিনি পর পর তিন রাত্রি কাঁথিতে এক কাপালিককে দেখেছিলেন, যে গভীর রাতে এসে তাকে ডাক দিত। গবেষকদের মতে দৌলতপুরের ডাকবাংলোতে থাকার সময় তার কপালকুন্ডলা উপন্যাস রচনা শুরু হয়েছিল। 

৪।। ১ মিলিয়ন = ১০ লক্ষ

৫।। তোমরা যদি হিসাব ঠিকঠাক করে থাকো তাহলে যে উত্তর পাবে সেটা হল ২৫৮.৯৭ মিলিয়ন। সেন্সাসে প্রকৃত সংখ্যাটা ছিল ২৫৯.৬ মিলিয়ন। আমরা সংখ্যাগুলিকে গোটাগুটি ধরায় এই তফাৎ এসেছে। প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল এক তথ্য থেকে আরেক তথ্যকে কীভাবে বার করে আনতে হয় সেই বিষয়ে একটা হাতেকলমে ধারণা দেওয়া।

৬।। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন বা ইন্ট্যারন্যাশন্যাল লেবার অরগানাইজেশন (ILO) ১৯১৯ সালে অক্টোবর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইউনাইটেড নেশন বা জাতিসংঘের পুরনো সংগঠনের মধ্যে এটি অন্যতম।  হেডকোয়ার্টার হল সুইজারল্যান্ডের জেনিভা। উদ্দেশ্য হল সারা পৃথিবী জুড়ে শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি, তাদের সুযোগ সুবিধা ও অধিকার নিশ্চিত করা। ১৯৬৯ সালে এই সংগঠনটি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিল।

৭।। অমিতাভ বচ্চন তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বার্ড এন্ড কোম্পানির বিজনেস এক্সিকিউটিভ হিসাবে এবং সেটা কলকাতায়। সালটা ১৯৬২; কোম্পানিটির কয়লা খনি সংক্রান্ত কাজকর্মের সঙ্গে অমিতাভ বচ্চন যুক্ত ছিলেন। পরে এটি ইস্পাত মন্ত্রকের অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিতে পরিণত হয়।

৮।। ইউনিসেফ, UNICEF এর পুরো কথাটি হল United Nations Children’s Fund, একে বাংলায় বলতে পারো ‘জাতিসংঘের শিশু তহবিল’। এটি জাতিসংঘের একটি সংস্থা যা শিশুদের অবস্থার উন্নয়ণ আর তাদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে সারা পৃথিবী জুড়ে। ১৯৬৫ সালে এই সংস্থা তাদের কর্মকান্ডের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিল। বর্তমানে মোটামুটি ১৯২টি দেশে এদের কর্মকান্ড ছড়িয়ে আছে। এই সংস্থার হেডকোয়ার্টার নিউ ইয়র্কে। তোমরা হয়ত ভাবছ, ইউনিসেফের ই-টা কোথায় গেল। আসলে আজকের ইউনিসেফ আগে ছিল 'ইউনাইটেড নেশন চিলড্রেন এমার্জেন্সি ফান্ড'। ১৯৪৬ সালে এই নামেই সংস্থাটি গঠিত হয়। ১৯৫৩ সালে এই নাম পরিবর্তন হয় কিন্তু সংক্ষিপ্ত নামটি অবিকৃত রেখে দেওয়া হয়। 

৯।। কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা হলেন শ্রী সন্দীপ দত্ত মহাশয়। আমাদের প্রজন্মের পরম সৌভাগ্য যে তার সান্নিধ্য আমরা পেয়েছি। ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতার ট্যামার লেনে শ্রী সন্দীপ দত্তের বাড়িতে। ভারতবর্ষে প্রথম তো বটেই, সারা বিশ্বেও এই লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিটির একটি আলাদা পরিচিতি আছে। কলেজ স্ট্রিট মোড়ের খুব কাছেই কয়েক পা দূরে এই লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিটি তোমরা সুযোগ পেলে দেখে নিও। লাইব্রেরি বলতে তোমর যে বিশাল ঘর আর বাড়ি ভাবো এটি তেমন মোটেই নয়। নিজের বাড়ির নিচের ঘরে আর প্যাসেজে কীভাবে তিনি হাজার হাজার পত্রিকাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন, গবেষকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন সেটা চোখে দেখার, শোনার নয়।

১০।। ২০২০ সালে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির আগের শিক্ষানীতি গ্রহন করা হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। সেই শিক্ষানীতির মুল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে অসাম্য দূর করা। মেয়েরা যাতে স্কুলে আরো বেশি করে আসে তার ব্যবস্থা করা তাছাড়া যাদের আমরা অনগ্রসর শ্রেণী বলি, যারা চির বঞ্চিতের দলে, সমাজের সেই শ্রেণীদের শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা করা। 
এবার আসি দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে। এই দুই শিক্ষানীতির মধ্যে তাহলে ৩৪ বছরের ব্যবধান। স্বাভাবিকভাবেই এই তিন দশকে জীবিকা জগতের চেহারা অনেক বদলে গেছে। এই বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাই শিক্ষানীতিরও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। ১৯৮৬ সালে আমরা কম্পিউটারের নাম শুনেছি মাত্র। ইনফরমেশন টেকনোলজি, সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার, প্রোগ্রাম ডেভেলপার, ডিশ এন্টেনা,  এইসব শব্দ ভাসতে শুরু করবে আরো পরে। মোবাইল বস্তুটি তখন অচেনা।  তোমরাই ভেবে দ্যাখো এইসব পরিবর্তনের ফলে কত নতুন নতুন ক্ষেত্রে কত নতুন ধরণের কাজ তৈরি হয়েছে। একই ভাবে যে চাকরির ক্ষেত্রে বা কাজের ক্ষেত্র তোমরা এখন দেখতে পাচ্ছ, যখন তোমরা বড় হবে তখন দেখবে কাজের এইসব ক্ষেত্র বদলে গেছে। তাই যারা বুদ্ধিমান, তারা নিয়মিত সংবাদপত্র পড়ে, দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে, দুনিয়াতে কী ঘটছে তার খবরাখবর রাখে।  তারা আন্দাজ করতে চেষ্টা করে আগামী দিনে কী ধরণের কাজের চাহিদা তৈরি হবে। এখন কী শিখলে ভবিষ্যতে তা কাজে দেবে। ঘাড় গুঁজে পাঠ্য বইতেই শুধু সময় কাটালে আর পরীক্ষার নম্বরকেই সবকিছু ভাবলে কিন্তু পরে অথৈ জলে গিয়ে পড়তে হতে পারে। কর্মহীনতার পেছনে দেশের দায়ভার আছে অবশ্যই কিন্তু কর্মহীনের দায়টিও খুব একটা কম নয়। 

  এই পর্বের সংক্ষিপ্ত উত্তরগুলি পাঠ প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সম্পাদককে পাঠিয়েছিল অশোকনগরের শ্বাশ্বতি কর। দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। ক্যুইজের মজা হল, যে নিজে খেটে উত্তর খুঁজে বার করবে তার মনে কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হবে সেই তথ্যগুলো। তাছাড়া খুঁজতে বসলে আরো অনেক তথ্য জানা যায়। সেটা অনেক বড় পাওনা। ক্যুইজের তাৎপর্য উত্তর দেখে নেওয়ায় নয়, উত্তর খোঁজায়। যারা আজ উত্তর দেখে নিলে আর যারা এই এক সপ্তাহে উত্তর খুঁজলে তাদের মধ্যে তফাৎ হল, যারা খুঁজল তারা আরো কিছু গল্পের সন্ধান পেল। 

সামনের রোববার চতুর্থ পর্বে আবার গল্প হবে।


পাঠ প্রতিক্রিয়া ১
( চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী সায়ন্তনী আদিত্য জ্বলদর্চির ৩৯ তম সংখ্যা পড়ে যা লিখল)

 জ্বলদর্চিতে দাদা দিদিদের আঁকা  ছবিগুলো আমার সব থেকে বেশী ভালো লাগে। আমার ছবি আঁকতে খুব ভালো লাগে তাই। খুব উৎসাহ পাই তাদের কাছ থেকে। কি মজা হচ্ছে সামনেই রথের মেলার কথা শুনে। আমি তো বাবা মা দিদির সাথে যেতাম ঘুরতে। কবি মুক্তি দাশের কবিতা আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার ঘরের জানালায় মাঝে মাঝে শালিক পাখি আসে। ওদেরকে নিয়ে লেখাটাও কত সুন্দর হয়েছে। সৌত্রিকী দিদি, মিথিলা দিদি সবাই খুব ভালো আঁকে। আমি তো আম খেতে ভীষন ভালোবাসি। আমের কথা শুনলেই জিভে জল আসে। লেখিকা বন্দনা সেনগুপ্ত এর আম নিয়ে গল্প টা খুব ভালো হয়েছে। শ্রীপর্ণা দিদি একটা মিষ্টি খরগোস এঁকেছে। সাদা খরখোস আমার খুব পছন্দের।রঙ খেলা নিয়ে সমাদৃতা দিদির লেখাও খুব সুন্দর লাগছে। কত লেখা, ছবি আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার খুব প্রিয় পত্রিকা এটা।


 পাঠ প্রতিক্রিয়া ২
( জ্বলদর্চির ৩৯ তম সংখ্যা পড়ে চন্দননগরের সুমনা বিশ্বাস যা লিখলেন)

জ্বলদর্চির আমি একজন একনিষ্ঠ পাঠক, পত্রিকার প্রতি সংখ্যা ই খুব মন দিয়ে পড়ি। নাঃ, বলা ভালো প্রতি সংখ্যাই নিজগুণে আমার মন টেনে নেয় নিজের দিকে। এই পত্রিকা আসলে একরাশ ছোটবেলা বয়ে আনে। আর মন থেকে আমরা কে কবে বড় হয়েছি বলো।

যথারীতি এর ৩৯ তম সংখ্যা পড়েও মুগ্ধ হলাম। এর প্রতি সংখ্যা তেই মণি মানিক্য ছড়িয়ে থাকে। চিকমিক করে নিজের দ্যুতি তে। এত্ত ছোট ছোট লেখক লেখিকা আর আঁকিয়ের দল, কিন্তু পাল্লা দেয় বড়দের সঙ্গে বা কখন ও ছাপিয়ে ও যায়।

এবারই যেমন প্রথম আকর্ষণ করলো রিপনের অসাধারণ ছবিটা। ওই টানা গাড়ি আর নিখাদ আনন্দে ছুটে চলা দেখে নিমেষে মন উধাও। আগেই গেলাম হাতে আঁকা ছবিগুলো দেখতে। মাত্র দশম শ্রেণীতে পড়া রাজেশের ছবি মনে থাকবে অনেকদিন। মিথিলার ছবি মনে রামধনু আঁকল। সায়নী , সঞ্চারী আর সমাদৃতা র ছবিও বেশ অন্য রকম। সৌত্রিকী র ছবি দেখে মনে পড়লো স্কুলের 15 th আগস্ট পালনের কথা। আর শ্রীপর্ণা এঁকেছে গল্প উপযোগী ছবি। ভীষণ সুন্দর। 

ছবি ছেড়ে গেলাম কবিতা পড়তে। মুক্তি দাশের আষাঢ়ে জগন্নাথ পড়ে মনে অনেক প্রশ্নের পাশাপাশি  রথের মেলার জন্য মন কেঁদে উঠলো। তেমনি মধুশ্রী র বৃষ্টিবেলা পড়ে শান্তিনিকেতন আর সোনা ঝুরির ছবি যেন ভেসে উঠলো চোখের সামনে। সমাদৃতা র রঙ উৎসব মনে রঙ লাগালো।

ভূমিকা গোস্বামীর শালিখ পরিবার  পড়তে পড়তে আমি নিজেই যেন শালিখ পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছিলাম। দধিমুখীর ভয়ে আমার ও ভয় করছিলো। বন্দনার গল্প থেকে আমি নিয়ে কত না জানা কথা জানা গেল। মনে পড়ল আমাদের বাবা মায়েদের কাছেও শোনা এই রকমই গল্প। সেই জীবন টাই ছিল অন্য রকম।
সুস্মিতা সাহার তিতির চড়ুই পড়ে দাদা বোনের মিষ্টি সম্পর্ক খুব অনুভব করলাম। সৌরভের তারাদের বাড়ি পড়তে পড়তে হারিয়ে গেলাম নিমো আর তার ছায়া শরীরের সাথে। তবে সোম রাজের লেখা সিটঙ এর বর্ণনা পড়ে মনে হলো নিজেই চলে গেছি পাহাড়ে। খুব ইচ্ছে রইলো একবার তার মতো করে সিটঙ দেখার।
ফুলকুসুমপুরের কথা বলার কিছু নেই। ইচ্ছে ঠাকুমা আমার ভীষণ প্রিয়। বিলম্ব দাদু ,তিন্নি,  বিন্নি সবাই প্রিয়। এই পর্বে কুমি আসাতে ইচ্ছে ঠাকুমার সাথে আমিও খুব উত্তেজিত।
রাজীব স্যারের গল্পে গল্পে ক্যুইজ থেকে প্রতিবারের মত এবারও জানতে পারলাম অনেক কিছু। মাথায় অনেক নতুন ভাবনা এলো। প্রশ্ন নিয়ে ভাবনা, আবার উত্তর নিয়েও ভাবনা। কিছু জানি আবার কত কিছুই জানিনা!
যথারীতি দুটি পাঠ প্রতিক্রিয়াই খুব ভালো। আর সবশেষে যেটা না বললেই নয়, সেটা হল মৌসুমী ম্যাম এর অসাধারণ সম্পাদকীয়। এর এক অন্য অনন্য আবেদন।
জ্বলদর্চির এই ছোটবেলার হাওয়া বইতে থাকুক।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. এগিয়ে চলুক ছোটোবেলা। আরো সমৃদ্ধ হোক নতুনের নতুন লেখায়।

    ReplyDelete