জ্বলদর্চি

হেরো নস্করের গল্প/ পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

হেরো নস্করের গল্প 

পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

(১)
"রাজপথ ফাঁকা পেয়ে সঙ্গে সামনে গ্রীন সিগন্যাল থাকায় মনের আনন্দে গাড়ি ছোটাচ্ছিল সন্ন্যাসী। খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবেই। হঠাৎ ক্রসিং এর  সামনাসামনি এসে রেড লাইট হয়ে যাওয়ায় আর সামনে একটা আধভেজা মেয়ে এসে প্রায় গাড়ির নিচে পড়ায় সম্বিৎ ফিরে মরিয়া  ব্রেক কষতে হলো তাকে। সিগন্যালে ভরা বর্ষার দিনের বেলায়  বাজছে  ভুল নির্বাচিত রবীন্দ্রসংগীত, 'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে।''
জুলাইয়ের এগারো তারিখ মৃত কোনো এক বৃদ্ধকে পোড়ানোর শেষে তার দোকানে চা খেতে এসেছিল কোনো এক শ্মশানযাত্রী। তার ফেলে যাওয়া জেলা থেকে বেরোনো এক দৈনিক পত্রিকার রবিবারের পাতায় বিশেষ এক বিজ্ঞাপনে  চোখটা আটকে গেল হেরো নস্করের। পাঠকদের গল্প লেখার প্রতিযোগিতায় আহ্বান করে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। ওপরের নিৰ্দিষ্ট ওই লাইনগুলো দিয়ে লেখা শুরু করতে হবে। সে তৎক্ষণাৎ ঠিক করল, গল্পটা লিখে পাঠিয়ে দেবে।

  সাধারণ যুক্তির বিচারে এ ইচ্ছের কারণটা আজব ও অভিনব। কাকতলীয় ভাবে এই লাইনগুলোর  অনেক শব্দের প্ৰতি হেরোর খুব টান। প্রথমত, গাড়ির ব্যাপারে তার খুব আগ্রহ। প্রায়শই সে চিন্তা করে কালচে মেরুন রঙের একটা কেতাদুরস্ত গাড়ি চালিয়ে অনেক অনেক দূর চলে যাচ্ছে সে। সেখানকার মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, ভাষা সব আলাদা, অচেনা। গাড়ির বনেটে নাম না জানা ফুলের ডাল এসে পড়ছে। সামনের কাচে ঝাপসা শিশিরের পর্দা। দ্বিতীয়ত, মেয়েমানুষ সম্বন্ধে তার আজন্মলালিত কৌতূহল। কেন তাদের অন্যরকম  গঠন, গড়ন, চলা, বলার ভঙ্গি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ আকর্ষণ বেড়েছে বই কমেনি। সমবয়সীরা তাকে 'মেয়ে পাগলা হেরো' বলে টিটকারি দেয়। তৃতীয়ত, ক্রসিং শব্দটা তার কাছে অত্যন্ত উত্তেজনার। শুনলেই তার মধ্যে ভয়ানক এক জেদ  ভর করে। মনে হয় অসহায়তার সব বাধাকে ডিঙিয়ে, অন্যায় ভাবে সফল হওয়া সব মানুষের সাফল্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, তাদের সামনে দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে সে উঠে যাবে সাফল্যের সব থেকে উঁচু চূড়ায়। সেখানে দাঁড়িয়ে আনন্দে চিৎকার করতে করতে  বুক বাজাবে আর চিৎকার করবে তেনজিং এর মতো। চতুর্থত, লাল লাইট অর্থাৎ রেড লাইট। শুনেছে এ কথার মধ্যে এক নিষিদ্ধ সাধের গন্ধ আছে। নিষিদ্ধতা এখনো চেখে দেখা হয়নি তার। একদিন অন্তত সে বস্তুর স্বাদ পেতে চায় সে। পঞ্চমত, গান ভালো লাগে তার। কাজের অবসরে আপন মনে গুন গুন করে সুর ভাঁজে আজও। সে শুনেছে, রবি ঠাকুর বলে কে যেন একজন খুব ভালো গান লিখতেন। সুরও করতেন। একবার , তিনি এখনো আছেন কিনা, থাকলে কোথায় থাকেন, এ নিয়ে বন্ধু মহলে খোঁজ খবর করতে গিয়ে খুব বিপদে পড়তে হয়েছিল তাকে। ষষ্ঠত, সন্ন্যাসী। মাঝে মধ্যে তার  ভীষণ বিরক্তি ধরে যায় জীবনের উপর। কারণ ছাড়াই। মনে হয়  সবকিছু ছেড়েছুড়ে সন্ন্যাসীর মতো বিবাগী হয়ে শান্তির খোঁজ করে। সে নিশ্চিত যে সন্ন্যাসীর সবসময় খুব শান্তিতে থাকেন। শেষে, ঘ্যাঁচ করে ব্রেক। এখনো পর্যন্ত এই জিনিসটিই তার জীবনের সার বস্তু। যখন যা করতে গেছে, কোনোকিছুতে সফল হয়নি সে। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক পড়ে গেছে কেবল সে বিষয়ে।

(২)
অশোকনগর ইতিনা কলোনি শ্মশানের এক কোনে হেরো ওরফে হরিপদ নস্করের গুমটি দোকান 'চাইকি নাইকি' । সেখানে পাউরুটি,  বিস্কুট, হাতরুটি, ঘুগনি, লাড্ডু চা, মুড়ি পান, বিড়ি, সিগারেট, বাংলা মদ, তাড়ি সবকিছু পাওয়া যায়। কিছু আড়ালে ও কিছু সামনাসামনি। বিভিন্ন কিসিমের খদ্দের। পয়সাওয়ালা ছেলে ছোকরা,  গরিব শ্রমিক, শ্মশানযাত্রী, খেলতে আসা বাচ্চা,  ভ্রমণে বেরোনো বুড়ো বুড়ি , কে নেই? মফস্বলে এ সবের চল না থাকলেও এর মধ্যে কলকাতা থেকে শ্মশানের উপর স্টাডি করতে আসা জিন্স পরা দুটো ইয়ং মেয়ে তার দোকান থেকে সিগারেট কিনে খেয়ে গেছে কিছুদিন আগে। শ্মশান জমজমাট। দোকানও জমজমাট। জন্মানোর মতো মরারও বিরাম নেই। বাচ্চা মরলে থমথমে শ্মশানযাত্রী, যুবক যুবতী মরলে আফসোস, বুড়োবুড়ি মরলে উৎসব। সঙ্গে তাল মেলানো নেশাও চলে বিভিন্ন ঢঙে। দুঃখের নেশা, রাগের নেশা, আনন্দের ও হতাশার নেশা।

  রোজ সকাল ছটায় দোকান খোলে হেরো। গুঁতোয় সারাদিন ধরে। টিফিন আর ভাতের ব্যবস্থা দোকানেই। রাত বারোটায় ঝাঁপ বন্ধ। তারপরেও তার দোকান অবারিত দ্বার খদ্দেরের কাছে। আর কেউ না এলেও আনন্দ।  তখন দোকানের এক কোণে চৌকির উপর ছোট বিছানায় শুয়ে আকাশ কুসুম আবোলতাবোল  ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে। এ এক বিলাসিতাই বলা যায় তার কাছে। বাবা নেই, মা নেই, বউ ছেলে নেই, ঝাড়া হাত পা লোক যাকে বলে। গল্পটা বরং বলাই যাক।

  হেরোর বাবা ধেনো ওরফে ধনঞ্জয় নস্কর  পেশায় ভাগ চাষি ছিল। বাড়ি বাণিপুরের জিওলডাঙায় । মা ফুলমনি সাঁওতালের মেয়ে।  দিনে লোকের বাড়ি ঝি খেটে, নিজের সংসার ঠেলে, রাতে ধেনোর নেশায় মাতাল বরের মার খেয়ে দিন কাটত তার। বয়সকাল পর্যন্ত ফি বছর একটা করে বাচ্চা বিয়াতো সে। অভাবের জীবনে বিলাসিতা। খ্যাঁদা, ন্যাড়া,গুপি, ভূতো, বোঁচা, পচা, অত হিসেব নেই। হাসপাতাল যাওয়ার  সময়, সুযোগ, সঙ্গতি কোনোটাই ছিল না তার। প্রথম দুটোর বেলায় কষ্ট পেয়েছিল খুব। তারপর করপোরেশনের ড্রেনের মতো জন্মপথ বেয়ে দ্রুত বাচ্চা বেরিয়ে আসত নিজের থেকে। বেরিয়ে বেরিয়েই বাছুরের মতো দুধ খেতে শুরু করত মায়ের উদোম বুক থেকে। মায়ের সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে তার কাজ করে যেত নীরবে এবং তীব্র অভিমানে।

  এরপর কিছুটা আকস্মিক ভাবে প্রকৃতির নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে  ধেনো এবং ফুলমনি পর পর মারা গেল  যথাক্রমে লিভারের অসুখ এবং নিউমোনিয়া হয়ে। বাচ্চাগুলো কে কোন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল, কে বা মরে গেল তার আর কে খবর রাখে? চোদ্দতম সন্তান  হেরো পাড়ার রিকশাচালক দিনু মন্ডল  ও তার বউ দুলি'র সংসারে আশ্রয় পেল আড়াই বছর বয়সে।

(৩)
দিনু ও দুলির আর্থিক অবস্থাও তথৈবচ। তারা মানুষ খারাপ ছিল না অবশ্য। অর্থহীনতা যে ঘরে, সে ঘরে অর্থের অভাবে বর হয়ে ওঠা শিশু মনে যতখানি প্রভাব বিস্তার করে ,তার অনেকখানিই আদরে, আহ্লাদে পুষিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু যে ঘরে আদর আহ্লাদ নামক বস্তু দুটো নেই, সে ঘরে অর্থ শুধুমাত্র অনর্থই করে, অন্য কিছু নয়। সুতরাং দিনু ও দুলির বাড়ির ডাল ভাতে বেশ বড় হচ্ছিল হেরো। একটু বড় হওয়ার পর দিনু তাকে পাড়ার ফ্রী প্রাইমারি স্কুলে ভর্তিও করে দিয়েছিল। পড়াশোনা করার পরেও বাকি সময়টা মাঠেঘাটে বনেবাদারে ঘুরত সে। ফুটবল খেলত। গাছপালা, পশুপাখি দেখত। খেয়াল করত বিভিন্ন মানুষের হাঁটাচলা কথা বলার ভঙ্গি। কিন্তু তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল মেয়ে জাতের প্ৰতি। অল্প বয়সেই নারী সৌন্দর্য্যের রহস্যময়তার কথা অনুভব করে মনে মনে যারপরনাই পুলকিত হতো সে। মাঝে মাঝে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে আসত এক নম্বর কলেজের পাশের তেমাথার মোড়ে। সেখানে বড় রাস্তা দিয়ে বাস, গাড়ি , লরি, ছুটে যেত হুশ হুশ করে। বাসে সাধারণ মানুষদের ভিড়ে ঠাসাঠাসি, গাড়িতে  কেতাদুরস্ত সব ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা। চোখে রঙিন রোদ চশমা। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়  তাদের গায়ের সুবাস তাকে যেন ছুঁয়ে দিয়ে যেত। সে মনে মনে ভাবত একদিন এদের মতো বড় হতে হবে।

  দুর্গা পুজোর সময় নীল আকাশে সাদা পেঁজা তুলো মেঘে আর মাঠে কাশের সঙ্গে সঙ্গে মণ্ডপে মণ্ডপে তারস্বরে মাইকের আওয়াজ রসভঙ্গ করলেও তার মধ্যে দু একটা জায়গায় চলত রবি ঠাকুরের গান। সেখানে সামান্য শান্ত পরিবেশ। ' যদি তারে না'ই চিনি গো', অথবা 'পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে', এ সব শুনতে শুনতে  মন কেমন যেন অন্য একটা ভালো লাগার জগতে চলে যেত তার। কে এই রবি ঠাকুর অতশত না বুঝে সে ভাবত, তাকেও বড় হয়ে এ রকম রবি ঠাকুরের গান লিখতে হবে।  গান গাইতে হবে। এ কথা একটুও অত্যুক্তি নয়। এবং এ ধারণা থেকে নিজেকে সরানোর তার কোনো আগ্রহই ছিল না।

  তারপর আরো বড় হলো সে। জীবনের আশাআকাঙ্খা গুলো অর্থের অভাবে  দুমড়াতে মুচড়াতে শুরু করল। ব্যর্থতা রোজকার সাথী হতে শুরু করল তার। সচ্ছ্বলতার কারণে সহপাঠী ও বন্ধুরা সাফল্যে তাকে ফেলে এগিয়ে যেতে শুরু করল। ফলে বিমর্ষতা ও বিষণ্নতা গ্রাস করতে শুরু করল তাকে। এমন কি এই বিষণ্নতার থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হিসেবে এক সময় আত্মহত্যা  করার কথাও ভেবেছিল সে। কিন্তু সেখানেও তো সাহস দরকার ! সাহস  ছাড়া কি কিছু হয় পৃথিবীতে ? সুতরাং অর্থহীনতা ও  ভীরুতার রাজজোটকে  ভাঙতে শুরু করল তার রঙিন মোড়কের স্বপ্নেরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনই হয় গরিবের ঘরে। চলার পথে ঠোক্কর খেতে জীবনে বাঁচার মৌলিক অধিকারগুলোর থেকে যখন পদে পদে বঞ্চিত হয় গরিব মানুষ, তখন এক সময় সখ শৌখিনতার কাজল তার চোখ থেকে মুছে গিয়ে ভাতের আয়োজনটাই জীবনের মোক্ষ হয়ে ওঠে। খ্যাতি এবং সমৃদ্ধির খবর নিয়ে  তাদের চুড়োয় ওঠার স্বপ্ন তখন ভারী অবাস্তব ঠেকে তাদের কাছে। অসংখ্য স্বপ্ন ও উচ্চাশার মৃত্যু হয় এভাবে।

  তার ষোল  বছর বয়সে এক বর্ষার রাতে দিনুও  তাকে ছেড়ে চলে গেছিল। দুলি গেছিল তার মাস ছয়েক আগেই।  দুলির যাওয়াতে দিনু  দুঃখ করার কোনো অবকাশই পায়নি অভাবের টানাপোড়েনে। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত অশক্ত শরীরে রিকশা টেনে গেছিল সে। তার মৃত্যুর পর জীবনের শৈশবে আরো একবার অনাথ হলো হেরো। পেশা হিসেবে  কি বেছে নেবে এ কথা ভাবার আগেই পাকেচক্রে সে দেখল, দিনুকে ইতিনা কলোনির শ্মশানে পুড়ানোর শেষে শ্মশানের  কোনের   ভুলু খ্যাপার চা, পান, পাউরুটি, বিস্কুট, বিড়ি, সিগারেটের দোকানে খেতে আসার সাথে সাথে  কি ভাবে যেন সে বয় হিসেবে বহাল হয়ে গেছে সেখানে। হয়তো বা  মালিকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তার অভাব ও ফলত কাজের প্রয়োজনীয়তার কথা বোঝাতে পারায় তা সম্ভব হয়েছিল। সেখানে সে ফাই-ফরমাশ খাটে, বদলে খাওয়া দাওয়া পায়। রাতে শুয়ে থাকে গুমটি দোকানের পিছনে একটা ছোট খাটিয়াতে। মালিক ঘুমোতে যায় পাশেই তার একটা ছোট কুঁড়েতে।  আদরের থেকেও পেটের জ্বালা জুড়োনোর তাগিদ যে বেশি, সেটা সেই বয়স থেকেই টের পেতে শুরু করেছিল হেরো।

(৪)
এই সেই দোকান। তার আসার  পর বিপত্নীক সন্তানহীন ভুলু খ্যাপাও মারা গেছে। সে শ্মশানের চিতাতেই পুড়ে গেছে তার দেহ। এবং কপালজোরে আস্ত দোকানটার মালিক হয়েছে  হেরো। মাথার উপরের নড়বড়ে ছাদটা নিজস্ব হয়েছে শেষমেশ, যদিও অভিভাবকত্বের ছাতা নেই মাথার উপর। আকাশের নিচে দাঁড়ালে শুধু সাদা কালো মেঘ। সামনে অন্তহীন অচেনা পথ, যা হাঁটা বাকি।
অতি দুর্দিনেও কিছু মানুষ স্বপ্ন দেখা ছাড়ে না। যদিও প্রতিটি স্বপ্ন হোঁচট খায় তাদের।

  হেরো'রও হয়তো তাই হতো যদি না অতি ভাঙনেও সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটার অভ্যাস বজায় রাখতে পারত। অতীতের সব লড়াই  তো ব্যর্থতায় শেষ। এক সময় ফুটবল মাঠ খুব টানতো তাকে আর পাঁচটা বাঙালি কিশোরের মতো। অথচ তার বড় মাথা। সরু সরু পা। মূর্তিমান অপুষ্টি সে। একদিন খেলতে গিয়ে উল্টো দিকের এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডান পায়ের হাঁটুর নিচের দুটো হাড় ভাঙল। চিকিৎসাতে  জুড়ল বটে কিন্তু একটু বেঁকে। এবং তাতে খেলার পাট চুকল। গান গাওয়ার নেশা আরো কিছুদিন পরের। স্বপ্নে ও নেশায় যে কোনো দোষ নেই তা যে কেন চতুষ্পদেরাও বোঝে না কে জানে! একদিন খোলা মাঠে চাটাই পেতে গলা ছেড়ে গান গাইছিল হেরো। তখন সে দিনুকেও হারিয়ে ভুলু খ্যাপার আশ্রিত। কোনো কুমতলব  ছিল না বেচারার। কিন্তু হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, কোথা থেকে হুঁতকো চারটে কুকুর এসে চার পাশ থেকে তাকে ঘিরে ধরে এমন শোরগোল ফেলে দিলো যে সে জন্মের মতো গান গাওয়াও ভুলে গেল। এরপর গাড়ি চালানোর পর্ব। ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হওয়ার পয়সা ছিলনা তার। কিন্তু পরিশ্রম ও মেধার ত্রুটি ছিল না কোনো।  অঞ্চলের পঞ্চায়েত প্রধানের ড্রাইভার পরোপকারী  ঠান্ডা মাথার  রসিক বৃদ্ধ হরেণ সাহা তাকে শেখানোর দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু শেখাতে এসে দু দিনের মধ্যেই বুঝলেন , এ জিনিস সে জিনিস নয়। তারপর তাকে ডেকে বললেন, ' বাবা হেরো। তোমায় একটা কথা বলি। রাগ করো না। বাড়ি, ঘর, গাছপালা, এদের তো হাত পা নেই। তারা দৌড়তে পারেনা। আর যারা পারে, তাদেরও তো একটাই প্রাণ! তাই, তুমি  বরং অন্য কিছুর পিছনে সময় দিলে সকলের মঙ্গল।' অর্থাৎ ড্রাইভিং ও গেল।

  পায়ে গন্ডগোল তাই খেলা নেই। সুর নেই তাই গান নেই। হাত-পা'র সঙ্গে  মাথার বোঝাপড়া নেই তাই ড্রাইভিং নেই। টাকাকড়ি নেই তাই সাহস নেই, ভরসা নেই। সবকিছুতেই ঘ্যাঁচ করে ব্রেক!

(৫)
শেষে কাগজের এই বিজ্ঞাপন। হেরো ঠিক করল গল্পই লিখে ফেলবে আস্ত একটা, এবং কাগজে পাঠিয়ে দেবে। এ আর এমন কি? বিখ্যাত হওয়ার এই হলো সহজতম উপায়। ছাপার অক্ষরে খবরের কাগজে লেখা প্রকাশ। যেই ভাবা সেই কাজ। লাইনগুলো নিয়ে  পনেরো দিন অবিরাম ভাবল সে। কিন্তু তার মাথায় ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো শুধু ওই কটা লাইনই পাক খেতে থাকল। বাকি আর কিছু ঘটল না।  অতি সহজ ও সাধারণ একটা ঘটনা! তার থেকে কি গল্প হয় ?  হওয়া সম্ভব? হলে কোন পথে এগোবে ? কোথায় বাঁক খাবে? কোথায় ক্লাইম্যাক্স ? কোথায় শেষ ? গল্পের শেষে কি প্রশ্ন থেকে যাবে ? শেষ পর্যন্ত আদৌ কি কিছু দাঁড়াবে? যদি দাঁড়ায়, তবুও কি তা ছাপার যোগ্য হবে ? ভাবতে ভাবতে রাতের পর রাত শেষ হয়ে গেল। কিন্তু নিট ফল সেই শূন্য।
শেষে হেরো বুঝল, গল্প লেখাও বেশ কঠিন কাজ। তার দ্বারা হবে না। খ্যাতি ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। আজীবন তার পিছনে ছোটে যারা, খ্যাতি তাদের থেকে পালিয়ে বেড়ায়। অথচ যে যোগ্যেরা তাকে এড়িয়ে চলতে চায়, সে তাদের পিছু ছাড়েনা অনেক ক্ষেত্রে। সৃষ্টি এক অদ্ভুত জিনিস। সে মনের গভীর থেকে উৎসারিত  ঝরনার ধারা। তাকে থামানো যায় না। দমানো যায়না। সে চলে নিজের মর্জিতে, নিজের গতিতে। নিজের পথে। সে ভাঙে। সে গড়ে।  নিজের দ্যুতিতে ভাস্বর হয়। অন্যকেও করে। জীবন সকলকে সব কিছু দেয় না। প্রতিটি পার্থিব জীবনের নির্দিষ্ট ও কিছু পূর্ব নির্ধারিত দায়িত্ব থাকে। এর অন্যথা হয় না। অনেক যোগ্য মানুষ তাঁদের থেকে ঢের অযোগ্য মানুষের পায়ের তলায় বসে গোটা জীবন কাটিয়ে দেয়। এও হলো ভবিতব্যের আর এক নাম। গল্প লিখতে বসে আরো একবার হেরে হেরোর মনে এই আশ্চর্য অনুভূতিগুলি খেলে তাকে অদ্ভুত হালকা করে দিলো। সে দেখল, এবার আর  ব্যর্থতা সত্ত্বেও তার আর কোনো কষ্ট হচ্ছে না। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে খ্যাত হওয়ার বাসনা ছেড়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত সে ফিরে গেল তার নিজের পেশায়।

(৬)
সব গল্পের একটা পরিশিষ্ট থাকে, তা না জানলে গল্পটা গল্পই থেকে যায়। বাস্তবের সাথে তাকে মেলানো যায় না। আগেই বলেছি, হেরোর গল্প লেখা হয়নি। তবে সে একটি চিঠি লিখেছিল সে পত্রিকা সম্পাদকের কাছে, যার কাছে ডাকযোগে তার লেখা পৌঁছনোর কথা। অতি মামুলি ও স্বপ্ন না দেখতে শেখার চিঠি। এমনকি ডাকেও দেওয়া হয়নি তা। হেলায় এক কোনে পড়ে আছে তার প্রতিদিনের টুকিটাকি জিনিস রাখার তাকে। এই চিঠি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই গল্পেরও শেষ।

তাই আপনাদের জন্য হুবহু তুলে দিলাম তা।

...প্রিয় সম্পাদক মশাই,
আমাকে ক্ষমা করবেন আপনার অমূল্য সময় নষ্ট করার জন্য।  আপনার কাগজে, যেখানে গল্পের প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপন দেওয়া, সেখানে লেখা আছে দফতরে বা আপনার সংর সরাসরি যোগাযোগ করা বারণ, তাই মনের তাগিদে অতি মামুলি ব্যক্তিগত এ চিঠি আমি আপনাকে লিখছি। পড়ার দাবি জানানোর ধৃষ্টতা নেই। সে আপনার ইচ্ছে বা অধিকার।

  ছোটবেলা থেকে জীবনের সব খেলায় হারতে হারতে কবে যে বাপের দেওয়া নামটা ভুলে নিজেকে হেরো নস্কর নামে মেনে নিয়েছি, তা আর এখন আমার মনেও পড়ে না। গল্প লিখতে বসে ব্যর্থ হয়ে জীবনের জন্য লড়াই করা ছেড়ে শেষ লড়াইও সম্ভবত আমি হারলাম।  কিন্তু বাকি জীবন আমি আনন্দে বাঁচব বলে ঠিক করেছি। সুতরাং এ হার আমার কাছে এখন একেবারেই গুরুত্বহীন। যে লাইনগুলো নিয়ে আপনি গল্প লিখতে দিয়েছিলেন আপনি, ঘটনাচক্রে তার প্রতিটি শব্দেরই আমার জীবনে ভীষণ গুরুত্ব ও ভূমিকা আছে বলে ভাবতাম, যদিও এখন আমি নিশ্চিত, ভুল ছিল সে ভাবনাতে। নইলে ভালো লাগা, ভালোবাসা এসব কিছুও মানুষকে কখনো ধোঁকা দেয়? 

  খ্যাতির সাধ থাকলেও তা যে পাওয়ার সাধ্য নেই আমার এ বোধিজ্ঞান লাভ করার পর থেকে ,বিশ্বাস করুন, আমার আর কোনো অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা নেই। এখন এ সহজ সত্যিটা আমি বুঝি যে একজন গল্পকারের যেমন তার সৃষ্টির উল্লাসে গর্বিত হওয়া সাজে, একজন ভিখারিরও তেমন তার কৃত কর্মের জন্য মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা সাজে, কারণ দিনের শেষে সে'ও তার পরিবারের জন্য চুরি না করে সৎ ভাবে ভাতের যোগান দিচ্ছে। ভিখারি যেমন গল্প লিখতে পারে না, তেমন গল্পকারও কি পারে ভিক্ষা করে তার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে? সেদিক থেকে কারো কৃতিত্ব কারো থেকে যে খাটো নয়, তা অন্তত এখন আমি বুঝতে শিখে গেছি।
ঠিক সে কারণে এখন থেকে আমি নিজেকে অসাধারণ এক শ্মশান দোকানি হিসেবে চিহ্নিত করে গর্বিত হব। আপনাকে আলাদা করে ধন্যবাদ দিতে চাই এ কারণে যে পুরোনো 'আমি'কে আজকের নতুন উন্নততর আমিতে রূপান্তরিত করার পরোক্ষ হলেও আসল কৃতিত্বের হকদার কেবল আপনিই। সত্যি কথা বলতে কি পৃথিবীর প্রতিটি যোগ্য মানুষেরই তার কৃত কর্মের জন্য গর্বিত হওয়া উচিত। আজকের প্রত্যাশা ও হতাশার পৃথিবীতে এ ভিন্ন বাঁচার আর অন্য কোনো পথ নেই।
আপনি ভালো থাকবেন। কোনোদিন যদি আসেন এদিকে, দেখে যাবেন আমার দোকান, জীবনযাত্রা, আর ফিনিক্স পাখি হয়ে ওঠা নতুন 'আমি'কে। আপনার সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করি।
                                  ইতি
                                হেরো নস্কর
                               (১১.০৭.১৯৯৯)
(যখনকার ঘটনা, সে তারিখ দেওয়া হলো)


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments