জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৫০/শ্যামল জানা



আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৫০
শ্যামল জানা
সাররিয়েলিজম্ (সূত্রপাত)

 আমরা আগে আলোচনা করেছি যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেটা ঘটে থাকে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ সাররিয়েলিজম্ স্পষ্টতই দুটি দলে ভাগ হয়ে গেছিল৷ একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন আন্দ্রে ব্রেতোঁ ও আর একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন ইভান গল (এই দুটি দলে কারা কারা ছিলেন আমরা ৪৬তম পর্বে সবটা উল্লেখ করেছি৷ তাই, আর পুনরুল্লেখ করলাম না)৷ দুটি দলই সাররিয়েলিজম্-এর দর্শন কী, তা বোঝাবার জন্য নিজেদের মত অনুযায়ী আলাদা আলাদাভাবে নিজস্ব সাররিয়েলিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করল৷ ইভান গল-দের যেটি, প্রকাশ পেল ১ অক্টোবর, ১৯২৪ সালে, এবং তা একবারই প্রকাশ পেয়েছিল, আর বেরয়নি(ছবি-১)৷ 



  তার ঠিক দু-সপ্তাহ বাদে ১৫ অক্টোবর-এ প্রকাশ পেল আ্ন্দ্রে ব্রেতোঁ-দের ম্যানিফেস্টো৷ এর ঠিক মাঝখানে, সাররিয়েলিস্ট শিল্পীদের যোগাযোগকেন্দ্র হিসেবে, ১১ অক্টোবর ১৯২৪, ইভান গল-এর পক্ষে থাকা আন্তোনিন অর্তাউদ Bureau of Surrealist Research নমে একটি অফিস প্রতিষ্ঠা করল৷ পাশাপাশি, আন্দ্রে ব্রেতোঁ-র দল তাদের সাররিয়েলিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশ পাওয়ার পরে পরেই ১ ডিসেম্বর ১৯২৪ থেকে La Révolution surréaliste (ইংরাজিতে- The Surrealist Revolution)  নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করতে শুরু করল৷ চলেছিল ১৯২৯ সাল পর্যন্ত৷ আর, মোট ১২টি সংখ্যা বেরিয়েছিল(ছবি-২)৷

    এভাবে আস্তে আস্তে গল আর ব্রেতোঁ-দের মধ্যে সংঘাত চরমে পৌঁছাল৷ এবং তা প্রকাশ্যেও এল৷ একটা সময়ে এঁদের মধ্যে ফাটলটা যখন স্পষ্ট হল, দুই দল একত্র হবার আর কোনো সম্ভাবনাই থাকল না, তখন “সাররিয়েলিজম্” এই নামটা কারা নেবে, সেই নিয়ে তুমুল যুদ্ধ বেঁধে গেল৷ এই সংঘাতের জেরে তাঁরা একদিন সরাসরি মারামারিতেও লিপ্ত হল Comédie des Champs-Élysées নামের এক থিয়েটার হলের মধ্যে৷

  শেষ পর্যন্ত আন্দ্রে ব্রেতোঁ-র দল যুদ্ধে জয়লাভ করল সঠিক কৌশল ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাহায্যে৷ সমস্ত বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে সাররিয়েলিজম্ অভিন্ন অর্থে প্রতিষ্ঠিত হল৷ এখান থেকেই অফিসিয়ালি সাররিয়েলিজম্ সূচিত হল৷ যদিও, সাররিয়েলিজম্-এর এই সূচনাপর্বের ইতিহাস লেখা হল অগ্রগণ্যদের মধ্যে ঝগড়া-মারামারির ভেতর দিয়ে আন্দ্রে ব্রেতোঁর এই জয়লাভের মুহূর্ত থেকে, যে মুহূর্তের ভেতরে পাকাপাকিভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকল— ভাঙন, পদত্যাগ, আলোড়ন, দল থেকে বহিষ্কার, দলের প্রতিটি ঘটনা ও লক্ষে কেউ কারোর কথা মেনে না নিয়ে প্রত্যেক সাররিয়েলিস্টদের নিজের মতকে প্রাধান্য দেওয়া, এই সবকিছুর মধ্যে থেকেই আন্দ্রে ব্রেতোঁ-র নেতৃত্ব মেনে নিয়ে সাররিয়েলিজম্-এর মোটামুটি একটা সংজ্ঞা খাড়া করা!

  ১১৯২৪ সালে আন্দ্রে ব্রেতোঁ তাঁর লেখা সাররিয়েলিস্ট ম্যানিফেস্টোতে সাররিয়েলিস্টদের উদ্দেশ্য কী, তা নির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করলেন৷ যা কিছু সাররিয়েলিজমকে প্রভাবিত করেছে, সেগুলিকে উদ্ধৃতি আকারে যুক্ত করলেন৷ সাররিয়েলিস্টদের কাজের উদাহরণ দিলেন৷ অবচেতন মন কীভাবে কাজ করে(Automatism), তা আলোচনা করলেন৷ এক কথায় সাররিয়েলিজম্ কী? তা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করলেন, ও সংক্ষেপে বর্ণনা দিলেন, ও সংজ্ঞা নির্দ্ধারণ করলেন৷ সেখান থেকে নিয়ে ডিক্সনারিতে, এনস্লাইকোপিডিয়াতে যুক্ত করা হল৷
অভিধানে(Dictionary) : Surrealism, n. Pure psychic automatism, by which one proposes to express, either verbally, in writing, or by any other manner, the real functioning of thought. Dictation of thought in the absence of all control exercised by reason, outside of all aesthetic and moral preoccupation.
বিশ্বকোষে (Encyclopedia) : Surrealism. Philosophy. Surrealism is based on the belief in the superior reality of certain forms of previously neglected associations, in the omnipotence of dream, in the disinterested play of thought. It tends to ruin once and for all other psychic mechanisms and to substitute itself for them in solving all the principal problems of life.

  ১৯২০ সালের মাঝামাঝি একটি ক্যাফেতে বসে সাররিয়েলিস্ট আন্দোলনের চরিত্র চিহ্নিতকরণ করা হয়েছিল৷ ওইখানেই সাররিয়েলিস্টরা একটা সহযোগিতামূলক “ড্রইংগেম” খেলেছিল৷ যেখানে প্রাথমিকভাবে সাররিয়েলিস্ট দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল৷ ওই ক্যাফেতে বসেই সাররিয়েলিজম্-এর থিয়োরি কী হবে, এবং নানা ধরনের কলা-কৌশলের কীভাবে উন্নতি ঘটানো যাবে, তাই নিয়েও আলোচনা করা হয়েছিল৷ যেমন “অটোমেটিক ড্রইং”৷ এই সাররিয়েলিস্ট আন্দোলনের প্রাথমিক অবস্থা থেকেই ব্রেতোঁ নিশ্চিত ছিলেন যে, যেদিন থেকে এই আন্দোলন দানা বেঁধেছিল, সেদিন থেকেই ভিসুয়াল আর্টস যত না শেখার ব্যাপার হবে, তার থেকে বেশি অবচেতন মনের সাহায্যে সুযোগমতো আপনি ঘটে যাওয়া ছবি হবে(Automatism)৷ এই ভাবনা বা সাবধানতাকে অতিক্রম করা গেছিল, নতুন নতুন কলা-কৌশল আবিষ্কার করা গেছিল বলে৷

  যেমন— ফ্রোট্টেজ(Frottages)৷ মানে ঘষা৷ ম্যাক্স এর্নস্ট-এর তৈরি করা এটি একটি অটোমেটিক পদ্ধতি৷ ঘষে ঘষে, চান্স ফ্যাক্টরকে কাজে লাগিয়ে, ছবি তৈরি করা৷

  যেমন— গ্রাট্টেজ(Grattage)৷ একটা গোটা ফ্রেশ ছবিতে আঁচড় কেটে কেটে চান্স ফ্যাক্টর থেকে আর একটা অন্য ছবিতে রূপান্তরিত করা৷
যেমন— দেক্যালোমেনিয়া(Decalcomania)৷ এটা এক ধরনের ডেকরেটিভ কলা-কৌশল৷ খোদাই করে করে, বা এনগ্রেভ করে করে করা হয়, কোনো শক্ত বস্তু, কাঠ বা ধাতুপাতের ওপর৷ তারপর ওটার থেকে নেওয়া প্রিন্টকে ট্রান্সফার করা হয় অন্য আর একটা মাধ্যমে, যেমন পটারি বা গ্লাস ইত্যাদিতে৷

  এভাবে দৃশ্যশিল্পের ক্ষেত্রেও সাররিয়েলিজম্-এ চূড়ান্ত সাফল্য এল৷ আর, তৎকালীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিত্রশিল্পীরা শীঘ্রই সাররিয়েলিজম্-এর সঙ্গে যুক্ত হল৷ জর্জিও ডি চিরিকো, ম্যাক্স এর্নস্ট, হোয়ান মিরো, ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, ইভেস ট্যাঙ্গে, সালভাদোর দালি, লুই বুনুয়েল, অ্যালবের্তো গিয়াকোমেত্তি, ভ্যালেন্টাইন হুগো, মিরেট ওপেনহেইম, টোয়েন, কানসুকে ইয়ামামোতো৷ কিছুদিন পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্ত হলেন এনরিকো দোনেতি৷

  পাবলো পিকাসো ও মার্শেল দুশাম্প-এর প্রতি আন্দ্রে ব্রেতোঁ-র অত্যন্ত শ্রদ্ধা ছিল৷ তাই, তিনি এই দুজনকে বিনীতভাবে অনুরোধ জানালেন, তাঁরা যেন তাঁদের এই সাররিয়েলিস্ট আন্দোলনের সাথে যোগ দেন৷ কিন্তু তাঁরা সরাসরি যুক্ত হলেন না৷ সহানুভূতির সঙ্গে পক্ষে থাকলেন৷ অথচ, দাদাইজম্-এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকা লেখক— ত্রিস্তান জারা, রেনে চ্যার ও জর্জেস সাদোউল সাররিয়েলিজম্-এর সঙ্গে যুক্ত হলেন৷                     (ক্রমশ)


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments