জ্বলদর্চি

সামাজিক দূরত্বই পারে সামাজিক ব্যাধি মুক্ত সমাজ গড়তে/সজল কুমার মাইতি

সামাজিক দূরত্বই পারে সামাজিক ব্যাধি মুক্ত সমাজ গড়তে

সজল কুমার মাইতি 

করোনা ভাইরাস (Covid - 19) আজ সারা বিশ্বকে ঘর বন্দি করে দিয়েছে l এই অতিমারি বিশ্ব সভ্যতা কে আজ প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে l সভ্যতার গর্বকে ভূপাতিত করে অরণ্যের জীবন ফিরে এনে দিয়েছে l অনেকটা খাঁচা বন্দি জীবের মতো লাগছে l করোনা কে দুষে লাভ নেই, অজান্তে এই ধরিত্রিকে সে অনেক কিছুই ফিরিয়ে দিয়েছে l এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্ক (AQI) অনেকটাই উন্নতি করেছে ও দিন কে দিন উন্নত হচ্ছে l কতো দূর থেকে এভারেস্ট এর চূড়া দেখা যাচ্ছে, কাঞ্চনজঙ্ঘার বিশাল রেঞ্জ সুস্পষ্ট অবলোকন করা যাচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় মরালরা (Flemmingo) ফিরে এসেছে l কোথাও কোথাও পাড়ায় পাড়ায় মযূর (Peacock) ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে l প্রাণভরে মুক্ত বাতাস নেওয়া যাচ্ছে l বিশ্ব জুড়ে কলকারখানা বন্ধ, গাড়িঘোড়া বন্ধ l পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু নেই, মাতালদের উৎপাত নেই, ধূমপান নেই l ডিসকো বন্ধ, মল বন্ধ l মিছিল নেই, যান জট নেইl অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই, অফিসে পিএন পিসি নেই l মুক্ত আকাশ, নির্মল পূর্নচন্দ্র রাত কে দিন করে দিচ্ছে l 

  বিজ্ঞজনেরা বলেন প্রতিটি বিপর্যয়ই একটি নতুন সুযোগ এনে দেয় l তার সদ্ব্যবহার করলে উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, অন্যথায় সমূহ বিপদ l করোনা আমাদের সামনে সেরূপ একটি সুযোগ এনে দিয়েছে, তার সদ্ব্যবহার করতে পারলে মানব সভ্যতা অনেক এগিয়ে যাবে l করোনা থেকে মুক্তির একটি অন্যতম প্রতিষেধক হিসেবে বিবেচিত হয় সামাজিক দূরত্ব l এই সুযোগে আমরা যদি আমাদের সামাজিক ব্যাধিগুলি থেকে আমাদের সামাজিক ও মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে মানব সভ্যতা অনেক এগিয়ে যাবে l সামাজিক ব্যাধিগুলি যেমন আর্থিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, সামাজিক ঘৃণার পরিবেশ, সামাজিক বিভেদ, রাজনৈতিক দলাদলি, ভোট সর্বস্য রাজনীতি, ভোট কারচুপি l যত্রতত্র থুতু ফেলা, অফিস ফাঁকি দেওয়া, স্কুল, কলেজ ফাঁকি দেওয়া,  উৎকোচ গ্রহণ l ঘুষ ও কাটমানির পরিবেশ, ধর্মীয় বিভেদ, রাজনৈতিক ও সামাজিক পক্ষপাতিত্ব l এই ব্যাধি গুলি থেকে আমরা যদি এই সুযোগে সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে সমাজ লোভের ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতার পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হবে, বিশ্ব সৌভাতৃত্বর মানববন্ধন তৈরী হবে l ঘৃণা, বিদ্বেষের সংক্রমণ ব্যাহত হতে বাধ্য l 

  থাকুক প্রতিযোগিতা, কিন্তু তা হবে সুস্থ মানবিক মুখ সহ প্রতিযোগিতাl মানবিক গুণের প্রতিযোগিতা, সহযোগিতার সহমর্মিতার প্রতিযোগিতা l সামাজিক দূরত্ব সামাজিক ব্যাধি থেকে মানব সভ্যতার ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে সাহায্য করতে পারে। 

   সমাজকে যেমন করোনা মুক্ত করতে হবে, তেমনই এই সুযোগে সামাজিক ব্যাধিগুলি থেকে মুক্ত করতে না পারলে আর হয়তো কখনো এই ধরাধাম এই সুবর্ণ সুযোগ বরাবরের মতো হারাবে l এ যেন চান্স ইন আ লাইফ টাইম l এ সুযোগকে হাতছাড়া হতে দেওয়া যায় না l সারা পৃথিবী যদি ঘর বন্দি হয়ে থাকতে পারে সব জীবন জীবিকা, সখ আল্লাদ, ধর্ম রাজনীতি দূরে ফেলে রেখে ; তবে আমরা কেন পারবো না সামাজিক ব্যাধিগুলো থেকে আমাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে? অন্তত প্রাণপণ নিঃসার্থ  চেষ্টা তো দেওয়া যেতে পারে, সফল হই না হই সে তো অনেক পরের কথা l

   সামাজিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভেদ, বঞ্চনা থেকে এই সুযোগে একটু দূরত্ব সৃষ্টি করি না কেন? দুর্নীতি, মিথ্যাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার, অযোগ্যর পদোন্নতি, সামাজিক ব্যাভিচার বন্ধ হোক না l চাই তো শুধু এগুলো থেকে আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের একটু দূরত্ব তৈরি করা l না না সব ক্ষেত্রেই দূরত্ব বজায় রাখার দরকার নেই, বরং হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে যাই না কেন বঞ্চিতদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে পৌঁছতে? ধনী নির্ধনের মধ্যে ব্যবধান এর দূরত্ব তৈরি করি না কেন? উচ্চ নীচের ব্যবধানের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করি না কেন? দূরত্ব তৈরি হোক সমাজের অনাচার, অন্যায়, কুসংস্কার, বিভেদ ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে l 
করোনা আমাদের  শিক্ষা দিয়েছে  শৃঙ্খলাপরায়ন হতে, নিয়ম মেনে চলতে l অহংকার, সম্পদ মূল্যহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে l সর্বশক্তিমান আজ অসহায় হয়ে গেল। বঞ্চিত, দরিদ্র হীনবলরা আজ নিশ্চিন্ত, নির্ভয় l লড়াইয়ের সৈনিক, সরবরাহের হাতিয়ার l 

  সম্পদের মালিক, ক্ষমতার অধিকারী আজ প্রাণ ভয়ে গৃহবন্দি l নির্ধন, বঞ্চিতরা আজ প্রাণ ভয়ে গৃহবন্দি না হয়ে বরং অগ্রণী সৈনিকদের ভূমিকায় l এই ব্যক্তিরাই ভাইরাস থেকে আমাদের দূরত্ব তৈরি করে দিচ্ছে নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে l দূরত্ব তৈরি হোক না ঘৃণার সৃষ্টিকারীর বিরুদ্ধে, সম্পদ অপহরণ কারীর বিরুদ্ধে l দূরত্ব তৈরি হোক দূষণকারীর বিরুদ্ধে, পথ ঘাট মলিনকারীর বিরুদ্ধে l অর্নগল কুৎসাকারীর বিরুদ্ধে, হিপক্রিটদের বিরুদ্ধে l সভ্যতার অগ্রগতি অবরুদ্ধকারীদের বিরুদ্ধে l বিজ্ঞানের অগ্রগতির প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে l 

   এই গ্রহকে রক্ষা করতে হলে ও এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এই সুযোগকে এক্ষুনি কাজে লাগাতে হবে l সব ধরণের দাদাগিরির বিরুদ্ধে দূরত্বের প্রাচীর গড়ে তুলতে হবে l লোভ হিংসার থাবা থেকে দূরত্ব তৈরি করে না পাওয়াদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান l ভন্ডামির মুখোশ খুলে মানবিক মুখের দূরত্ব হঠাতে হবে l নূতন সূর্যের আলোর দূরত্বের হ্রাস করতে হবে l
এতকিছু করতে হবে, কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? হাঁ সম্ভব, এবং তা বর্তমান বিভিন্ন  চালু আইনের দ্বারা l যেমন ভাবে বর্তমান আইনের বলে সরকার আমাদের সবাইকে গৃহবন্দি করে রেখে দিয়েছে দিনের পর দিন l আইন পাস করা টা কোন কৃতিত্বের নয়, যদি না সেই আইন সফলভাবে প্রয়োগ করা না হয় l বর্তমানে যথেষ্ট সংখ্যক আইন আমাদের হাতে আছে, শুধু দরকার সেগুলোর সফল প্রয়োগ l তা করতে গিয়ে প্রাথমিক বাধা বিরোধ আসবে, ঠান্ডা মাথায় বিক্ষিপ্ত প্রয়োগই সাফল্য এনে দিতে পারে l লক ডাউন পিরিয়ডে বর্তমান চালু আইন ডিজাস্টার ম্যানেজমেনট অ্যাক্টই দেখিয়ে দিয়েছে যে এই আইনের বলে সবই করা সম্ভব l সেভাবে অনেক আইনই বর্তমান যেমন দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন, আয়কর আইন, সম্পদ কর আইন,  অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন, অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আইন। 

   এ ছাড়া আরও অনেক আইন যেগুলোর সফল প্রয়োগ আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করতে পারে l নিশ্চয়ই তার প্রয়োগ হতে হবে মানবিক মুখ নিয়ে l আইনের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ই আইন l অতএব তার প্রয়োগ হতে হবে মানবিক দিক বিচার করে, কেবল আইনের শাসনের জন্য নয় l তবেই সাফল্য আসবে ধৈর্য এর হাত ধরে, রাতারাতি এ যুদ্ধে জেতা যায় না l শুধু আইনের প্রয়োগ দ্বারা এই ব্যাধিগুলি থেকে পরিত্রাণ নেই, তার জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা l জনসচেতনতাই পারে সামাজিক ব্যাধি থেকে সামাজিক দূরত্ব তৈরী করার কাজকে সহজ করে দিতে l আইনের সফল প্রয়োগ ও জনসচেতনতার যুগল বন্দিই পারে দেশ / পৃথিবী থেকে সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করতে l

  আসুন না চেষ্টা করে দেখতে দোষের কি! এই সুযোগ হাতের বাইরে চলে গেলে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কি রেখে যাব? আর যদি এই কাজে সফল হতে পারি, তবে কিন্তু আগামী দিনের শিশুরা পাবে নির্মল আকাশ নির্মল বাতাস দুর্নীতিহীন বিভেদ বঞ্চনাহীন বাসযোগ্য এই পৃথিবী। 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 


Post a Comment

0 Comments