তৈমুর খানের কয়েকটি প্রাচীন কবিতা
সাপ
দুধ দিয়ে সাপ পুষছি
সাপের ফণা দেখব কবে
ফণার ভেতর বিষের থলি
এক ছোবলেই জানিয়ে দেবে।
অন্ধকারে গর্ত খুঁড়ে
এখানে রোজ তার বসতি
গোপন আদরে বেড়ে ওঠে
নিষিদ্ধ সব ইচ্ছেগুলি।
পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখি
অস্ত রোদের রঙিন আলোয়
সাপ খেলছে আপন মনে
মেলেছে ডানা আকাশমুখি।
তার চোখে চোখ জ্বলে যায়
বুঝতে পারি চোখের ভাষা
কাল মহাকাল প্রলয়শিখায়
করতে থাকে যাওয়া-আসা।
শিকারি
অন্ধকারে আমার যখন বেড়াল ইচ্ছে
তুমি তখন পায়রা নামাও
লাল পায়ে, সাদা ডানায়
পায়রা নামাও
চারিদিকে সব মিছিল আসছে
ভারী বাতাস স্লোগান উড়ছে
আমি তখন গা ঢাকা দিই
তোমার গায়ে
প্রেম ফুটুক পলাশবনে
কাঁটার ভেতর রক্তমাখা হৃদয় ধুয়ে
বসে আছি নিষ্ঠাবান এ সভ্যতার
দুরন্ত শিকারি
কাঁপন
আমার আয়ু খেয়ে নিচ্ছে
সমস্ত দিন, সমস্ত রাত
আমার জীবন গলে যাচ্ছে
গলে গলে মোমের চাঁদ।
হু হু শব্দে বইছে বাতাস
একাকী ভয় নামছে পথে
আমার শুধু দেখা হয়ে যায়
গভীর রাতে ভয়ের সাথে।
বুকের কাছে ঝটপটানি
উড়ছে পাখি, মেলছে পাখা
এই চরাচর ঘুমিয়ে গেলে
আমারই শুধু জেগে থাকা।
জাগতে জাগতে কাঁপন লাগে
ও কাঁপন, তুই শীতের কে?
একটু রোদের প্রলেপ মেখে
আজ আমাকে থাকতে দে।
সভ্যতা
আমরা এগিয়ে চলেছি আর
অন্ধকার আমাদের পিতৃপুরুষেরা
লোলচর্ম ঝুলে আছে, সংস্কৃত দেহ
দ্রাবিড় লিপির সংকেতে দিয়েছি পাহারা
পুরনো মেঘের কাছে নতুন বৃষ্টির প্রার্থনা
অথবা প্রথম বর্ষা বীজের ঘুম ভাঙা-
রমণ স্বপ্নের ডাকে জেগে উঠছে মাঠ
আমরা পেরোচ্ছি একে একে শুকনো ধুলো ডাঙা
অতীত নির্জন গুহা, আমরা বিনম্রবিহীন
পথেই দো-তারা ক্ষুধিত
পাথরে পাথর ঘষে সভ্যতা আসে
রঞ্জন বাউল গায় নন্দিনীর পাশে।
বোধ
মুহূর্ত নাড়ায় আর শব্দের খিলানে
ফুঁসে ওঠে ষাঁড়
বিধি আর চৈতন্যের পারে
দেহের বিভাবে নামে অন্ধকার
চক্র আসে ঘোর চক্রপথে
লালগন্ধ পাপ
দৈব এসে ছুঁয়ে যায়
অদৈবের তাপ
বাঁচার নরম আয়ু দিনান্তের ডাকে
তরবারি মেলে দেয় রোদ
কিছুটা আগুনে, কিছুটা আলোতে
সেঁকে নিই আমাদের বোধ।
হরিণী
এই বনের পাশে দাঁড়িয়ে তোমাকে ডাকার ভাষা ভুলে গেছি
সমস্ত বুকের সবুজ ঘাস খেয়ে যাও তুমি
ডালপালা নুইয়ে ভাঙো
তোমার তীক্ষ্ণ চতুর প্রতিবাদী শিং ঘষে নাও
তোমাকে ধরার ফাঁদ বাতাসে উড়িয়ে দিই
তোমার আসার রাস্তায় ছায়া হয়ে দাঁড়াই
শিকড় ছিঁড়ে গেলেও বলি না কখনও
আমার বৃষ্টিভেজা দিন
আমার রৌদ্দুরদগ্ধ দিন
আমার উদাস চাঁদের আলো
আমার গভীর অন্ধকার
তোমাকে বোঝাব না কোনওদিন
এই বনের পাশে ফেলে যাব নীরব উচ্ছ্বাস
আর হলুদ পাতায় না লেখা চিঠি...
শব্দের দিন
নতুন শব্দ পেলে আমার শৈশবকে ডেকে আনি
ঘুম থেকে জাগাই।
ধুলোর ঘর ভেঙে, কলমি ঝোপের ফুল ভেঙে
শিব-গাজনের নৃত্য ভেঙে
শৈশবকে তুলে আনি।
ফ্যান-ভাতে নুন দিলে কীরকম পোলাও হয়
আর গরম জলে স্যাকারিন দিলে কীরকম চা হয়
আর কচু গাছ সেদ্ধ খেলে কীরকম ঘুম হয়
এসবই দেখেছিল সে।
এখন শব্দের দিন
জানালার ওপারেই সমুদ্দুর
নীল জলাশয়ে রঙিন মাছ
আকাশে যূথচারী পাখি
থালায় থালায় শব্দ
শুধু শব্দের ব্যঞ্জন।
পরিচিতি:
তৈমুর খান, নব্বই দশকের কবি ও গদ্যকার ।কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল : এই ভোর দগ্ধ জানালায়, বৃত্তের ভেতরে জল, জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা, নির্বাচিত কবিতা, উন্মাদ বিকেলের জংশন, স্তব্ধতার নিরুত্তর হাসি ইত্যাদি । পুরস্কার পেয়েছেন : কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার, দৌড় সাহিত্য সম্মান এবং অক্সিজেন সাহিত্য সম্মান এবং নতুনগতি সাহিত্য পুরস্কার ।ঠিকানা : রামরামপুর, শান্তিপাড়া, রামপুরহাট, বীরভূম জেলা, পিন কোড ৭৩১২২৪
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
https://www.jaladarchi.com/2021/07/only-social-distance-can-build-a-social-disease-free-society.html
0 Comments