জ্বলদর্চি

দুটি অণুগল্প/ সন্দীপ দত্ত

দুটি অণুগল্প 
সন্দীপ দত্ত

পাটকেল

বৈঠক সেরে বেরিয়ে লালমোহনের মনে হল,পিঠে যেন এক চাঁই পাথর চাপল। তবে তিনি ঢেঁকুর তুললেন সন্দেশের। বাণীপ্রসাদের শেষ কথাটা বুকের মধ্যে আরও একবার কোকিলসুরে ডাকতেই সমস্ত ক্লান্তি ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল মুহূর্তে। পারলে যেন এক্ষুণি জনগণের উদ্দেশ্যে দু হাত বাড়িয়ে বলে ওঠেন, 'আমি এসে গেছি।' কিন্তু  আজ সেটা সম্ভব নয়। শুরু হবে কাল থেকে। 
      নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম নয় লালমোহনের। আগেরবারেও তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন গোপীনাথপুর এলাকায়। জিতেওছিলেন অনেক ভোটে। তবু এলাকাটার তেমন উন্নতি হয়নি। সব জেনেশুনেও মন্ত্রীমশাই লালমোহনকে আবার একটা সুযোগ দিলেন। সুযোগ দিয়ে যেন কান ধরে বুঝিয়ে দিলেন,"ভুলগুলো শুধরে নাও। আর যেন না হয়।  ভোট চাও নিজের দক্ষতায়। প্রতিশ্রুতি দাও। নুয়ে পড়। তবে যদি পাবলিক তাকায়।"
       পরদিন সকালে প্রচারের প্রথম দিন থেকেই জনগণের কাছে যারপরনাই নত হল লালমোহন। গ্রামের এক মহিলা গোবর ফেটিয়ে ঘুঁটে দিচ্ছিল। সেখানে গিয়ে তিনি ভোট চাওয়ার অছিলায় হাত লাগালেন। মহিলার দেখাদেখি দু দুটো ঘুঁটেও দিয়ে ফেললেন। ব্যস, হাত একেবারে গোবরে একাকার! তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গো যারা ছিল, স্যারের জন্য তাড়াতাড়ি জল চাইলে কেউ সাহায্য করল না। উল্টে দেখিয়ে দিল, সামনের চাপাকল। কিন্তু  চাপাকল'টা যে খারাপ, কে জানত!
     গ্রামবাসীদের বলতে, ওরা হাসে। হাসতে হাসতে রাগ দেখায়। রাগ দেখিয়ে বুকে জমে থাকা ক্ষোভ'টার আশ মেটায়। বলে,"কোনো কাজ করবেন না অথচ জনগণের পাশে আছি,এ কেমন কথা? আজ অনেকদিন হয়ে গেল এ  এলাকার নলকূপগুলো খারাপ। কই,খোঁজ নিয়েছেন একবারও? জানতে চেয়েছেন,জলের জন্য আমাদের জীবনগুলো কতখানি দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে !"
"তাবলে স্যারকে আপনারা হাত ধুতে জল দেবেন না?" সাঙ্গোপাঙ্গোরা বলে উঠল।
"না, দেব না। ঐ গোবরমাখা হাত নিয়েই ওনাকে ফিরে যেতে হবে। তবে যদি বোঝেন।"
       মুখ কাচুমাচু করে সাঙ্গোপাঙ্গোদের দিকে তাকালেন লালমোহন। ততোধিক চুপসে গিয়ে ওরা বলল,"কী করবেন স্যার! রুমালটাই বের করুন।"


 অহংকার

মর্নিংওয়াকে অনেকটা হাঁটার পর বসবার জন্য একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজছিলেন গোবিন্দ। সঙ্গী দীর্ঘদিনের বন্ধু বামাপ্রসাদ। দুজনেই সত্তরোর্ধ্ব। দুজনেরই একজন করে ছেলে এবং পাঁচ মাস আগে ওরা একসাথেই চাকরি পায় হাজার চল্লিশের মাসিক বেতনের কোনো উঁচু  পদে। বলা যায়,সেই সুবাদে গোবিন্দ আর বামাপ্রসাদের সম্পর্কটা আরও যত না নিবিড় হয়েছে,নীরেনের সাথে গা ছাড়া মনোভাবটা বেড়েছে বেশি। নীরেনেরও এক ছেলে। নীরেনও গোবিন্দ আর বামাপ্রসাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুই ছিল একদিন। কিন্তু  গত পাঁচ মাসেই সব উল্টে গেছে। ছেলেদের মোটা মাইনের সরকারি চাকরির কারণে বামাপ্রসাদ আর গোবিন্দের মনে জমেছে অহংকারের পুরু স্তর।একই বয়স এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যেখানে ওদের ছেলে সরকারি চাকুরে,নীরেনের ছেলে চাকরি না পেয়ে শেষে কিনা খুলল মুদিখানা! তাতেই নীরেনের কী মাথা উঁচু ! যেন উর্দি পরা সাহেব।
     দুজনের একসাথে দেখা হলে এই প্রসঙ্গটা প্রায়ই তোলেন গোবিন্দ আর বামাপ্রসাদ। বসার ভাল একটা জায়গা পেয়ে আজও তুললেন। কিন্তু  কে জানত,ঐ রাস্তা দিয়েই হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে আজ এগিয়ে যাবেন নীরেন!
     বামাপ্রসাদ আর গোবিন্দের কথা কানে আসতেই থমকে দাঁড়ালেন তিনি।
"বলি,অহংকারটা কার করা সাজে আপনারা জানেনই না। দশটা পাঁচটার মোটা মাইনের চাকরি করে যারা,তাদের খেতে হয়না? খাওয়ারটা জোগায় কে? যে যত বড়ই চাকরি করুক না কেন,মুদিখানাগুলো থাকে বলেই দিনের শেষে দুটো মুখে দেওয়ার সুযোগ পায় ওরা। এবার বলুন তো অহংকারটা কাদের বেশি থাকা দরকার?"
নীরেনের কথা শুনে মাথা নামিয়ে ফেললেন গোবিন্দ আর বামাপ্রসাদ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments