জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম ---- পর্ব-১৬/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -পর্ব-১৬

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মের মাহাত্ম্য 

এখন দেখা যাক ধর্ম ও তার বিন্যাস। 
প্রাচ্য পাশ্চাত্যের দর্শনগত ও ধর্মীয় জিজ্ঞাসার মধ্যে মৌলিক তফাৎ একটি ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রাচ্য পৃথিবীকে মাতৃজ্ঞানে অনুভব ও ভক্তি করে; পাশ্চাত্য পৃথিবীকে বস্তুজ্ঞানে বিচার করে। মানুষের পৃথিবীতে সব ধর্মের উত্থান ঘটেছে প্রাচ্য-ভূমি থেকে। ভৌগোলিক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ যে ভারত, সেখানে যতগুলি ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে, সেগুলি থেকেই ভারত-ধর্মের উত্থান ঘটেছে। ব্রাহ্মণ্যধর্ম, আর্যধর্ম, বৈদিকধর্ম, জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, শিখধর্ম প্রভৃতি ধর্মগুলি ভারত-ধর্মের অঙ্গ। প্রতিটি ধর্মেই সাম্য ও ঐক্যের দিক দিয়ে প্রভূত মিল শুধু নয়, একে অপরের পরিপূরক ও অংশ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলির মধ্যেও একই ঐক্যের বাণী। প্রতিটি ধর্মের উত্থানের পিছনে যে প্রবক্তাগণের আবির্ভাব ঘটেছে এবং তাদের আধ্যাত্বিক উপলব্ধিজাত বাণী সেই সেই ধর্মের যে উত্থান ও ব্যাপ্তি ঘটিয়েছে, তার অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। 

হিন্দুধর্ম বলে যা পরিচিতি পেয়েছে তা মূলত সনাতন ধর্ম। কারণ হিন্দুধর্মের উত্থানের ক্ষেত্রে কোন বিশেষ প্রবক্তা নেই, যা অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে আছে- 'হিন্দু' শব্দটি সংস্কৃত শব্দ নয়, এই শব্দটি গ্রিকদের কাছ থেকে পাওয়া। পঞ্চধারায় প্রবাহিত নদ যা পঞ্চসিন্ধু নামে পরিচিত, তার তীরে এবং সরস্বতী ও দৃষদ্বতি নদীর তীরে বসবাসকারীদের গ্রিকগণ 'হিন্দু' বলতেন। উচ্চারণজনিত সমস্যার কারণে সপ্তসিন্ধুকে (সিন্ধুনদের পঞ্চধারা এবং সরস্বতী ও দৃষদ্বতি নদী) তারা 'হপ্ত হিন্দু' বলতেন-ঠিক এই কারণে বিশাল ভারত ভূখণ্ডে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী প্রাচীন মুনি-ঋষীগণ আধ্যাত্বিক ভাবনার নির্যাসগুলি মুখে মুখে উচ্চারণ করতেন। এই উদ্গীত বাণীই পরবর্তীকালে বেদের উপনিষদের বাণী হয়ে লেখ্য রূপ পেয়েছে। কোন একজন প্রবক্তার দ্বারা এই আধ্যাত্মিক জগতের উন্মেষ ঘটেনি। 

ভারত- ধর্মের ক্ষেত্রে বিশ্বাস ও অবিশ্বাস প্রবণতা দুই-ই প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ এখানে একের প্রাধান্য নেই। বহু-র সংশ্লেষ ঘটেছে বলে ধর্মজগতে অবিংসবাদী প্রাধান্য সম্ভব হয়নি। এই কারণেই ভারত-ধর্ম শুরু থেকেই সহিষ্ণুতায় সচল থেকেছে। ভারত ছাড়া পৃথিবীতে আর একটিও দেশ নেই, যেখানে ধর্ম বিষয়ে এত গ্রন্থ রচিত হয়েছে এবং এই সমস্ত ধর্মগ্রন্থের মধ্যে বিশেষ ধর্মীয় মতের সঙ্গে মতান্তর-জনিত যুক্তিগুলো ও প্রাধান্য পেয়েছে।

  Comparative Religion গ্রন্থেA.C Bouquet বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন- "India in particular furnishes within its limits examples of every conceivable type of attempt at the solution of religious problem" সুতরাং প্রশ্ন ও প্রতিপ্রশ্ন- বিশ্বাস ও অবিশ্বাস, এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই ভারতধর্মের ব্যাপ্তিও এই কারণেই আসমুদ্র-হিমাচল সম্ভব হয়েছে। এখানেই অন্য ধর্মের সঙ্গে ভারতধর্মের মৌলিক তফাৎ। অন্য ধর্মের প্রতিপ্রশ্নের সুযোগই নেই। ঋকবেদের ১০ মণ্ডলের ১৯ সূক্তটিতে সৃষ্টিরহস্য কি অসাধারণ উপলব্ধি নিয়ে ত্রিষ্টুপ ছন্দে প্রজাপতি বর্ণনা করেছেন: "সেকালে যা নেই তাও ছিল না, যা আছে তাও ছিল না। পৃথিবীও ছিল না, অতিদূর বিস্তার আকাশও ছিল না। আবরণ করে তবে কি ছিল? কোথায় স্থান ছিল? দুর্গম ও গম্ভীর জল কি তখন ছিল? তখন মৃত্যুও ছিল না, অমরত্ব ছিল না, রাত্রি-দিনের প্রভেদ ছিল না।

   কেবল সেই একমাত্র বস্তু বায়ুর সহকারিতা ব্যতিরেকে আত্মা মাত্র অবলম্বনে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস যুক্ত হয়ে জীবিত ছিলেন। তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। সর্বপ্রথমে অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিল। সমস্তই চিহ্ন বর্জিত ও চতুর্দিকে জলময় ছিল। অবিদ্যমান বস্তু দ্বারা তিনি সর্বব্যাপী আচ্ছন্ন ছিলেন। তপস্যার প্রভাবে সেই এক বস্তু জন্মালেন। সর্বপ্রথম মনের উপর কামের আবির্ভাব হল, তা থেকে সর্বপ্রথম উৎপত্তির কারণ নির্গত হল। বুদ্ধিমানগণ বুদ্ধি দ্বারা আপন হৃদয়ে পর্যালোচনা পূর্বক  অবিদ্যমান বস্তুর উৎপত্তি স্থান নিরূপণ করলেন। রেতোধা পুরুষেরা উদ্ভব হলেন, মহিমা সকল উদ্ভব হলেন। ওদের রশ্মি দু-পার্শে ও নিন্মের দিকে এবং ঊর্ধ্বদিকে বিস্তারিত হল, নিম্নদিকে স্বধা রইল, উর্ধ্বদিকে প্রয়তি রইলেন। কেই বা প্রকৃত জানে? কেই বা বর্ণনা করবে? কোথা হতে জন্ম? কোথা হতে এ সকল নানা সৃষ্টি হল? দেবতারা এ সমস্ত নানা সৃষ্টির পর হয়েছেন। কোথা থেকে যে হলো তা কে বা জানে? এ নানা সৃষ্টি যে কোথা হতে হল, কার থেকে হল, কে কেউ সৃষ্টি করেছেন কি করেননি, তা তিনিই জানেন, যিনি এর প্রভুস্বরূপ পরমধামে আছেন অথবা তিনিও না জানতে পারেন।"

 এই সূক্তের ওপর Muir এর ব্যাখ্যা হল: "A self-supporting principle beneath,and energy aloft"। সেদিনের ঋষি সৃষ্টির আগেই সৃষ্টিকর্তাকে অনুভব করতে পেরেছিলেন এবং প্রকৃতির যা-কিছু ঋষিগণ দেবতাজ্ঞানে পূজা করতেন, সেই দেবতারা কেউ-ই আদি দেব নন- তারাও সৃষ্ট হয়েছেন। তাই এই বিস্ময়কর প্রশ্ন- তবে আদি কে? এই প্রশ্নের উত্তর আজও বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন, অধ্যাত্মবাদীগণ খুঁজছেন। কেউ বলছেন, তাকে পেয়েছি, কেউ বলছেন, তিনি চির-রহস্যাবৃত, ধরাছোঁয়ার অতীত। এখন থেকে ৩,৫০০ বছরের ও আগে প্রাচীন ঋষিগণের মনে যে প্রশ্ন জেগেছিল, তার উত্তর আজও পাওয়া যায়নি। যারা অজ্ঞেয়বাদী অর্থাৎ বস্তুজগতের বাইরে ঈশ্বর বা পরম কোন কিছু সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ অসম্ভব- এই দার্শনিক মতে বিশ্বাসী, এবং যারা নাস্তিক অর্থাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না- এদের সঙ্গে ঈশ্বর বিশ্বাসীদের দ্বন্দ্ব আবহমান থেকেই যাবে, কারণ কোন দর্শনই স্বয়ং সম্পূর্ণ বা কোন ধর্মমতই সর্বজনগ্রাহ্য হতে পারে না। এর ফলে ধর্ম-চিন্তার ক্ষেত্রে বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। 

 ভাববার বিষয় হল, ভারত ধর্মেই এই সংশয় ও বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটাতে একজন মহাপুরুষের আবির্ভাব হলো। তার জন্মের বহু আগে এবং তার জীবিত অবস্থায় যে লোকায়ত দর্শন ভারত-ধর্মকে ভিন্নধারায় প্রবাহিত করতে চেয়েছিল, তা হল লোকায়ত দর্শনের প্রাণপুরুষ চার্বাক-কে কেন্দ্র করে। সংশয়বাদ ও বস্তুবাদ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে বিপুল ব্যাপ্তি পেয়েছিল এবং তারই ফলিত রূপ লোকায়ত দর্শন। উপনিষদেও এই লোকায়ত ধর্মের অনেক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। চার্বাক দর্শন মুক্তমনে বাস্তবকে পর্যালোচনা করে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের দর্শন।

   আজ ও যে দর্শনের ধারাটি স্পষ্ট হয়ে প্রতীয়মান। ব্রাহ্মণস্পতি ভারতীয় বস্তুবাদের বা বস্তুবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। ঋকবেদের দশম মন্ডলের ৭২ সূক্তের দ্বিতীয় মন্ত্রটির অর্থ হল: "দেবতারা উৎপন্ন হওয়ার পূর্বকালে ব্রহ্মণস্পতি নামক দেবতা, দেব কর্মকারের ন্যায় দেবতাদের নির্মাণ করলেন। অবিদ্যমান বস্তু উৎপন্ন হল।" বৈদিক যুগেই বৈদিক দেবতাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। লোকপুত্র বৃহস্পতিই এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। ( ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments