জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৪৮



সম্পাদকীয়,
ছোটো বন্ধুরা, জানো তো, টিয়া রঙের পাখি মানেই কিন্তু টিয়া পাখি নয়। ঐ যে দেখনা, সোহম দাদার তোলা ছবির ওই পাখিটাকে আমি ভুল করে যেই না টিয়া বলে ফেলেছি অমনি পাখিটা রাগে গোঁজ হয়ে বসে রইল। আরে ভুল কি আর সাধে হয়েছে? মানসী আন্টির পান্নার গল্প পড়ছিলাম তো! পান্না কে? আরে পান্না তো টিয়া পাখির নাম। সুমনাদিদিও তো ছড়ায় দুটো পাখির কথা বলেছে। ব্রততী আন্টি ছড়ায় ফড়িং, পিঁপড়ে আর টিকটিকি নিয়ে ছড়া লিখেছে। আর রাজীব তন্তুবায় আঙ্কেল ছড়ায় ফড়িং, জোনাকি, পায়রা, কত কিছুর কথা বলেছে, পড়লে জানতে পারবে। পশু পাখিদের কথায় মনে পড়ে গেল, ফুলকুসুমপুর খুব কাছেতে বিংগো, মিঁউ, কুমি,  রাধাগোবিন্দ কত কত বন্ধুরা, তাই না? কিন্তু ফুলকুসুমপুরের বিলম্ব দাদু তো হারিয়ে গেছে। কোথায়?  কে জানে হিল্লি দিল্লী চলে গেছে হয়তো। কিংবা তুলতুলির ঠাম্মির সঙ্গে আমেরিকার সান ডিয়াগো চলে যায় নি তো? তুলতুলি কে? জানতে হলে কল্যাণী আন্টির গল্প পড়তে হবে। তবে সোনালি দিদি  স্বচ্ছ ভারত নিয়ে খুব সুন্দর একটা গল্প লিখেছে। স্বাধীনতা দিবস সবে গেল। এসো আমরা আমাদের দেশ ভারতবর্ষকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখি। ঠিক নিজেদের ঘরকে যেমন রাখি। অবশ্য ঘরকে পরিষ্কার রাখে মা। তাই তো? এবারে মা কে নিয়ে ছড়া লিখেছে সমাদৃতা আর প্রীতি দাদু ঠাকুমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছে। তবে যাই বলি না কেন এবারের সংখ্যার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল তোমাদের এঁকে পাঠানো রঙীন ছবিগুলো। তাই খুদে শিল্পীদের পাঠালাম আদর আর ভালোবাসা।   - মৌসুমী ঘোষ।


নড়ি 
কল্যানী মিত্র ঘোষ

ছোট্ট তুলতুলির খুব আনন্দ, তার দিম্মা আসছে ইন্ডিয়া থেকে, থাকবে ছ মাস। তুলতুলির বয়স চার বছর, বাবা মায়ের সঙ্গে ও আমেরিকার স্যান ডিয়েগো শহরে থাকে। এই এক বছর হলো ও  সপ্তাহে তিনদিন করে একটা প্লে স্কুলে যায়। স্কুলে যেতে ওর অবশ্য খুব ভালোই লাগে। প্রথম দিন যেদিন ওর মা ওকে রেখে এল, তুলতুলি বোঝেনি কেন যে মা ওকে চুমু দিয়ে অমন কাঁদোকাঁদো মুখ করে ওকে স্কুলের গেটে নামিয়ে দিয়ে " বাই বেবি!" বলেছিল। তুলতুলি কিন্তু দিব্যি গটমট করে হেঁটে ক্লাসের ভেতরে চলে গেছিল, এক বারও গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের দিকে পিছু ফিরে তাকায়নি। 

এদিকে স্কুলে দিয়ে আসার পর তুলতুলির মাম্মির সে কি মন খারাপ। সারাক্ষণ তো সে তুলতুলির পিছনেই দৌড়ে বেড়াত, ধরধর করতে হত, নইলে সে ধুপুশ অথবা কোনো অকম্ম করে ফেলত! তুলতুলি এমনিতে ভারী লক্ষী মেয়ে, অসুবিধা বলতে দুটো, সে খেতে চায়না আর ঘুমোতে চায় না। সব সময় সে বড্ড ব্যস্ত, খাওয়া আর ঘুমের জন্য সময় চলে গেলে তার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে এমনটাই হাবভাব। ওর মায়ের নাম রিয়া, সে সারাক্ষণই খাবার নিয়ে মেয়ের পেছনে দৌড়য় আর ঘুম পাড়ানোর সময় বিছানায় তার পাশে শুয়ে পিঠে চাপড় মেরে মেরে অনেক গান গায়। এর ফলে তুলতুলিও ঘুমটুম ভুলে চোখ বড় বড় করে মায়ের সঙ্গে গলা মেলায়, ওর বাবা বিক্রম এটাকে বলে "ঘুম তাড়ানি" গান। মা তাই শুনে রেগে যায়। আর তুলতুলি কিছু না বুঝেই হাসে। 

তুলতুলির ভাই বোন নেই, ওর বন্ধুদের কিন্তু কিউট লিটল ব্রাদার বা সিস্টার আছে। মন খারাপ হয় তুলতুলির। কিন্তু মা কে বললে মা বলে মায়েরও নাকি ভাই বোন নেই। কিন্তু মা তো ইন্ডিয়া তে বড় হয়েছে, কত কাজিন ছিল মায়ের! কে বোঝাবে মা কে এই দুঃখের ‌কথা। মা খালি বলে ,
"এই তো এতো পুতুল, খেল না এগুলো নিয়ে। ছোট বোন এলে দেখবি কি ঝামেলা, তোর সব টয় নিয়ে নেবে, আর রাতে তোর মায়ের কোলের পাশটা তখন ও ই নিয়ে নেবে!" 

না বাবা, দরকার নেই, মায়ের পাশের জায়গাটা ছাড়া যাবেনা। স্কুলে ওর তিনজন খুব প্রিয় বন্ধু হয়ে গেল, পাইপার, সিসি আর ক্যামরন, তিনজনেই মেয়ে। আর জ্যাক বলে একটা ছেলে ওর সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করেছে, তুলতুলির ও খুব ইচ্ছে ছিল ওকে হাই বলতে, কিন্তু ক্যামরন বেশ রেগে বলেছে,
"একদম বয়েজ দের সঙ্গে মিশবি না ঠুলি!" 

ও মেশেনি। 

রোজ বাড়ি ফিরে ভাত মাছ খেতে খেতে ঠুলি ওরফে তুলি মাকে স্কুলের সব মজার মজার গল্প শোনায়। ওদের কেমন লাইন দিয়ে একে একে পটি, পি পি করে আসতে হয়। ডায়পার তো সেই দু বছর বয়সেই ছেড়ে ফেলেছিল তুলি, কিন্তু তারপরেও টুকটাক অ্যাকসিডেন্ট তো হয়েই যেত। তখন মা রাত্তির বেলা ওকে পুল আপস্ পরিয়ে দিত। আসলে রাত্তিরে খুব অদ্ভুত ব্যাপার হত, তুলি দেখতো ওর হিসু পেয়েছে আর ও পটিতেই বসেছে, কিন্তু ঘুম ভেংগে দেখতো, এ মা, এতো তার ক্রিব! খুব লজ্জা পেত। কিন্তু মা খুব স্মার্ট, ওর বেডের ওপর একটা প্যাড পেতে রাখতো, তাই রক্ষে। এখন তো তুলি পুল আপস ও পরে না। মা শুধু দু বার ঘুম থেকে তুলে হিসু করিয়ে দেয়। এই স্কুলেও ও পটি ট্রেইন্ড হয়েই এসেছে। কিন্তু পরশু দিন আমান্ডা ওর ক্লাসের মাঝেই অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলেছে, সবাই হেসে উঠেছে, তুলি কিন্তু ওর কাছে গিয়ে হাগ করে বলেছে,
"ইটস্ ও কে!"
আমান্ডা লাজুক মুখে হেসেছে। মিস জুলিয়া ওকে পরিষ্কার করে ক্লাসে এসে সবাইকে বলেছে ,
"সে থ্যাংক ইউ ঠু ঠুলি, ও কিন্তু হাসেনি। তোমরা শিখে নাও, কখনো কেউ পড়ে গেলে বা অ্যাকসিডেন্ট করে ফেললে হাসতে নেই, তাহলে তাদের মনে কষ্ট হয়। বি কাইন্ড!" 

"সরি মিস অ্যান্ড থ্যাংক ইউ ঠুলি!"
সবাই একসঙ্গে বলে ওঠে। খুব বুক ফুলিয়ে এই গল্পটা মাকে বলল তুলি। 

শুক্রবার রাতে খুব আনন্দ তুলির, কাল শনিবার, দিম্মা আসছে, তারা সবাই যাবে লস অ্যাঞ্জেলেস এয়ারপোর্টে দিম্মা কে আনতে যাবে। খুব ভোরে উঠতে হবে তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল তুলি। সকালে উঠে খেতেও কোনো ঝামেলা করল না, মাকে কি হাসিখুশি দেখাচ্ছে! বাবা গাড়ি চালাচ্ছে, মা পাশে আর পেছনের কার সিটে তুলি আইপ্যাডে একটা ম্যাথের ফান গেম খেলছে। প্রায় তিন ঘন্টা পরে ওরা লস এঞ্জেলেস পৌঁছল, মাঝে একবার বাবা কফি আর তুলি হিসু ব্রেক নিয়েছিল। ম্যাকডনাল্ড থেকে চিকেন নাগেট খেতে খেতে বাকি রাস্তাটা কাটিয়ে দিয়েছিল তুলি। 

এয়ারপোর্টে একটা জায়গায় ওরা দিম্মার জন্য ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছে, একে একে সবাই বেরিয়ে আসছে, তুলির আর তর সইছেনা , দিম্মির সঙ্গে তো রোজই ভিডিও কল হয়, আজ সামনে থেকে দেখবে, ছুঁতে পারবে, বুকটা আনন্দে ধকধক করছে! এমন সময় একটা হুইলচেয়ারে বসা সাদা ধবধবে চুলের দিম্মাকে দেখতে পেল তুলি। মা তো সব কিছু ভুলে, " মা আ আ, আমরা এখানে এ এ" বলে বাঙলাতেই চেঁচিয়ে উঠল, দিম্মাও হাত নাড়তে লাগলো। যে ছেলেটি হুইল চেয়ার ঠেলছিল বাবা তাকে পাঁচ ডলার বখশিশ দিল। এরপর দিম্মি হুইলচেয়ার ছেড়ে আস্তে আস্তে তাদের দিকে হেঁটে এল, সঙ্গে দিম্মির লাঠিটা ছিল অবশ্য। 

তুলি ছুট্টে গিয়ে দিম্মির হাঁটু জড়িয়ে ধরল,
"তোমাকে আর লাঠি নিতে হবে না, এখন থেকে তুমি আমার হাত ধরে হাঁটবে দিম্মি!" 

দিম্মি অমনি টুক করে ওকে কোলে তুলে নিয়ে অনেক্ষণ ধরে একটা হামি খেল।



পিগাইপাপ এর বন্ধুরা
ব্রততী ভট্টাচার্য

পিগুর মনে দুঃখ ভীষণ,
        টিকটিকিটা নামছে না | 
ফড়িং দাদাও মুখ লুকিয়ে,
        পিঁপড়ে গুলোও আসছে না |
কাদের সঙ্গে খেলবে পিগাই ?
        সবাই যদি ভয়েই পালায়
একটু নাহয় দুষ্টু বেশী ,
         নাহয় একটু বেশীই জ্বালায় |
তবুও তো বন্ধু বল ,
          ওরা ছাড়া আর কে আছে ?
ওরাই যদি আড়ি পাতায়,
           পিগাই যাবে কাদের কাছে ?


পান্না 
মানসী গাঙ্গুলী

      আমি তখন বেশ ছোট, আমাদের বাড়িতে একটা টিয়া পাখি ছিল, নাম ছিল তার পান্না। মা দিয়েছিল ওর এই নাম। পান্না  ছিল মায়ের ভারী পছন্দের। মা ওকে ছানা, ছোলা, কখনও দইভাত মেখে খেতে দিত আর পান্না কুপকুপ করে খেত। তারপর খাওয়া হয়ে গেলে মা ওকে কলের নিচে খাঁচাশুদ্ধু বসিয়ে দিত আর ও ডানা ঝাপটিয়ে ঝাপটিয়ে চান করত। চান হয়ে গেলে খাঁচা জলের তলায় ভালো করে ধুয়ে মা ওকে খাঁচাশুদ্ধু রোদ্দুরে দিত। আমরা দেখতাম, খুব মজা পেতাম।
        মা আমাদের যেমন খেয়াল রাখতো ওরও খেয়াল রাখতো খুব। আমাদের ডাকা শুনে ও মাকে 'মা মা' করে ডাকতে শিখে গেল। ও উড়তে পারত না, তাই মা অনেক সময় খাঁচার দরজা খুলে দিত, ও বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাদের ঘরময় ঘুরে বেড়াতো। তবে মা চানে গেলে বা ঘুমাতে গেলে ওকে খাঁচায় ঢুকিয়ে বন্ধ করে রাখত, যদি বিড়ালে খেয়ে নেয়। ও ঘুরত ফিরত আর 'মা মা' করে ডাকতো। মা-ও  সাড়া দিত ওকে আর কত কথা বলত ওর সঙ্গে। ও কি বুঝত কি জানি, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো।
         একবার আমার মায়ের নাকের হিরের নাকছাবিটা কোথায় হারিয়ে গেল। মা কাপড়ে মুখ মুছতে গিয়ে বোধহয় খুলে পড়ে গিয়েছিল কোথাও। ঠাকুমার চোখে পড়ে। বলেন, "বৌমা তোমার নাকছাবি কোথায় গেল?" খোঁজ পড়ে গেল বাড়িময়। ছোট জিনিস খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সবাই আমরা খুঁজছি, মায়ের খুব মনখারাপ অত দামী জিনিসটা হারিয়ে যাওয়ায়। কাজের লোককে ঠাকুমা বললেন, "ভালো করে ঝাঁট দিয়ে দেখ"। এমন সময় পান্না গিয়ে মায়ের কোলে বসে মায়ের হাতে তুলে দিল হিরের নাকছাবিটা। ঘুরে বেড়াচ্ছিল ঘরময়, কোথাও দেখতে পেয়ে ঠোঁটে করে তুলে এনেছে। মায়ের নাকে থাকে ও দেখেছিল নিশ্চয়ই। হারিয়ে গেছে, সবাই খুঁজছে বুঝে এনে তুলে দিল মায়ের হাতে। মা ওকে হাতের মধ্যে নিয়ে আদর করে, চুমু খেয়ে অস্থির করে তুলল।
        একবার মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। আমার একটা ভাই হল। সেই সময় পান্না খাঁচার ভেতর ছটফট করছে দেখে আমার ঠাকুমা খাঁচার দরজা খুলে দিল। কিছু পরে ওকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। আমাদের সবার মনখারাপ, মাকে হাসপাতালে আর কিছু বলা হল না। এরপর মা ভাই নিয়ে বাড়ি ফিরে পান্নার খোঁজ করলে সব বলা হল মাকে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার আমরা শুনতে পেলাম পান্নার গলার আওয়াজ, 'মা মা' করে ডাকছে। ওর গলা তো আমাদের চেনা। আমরা আওয়াজ অনুসরণ করে ছুট্টে গেলাম ছাদে। দেখি পান্না পাঁচিলের ওপর দিয়ে গটমট করে হাঁটছে আর 'মা মা' করে ডাকছে। আমরা সবাই কত ডাকলাম এল না কাছে, সেই একইভাবে গটমট করে হাঁটছে। অভিমান ফেটে বেরোচ্ছে ওর চোখমুখ থেকে। কারোর ডাকে সাড়া না দেওয়ায় মা তখন বলল, "আমি যাই, গিয়ে নিয়ে আসি ওকে। ঠাকুমা বললেন, "বৌমা এই আঁতুড় গায়ে খোলা ছাদে যাবে?" মা বলল, "কি করব মা, নাহলে আসবে না যে, গিয়ে মান ভাঙাই ওর"।
           মা ছাদে গিয়ে 'পান্না' বলে ডাকতেই 'মা মা' করে যেন দৌড়ে এল। মা গায়ে হাত বুলিয়ে ওকে নিচে নিয়ে এল। কিছুদিন পর আমার ছোটকাকা এল ভাই দেখতে। কিছুক্ষণ থেকে গল্পগুজব করে যাবার সময় ছোটকাকা জুতোটা পরতে যাবার সময় পান্না ডানা ঝটপট করে চিৎকার করতে লাগল। ছোটকাকা বলল, "দেখো বৌদি, আমায় যেতে দেবে না"। সবাই হাসলাম। আবার জুতো পরতে যেতেই ওরকম শুরু করল।  বাবা বললেন, "কি জানি জুতোয় কিছু ঢুকল নাকি? ও হয়তো দেখেছে কিছু তাই ওরকম করছে। তুই জুতোটা ঝেড়ে পর"। মা তখন বলল,"ঠাকুরপো তুমি বরং হাত দিও না জুতোয়, একটা লাঠি দিয়ে জুতোটা উঠোনে ফেলো কিছু থাকলে বেরিয়ে যাবে। হাতের কাছে বাবার বড় ছাতাটা ছিল, ছোটকাকা সেটা দিয়ে ধরে জুতোটাকে উঠোনে ছুঁড়ে ফেলতেই একটা সাপ তার ভেতর থেকে হিলহিল করে বেরিয়ে গেল। ছোটকাকা বলল, "পান্না আজ আমায় বড় বাঁচা বাঁচিয়ে দিল রে। আমরা এতগুলো মানুষ যা দেখতে পাইনি, পান্না, একটা ছোট্টপাখি, তা দেখে কেমন সতর্ক করে দিল। আমরা সবাই পান্নার গর্বে তখন গর্বিত।



খুকুর তারা
রাজীব তন্তুবায়

একটু আগে বৃষ্টি হলে  
উঠোন ভরা জল,
ঐক্যতানে উচ্চস্বরে
ডাকছে ভেকের দল।
শির্ শির্ শির্ হালকা হাওয়ায় 
প্রদীপ নিভে যায়,
হাতের পড়া ফেলে খুকু 
হাত দিয়ে বাঁচায়।

ওই পাড়াতে তবলা বাজে
ধা ধিন ধিন ধা,
পায়রা-খোপে পায়রাগুলো
ডিমেতে দেয় তা।
হঠাৎ এক গঙ্গা ফড়িং
এলো কোথা থেকে,
খাতার ওপর বইয়ের ওপর
লাফায় থেকে থেকে।

খুকুর মনে কী আনন্দ
খুশির ছড়াছড়ি,
"ও মা, দেখো কী এক ফড়িং
এসো তাড়াতাড়ি।"
নাইবা এলো ডাক শুনে মা
ব্যস্ত এখন কাজে,
রুটির সাথে উনোনশালে
তপ্ত আগুন ঝাঁজে।

হঠাৎ ফড়িং লাফ দিয়ে যেই
বাইরে এসে পড়ে,
খুকুও তাকে ধরবে বলে
তার পিছনে দৌড়ে।
বাইরে আবার চাঁদ উঠেছে
মেঘ যে গেছে সরে,
হাজার আলোর তারায় তারায়
আকাশ ওঠে ভরে।

অবাক চোখে ভাবছে খুকু
তারার পানে চেয়ে,
রূপকথার ওই নীল-পরীরা
ওইখানের‌ই মেয়ে?
ওইখানেতে হয়তো আছে
সুখ-সারীদের বাসা,
নীল-পরীদের আপন যারা
ভীষণ তাদের পোষা।

গন্ধরাজের গন্ধে ভরা 
গাছের তলা ভুলে,
উড়ে এলো জোনাকি এক 
বসল খুকুর চুলে।
দু'হাত দিয়ে ধরলো তাকে
ছুটল মায়ের কাছে,
"ও মা, দেখো একটা তারা 
পেলাম হাতের কাছে।"

মা হেসে কয়, "দুষ্টু খুকু,
ছাড়বে ওকে কি?"
নয়কো তারা, ছোট্ট পোকা
আলোর জোনাকি।"
মায়ের কথায় খুকুর তখন 
ভীষণ হল রাগ,
নয়কো তারা? জোনাকি এ?
যা, তাহলে ভাগ।

উড়ছে পোকা আলোয় ভরা
হাজার প্রশ্ন মনে,
ভাবছে খুকু জোনাকি তারায়
অমিলটা কোনখানে?
মায়ের কাছে অমিল আছে
খুকুর কাছে নেই,
তার কাছেতে তারাও যেমন
জোনাকিও সেই।



 পোস্টার  
 সোনালী জানা

গ্রীষ্মকালের রোদ! মাথা ফেটে যাওয়ার জোগাড়! তাই সকাল সকাল বাজারটা সেরে গ্রামের পথে ফিরছেন কালিপদবাবু। ব্যাগ ভর্তি বাজার। বেশ হিসেব করে দেখে বেছে জিনিস কিনেছেন। এখন একটা ভারিক্কি চালে চলেছেন।

স্কুল মোড়টায় এসে থমকালেন। লোকজনের ভিড়। আবার কীসের জটলা? কালিপদবাবুর কপাল গেলো কুঁচকে।
ওঃ, এখন তো মর্নিং স্কুল। ছেলেমেয়েরা লাইন করে রাস্তা পেরোচ্ছে...সামনে মাস্টার দিদিমনিরা।
ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের হাতে ব্যানার|রঙিন ফেস্টুন। বেশ হইহই করে চলেছে সব। একদল ছড়া বলছে, একদল গান গাইছে।  'এখানে নয়,ওখানে নয়,
মাঠে-ঘাটে কোথাও নয়...
যেতে হবে শৌচালয়।'

ওদের কথা শুনেটুনে কালিপদবাবু রেগে উঠলেন ভীষণ।
  " বলি এইসব হচ্ছে? মাস্টারগুলোর আর কাজ নেই? সকাল সকাল দশটা পোস্টার হাতে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। বলি, পড়াশোনা তো কিচ্ছু নেই! যত্তসব ফাঁকিবাজের দল জুটেছে। এই করেই তো বাচ্চাগুলো উচ্ছন্নে গেলো! আর দেশটাও!"

 মেজাজি গলা শুনে আশেপাশের ভিড় থেকে অনেকেই তাকে দেখছেন। গরম গরম কথাগুলো বলে বেশ একটা আত্মতৃপ্তি পেলেন।

লাইনটা ধীরে ধীরে শেষ হলো। ঘামটাম মুছে কালিপদবাবু এগিয়ে চললেন ব্যাগ হাতে।

কিছুটা এগোতেই কালিপদবাবুর মনে হলো যেন চেপেছে। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো পোস্টার দেখেই হোক.. কিংবা ছড়া-গান শুনে, জোর চেপে গেছে। এখনো তো যেতে হবে অনেকটা পথ |

বাজারের দিকে রাস্তা, লোকজন বেশি। কালিপদবাবু এখন একটু ফাঁকা জায়গা খুঁজছেন।  কিছুদূর এগোতেই স্কুলের প্রাচীর। 

সামনেটা তো ফাঁকাই মনে হচ্ছে। কালিপদ বাবুর মাথার পোকাটা নড়ে উঠলো।

"ভালোই হয়েছে। ছেলেপুলেগুলো এখন সব পোস্টার হাতে রাস্তায় ঘুরুক। এই ফাঁকে... "

স্কুলের লম্বা প্রাচীর শেষ হয়ে যেখানে পেছনে বাঁক নিয়েছে, কালিপদবাবু সেই আড়ালটায় ঢুকে পরলেন তাড়াতাড়ি।

কিন্তু হায়! চমকে উঠলেন কালিপদবাবু। হঠাৎ করেই কোথা থেকে উদয় হলো একদল ছাত্রছাত্রী। হাতে তাদের একগুচ্ছ পোস্টার আর আঠা। কান্ড দেখে তারাও বেশ রেগে গেছে।
সবচেয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার নিজের নাতনি। "স্বচ্ছ ভারত অভিযান"-এর পোস্টারটা তিন্নি কোথায় লাগাবে বুঝতেই পারছে না!



ছোট্ট চড়াই
সুমনা বিশ্বাস


দুটো পাখি আমার ঘরে 
       করলো বাসা
সকাল বিকাল দেখি তাদের 
        যাওয়া-আসা।

কিসের টানে, কে ই বা জানে 
      এলো ঘরে,
ছোট্ট বেলার চড়াই ধরা 
       মনে পড়ে।

অর্থ বিহীন কিচির মিচির 
        শব্দ বাজে
বুঝতে গিয়ে মন লাগে না
        কোনো কাজে।

ক'দিন পরে দুস্টু মিষ্টি 
       হবে ছানা
ঘরের মাঝে বাড়বে তাদের 
       আনা গোনা।

তারপরে তে হঠাৎ তারা
      মেলবে ডানা,
আকাশ তাদের ডাক দেবে যে---
       শুনবে মানা?

শূন্য বাসা থাকবে পড়ে
      ঘরের কোণে,
উড়বে যারা রাখবে কি আর 
       আমায় মনে?



 মা
সমাদৃতা রায়
নবম শ্রেণী
উত্তরপাড়া গার্লস হাই স্কুল
হুগলি

 যখন আমি অনেক বড় হব
বড়ো হয়ে মায়ের মত হব।।
মায়ের মত সাত টা বেজে গেলে রোজ সকালে অফিসে তে যাবো ।
অফিসে গিয়ে করব আমি নানা রকম কাজ ।
মায়ের মত নানা রঙের শাড়ি পড়বো আমি সঙ্গে নানা সাজ।।
রোজ সাত টা বেজে গেলে মা যখন ফেরে অফিস থেকে।।
তখন সব ভুলে যাই আমি।
ঝাপাই গিয়ে মায়ের বুকে সুখে।।



 আয়োজন
প্রীতি জ‍্যোতি
অষ্টম শ্রেণি
কোমধাড়া মথুরকুড় উচ্চ বিদ‍্যালয়

অনেক দিন পর আমরা গ্রামের বাড়ি এলাম একটা বিশেষ অনুষ্ঠানে। সেটা হল দাদু ঠাম্মার বিবাহ বার্ষিকী পালন করার জন্য। আমরা ছয় ভাই বোন মিলে একটা হোয়াটস এপ গ্রুপে ঠিক করেছি কি কি আয়োজন করা হবে। 

গ্রামের বাড়িতে বড়ো জেঠু থাকে দাদু ঠাম্মার সাথে।আমার বাবা মেজো আমরা থাকি ভূপালে আর ছোট কাকু থাকে চেন্নাই। জেঠতুতো দাদা দিদি বাপুনদা আর বুল্টিদি ওরাই প্ল‍্যানটা করেছে আমাদের সবাই কে একসঙ্গে জমায়েত করার জন্য। আসলে কোভিডের জন্য স্কুল কলেজ বন্ধ পড়াশোনার তেমন চাপ নেই, যা হচ্ছে অনলাইনে।
           দাদুর কাঠের ব‍্যবসা সেটা জেঠু চালায় এখনো। গ্রামের বাড়ির কথা  মনে পড়লেই সেই কাঠ চেরাই করার মেশিনের বিকট  শব্দ মনে পরে। ভাবলে এখনো গা শিউরে ওঠে। মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি গুদাম ঘরে সাজানো। সেই ঘরে ঢুকলে মনে হয় অ‍্যানাকোন্ডার মতো গিলতে আসছে। আমার দিদি বুড়ি খুব সাহসী ঐ ঘরে ঢুকে আমাকে বুড়ো বুড়ো বলে জোরে জোরে ডাকে। সেই ডাক চারিদিকে গমগম করে, আমি যত ভয় পেয়ে পালাতে থাকি ও পেছন থেকে আমার জামা ধরে টেনে তত চিৎকার করতে থাকে। একবার আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম তার জন্য বুড়ি খুব বকুনি খেয়েছিল সবার কাছে।
           যাইহোক, যথারীতি আমরা অনুষ্ঠানের আগের দিন সকালে আর ছোটকাকু, কাকিমা , লতা - মালা দুপুরের মধ্যে পৌঁছালাম। লতা - মালা যমজ আমি ওদের কে এখনও গুলিয়ে ফেলি। ওরা বেশিরভাগ একই রকম ড্রেস পরে। তাই আরই গুলিয়ে ফেলি। একবার দুটো ডেয়ারি মিল্ক লতাকে না দিয়ে মালাকেই দুবার করে দিয়ে ফেলেচগিলাম। মালা তো  আর দেবে না লতাকে। তাই লতার কান্না আর থামানো যায় না।
           এখন লতা-মালা অনেকটাই বড়ো হয়ে গেছে। বেশ দেখতেও হয়েছে। বিকেল থেকে আমি, বুড়ি বেলুন ফোলাতে লাগলাম আর লতা - মালা বেলুনের ওপর হ্যাপী এনিভার্সারি দাদু ঠাম্মা ইত্যাদি লিখল। আমরা সঙ্গে করে  অনেক সাজানোর জিনিস এনেছিলাম। সেগুলো দিয়ে সমস্ত ঘর সাজালাম। রজনীগন্ধা, জুঁই, গোলাপ ফুল দিয়েও সাজালাম। ফুলের গন্ধে সমস্ত ঘর ভরে গেল। দাদু - ঠাম্মার বসার জন‍্য সোফাটাকে সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হলো। বাপুনদা আর বুল্টিদি দাদু - ঠাম্মার ড্রেস কিনতে গেছে। আমি টোপর কিনতেও বলে দিয়েছি। খাওয়া-দাওয়ার দিকটা বড়োরা দেখছে। আমাদের আয়োজন দেখে দাদু -ঠাম্মা তো খুব খুশি। আমাকে দাদু কাছে ডেকে বলল-" ঠাম্মাকে খুব সুন্দর করে সাজাবে।"
           সব কাজ করে সকালের এলার্ম দিয়ে সবাই ঘুমাতে গেলাম। ডাইনিং রুমের ঘড়িটা যেমন বড়ো তেমনই তার আওয়াজ। এলার্ম দিলে সবাই একই টাইমে ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য। নতুবা দুটো তিনটে বালিশ কানে চাপা দিয়ে আর একটু বেশিক্ষণ ঘুমানো যায়। সাধারণত এই ঘড়িতে এলার্ম দেওয়া হয় না। শুধুমাত্র আগামীকাল একসঙ্গে ওঠার জন্য বাবাকে বলে এলার্ম সেট করিয়ে নিয়েছি।
           এলার্ম বাজতেই আমি ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। উঠেই দেখি ঘড়িতে আটটা বাজে। বড়োরা ডাইনিং রুমে বসে চা খাচ্ছে। সাথে বাপুনদা আর বুল্টিদিও। আমাকে দেখে বাপুনদা হা - হা করে হেসে উঠল। আমি বললাম ৬ টায় এলার্ম দেওয়া হয়েছিল আমার, বুড়ি আর লতা - মালার জন্য। আমি খুব রেগে গেলাম। তখনই বুল্টিদি বলল " বুড়ো তোরা তো কাল অনেক জার্নি করে এসেছিস তাই আমি বললাম এলার্মটা পিছিয়ে দিতে। আর দেখ প্রায় রেডি।
           দাদু - ঠাম্মাকে আমরা সবাই মিলে সাজালাম। ঠাম্মা টোপর পরতে চাইল না। দাদুকে যেমন সাজাই তেমনই সাজে। দাদু ঠাম্মাকে কি যেন বলল ঠাম্মা তারপর বুল্টিদিকে টোপরটা পরিয়ে দিতে বলল। আমরা সবাই মিলে গ্রুপ ফটো তুললাম সাথে সাথেই ফটো ফেসবুকে পোস্ট করলাম। খাওয়া -দাওয়াও দুর্দান্ত হল। দাদু সুগার পেসেন্ট। তা সত্ত্বেও জোর করে ঠাম্মার নিষেধ এড়িয়ে  কয়েকটা মিষ্টিও খেয়ে ফেলেছে। দাদু বলে আজকের দিনে না খেলে হয়!
           সন্ধে থেকে দাদুর বড়ো বড়ো হাই উঠতে লাগল। আমি বললাম দাদু আমরা এত পরিশ্রম করলাম আমাদের ঘুম এল না তোমার এত তাড়াতাড়ি ঘুম চলে এল। দাদু বলল - কি জানি.....অনেক আনন্দে অনেক খেয়ে ফেলেছি তাই.....। ঠাম্মা তো সন্ধ‍্যা হলেই  জি বাংলা চালিয়ে বসে পরপর সিরিয়াল দেখতে লাগল।
           আজ আমরা রাত্রে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে দরজায় ধাক্কার শব্দ শুনলাম কে যেন ডাকছে বুড়ো - বুড়ি তাড়াতাড়ি ওঠ। আমরা দুজনে তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুললাম। দেখলাম দাদু  নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। দাদু যেন ঠাম্মার কান্নার আওয়াজ একটুও শুনতে পাইনি। সবাই কাঁদছে। আমরা দাদুর কাছে গিয়ে দাদুকে ডাকলাম - দাদু...ও দাদু.... দাদু.....ওঠ..। 
এম্বুলেন্স এল। দাদুকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাবারা রাতে সন্ধেবেলায় হাসপাতাল থেকে ফিরে বলল, দাদুর একটা অপারেশন হলেই দাদু বাড়ি ফিরে আসবে। আমরা সকলে সে কথা শুনে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলাম। 

সেইদিন থেকে যতদিন না দাদু হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরে ততদিন রোজ রাতে আমরা ঠাম্মার কাছে শুয়ে গল্প শুনতে লাগলাম। কোন দিন রামায়ণের, কোনদিন মহাভারতের...
 

 


স্মরণীয়
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র
কলমে - পীযূষ প্রতিহার

 তোমরা কি কেউ রেডিও শোনো? অন্তত মহালয়ার ভোরে রেডিওতে 'মহিষাসুরমর্দিনী'? হ্যাঁ, ঐ ভাঙ্গা ভাঙ্গা, হাস্কি গলায় যিনি 'মহিষাসুরমর্দিনী'র ভাষ্যপাঠ এবং চণ্ডীপাঠ করেন উনিই হলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। ১৯০৫ সালের ৪ আগষ্ট কলকাতার আহিরীটোলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা ছিলেন রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ভদ্র, মাতা সরলাবালা দেবী। ছোটোবেলায় ডিপথেরিয়া রোগের হাত থেকে বেঁচে গেলেও চিরকালের জন্য স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ। সেই কারণে প্রথম বার রেডিওর অডিশনে বাতিল হয়ে যান তিনি। পরে একটি রেডিও নাটকে রাক্ষসের চরিত্রে কাউকে পছন্দ হচ্ছিল না প্রযোজকের। তখন ডাকা হয় বীরেন্দ্র কৃষ্ণকে তার অদ্ভুত কণ্ঠস্বরের জন্য। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একের পর এক নাটকে অভিনয়, একাধিক নাটক পরিচালনা, গ্রন্থনা, নাট্যরূপ রচনা, ধারাবিবরণী সহ যেকোনো অনুষ্ঠানে তার ছিল অসম্ভব দক্ষতা। ক্রমে রেডিওর সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আর বাণী কুমার ভট্টাচার্যের গ্রন্থনায়,পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সঙ্গীত পরিচালনায় ১৯৩১ সালের মহালয়ার ভোরে 'মহিষাসুরমর্দিনী' নামে যে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছিল তা তাকে অমর করে রেখেছে। আজও ঐ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাঙালির দুর্গোৎসবের সূচনা হয়।
১৯২৪ সালে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ১৯২৬ এ আই.এ. এবং ১৯২৮এ বি.এ. পাশ করেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়া শুরু করলেও শেষ করেননি তিনি। ১৯২৮ সালেই ইষ্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের ফেয়ারলি প্লেসের হেড অফিসে ক্লার্কের চাকরি নেন তিনি। ঐ বছরই যোগ দেন রেডিওতে,'ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি'তে। এই কোম্পানি ১৯৩০ এ অর্থনৈতিক সংকটে পড়লে কেন্দ্রীয় সরকার ১লা এপ্রিল ১৯৩১ থেকে রেডিও অধিগ্রহণ করে। ঐ সময়েই প্রথমে মেঘদূত ও পরে বিষ্ণুশর্মা ছদ্মনামে 'মহিলা মজলিস' নামে শুধু মহিলাদের জন্য একটি অনুষ্ঠান শুরু করেন।যা ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল।'সবিনয় নিবেদন', 'বিরুপাক্ষের আসর', ' আবৃত্তি', 'পঞ্চভূতের আসর' ছাড়াও স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান,গল্প পাঠের আসর,মিথোলজিক্যাল গল্পের নানা জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের স্থপতি ছিলেন তিনি। নাট্যকার হিসেবে ১৯৩৫এ 'সীতা' ছিল তার প্রথম ব্যবসা সফল রেকর্ডিং। বিরুপাক্ষ ছদ্মনামে অনেক হাস্য রসাত্মক নাটক রচনা করেছেন।
১৯৪১ সালের ৭ আগষ্ট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা গেলে নিমতলা শ্মশান ঘাট থেকে নিজের জীবন বাজি রেখে শ্মশানঘাটের ভাঙ্গা কার্নিশে দাঁড়িয়ে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র বলতে শুরু করেন,"সুমুখে দেখছি অপরাহ্নের সুর্য শেষ বিদায়ের পাঠ নিচ্ছে - ভাগিরথীর গৈরিক জলপ্রবাহে উঠেছে এক করুন তাপ---বাতাসে হাহাকার---বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ আর নেই"। সম্ভবত এটাই প্রথম বেতার ধারাবিবরণীর ঘটনা। যা আজও অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশনে রক্ষিত আছে।
   তার কাজের প্রতি ভালোবাসা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও দূরদর্শিতা ছিল প্রশ্নাতীত। ১৯৭০ সালে ৬৫বছর বয়সে তিনি রেডিও কলকাতা থেকে অবসর নেন।১৯৮০ সালে তাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরষ্কারে ভূষিত করে।১৯৯১ সালের ৩নভেম্বর এই প্রথিতযশা বেতার শিল্পীর জীবনাবসান হয়।



ফুলকুসুমপুর খুব কাছে ২১
রতনতনু ঘাটী

ফুলকুসুমপুরের ত্রিপাঠীবাড়ির সব নিয়মই ইচ্ছেদাদুর মাথা থেকে আসে। যেমন এ বাড়ির জন্যে এরকম একটা নিয়ম আজ বছর পাঁচেক আগে তৈরি করে দিয়েছিলেন। সে নিয়ম এখনও চলছে। সেই নিয়মটা হল, দু’বেলাই বাড়ির কোনও কোনও রান্নামাসি রান্না করবে না। দাদু বলেছিলেন, ‘আমাদের বাড়ির তিনজন বউমা, বদলে-বদলে তিনজনই রান্না করবে। আমি বউমাদের হাতের রান্না না খেয়ে তৃপ্তি পাই না! মানে যদি মাধুরীবউমা প্রথম দু’ মাস রান্না করে, করবীবউমা ওই দু’ মাস করবে সকালবেলার ব্রেকফাস্ট আর বিকেলবেলার স্ন্যাক্স। আর বকুলবউমা এই দু’মাস ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার জন্যে রেডি করে দেবে—অতিথি আপ্যায়ন সামলাবে।’
   ঠাকুরমা তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমার কাজটা তা হলে কী হবে?’
   ‘তোমার কাজ?’ বলে দাদু হো-হো করে বলেছিলেন, ‘তুমি তো চব্বিশ ঘণ্টা ঘড়ির কাঁটার মতো সকলের মাথার উপর ঘুরঘুর করবে, সব তদারক করবে ! তুমি না থাকলে এ সংসার চলবে নাকি? তবে হ্যাঁ, কুয়াশামাসি দিনে দু’বার আসে আমাদের বাড়িতে। মানে তোমার ওই জয়তীর কথা বলছি। ওকে দিয়ে যা কাজ করিয়ে নেওয়ার, তুমিই করিয়ে নিও। আর বিলম্বকুমারকে সামলানোর কাজটি তোমাকেই নিতে হবে কিন্তু, এই আমি বলে রাখলাম!’ 
   একরমই সব ঠিকঠাকই চলছিল। এ বাড়িতে বিলম্বদাদুকে কোনও কাজের কথা বললে সে গজগজ করে ঠিকই, সময়ে কাজটা না শেষ করতে পারলেও এক সময় শেষ করে বইকী! তবে ছোটরা লক্ষ করে দেখেছে, বিলম্বদাদুর একটা কাজে উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। সে কাজটি হল, কাগজওলাকে ডেকে ওদের পুরনো খাতা আর বইপত্র বিক্রি করার ব্যাপারে। ইচ্ছেদাদু বলে দিয়েছেন, ‘বিলম্ব, এসব জঞ্জাল বাড়িতে যেন মাসের পর-মাস জমে না থাকে! তুই কাগজওলাকে ডেকে বিক্রি করে দিবি। তবে হ্যাঁ, ওই বিক্রির টাকা তোর। ও টাকা তোকে এ সংসারে দিতে হবে না!’ 
   সেই কবে থেকে বিলম্বদাদু পুরনো বইখাতা বিক্রি করে টাকা জমিয়ে রাখছে। কেননা, তেমোহানি নদীর ওপারেও নাকি একটা দড়ি-বাঁধা খেয়া পেরনো নদী আছে। এই দুটো নদী পেরিয়ে সারাদিন ধরে টানা হাঁটলে তবে নাকি বিলম্বদাদুর গ্রামের বাড়ি। কখনও সে গ্রামের নাম কী, বিলম্বদাদু মনে করে বলতে পারে না। সেই কোন ছেলেবেলায় কীভাবে যে তেমোহানি নদীর ধারে সে চলে এসেছিল, তার কিচ্ছুটি মনে নেই। তার আসল নামটাও যে কী, সেও মনে করে বলতে পারে না। 
   কিন্তু সেদিন যে ঘটনা ঘটে গেল, সেটা ত্রিপাঠীবাড়ির পক্ষে খুবই কষ্টের। ছড়াপিসিরা দুমকা ফিরে যাওয়ার ঠিক পরের শনিবারের ঘটনা। বিকেলে ইচ্ছেদাদু একটা সাদা খাতা কিনে আনতে পাঠিয়েছিলেন বিশালক্ষ্মী স্টোর থেকে বিলম্বদাদুকে। বিকেলে দাদুর দু’জন বন্ধুরও আসার কথা ছিল। তাই তাঁদের জন্যে চারটে মিঠাইও আনতে বলে দিয়েছিলেন। দাদুর দোষ হল, বিলম্বদাদুকে কাগজে লিখে দেননি কী কী আনতে হবে।
   তারপর হল কী, দাদুর সেই দুই বন্ধু বিকেলে এলেন, ফিরেও গেলেন সন্ধেবেলা। তাঁদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা গেল না। রাতে ডিনারের সময় সকলে যখন খাওয়ার টেবিলে, অমন সময় বিলম্বদাদু যাত্রাদলের সেনাপতির ভঙ্গিতে বাড়িতে এসে ঢুকল। 
   ইচ্ছেদাদু রাগত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাত্র দুটো জিনিস আনতে পাঠালাম সেই কোন বিকেলবেলা? আমার অতিথিরা এসে চলেও গেলেন। এই তোর আসার সময় হল রে বিলম্ব?’
   বিলম্বদাদু মাথা চুলকে জিনিস দুটো দাদুর সামনে খাওয়ার টেবিলে রেখে বলল, ‘এই তো গেলুম, আর ফিরে এলুম। তোমাদের সব কিছুতেই বড্ড তাড়া।’
   ইচ্ছেদাদু জিনিস দুটোর দিকে তাকিয়ে ভীষণ রেগে গেলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ রে হতভাগা, তোকে একটা খাতা আর চারটে মিঠাই আনতে পাঠালাম। আর তুই তিনঘণ্টা পরে কিনা একটা মোমবাতি আর আড়াইশো গ্রাম মুড়ি কিনে এনেছিস? ছিঃ, ছিঃ! তুই এক্ষুনি আমার সামনে থেকে চলে যা! আমি তোর মুখ দেখতে চাই না।’ 
   খাওয়ার টেবিলটা থমথম করে উঠল। মিনিট কয়েক চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বিলম্বদাদু হঠাৎ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ইচ্ছেঠাকুরমা বললেন, ‘আহা-হা, তুমি বিলম্বকে অমন করে বকলে কেন বলো তো? মানুষটা বুড়ো হয়েছে। তাই ভুলোমনের অসুখটা ওর এখন একটু না হয় বেড়েছে। তা বলে কি অমন করে বকতে হয়?’
   দাদু কোনও উত্তর দিলেন না। গম্ভীর মুখে খাওয়া শেষ করে উঠে দোতলায় শোবার ঘরে চলে গেলেন। 
   ঠাকুরমা মাধুরীজেম্মাকে বললেন, ‘দ্যাখো তো বড়বউমা, বিলম্ব কোথায় গেল? মনে হয় একতলায় বসার ঘরে ওর পেতে শুয়ে পড়েছে। বাবুর আবার অভিমানও তো কম নয়!’
   মাধুরীজেম্মা চারদিকে খুঁজে এসে বললেন, ‘মা, বিলম্বদাদুকে কোত্থাও দেখতে পেলাম না তো?’
   কাকাদেরও খাওয়া শেষ হয়ে এসেছে। ঠাকুরমা শুধুকাকাকে বললেন, ‘দ্যাখ তো রে শুধু, বিলম্ব কোথায় গেল? যা, রাগ ভাঙিয়ে ডেকে আন!’
   ছোটদের বুকটা তখন ভয়ে দুরুদুরু করছে। ঠাকুরমা ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যাও, তোমরা শুতে যাও! বিলম্ব কোথায় আর যাবে অন্ধকারে? ও যা ভিতু! দ্যাখো, অন্ধকারে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে।’
   একতলা, দোতলা, দোতলার বারান্দা, নীচে সামনের বাগান, বাড়ির পাশের চালতা গাছের নীচে, বাতাবিলেবুর ঝোপজঙ্গলে, ঘাটপুকুরের পাশের করঞ্জাতলায়, না কোত্থাও পাওয়া গেল না বিলম্বদাদুকে। শুধুকাকা, গল্পকাকা, বড়বাবু, সকলে খুঁজে হতাশ হয়ে ফিরে এলেন। সেই খবরটা দাদুর কানে পৌঁছে দেওয়া হল। 
   ইচ্ছেদাদু ভেজা-ভেজা চোখে ঠাকুরমাকে বললেন, ‘বড় বাড় বেড়েছে! কোত্থাও খুঁজতে হবে না। যেদিকে গেছে যাক। ওর আর এ বাড়িতে ঠাঁই হবে না, এই আমি বলে দিলাম।’
    জেঠিমা-কাকিমাদের অনুরোধ, কাকাদের অনুনয়, ঠাকুরমার জলভরা চোখ, কিছুতেই ইচ্ছেদাদুকে টলানো গেল না। ঠাকুরমা না খেয়েই শুতে চলে গেলেন। মাধুরীজেম্মা, করবীকাকি আর বকুলকাকিও এক টুকরো খাওয়ারও মুখে তুলতে পারলেন না।
   এত রাতেও রাধাগোবিন্দ কিছু একটা বিপদের আঁচ পেয়ে ‘ট্যাঁ-ট্যাঁ’ করে কোনও কথা যেন বলতে চাইল। মিঁউ হঠাৎ চঞ্চল চোখে চারদিকে তাকাতে লাগল। বিংগো ‘ভৌ-ভৌ’ করে কয়েকবার ডেকে থেমে গিয়ে রাগে গরগর করল অনেকক্ষণ। কুমি খাঁচার ভিতরে নরম ঘাসের মধ্যে মুখ লুকিয়ে নিজেকে লুকনোর চেষ্টা করছিল। তখনও ছোটদের চোখে একফোঁটা ঘুমই এল না।
   একটা বড় কোনও বিপদের গন্ধ ভেসে আসতে তিন্নির বাবা মুখটা গম্ভীর করে বেরিয়ে গেলেন ফুলকুসুমপুর পুলিশ স্টেশনের দিকে। যাওয়ার সময় ইচ্ছেঠাকুরমাকে বলে গেলেন, ‘মা, দিনকাল তো ভাল নয়। আমার মনে হয়, বিলম্বদাদুর জন্যে থানায় একটা মিসিং ডায়েরি করে রাখা ঠিক হবে।’ 
(এর পর আগামী রোববার)


গল্পে গল্পে ক্যুইজ 
রাজীব কুমার ঘোষ

পর্ব ৮

কী করে টাইম মেশিন বানাতে হয় (পর্ব ২)

আজ কথা ছিল তোমাদের অতীতে যাবার টাইম মেশিন বানাবার কৌশল শেখাবার। তার আগে আগের দিনের ক্যুইজের উত্তরগুলো আমরা দেখে নিই।

উত্তর পর্ব ৭
১।। “The Time Machine” পৃথিবী বিখ্যাত এই কল্পবিজ্ঞান কাহিনির লেখক হলেন হার্বাট জর্জ ওয়েলস্ যাকে আমরা সবাই এইচ জি ওয়েলস্ নামেই চিনি। দ্য টাইম মেশিন, এইচ জি ওয়েলস্-এর প্রথম ‘নভেল’ বা উপন্যাস। তোমরা মনে রাখবে সালটা হল ১৮৯৫, তখন কিন্তু সায়েন্স ফিকশন এখনকার মতো এত বহুল চর্চিত বিষয় ছিল না। আমরা যখন প্রথমদিকের সায়েন্স ফিকশন নিয়ে আলোচনা করি তখন তিনটি নাম আমাদের মুখে উঠে আসে, মেরি শেলি (তার ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাসের জন্য), এইচ জি ওয়েলস্ এবং জ্যু়ল ভ্যের্ন্। এরাই হলেন সায়েন্স ফিকশনের আদি লেখকবৃন্দ। তোমরা খেয়াল করবে নামের বানানে আমি ‘জ’ এর তলায় একটি ডট্ বসিয়েছি ‘জ়’। কেন বসিয়েছি এই নিয়ে আমরা পরে আরেকদিন গল্প করব।

২।। এই চলচ্চিত্রটি হল ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার’ যার তিনটি পার্ট আছে। প্রথমটি ১৯৮৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল, পরের দুটি যথাক্রমে ১৯৮৯ এবং ১৯৯০ সালে। তোমরা সম্ভব হলে পর পর এই তিনটি চলচ্চিত্র দেখে নেবে। অনাবিল আনন্দ পাবে। 

৩।। ইন্টারস্টেলার চলচ্চিত্রের পরিচালক হলেন ক্রিস্টোফার নোলান। আমার এক ছাত্র তাকে গড ক্রিস্টোফার নোলান বলে অভিহিত করেছিল। আমি অবাক হয়েছিলাম, কিন্তু পরে তার চলচ্চিত্রগুলি দেখে আমার মনে হল এই অভিধা সার্থক। আমরা জানি লেখকদের দ্বিতীয় ঈশ্বর বলা হয়, কারণ তারাও সৃষ্টি করেন, সেই অর্থেই অবশ্যই এই পরিচালক ওই ‘গড’ অভিধার যোগ্য। আমি নিজেও ক্রিস্টোফার নোলানের ভক্ত। কল্পনার যে সীমা হয় না তা তার সৃষ্ট চলচ্চিত্রগুলি দেখলে বোঝা যায়। তার চলচ্চিত্রগুলির নাম আমি বলব না। নিজেরা একটু খুঁজে নাও। কোনো কিছু খুঁজে বার করলে তা মনে স্থায়ী হয়। 

৪।। হ্যারি পটারের ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য প্রিজনার অফ আজকাবান’ পর্বে আমরা টাইম ট্রাভেলের দেখা পাই। 

৫।। সেই বিখ্যাত হিট হিন্দি ছবিটি হল ‘ক্রিশ’। এটি ২০০৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল। এর আগের পর্বটি হল ‘কোয়ি মিল গেয়া’ (২০০৩) এবং পরের পর্বটি হল ক্রিশ ৩ (২০১৩)।

আমি আগের পর্বেই বলেছিলাম অতীতে যাবার টাইম মেশিন কিন্তু এখন থেকেই বানাতে হবে। সঠিকভাবে বললে তোমাদের মধ্যে অনেকেই হয়ত অজান্তে তা বানিয়ে চলেছ আর যারা বানাও নি তারা আজ থেকেই বানাতে শুরু করে দাও।

আজ থেকে কুড়ি বা তিরিশ বছর পরে যখন তোমরা পৌঁছে যাবে তখন তোমরা ঠিক আজকের দিনটিতে ফিরে আসতে পারবে এবং ঠিকঠাক বানাতে পারলে এরপরের প্রতিটি দিনেই ফিরে আসতে পারবে। চলো আমরা দেখে নিই কী ভাবে তা সম্ভব।

 আমি একটি মাত্র সহজ পদ্ধতি বলব। এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে বাকী পদ্ধতিগুলি তোমরাই খুঁজে বার করতে পারবে। সব কিছু বলে দিতে নেই। নিজের যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করার আনন্দ আলাদা। জেনে রাখবে আরো অন্তত দু’টি সহজ পদ্ধতি আছে।

অতীতে ফিরতে চাইলে তোমাদের আজ থেকেই একটি দিনলিপি রাখতে হবে। দিনলিপি যাকে অনেক সময় আমরা প্রতি দিনের ডায়রি বলে থাকি। দিনলিপি যে দামী ডায়রিতেই লিখতে হবে তার কোনো নিয়ম নেই। ভালো পাতার খাতাতেও তা লেখা যায়। শুধু খেয়াল রাখবে ডায়রি হোক আর খাতা হোক পাতাগুলো যেন একটু ভালো হয়, কারণ এগুলোকে অনেক বছর পাড়ি দিতে হবে। ডায়রি লেখার অনেক নিয়ম-টিয়ম তোমাদের হয়ত কেউ কেউ বলেছেন বা স্কুলেও বলেছে আমি বলব তোমার দিনলিপিকে কীভাবে লিখলে তুমি তাকে টাইম মেশিন করে তুলতে পারো। 

১. চেষ্টা করবে রোজ লিখতে

২. রোজ আগে তারিখ লিখবে তারপর স্থান লিখবে, মানে কোথায় বসে তুমি দিনলিপি লিখছ তারপর সময় লিখবে। দিনে একাধিকবার যদি দিনলিপি লেখ তাহলে প্রতিবার সময় উল্লেখ করবে।

৩. প্রতিদিন যা যা করেছ তা সংক্ষেপে, খুব সংক্ষেপে লিখে ফেলার কৌশল তোমরাই বার করে ফেলবে আমি জানি। এই যা যা ঘটছে তার মধ্যে যেটাকে তুমি উল্লেখযোগ্য বলে মনে করছ তা নিয়ে একটু বেশি লিখবে।

৪. রোজ আমাদের রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, দেশের উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা আর আন্তর্জাতিক স্তরে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা সংক্ষেপে লিখে রাখবে।

৫. দিনলিপির কোনো নির্দিষ্ট আকার হয় না। আমি কখনো কখনো দিনে দশ পাতারও বেশি দিনলিপি লিখেছি আবার কখনো মাত্র দু’লাইন। মূল কথাটা হচ্ছে রোজ দিনিলিপি লেখা অভ্যাস করতে হবে, সে যে ভাষাতেই তুমি লেখ।

তোমরা ভাবছ এ আর এমন কী কথা, কিন্তু বিশ্বাস করো এটা খুব সহজ কাজ নয়। যারা দিনলিপি লেখা শুরু করে তারা কিছুদিন পরেই অবহেলা করতে শুরু করে এবং একসময় ছেড়ে দেয়। টাইম মেশিন কিন্তু সবার ভাগ্যে জোটেনা। আমি আজও যখন আমার পুরনো দিনলিপিগুলি পড়ি তখন ফিরে যাই ঠিক সেই দিনটিতে। তাছাড়াও দিনলিপি আমাকে অনেক দিয়েছে দু’হাত ভরে। রোজ দিনলিপিতে নিজের কথা লিখতে লিখতে কখন আমার লেখালেখির হাত তৈরি হয়ে গেছে টেরই পাইনি। কত কল্পনার কথা লিখতে লিখতে কখন গল্প কবিতা লিখতে শুরু করে দিয়েছি অজান্তেই। সবচেয়ে বড় কথা ফিরে ফিরে দিনলিপি পড়ে বুঝতে পেরেছি আমার আগের চিন্তাভাবনায় কী ভুল ছিল, কী ঠিক ছিল। এটা কিন্তু অনেক বড় একটা ব্যাপার, নিজে নিজেকে বিচার করার সুযোগ। 

তোমাদের মধ্যে কার কার
১. বাংলা লিখতে বা ইংরাজি লিখতে সমস্যা হয়?
২. মনোযোগের সমস্যা হয়, কোনো কিছুতে সহজে মনোযোগ দিতে পারো না?
৩. কোনো খুব কাছের বন্ধু নেই, যাকে মন খুলে অনেক কথা বলা যায়?
৪. লকডাউনে খুব মন খারাপ করে বা মাঝে মাঝেই মন খারাপ করে?
৫. লেখক হতে খুব ইচ্ছে হয় বা সাংবাদিক হতে?
তারা অবশ্যই দিনলিপি লেখা শুরু করে দাও। অন্তত এক মাস নিয়মিত লেখার পর একটু ভেবে দেখো ওপরের সমস্যাগুলো কমেছে না কমেনি। 

তোমাদের কথা দিয়েছিলাম আমার টাইম মেশিনে তোমাদের একটু ঘুরিয়ে আনব। আমি আমার দিনলিপি থেকে কিছু লাইন তুলে দিলাম। 

১৩.০৯.১৯৮১ — আজ স্কুলে স্যার বলেছেন (মালিকবাবু) আমার দ্বারা বিজ্ঞান হবে।

২৩.০৪.১৯৯২, বৃহস্পতিবার —  এইমাত্র (সন্ধ্যা ৭.৩০) শুনলাম সত্যজিৎ রায় আর নেই। কান্না পাচ্ছে। সত্যজিৎ রায়ের সাথে প্রফেসার শঙ্কু, প্রদোষ মিত্র সবাইকার মৃত্যু। আর লিখতে পারছি না।

২৪.১১.১৯৯৩, বৃহস্পতিবার, রাত্রি ৯.৩০ — আজ বাংলা পরীক্ষা ছিল। এই প্রথম ডট পেনে পরীক্ষা দিলাম। অসুবিধা যথেষ্ট হয়েছে।

ভেবে দ্যাখো আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমার স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষকের কথায় আমি কতটা উজ্জীবিত হয়েছিলাম। তাই তো এই লাইনটা দিনলিপিতে জায়গা করে নিয়েছিল। সত্যজিৎ রায় চলে যাবার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া লেখা হয়েছে দিনলিপিতে। আর শেষটা পড়ে তোমরা মজাই পেয়েছ। এখন তোমরা সবাই ডট পেনেই লেখ, আমরা কিন্তু কালিপেন বা ফাউন্টেন পেনে লিখে বড় হয়েছি। ডট পেনে আমি লিখতাম বটে কিন্তু প্রথম পরীক্ষাতে লিখেছিলাম এই দিন। আসলে আমাদের একজন স্যার মানা করেছিলেন কালি পেনে লিখতে। ভয় দেখিয়েছিলেন, ফাইনালে কালি পেনে লিখবি তারপর যদি উত্তরপত্র বৃষ্টিতে বা জলে ভিজে যায় বা ধর যিনি পরীক্ষক তিনি বাড়িতে চান করার পর  যদি ভিজে গামছাটা ভুলে খাতার ওপর রেখে দেন? সেই আতঙ্কে আমরা অনেকেই পরীক্ষাতেও ডট পেন ব্যবহার করা শুরু করেছিলাম।

শেষে একটা সতর্কবাণী দিয়ে যাই, দিনলিপি কখনো ডিজিটাল মাধ্যমে লিখবে না, অর্থাৎ ফোনে বা মোবাইলে। প্রথম কথা আজকের সফটওয়্যার আজ থেকে তিরিশ বছর পরে কাজ নাও করতে পারে। ব্যাপারটাই উঠে যেতে পারে। যদি ইচ্ছে হয় দিনলিপির পাতা স্ক্যান করে ডিজিটালাইজেশন করে রাখতে পারো। 
দ্বিতীয় কথা, কোনোভাবে কম্পিউটার বা মোবাইল হ্যাক হয়ে গেলে তোমার ব্যক্তিগত অনেক তথ্য অন্যের হাতে চলে যাবে। দিনিলিপির খাতা যদি বাঁচিয়ে রাখতে পারো তাহলে তা পঞ্চাশ বছর তো টিঁকবেই। 

পরের বার ভবিষ্যতে যাবার টাইম মেশিন বানাবার পদ্ধতি নিয়ে আসছি। এবার আজকের ক্যুইজের পালা। একটি প্রশ্নই থাকবে আজকে।
পৃথিবী বিখ্যাত একটি দিনলিপি হল ‘দ্য ডায়েরি অফ এ ইয়ং গার্ল’। ১৯৪৭ সালে এটি জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়, যে ভাষায় ডায়রিটি লেখা। ১৯৫২ সালে ইংরাজিতে অনুবাদ হয়। তারপর কত যে ভাষায় ছাপা হয়েছে তার হিসাব পাওয়া মুস্কিল, অন্তত ৭০টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, তার চেয়ে বেশিই হবে। শুধু অনুবাদ নয়, নানা দেশে উচ্চ মাধ্যমিক বা কলেজ স্তরে এই ডায়েরি পাঠ্য তালিকাতেও আছে। কে লিখেছিল এই ডায়েরি? কত বছর বয়সে লেখা এই ডায়েরি? কেন অত বিখ্যাত এই ডায়েরি?


পাঠ প্রতিক্রিয়া
( ৪৭ তম ছোটোবেলা সংখ্যা পড়ে ব্যাঙ্গালোরবাসী সুলেখিকা শ্রীপর্ণা দাস ব্যানার্জী যা লিখলেন) 

সম্পাদিকা মৌসুমী ঘোষের  জ্বলদর্চির ছোটোবেলার ৪৭তম এই পত্রিকায় চোখ রাখতেই আমার নজর কেড়েছে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের অপূর্ব সব চিত্রাঙ্কন। সৌনক বসুর আঁকা কালো ঘোড়াটা অসম্ভব সুন্দর ।  রাজদীপ দাস আঁকায় কতটা দক্ষ হলে এমন আঁকা সম্ভব। অনমিতা মুখার্জী, প্রমিত নস্কর, তানভী সাহা, সায়নী কুণ্ডু সবার আঁকার দক্ষতায় আমি সত্যি অবাক। 
এবার আসি গল্পে, বহ্নিশিখা ঘটকের তৈরি টুটুল চরিত্রটি সবচেয়ে মন কেড়েছে আমার। অমন সাদা মনের স্বপ্ন, আহা! ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন, একটু সমুদ্র দেখার, অঙ্কে ভালো ফল করার। অথচ সময়ের পাকে চক্রে তার সমুদ্র দেখা হয়ে ওঠে নি। গল্পের শেষে এসে বোঝা যায় বেচারা স্বপ্ন দেখছিল। টুটুলের সাথে আমার মনটাও খারাপ হয়ে ওঠে। খুব মজা লেগেছিল যখন মাস্ক, হেডশিল্ড পড়া টিটি টুটুলের পিঠ চাপড়ে দেয়। আজকাল সত্যিই কেউ কাছে এসে গেলেই ভয় করে, আমার মনের অনুভূতিটা গল্পে পড়ে বেশ হাসি পেয়েছিল। যেন আমারই মনের কথা।  
অগ্নিযুগের অগ্নিকিশোর - মুক্তি দাশের এই লেখা তো অসামান্য অবশ্যই, এমন লেখা যুগ যুগ ধরে বাঙালীর মন কেড়ে নেবে, ষে বিষয়ে কোনো  সন্দেহ নেই।
 
পরিকল্পনা গল্পটিও একদম অন্যরকম। গল্প পড়তে তখন ভালো লাগে যখন গল্পের শেষটা কি হবে  কিছুতেই ধরা যায় না। এখানে রিম্পার মা নিজেই যে বই সরিয়ে রেখেছেন সত্যি বলছি সেটা মাথায় আসেনি।  একটা ধারণা আমারও হল বলা চলে, আমারও মেয়ে আছে - দরকার পড়লে এই পদ্ধতি আমিও অবলম্বন করতে পারি। আজকাল সত্যি কিন্তু বাংলা মাতৃভাষা হলেও অনেকের কাছে  সেটাই সবচেয়ে শক্ত বিষয়। এটা হতে দেওয়া ঠিক না বলেই এমন গল্পের প্রয়োজন ।  

জম্বি গেম - সৃজিতা দাসের লেখা নিয়ে কি যে বলব জানি না, আসলে ও আমারই মেয়ে। ওকে বেশিরভাগ সময় মোবাইল নামক জিনিসটা দেওয়া হয় না বাড়িতে। মনে হয়ে সেটা থেকেই এই গল্পের জন্ম। ঐ যে কথায় আছে আঙ্গুর ফল টক, বেচারি মোবাইল না পাওয়ার কষ্টে একটা কারণ ভেবে গল্পের ছক খুঁজে বের করেছে, যাতে মোবাইল নিতে ইচ্ছে হলেই গল্পটা মনে পড়ে যায়।  

পীযূষ প্রতিহারের স্মরণীয় প্রবন্ধটি খুবই তথ্যপূর্ণ, আচার্য হরিনাথ দে’র সম্বন্ধে অনেক কিছু মূল্যবান তথ্য আমরা পেলাম এই প্রবন্ধটিতে । 

এছাড়া রতনতনু ঘাটীর ছড়াপিসি, ইচ্ছেদাদু আর ইচ্ছেঠাকুরমা, লিমেরিক আর হাইকুর সাথে তো সামনের রবিবারে আবার দেখা হচ্ছে, অপেক্ষায় রইলাম। আর তাছাড়া টাইম মেশিন বানানোর কৌশল শিখতেও তো রবিবারের অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।  ব্যাস তাহলে আর কি ? জমজমাট লেখার সাথে আবার একটা রবিবারের অপেক্ষা। 

গল্পে গল্পে ক্যুইজ - রাজীব কুমার ঘোষের কথা আলাদা করে কিছু বলার নেই। খুবই জনপ্রিয় বিভাগ এটা। 

প্রত্যাশায় স্বাধীনতা, আমরা করব জয় তো অবশ্যই প্রশংসনীয়; কিন্তু জীবনের লক্ষ্য -  চতুর্থ শ্রেণীর সুহেনা মন্ডল ফুটিয়ে তুলেছে দারুণভাবে। 
সমস্ত লেখক লেখিকা, খুদে শিল্পীর সমন্বয়ে জ্বলদর্চি এগিয়ে চলুক আর সাথে সাথে ছেলেবেলা হয়ে উঠুক রঙে রূপে প্রাণে ভরপুর। অনেক শুভেচ্ছা রইলো সম্পাদিকা মৌসুমী ঘোষের এই দারুণ উদ্যোগকে।


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 


Post a Comment

1 Comments

  1. মৌসুমী মাসি! আজকের গল্পগুলো সব দূর্গাপূজো নিয়ে লেখা। আমি বৈভবী সেনগুপ্ত বলছি। আজ পীষূষ প্রতিহার বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রকে নিয়ে স্মরণীয় লিখেছে। আজকের সংখ্যা পড়তে আমার খুব ভালো লেগেছে। রাজীব আঙ্কেল টাইম মেশিন বানাতে শিখিয়েছে।

    ReplyDelete