জ্বলদর্চি

রাখীবন্ধন : মিলনের উৎসব /প্রসূন কাঞ্জিলাল

রাখীবন্ধন : মিলনের উৎসব 
প্রসূন কাঞ্জিলাল 

ভাই-বোনের ভালোবাসা ও অটুট সম্পর্কের উৎসব রাখী বন্ধন। কিন্তু জানেন কী, শিব-সহ অন্যান্য দেবতাদেরও বোন আছে? রাখীবন্ধন উপলক্ষে জানুন তাঁদের অজানা তথ্য। রাখীবন্ধন উপলক্ষে আসুন জেনে নেওয়া যাক দেবতাদের বোনেদের নিয়ে অজানা উপাখ্যান ,যেমন অনেকে বলে থাকেন যমুনা তাঁর ভাই যমের হাতেও রাখি বেঁধেছিলেন এই দিন। আবার অনেকে বলেন দ্রৌপদীও শ্রীকৃষ্ণের হাতে রাখি বেঁধেছিলেন। পুরাণে আছে একবার কৃষ্ণের আঙুল কেটে যায়, দ্রৌপদী তাঁর গায়ের কাপড় ছিঁড়ে তা বেঁধে দিয়েছিলেন কৃষ্ণের আঙুলে। এর বদলে কৃষ্ণ কথা দেন, যে কোনও বিপদেই তিনি দ্রৌপদীকে রক্ষা করবেন।

আবার অনেকে বলে থাকেন শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার দিনে হতদরিদ্র নারীর বেশে বালির কাছে আশ্রয় চান লক্ষ্মী। বালি নিজের প্রাসাদের দরজা খুলে দেন তাঁর জন্য। খুশি হয়ে লক্ষ্মী, কাপড়ের টুকরো বেঁধে দেন বালির হাতে।

 কথিত আছে গণেশের দুই পুত্র, শুভ ও লাভ বায়না ধরেছিল নিজেদের বোনের হাতে তারা রাখি পরতে চায়। কিন্তু কোনও উপায় নেই। শেষে গণেশের দুই স্ত্রী, ঋদ্ধি ও সিদ্ধির অন্তর থেকে নির্গত অগ্নি সৃষ্টি করা হয় সন্তোষীকে। তার হাত থেকে রাখি বাঁধে গণেশ পুত্ররা।

১) শিব ও তাঁরই সৃষ্ট সহদরা আশাবরী দেবী

শিব-পরিবার সম্পর্কে সকলেই জানেন, কিন্তু খুব কম লোকই জানেন যে শিবের একটি বোনও ছিলেন। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, কৈলাস পর্বতে পার্বতী একাকীত্ব অনুভব করায় তাঁর মনে হয়, ননদ থাকলে খুব ভালো হত। পার্বতীর মনের কথা বুঝে মহাদেব আপন মায়ায় সৃষ্টি করলেন তাঁর বোন আশাবরীকে।পার্বতীর মনের কথা বুঝে মহাদেব নিজের মায়াবী ক্ষমতার সাহায্যে এই বোন সৃষ্টি করেন। তাঁর নাম আশাবরী দেবী।

২) মহাভারতে কৌরবদের এক বোন ছিলেন। তাঁর নাম ছিল দুঃশলা।

৩) রাজা বলির এক ধর্ম বোন ছিলেন। একদা রাজা বলির যজ্ঞে বিষ্ণু বামন অবতার ধারণ করে উপস্থিত হন। সেখানে নিজের পায়ের তিন ধাপের সমান মাপের জমি রাজার কাছ থেকে চান। বামনের পায়ের ধাপে কতটুকুই জমি ধরবে, এই ভেবে বিষ্ণুকে জমি দিতে রাজি হন রাজা। নিমেষের মধ্যে বিষ্ণু সমস্ত ভূমি নিয়ে নেন ও রাজা বলিকে পাতাল লোকে পাঠিয়ে দেন। তখন বলি বিষ্ণুর কাছে বর চান। বিষ্ণুকে সব সময় নিজের সামনে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন রাজা বলি। এই বরের কারণে বিষ্ণু পাতাললোকে রাজা বলির দ্বাররক্ষী হন। সে সময় স্বামীকে ফিরিয়ে আনার জন্য লক্ষ্মী এক সাধারণ মহিলার রূপ ধারণ করে কাঁদতে কাঁদতে পাতালে পৌঁছন। সেখানে রাজা বলি লক্ষ্মীকে তাঁর দুঃখের কারণ জিগ্যেস করায়, তিনি বলেন, তাঁর কোনও ভাই নেই। এর পর রাজা বলি লক্ষ্মীকে নিজের বোন পাতান। মনে করা হয়, তখন থেকেই রাখীবন্ধন উৎসব পালিত হয়।


৪) যমরাজের বোন যমুনার কথা অনেকেই জানেন। একবার যমুনা নিজের ভাই যমকে আমন্ত্রণ জানান। যম নিজের বোনের বাড়ি গেলে, যমুনা সেখানে তাঁকে ভোজন করান। প্রসন্ন হয়ে যম বর দিতে চান। যারা তাঁর জলে স্নান করবে, তারা কখনও যমলোকে যাবে না, এমন বর চান যমুনা। বর শুনে চিন্তিত হয়ে পড়েন যম। ভাবেন, এভাবে যমলোকের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হবে। ভাইকে চিন্তিত দেখে যমুনা ফের বর চান যে, এদিন যে ভাই নিজের বোনের বাড়িতে আহার করবে ও যমুনার জলে স্নান করবে, তাঁকে যমলোকে প্রস্থান করতে হবে না। তখন থেকে যমদ্বিতীয়া পালিত হচ্ছে।

৫) রোহিণী-কন্যা সুভদ্রা কৃষ্ণের বোন ছিলেন। আবার যশোদার গর্ভ থেকে যোগমায়া হিসেবে জন্ম নেন দেবী সতী। কৃষ্ণের সঙ্গে পাল্টে বাসুদেব যোগমায়াকেই মথুরা নিয়ে যান। এ ভাবে যোগমায়া কৃষ্ণের বোন। পাশাপাশি দ্রৌপদীকে কৃষ্ণ নিজের বোনের সম্মান দিতেন।

৬) রামের ভাই সম্পর্কে সকলেই জানেন। কিন্তু রামের এক বোনও ছিলেন। তাঁর নাম ছিল শান্তা। রাজা দশরথ ও কৌশল্যার বড় মেয়ে ছিলেন শান্তা। জন্মের কয়েক বছর পর রাজা দশরথ কিছু কারণবশত অঙ্গদেশের রাজা রোমপদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের কন্যাকে। এর পর রাজা রোমপদ ও তাঁর স্ত্রী শান্তার লালন-পালন করেন।

৭) রাবণের বোন শুর্পনখার নাম সকলেরই জানা। তবে জানেন কী, রাবণের আর এক বোনও ছিলেন। তাঁর নাম ছিল কুম্ভিনী। মধু নামক এক রাক্ষস কুম্ভিনীর অপহরণ করে। ক্রোধবশত মধুকে করতে পৌঁছলে বোনের কাছ থেকে রাবণ জানতে পারেন যে, মধু রাক্ষস কুম্ভিনীর সঙ্গে বিবাহ করেছে।


বঙ্গভঙ্গ, রাখীবন্ধন এবং রবীন্দ্রনাথ 

আজ রাখী। স্বাধীনতা প্রাপ্তির আড়ালে থাকা দীর্ঘ সংগ্রামের সঙ্গে রাখীবন্ধনের এক গভীর যোগ রয়েছে। ফিরে দেখা যেতে পারে সেই ইতিহাস।

শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমায় ভাইয়ের হাতে বোনেরা রাখী বেঁধে দেন। মূলত ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় এই রীতি চলে আসছে। অবাঙালীদের কাছে রাখী বন্ধন রক্ষাবন্ধন নামেও পরিচিত। কিন্তু বাঙালীদের কাছে রাখী কেবলই ভাই বোনের মধ্যে আবদ্ধ নয়। এছাড়া ধর্মীয় ও সামাজিক গণ্ডি পেরিয়ে রাখীকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও জায়গা দিয়েছে বাঙালিই। আর বাঙালির এই রাখী বন্ধনের প্রসঙ্গে উঠে আসবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। 

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করতে রাখীকে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই  বছরের ১৯শে জুলাই ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের কথা ঘোষণা করে। জানানো হয়, এই আইন কার্যকরীর হবে ১৯০৫ এরই ১৬ই অক্টোবর, বাংলায় ৩০শে আশ্বিন। 

১৯০৫-এর ১৯ জুলাই। বঙ্গভঙ্গের কথা ঘোষণা করলেন ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন। সেই সময় অবিভক্ত বাংলা মানে ছিল এখনকার বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, অসম, ত্রিপুরা মিলে যে ভূখণ্ড। আর এই অবিভক্ত বিশাল বাংলাকে শাসন করা ছিল ব্রিটিশের এক বড়ো সমস্যা। প্রশাসনিক সুবিধার অজুহাতে ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। ঠিক হল যে অঞ্চলে যে ধর্মের মানুষের সংখ্যা বেশি সে হিসাবে বিভাজন করা হবে বঙ্গকে। হিন্দু আর মুসলিম জনসংখ্যা অনুযায়ী দুই সম্প্রদায়কে আলাদা করে দেওয়া হবে।

আসলে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছিল বাংলা। তাই ইংরেজ শাসকদের উদ্দেশ্য ছিল বিশাল বাংলাকে ভাগ করে বিদ্রোহের গতি কমিয়ে ফেলা। ব্রিটিশের বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব পাশ হতে দেরি হল না। দিনটা ছিল ১৬ আগস্ট অর্থাৎ শ্রাবণ মাস।

অদ্ভুত ভাবেই রাখীপূর্ণিমা ছিল তখন। ফলে প্রথা মেনে হিন্দু ঘরের মেয়েরা তাদের দাদা-ভাইয়ের হাতে রাখী বাঁধবে। সেই ভালোবাসার বন্ধনের দিনটিকে অন্য রকম ভাবে কাজে লাগাতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন পাকা করতে রাখীবন্ধনের কথা ভাবলেন। ফলে রাখীবন্ধন কেবলমাত্র ভাই-বোনের মাঝেই আটকে রইল না, হয়ে উঠল হিন্দু-মুসলিমের সম্প্রীতির বন্ধন। এক মহান উৎসব।

রবীন্দ্রনাথ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করলেন। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের হাতে রাখী বেঁধে দিচ্ছেন। ভালোবেসে একে অপরকে জড়িয়ে ধরছেন। এই ভাবেই রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশদের দিকে প্রতিবাদের আগুন ছুড়ে দিয়েছিলেন।

এই দিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে বিশাল মিছিল গঙ্গার উদ্দেশে পথে নামে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন সমাজের গণ্যমান্য নামী ব্যক্তিরাও। সমস্ত দোকানপাট বন্ধ ছিল। গাড়ি ঘোড়াও বন্ধ ছিল। মিছিলের মানুষজন গঙ্গায় ডুব দেওয়ার পর একে অপরের হাতে হলুদ রঙের সুতো বেঁধে দিয়েছিলেন। তাঁর এক ডাকে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সারা বাংলার মানুষ পথে নেমেছিলেন। এক হয়েছিলেন। কলকাতার বিডন স্কোয়ার-সহ অনেক জায়গাতেই এই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল।

কবিগুরু এই দিনটিকে "রাখীবন্ধন" উৎসব পালন করার ডাক দেন। বাংলায় হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বকে ফুটিয়ে তুলতেই এই উদ্যোগ নেন রবীন্দ্রনাথ।

এই  ভগবানের সৃষ্ট রাখীবন্ধন উৎসবে সম্প্রীতি যে ভাবে জায়গা করে নিয়েছিল, তা আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ এই রাখীবন্ধন উৎসব নিয়েই গান লিখেছিলেন -----

 ‘'বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ-
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান।
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা –
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান।
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন –
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।”

গোটা বাংলার আকাশে-বাতাসে সে দিন এই গান ধ্বনিত হয়েছিল। কলকাতার বিডন স্কোয়ার-সহ অনেক জায়গাতেই এই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। এই প্রতিবাদ ইংরেজ শাসকদের টনক নাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রতিবাদ ধীরে ধীরে অন্য মাত্রা নিয়েছিল। অবশেষে ছয় বছর পর ১৯১১ সালে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ রদ করেন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 



Post a Comment

0 Comments