জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -- পর্ব--(১৮)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম ---- পর্ব--(১৮)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মের মাহাত্ম্য 

লিউ টলস্টয় (খ্রিঃ ১৮২৮-১৯১০) ৮২ বছরের দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে সভ্যতা শব্দটির একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। সেই নিরিখেই মানুষ ও ধর্মকে তা প্রাচ্যেই হোক বা পাশ্চাত্যেই হোক, বিচার করা যেতে পারে। কারণ সব ক্ষেত্রেই মানুষের জীবনই একমাত্র বিচার্য বিষয়। সংজ্ঞাটি হলো: "The aim of civilization is to enable us to get enjoyment out of everything." মানুষের সুখ কিসে? প্রতিটি মানুষের যাবতীয় কাজ বা উদ্যোগের পেছনে তার ব্যক্তিগত সুখ চিন্তা নিত্য বর্তমান। 

ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থতা ছাড়া অন্য বিশেষ কোনো অভিপ্রায়ের জোর দানা বাঁধতে পারে না। অন্য অভিপ্রায় বলতে নিজের বাইরে পরার্থপরতার ভাবনা। সুখী মানুষই নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে এই ভাবনায় ভিড়তে পারে। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে তার নিত্য সংগ্রাম ঘরে ও বাইরে। মানুষের সুখে দুঃখে, দুই অবস্থাতেই প্রশ্ন, আমি কে এবং কি জন্য আমি আছি বা থাকবো? সুখে থাকতেও তাকে সংগ্রাম করতে হয়, দুঃখে পড়লেও এই সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে পড়ে। ধর্মের আশ্রয় অথবা রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে আশ্রয় কোনটাই তাকে সুস্থিতি দিতে পারে না। 
টলস্টয় ব্যক্তি জীবনের নানা সংঘাত থেকে এই উপলব্ধি করলেন- "Unending evolution and struggle..As if there could be any direction and struggle in infinity"। তার গভীরতম আত্মসংকট নিরসনে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন শুধু নয়, তার সব সঙ্কটের অবসান হবে, এই আশায় তিনি প্রচণ্ড রকমভাবে ধর্মীয় মৌলবাদী হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকায় শান্তি বা সুখ পেলেন না। 

বিত্তবান এই মনীষী অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপনের  ভিতর দিয়ে সংসারত্যাগী হয়ে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে আশ্রয়হীন অসহায় অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি তার পরীক্ষিত জীবনের সারসত্য প্রকাশ করলেন, "If goodness has a cause, it is no longer goodness;if it has a consequence- a reward, it is not goodness. Therefore goodness is beyond the chain of cause and effect" কী সংসার ক্ষেত্রে, কী রাষ্ট্র ক্ষেত্রে অধিকারের আধিপত্য মানুষের মনে যে স্বার্থপরতার জন্ম দেয় তার থেকে বের হয়ে আসার মতো শক্তি কি মানুষ অর্জন করতে পারে? যদি পারে, তবে সেই শক্তি সে কোথা থেকে, কার কাছ থেকে পায়? এই ভিন্নতর বোধ কি কার্য কারণ ব্যতিরেকে জন্মলাভ করতে পারে মানুষের মনে? 

ধর্মের জন্যে মানুষ প্রাণ দিয়েছে। প্রেমের জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে। দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে প্রতি ক্ষেত্রেই এই প্রাণ দেওয়ার পিছনে কার্যকারণ সম্পর্ক অবশ্যই থাকে আবার কোন বিশেষ ক্ষেত্রে মানুষ নিঃস্বার্থ নিঃশর্তভাবে আত্মদান করার শক্তি সাহস নিয়ে আত্মবিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না, যদিও এই ঘটনা ব্যতিক্রমী। টলস্টয়ের উপলব্ধি হল- "Reason has discovered the struggle for existence and the law that I must throttle all those who hinder the satisfaction of my desire.That is the deduction reason makes. But the law of loving other could not be discovered by reason because it is unreasonable." Anna Karenina (খ্রিঃ ১৮৭৫-১৮৭৭) তার লেখা বিখ্যাত উপন্যাস।

 বিষয়টি আরও খোলাসা করার প্রয়োজন এবং মানুষের অন্তঃশক্তির উৎসে আত্মত্যাগের বীজ যে নিহিত থাকে, এই উপন্যাসের একটি অংশ থেকে তা জানা যায়। 
খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত স্ক্যান্ডিনেভিয়ার  Norseman (Vikings) রা জলদস্যুবৃত্তি গ্রহণ করে সমুদ্রপথে অভিযান চালিয়ে একের পর এক ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল অধিকার করত এবং তারা রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল এইভাবেই অধিকার করেছিল। এইসব অঞ্চলে স্লাভ জনজাতিদের বসবাস ছিল। রাশিয়া এই স্লাভগণকে কখনোই মানুষ হিসেবে দেখতো না, তারা সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হতো। Norsemen- রা বিজয়ী হয়ে বিজিত এই স্লাভদের আপন করে নিল এবং স্লাভ জনজাতিগণও তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের অংশীদার হয়ে নিজেদের আত্মপরিচয় খুঁজে পেল। সহজ সরল প্রাণ স্লাভজাতি Norsemen নেতা Varyags কে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছিলেন- "Come and rule over us! We joyfully promise complete obedience.All labours,all humiliations,all sacrifices we take upon ourselves;but we will not judge or decide."
 আত্মপ্রকাশের আনন্দে ও আত্মপরিচয়ের গরিমায় উদ্দীপ্ত মানুষের সারল্য প্রতিস্পর্ধী না হয়ে আত্মসমর্পণকে বেছে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে ওঠেনি। Norsemen রা নিঃস্বার্থ ছিল না; কিন্তু আত্তীকরণর মধ্য দিয়ে সম্পর্কের ভিত গড়ে উঠলো যখন, তখন জাতি-ধর্ম-দেশ একাকার হয়ে গেল। সারা পৃথিবীতে এমন এমন বহু ঘটনার উল্লেখ করা যায়, যেখানে এই পরিগ্রহণ প্রাণের সম্পর্কে অভিরঞ্জিত হয়েছে। 

মুসলমান আক্রমণে বিপর্যস্ত মানুষ দলে দলে স্বভূমি ত্যাগ করে উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবেশ করলে কিরাত জনজাতিগণ সাদরে তাদের আশ্রয় দান করেছে। সরলপ্রাণ সাধারণ মানুষের এই আন্তরিক অভিব্যক্তিকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। অন্তরের অন্তঃস্থলে যে বোধি সদাজাগ্রত, প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার উদ্দীপন সেখান থেকেই শুরু হয়। হয় তা আত্মসমর্পনে অথবা সংগ্রামে বা ভালোবাসায় পরিণতি পায়। মানুষকে ও বিশ্বের প্রতিটি প্রাণকে ভালোবেসে, মানুষ মানুষের সামনে দাঁড়ায় তার আত্মজিজ্ঞাসা নিয়ে। 
মানুষ যীশু তার ঈশ্বরত্বকে নস্যাৎ করে আত্মপরিচয়ের গরিমায় অম্লান ছিলেন। তিনি জোসেফ মেরির পুত্র- তার ভাইবোন আছে, তিনি চিরবঞ্চিতা ব্যভিচারিণী নারীর শারীরিক সম্পর্কের উষ্ণতায় উজ্জীবিত, তরুণ যুবক তার জীবনসঙ্গী, -ইহুদী জাতির মসিহা, মহামানবিক গুণে সমৃদ্ধ এক মহামানব। তিনি বেথেলহেমের ইয়েশুয়া। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি বাবার  মতোই ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মানুষের জন্য আত্মদান করেছিলেন। 

দরিদ্র কাঠমিস্ত্রির সন্তান তিনি ইহুদি জাতি কে রোমান সম্রাট  Herod- এর অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি নিজেকে ইহুদিদের সম্রাট হিসেবেই রোমানদের আধিপত্য থেকে স্বভূমিকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। এই কারণেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় রোমান গভর্নর পিলেটের (pilate খ্রিঃ ৩৬) আদেশে। নিঃস্বার্থ আত্মদানের  এই ইতিহাস স্মরণীয় হয়ে আছে। এখানে বিজয়ী ও বিজিতের চারিত্র্যধর্ম ভিন্ন। এই ঘটনার পিছনে চরম স্বার্থপরতার আর একটি দিক ভুলবার নয়। অত্যন্ত প্রিয় শিষ্য Judas Iscariot (খ্রিঃ-৩০)  বিশ্বাসঘাতকতা করে যীশু কে চিনিয়ে দিলেন, যার ফলে তাঁকে বন্দী করা সহজ হল। এই পিলেটকেও  রোমান সম্রাট Gaius Caeser এর নির্দেশে হত্যা করা হয় । Gaius Caeser (caligula, জন্ম খ্রিঃ১২-৪১ আততায়ীদের হাতে নিহত হয়)। পিলেট যীশুর মধ্যে এমন কোনপ্রকার ত্রুটি খুঁজে পাননি তবু তাকে মৃত্যুদণ্ড পেতে হয়। কারণ জনমতের বিরুদ্ধাচরণ করার শক্তি তাঁর ছিল না। এই জনমত সর্বকালে বেশিরভাগ ক্ষমতার আধিপত্যের বশ্যতা মেনে নিয়েছে।

 কদাচিৎ প্রমত্ত রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধী হয়ে জনতাকে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে ধরে রাখতে পেরেছে। নিরপরাধ যীশুর মৃত্যুদণ্ডকে জনতা দেবত্বের রত্নাধারে সুরক্ষিত রেখে কল্পকাহিনী রচনা করেছে। পিলেটের উক্তিটি Quod Scripsi scripsi (what I have written,I have written) যীশুকে স্মরণ করে সাধারণ মানুষের হৃদয়কে মথিত করে।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments