জ্বলদর্চি

এই যে আলোর আকুলতা-৩/(উৎসব ১৪২৮)/আবীর ভট্টাচার্য

এই যে আলোর আকুলতা
আবীর ভট্টাচার্য 
(তৃতীয় অধ‍্যায়)





গাড়ি যত এগিয়ে চলছে গন্তব্যের দিকে, স্মৃতি যেন কলকলিয়ে উঠছে অরণির মনে মনে। রাস্তায় ইতস্ততঃ ছুটে চলা, হাতে বানানো তালপাতার চরকি নিয়ে আদুড়-গা ছেলেমেয়েদের দলে দেখতে পাচ্ছেন কবেকার আরিফ,সুলেখা,অসীমা,দিলীপের সঙ্গে আপনাকে, সেই এক আনন্দ-মুখরতা, সেই এক শৈশব উচ্ছলতা। হারায় না, কিছুই হারায়না, আমরা শুধু হয়তো ভুলে থাকি সব।
      
  চারিদিকে উজ্জ্বল সবুজের মেলা, পুকুর মাঠঘাট বর্ষার জলে টইটম্বুর, উজ্জ্বল নীলকন্ঠপাখির পালকরঙা আকাশ যেন সমুৎসুকী আলিঙ্গন-পিয়াসী, গাড়ির সওয়ারীদের মনে-মনেও যেন অকাল বোধনের সুর...
'আজ যেমন করে গাইছে আকাশ'-পেছনের শীট থেকে গুনগুনিয়ে উঠছে অরূন্ধতীর কন্ঠ, আরও মৃদুকন্ঠে বিমলের ফিসফিস, 

-অনেকদিন গান শুনিনি তোমার! একসময়ে কি ভালো গাইতে! গাও না কেন!

সত্যিই,ব্যস্ততা আমাদের জীবনের কতো কি কেড়ে নেয়, তবু এমন সব নিরালা অবসরে, প্রকৃতির নিবিড় অনুসঙ্গে এই সব চিরায়ত কথা মনে পড়ে যায়, অভ্যস্ততার নৈমিত্তিক সম্পর্কেও আলো এসে পড়ে...গলাটা কি আরো একটু স্পষ্ট হলো প্রিয়-উৎসাহে!...

এখন গাড়িশুদ্ধ সবাই শুনছেন,মনেমনে গাইছেন,'আজ যেমন করে গাইছে আকাশ'...গাড়ি এগিয়ে চললো, একসময়ে পৌছলো গন্তব্যে, মূল রাস্তা থেকে বাঁক ঘুরতেই তাঁদের বাড়ি, দূর থেকেই দেখতে পেলেন, মা-বাবা সহ বাড়িশুদ্ধ সবাই দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁদের প্রতীক্ষায়। 

নতুন কেউ বাড়িতে এলে চিরাচরিত প্রথা অনুসারে বরনের জন্য চন্দনবাটি, ঘী-প্রদীপের আলো নিয়ে সবাই প্রস্তুত। চন্দনের ফোঁটা, মঙ্গলশঙ্খনিনাদ অভ্যর্থনায় যেন অতিথিদের মন এই গৃহে আগমনের আনন্দ কানায় কানায় ভরিয়ে দিলো। ভেতরে প্রবেশ করেই দেখা গেল, চারিদিকে বাড়ি ঘেরা প্রশস্ত উঠোনের এককোনে জলবালতি, গামছা রাখা, আগের মতোই। যেই আসুক,পা-হাত ধুয়ে গৃহপ্রবেশের যে শুদ্ধাচার আমরা আধুনিক মানুষেরা ভুলে গিয়েছি, গ্রামীনজীবনে এখনও তার ব্যত্যয় হয়নি, তাই হয়তো জীবানু-সংক্রমণ এদিকটায় এখনও কম।

     তাঁরা সবাই বাড়িতে ঢুকলেন, এ বাড়িতে মা-বাবা,দাদা-বৌদি ছাড়াও জ্ঞাতি কাকা-জেঠামশায়ের পরিবার একসঙ্গে এখনও বাস করেন, আগের মতই। এখন হয়তো নিজেদের প্রয়োজনেই পৃথগান্ন, তবু মনেমনে এখনও তাঁরা এক অখন্ড যৌথ পরিবারের অংশ।

প্রথমেই আপ্যায়ন গাছের গন্ধলেবুর শরবতে, একটি সুন্দর কুরুশকাঠির কাজ করা খঞ্জিপোষে গ্লাসগুলি সাজিয়ে নিয়ে এলো এবাড়ির বৌমা, স্হানীয় মাধ্যমিক স্কুলের দিদিমনি, একটি সুন্দর কন্যের মা। বাধ্য, হাস্যমুখী মেয়েটিকে বাড়ির সবাই পছন্দ করেন, যথাসাধ্য পারিবারিক দায়িত্বও সামলায়, বিদ্যা যে মানুষকে সত্যিই ঐশ্বর্য্যবান করে, এই নিরহঙ্কার গুনী মেয়েটি তার প্রমান। শরবতের সৌকর্যে হোক, বা তার গুণেই হোক, মেয়েদের সঙ্গে ভাব জমাতে তার দেরী হলোনা, ও নতুনকাকিমাদের নিয়ে ভেতরবাড়িতে চলে গেল। কোন এক অজানা কারণে রূপার সঙ্গে বৌদির সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক নয়, কিন্তু বৌমা সবার প্রিয়, এখনও  ঘরের মধ্যে থাকা তিন পুরুষ শুনলেন, বাইরের বারান্দায় অসমবয়সী নারীদের স্বচ্ছন্দ্য হাসাহাসি। এই অবসরে, অরণি সেরে নিলেন কাজের কথা বন্ধুদের সঙ্গে,

-যদি কোন অসুবিধে হয় এখানে থাকতে,বলতে দ্বিধা করিসনা, আমি ভাইপোর সঙ্গে কথা বলে ঝাড়গ্রামে হোটেলে থাকার ব্যবস্হা করে রেখেছি, ওখানে থেকেও বেড়ানো যাবে। তবে প্লীজ, মা-বাবা অথবা, দাদা যেন না জানে,ওরা খুব দুঃখ পাবে।

-সঙ্গে সঙ্গে তারস্বরে দুই বাল্যবন্ধুর চিৎকার:

-তুই এটা কি বলছিস ভাই! আমরা  একসঙ্গে থাকবো বলেই তো এসেছি।

-আমাদের কথা হচ্ছে না, বাকিদের কথা ভেবেই বলে রাখলাম।

মনেমনে ভাবলেন, তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা তো ভালো নয়,ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই যে ভয় পায়….

ইতিমধ্যে কচিকাঁচার দল হৈ হৈ করে যে যার ঘরে সুটকেস পৌঁছে দেওয়ার জন্য পৌঁছে গেছে, তাদের বৌদির নির্দেশ মতন। ব্যবস্থা হয়েছে দোতলায়। চওড়া মাটির সিঁড়ি পৌছেছে লোহার রড আর কাঠের রেলিং দেওয়া বারান্দায়, তার দুপাশে দুটি করে চারটি ঘর, শেষপ্রান্তে দুদিকে দুটি বাথরুম। এই দুটি আধুনিক বাথরুম অনেক সাধ্যসাধনার পরে, বৌমাকে এবাড়িতে আনার আগে অরণি বানিয়েছিলেন; বাড়ির লাগোয়া নাকি শৌচাগার বানাতে নেই, এই যুক্তির তীব্র প্রতিবাদ করে; নীচেও একই ব্যবস্হা।

ওপরে এসে দেখলেন,তাঁর ঘরের পাশে অরূপ-দোলাদের থাকার ব্যবস্থা, অন্যদিকে,ভাইপোর ঘরের পাশে বিমল-অরূন্ধতীর অস্হায়ী আস্তানা। বৌমা দুই নতুন কাকিমাকে দুই বাথরুমের দিকনির্দেশ করে বললে,

-আমি ভালোভাবে পরিষ্কার করে রেখেছি, আপনারা এই কয়দিন নাহয় এদুটি ব্যবহার করবেন, আমরা বাড়ির সকলে নীচে, কি বলো কাকিমা?

এবার ওর চোখ রূপার দিকে। তিনি তো বটেই, রূপাও এই ব্যবস্থায় যে যারপরনাই স্বস্তি এবং খুশিতে, ওর চোখমুখ তা বলে দিচ্ছিলো। নাগরিক জীবনের যে সমস্ত অভ্যাস আমরা ছাড়তে পারিনা, 'স্যানিটারি প্রাইভেসি'  তার মধ্যে প্রধান। কিন্তু সমস্যা হচ্ছিল, এই কথা তাঁরা দুজনেই বাড়ির কাউকেই বলতে পারছিলেন না সঙ্কোচে, আর প্রধানতঃ সেই কারণেই ঝাড়গ্রামে হোটেলের বিকল্প ব্যবস্হা। কিন্তু আজন্ম গ্রামে বড়ো হওয়া বুদ্ধিমতী মেয়েটি কখন যে ওদের মনের কথা পড়ে ফেলেছে, তার সুস্থ সমাধানও করে ফেলেছে, তিনি অবাক হয়ে গেলেন,সাধে কি আর মা বলেন,

-সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে!

মনে মনে ভাইপো-ব্যাটাকে একটু হিংসে হলেও ভালো লাগছিলো খুব; বধূ নির্বাচনে তাঁদের ভুল হয়নি, সংসারের চাবিকাঠির উত্তরাধিকার যোগ্যহাতেই মা দিয়ে যেতে পারবেন হয়তো…..
         

 বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন সামনের আউশে ধানজমিতে শারদবাতাসে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ খেলে যাচ্ছে, দূর থেকে ভেসে আসছে ঘাটের বাদ্যি…. অনেক দিন পরে,ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে, পুজোও কি এলো?...এলো!
এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভূতি স্মৃতিমেদুর শিউলীগন্ধভরে তাঁকে বিবশ করে দিচ্ছিলো, ঘোর ভাঙলো বৌদির ডাকে,

-খেতে এসো গো সবাই, আমার রান্না যে সব জুড়িয়ে যায়!

 কি ভীষণ ভালোবেসে অরণি তাকালেন তাঁর এই আপাত সাধারণ ভালোমানুষ বৌদির দিকে। 

মনে পড়ে, সেই কোন সতের বছরের মেয়েটি এসেছিলেন, তিনি তখন নাইনে পড়েন। সবাইকে লুকিয়ে আমছেঁচা, তেঁতুলমাখা খাওয়া, ছুটির দুপুরে গাছে গাছে টিয়াপাখি ধরা, পুকুরে ছিপ ফেলে মাছধরা...দেবর-বৌঠান সদাসঙ্গী ছিলেন। তারপরে সময় এগিয়েছে, তিনি বড়ো হওয়ার লক্ষ্যে দূরে, আরও দূরে সরে গেছেন, এই বন্ধুটি কিন্তু রয়ে গেছেন; এক  এবং অবিচল।

চিত্র- লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

3 Comments

  1. বড় নরম তুলি দিয়ে আঁকা এ লেখা।

    ReplyDelete
  2. অনবদ্য লেখা ও আঁকা।

    ReplyDelete
  3. ভালো লাগছে। এগিয়ে চলুক।
    -উপাসিকা

    ReplyDelete