জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা/(উৎসব ১৪২৮)/শুভজিৎ মুখার্জী

গুচ্ছ কবিতা
শুভজিৎ মুখার্জী


উপলব্ধি

শরৎকালের শিউলি ফুলের দিনে,
প্রতিবছর আসছো মাগো তুমি--
দাও বুঝিয়ে অধম দীনহীনে,
খুঁজবো কোথা তোমায়, শান্তিরূপিণী ?

ওগো দয়াময়ী তুমি, করো মোরে দয়া--
যেন তোমারে বুঝিতে, চিনিতে পারি--
বলো কোথা তুমি, ওগো সর্বজয়া !
চাই না অন্য কিছুই তোমারে ছাড়ি ।

মহিষাসুরের বুকে শেল বিঁধে হায়--
করিলে তুমি যে তাহার দর্প চূর্ণ !
প্রাণ চাহি যেই ধরিল তোমার পায়, 
দেখালে তোমার হৃদয় দয়ায় পূর্ণ ।

বহুরূপে, বহুবার মাগো তুমি--
খেলেছো  বিশ্ব নিয়ে । অবশেষে,
রাখো নি কোথাও ফাঁক যে একটুখানি,
যাতে তোমাকে চিনি এক নিমেষে ।

ব্যর্থ হলাম এতো খোঁজাখুঁজি করি,
সারাটা জীবন-- সকাল, দুপুর, সাঁঝে,
বুঝিনু এবার মূর্তিটি ত্যাগ করি--
খুঁজতে হবে আপন হৃদয় মাঝে ।



ব্রত

যৌবনে যৌনতা রানী 
প্রৌঢ়ত্বে প্রেমিকা--
শৈশবের 'স্নেহ'-খানি 
হয়, বার্ধক্যে সেবিকা ! 

শুধু কৈশোরে ওঠে ঝড়
আনমনো, সুরভিত ছন্দে--
সদা কল্পনা-নির্ঝর 
নবরাগে, ললিত বিভঙ্গে ।

রতিক্রীড়া নয় সম্ভোগ ।
শরীরে মেশে না সেথা মন
ক্ষমতার অপপ্রয়োগ--
পরিণতি, কায়া-ধর্ষণ । 

তবে কোথা লুকায়িত প্রেম !
কোথা সে বিমল অনুভূতি ?
অস্তরাগের মায়া-হেম, 
জপে শুধু স্মৃতি-মালা স্তুতি ।

এভাবেই এ জীবন তরী,
ভেসে যায় সময়ের স্রোতে--
শুধু আমি দিবস-শর্বরী,
নিয়োজিত, নারী-জপ ব্রতে ।



রমণী-মোহনের কথা

                // ১ //
চোখের দেখা নাই বা হোলো,
অন্তরে পাই দেখা ---
তার উপরে স্বপ্নগুলো
মেলছে খুশীর পাখা!
সবার কথা জানার সুযোগ,
হয়তো আমার নেই ---
ভয়ংকর এক প্রেম-রোগ
মরছি আমি নিজেই।

               // ২ //
মিশে যাব মোহনায়
         সেই শেষ বেলা
তবু মন বেয়ে যায়
         জীবনের ভেলা।
যে মোহনায় পেতে বুক
         সাগর প্রতীক্ষায়--
মিলনেই সর্ব সুখ,
          জীবনের শিক্ষায়।

            // ৩ //
জানি, আমায় নিয়ে বিপদে পড়েছ তুমি--
কত কথা যে জানাতে চাও
তবু, বলিবারে নাহি পাও।
তোমারও সুখের নীড়ে
শতেক কাজেরও ভীড়ে
কখনো একাকী, গোপনেতে সখী
দ্যাখো মোর ছবিটিরে
মম মন-প্রাণ, বিরহের গান
গাহিছে ব্যথা-সমীরে--
জীবন-নদীর তীরে।

                // ৪ //
ওগো সোনার মেয়ে,
তুমি ভীষণ স্পষ্টবক্তা--
তোমার পানে চেয়ে,
ওগো সত্যানুরক্তা--
বুঝি, সঠিক বিচার তব ।
ভালোবাসার খোঁজে--
আমি রমণী-মোহন হব ।
তাই ভাষাতে রই মজে !



প্রিয়তমা

চুলগুলো তার কোঁকড়ানো আর,
জোড়া ঘন ভুরু--
এখান থেকেই বর্ণনা তার
করতে পারি শুরু ।
কাজলা দীঘি হার মানে তার,
চোখ দুখানি এমন--
বিদ্যুতের ঐ ঝলক হানার,
দৃষ্টি খানি তেমন ।
টিকোলো তার নাকখানা আর
গাল দুটি তুলতুলে--
লজ্জা পেলে রক্ত আবার
ছোটে কর্ণমূলে ।
তখন যে তার চোখের পাতার,
ভীষণ কাঁপন হয়--
অনুরাগে কথা বলার,
সাধ্য নাহি রয়  ।
অল্প হেসে হয়তো সে তার,
গালেতে টোল ফেলে--
তখন সারা মুখটাতে তার
উজ্জলতা খেলে ।
জ্যোৎস্না হাসি ঝকমকে তার,
ভেজা ঠোঁটের ফাঁকে--
মিষ্টি সুবাস অঙ্গে তাহার,
জড়িয়ে যেন থাকে ।
এই পৃথিবী নদী পাহাড়,
ঝরনা সমতল ---
লুকিয়ে আছে শরীরে তার,
রহস্য অতল ।
এত দেখি তবু যে তার,
ঠিকঠিকানা কোন--
পাইনা খুজে, তাইতো আমার
মনটা যে আনমনো ।
এবার বলি কে সে আমার ?
সব কিছু যে সেই--
সে বিনা মোর জগতে আর,
বাঁচার ইচ্ছা নেই ।
প্রাণেশ্বরী সে যে আমার,
মিষ্টি প্রিয়তমা--
মোদের মিলন স্বপ্ন সত্যি করার,
শপথ রইল জমা ।


প্রত্যাশা

ওহোঃ তুমিতো ভালবাসায় বিশ্বাস করো না ।
শুধু প্লেটোনিক লাভ !
হায় ! ভাগ্যিস প্লেটো জন্মেছিলেন !
এবং তুমি আর, অবশ্যই আমি !
না হলে কারা কিভাবে এই,
অদ্ভুতুড়ে দেহহীন প্রেমের বিষয়ে--
আলোচনা করতাম ?
জীবন অপরাহ্ণে এসে, এত দ্বিধা-জটিলতা ?
চাওয়া ও পাওয়ার নিরিখে,
ধরা যাক দেহটা নেই ---
তাহলে প্রেমানুভূতির উন্মেষ,
কাকে ঘিরে জাগরিত হবে ?
আবার, পরমা সুন্দরী এক কন্যা--
যদি মানসিক প্রতিবন্ধী হয়,
তাহলে সে কিভাবে কারো
প্রেমিকা হয়ে উঠবে ?
দেহটা তো তারও পরে আসে !
বাহ্যিক সৌন্দর্য নাইবা থাকুক--
নাইবা অঙ্গ-বরণ হোক দুধে-আলতা !
অনুভূতির স্নায়ুকোষ গুলো যেন,
আবেগে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে আমায় ।
আমিতো মহর্ষি কুতুক নই !
যে পরতে পরতে আভরণ ও  আবরণ
আর, চামড়া-মাংস-হাড়ের নির্মোক অভিলাষী !
আমি শুধু চাই, এই জীবনে একটি বার--
নিজেরে মিশিয়ে দিতে প্রেয়সীর মাঝে ।
শুধু একটিবার । জীবন তরী বেয়ে,
মৃত্যু মোহনায় পৌঁছানোর আগে ।
সংসার চলুক না তার আপন খেয়ালে !



নীল রঙের খিদে

বিদ্যুতের নীল লকলকে সেই শিখা ---
আকাশটাকে চিরে ফেলার সাথে সাথেই,
আবার আমার মনে পড়ে গেল,
সে এসেছিল ।

সে এসেছিল, কিন্তু ভালোবাসেনি ।
শুধু প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে, আর
তার হিংস্র কামোন্মাদিনী রূপটাকে ---
রূপের মোড়কে মুড়ে,
সে এসে দাঁড়িয়েছিল আমার সামনে ।
তার সেই বিভীষিকাময়
নখ ও দাঁত লুকিয়ে রেখে,
সে আমাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল,
পিচ্ছিল-আনন্দঘন এক পথে ।
এবং তারপরে,
কলস পত্রী উদ্ভিদের পাতার ফাঁদে
আটকে পড়া মাছির মত
আমি যতবার ক্ষীণ  চেষ্টা করেছি
সেই আবর্ত থেকে মুক্তি পেতে,
ততোবারই এক আঠালো জৈবিক রস
আমাকে টেনে নামিয়েছে
আরও আরও গভীরে ।

এবং আজ,
যখন আমার নাভির
উপর ও নীচের দিকটা জুড়ে
খিদের এক মিশ্র আগুনের নীল শিখাটা
জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দিতে চাইছে সবকিছু
তখন সে হয়তো ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করছে
আর একটা মাছির জন্য ;
অথবা হয়তো পেয়েও গেছে !
কেননা আমার কাছে নাকি আর,
তার কিছু পাওয়ার নেই ।
অর্থাৎ আমাকে নিঃশেষে  নিংড়ে
শুষে নেওয়ার কাজ সম্পূর্ণ ।

তবুও মাঝে মাঝে আজকাল
আমার আমিত্বের এই ছিবড়েটুকু
মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায় ।
আর তখনই আমি,
হতাশার চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে যেতে
নিজের বিদ্রোহী দেহটাকে
ছুঁড়ে দেই বিছানার উপর ।
কিছুক্ষণের প্রবল সংগ্রাম ---
বেঁচে থাকা ও বাঁচিয়ে রাখার জন্য।

এবং তারপর,
যখন ক্লান্তি এসে চোখের কোণে জমা হয়
তখন অবসন্ন হাতটাকে টেনে টেনে,
অতি কষ্টে কিন্তু পরম যত্নে,
বিছানার চাদরটাকে টান করতে করতে ভাবি ---
এ পৃথিবীতে দু'রকমের খিদে আছে,
এবং দুটোই অনিবার্য ।


আমি ইন্দ্র

তব প্রেমআঁখিদ্বয় করি নিমীলিত,
উন্মীলিত কর দেবী তৃতীয়লোচন---
উন্মোচিয়া সযতনে, রুদ্ধ মেখলা, 
মিলনালোকেতে স্নাত কর মম শির।

অকর্ষিতা-প্রস্তরবৎ, ছিল না সে আগে।
বুঝেও বোঝেনি সে, পুরন্দরী-মায়া---
সম্পর্ক বা রূপ --- হোক না যা খুশী,
প্রকৃতি আদতে হোলো ভোগ-পূজারিণী।

প্রচন্ড রুষ্ট ঋষি, উদারতা ভুলে,
ছদ্মবেশীর কায়া ভরায় সহস্র রতি-যতি---
শেষে সে বিশেষ চিহ্নের নেত্রে রূপান্তর
সহস্রাক্ষ সার্থক করে, জন্ম ধরা-বুকে।

মুক্তি পাক দৈত্যাচার্য, বিষ্ণু-হৃদয় হতে---
নটরাজের সুদীর্ঘ নৃত্যপথ বাহি,
মম অন্তর ধায়, কচি দুর্বাদল---
জোড়া পর্বতের নীচে ; আমি যে 'ইন্দ্র'।



স্বীকারোক্তি

আমি তোমার কাছে ঋণী ।
মহাপ্রলয়ের পূর্ব মুহূর্তে,
যখন ঈশ্বর ও শয়তান মিলিত হবে--
যখন এক সাদাকালো প্রতিচ্ছবি,
শুষে নেবে বাকি সব রঙগুলোকে--
যখন অশরীর ছায়া ঢেকে দেবে,
সকল আলোকবিন্দু--
যখন মহাশূন্য পূর্ণ হয়ে পরিণত হবে,
কেন্দ্রীভূত শক্তিপুঞ্জে--
যখন স্বার্থের জটিল হিসেব-নিকেশে,
তলিয়ে যাবে আমার মন--
ঠিক তখনই আমার আমিত্ব অনুভব করবে,
আমি তোমার কাছে ঋণী ।
এ জীবনে যে ঋণ শোধ হওয়ার নয় ।
এমনকি মৃত্যুও অক্ষম এ ঋণ পরিশোধে--
কারণ তোমার গভীর দৃষ্টিতেই তো,
আমি বাঁচার আনন্দ খুঁজে পেয়েছি ।



জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments