জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব-২০/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম ---- পর্ব-(২০)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্ম ও মানুষ

জাগতিক জীবনের অনিরাপত্তা ও অনিশ্চয়তার পরিবেশের মধ্যে কাল্পনিক ইচ্ছাপূরণের আশায় ব্যক্তিমানুষের ধর্মাচরণ আজও অনেকটা সেরকমই আছে। সন্তান লাভের আশায়, দুই মেয়ের পর অন্তত তার ছেলের জন্মের আশায়, অসুখ সরিয়ে দেবার আশায়, ব্যবসায়ে লাভের আশায়, চাকুরীতে উন্নতির আশায়, মামলা জেতার আশায়, পরীক্ষা পাশের আশায়, শত্রুর পরাজয় কিংবা মৃত্যুর আশায়, স্বামীর মতি ফেরাবার আশায়, আজও অনেক মানুষ শিব, বিষ্ণু, দুর্গা, কালী, লক্ষী, গণেশ, জগদ্ধাত্রী, বিশ্বকর্মা, ষষ্ঠী, শীতলা প্রভৃতি কল্পিত দেব-দেবীর পূজা করে। বনে কাঠ কিংবা মধু সংগ্রহ করতে যাবার আগে বন্যজন্তুর আক্রমণে মৃত্যু ঠেকাবার আশায় বনবিবি এবং দক্ষিণ রায় (বাঘ) এর পুজো করে। তবে কৃষি ভিত্তিক প্রাচীন সভ্যতায় মিশর, ব্যাবিলনিয়া, প্রাচীন গ্রীস, প্রাচীন ভারত এবং অন্যান্য দেশে পৌরাণিক অতিকথার ভিত্তিতে যেসব দেবদেবী ও ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিলো, ভারতবর্ষ ছাড়া আর প্রায় সর্বত্রই সে ধরনের পৌরাণিক ধর্ম বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভারতবর্ষের হিন্দুধর্মে সে প্রাচীন অন্ধ ঐতিহ্য আজও শক্তিশালী। জাগতিক জীবনের অনিরাপত্তা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে লব্ধ বস্তুর রক্ষা এবং অলব্ধ বস্তুর প্রাপ্তির আশায় এদেশের হিন্দুরা আজও পৌরাণিক দেব-দেবীদের কাছে, অনুন্নত প্রাচীন মানুষের সে পুজো-প্রার্থনা অব্যাহত রেখেছে। 

মানুষের জাগতিক অনিরাপত্তার অসংখ্য কারণের মধ্যে যেটি ক্রমশ সর্বপ্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এবং এখনো আছে, তা হলো মৃত্যুর অনিবার্যতা। মৃত্যুর সর্বগ্রাসী রূপ মানুষের জৈবিক অস্তিত্বের পরিপন্থী, এবং সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার কারণ। প্রাচীন কালেও ছিলো, এখনো আছে। মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে জীবজগতে কারোরই রক্ষা নেই। এই আমি এত কর্মময় জীবনের মধ্যে, এত সন্তান-সন্ততি, প্রিয়জন, বিষয়সম্পত্তি ছেড়ে একদিন একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো, প্রাচীন মানুষ (এবং অনেক আধুনিক মানুষ) এ সত্যকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তাই সে সৃষ্টি করেছে কাল্পনিক আত্মার তত্ত্ব। যে আত্মা হচ্ছে এই শরীরের ভিতরে প্রকৃত আমি। দেহ নষ্ট হয়ে গেলেও সে আমি অক্ষত হয়ে বেঁচে থাকবে। সে অস্ত্রে ছিন্ন হবে না, আগুনে পুড়বে না, জলে ভিজবে না,' বাতাসে শুষ্ক হবে না। বিদেহী আত্মার এসব বিপদ তো অবশ্যম্ভাবী। কারণ মৃত্যুর পরে তাকে যে সুদূর্গম পথে বহুদূর যেতে হবে। আত্মা অমর, চিরন্তন, শাশ্বত। সে আসল আমি কি কখনো মরতে পারে? আর এ কল্পনার বিস্তার থেকেই এসেছে পরলোকতত্ত্ব, স্বর্গ-নরকের কল্পনা। যে কল্পনায় ইন্ধন জুগিয়েছে ধর্মগ্রন্থ ও পুরোহিত শ্রেণি। পুরোহিত শ্রেণির সামাজিক ভূমিকা আমরা পরে আলোচনা করবো। পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অনুশাসন মেনে চললে যেমন পিতামাতা, সমাজপতিরা, অথবা রাজা, ব্যক্তিমানুষের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন এবং অনেক সময় তাকে পুরস্কৃত করেন, তেমনি ভাবে ধর্মের অনুশাসন মেনে চললে ঈশ্বর বা মৃত্যুর দেবতা খুশি হয়ে আত্মাকে স্বর্গে পাঠাবেন। স্বর্গ স্নিগ্ধ আলোকে চির উজ্জ্বল এবং সুগন্ধময়। সেখানে অমরত্ব, চিরযৌবন, চিরযৌবনা অপ্সরা (যেহেতু ধর্মগ্রন্থ পুরুষেরা লিখেছে, তাই নারীর আত্মা স্বর্গে গেলে কি কি পাবে সেকথা কোনো ধর্মগ্রন্থে লেখা নেই),নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু, মলয়ানিল, চিরতোয়া নদী, সুগন্ধ অম্লান পুষ্প প্রভৃতি পৃথিবীতে যা কিছু অর্থ অলভ্য কিংবা দুর্লভ, তার সব কিছুই পাওয়া যাবে। আর নরকবাসের ফল হলো পৃথিবীতে মানুষের জৈবিক অস্তিত্বের যা-কিছু পরিপন্থী, তার সব কিছুর সমাহার। নরক চির অন্ধকার এবং দুর্গন্ধময়। সেখানে পা উপর দিকে আর মাথা নিচের দিকে করে ঝুলিয়ে আত্মাকে আগুনে ঝলসানো হয়, ফুটন্ত তেলে সেদ্ধ করা হয়, করাত দিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নিচের দিকে কেটে দু'খন্ড করা হয়, গনগনে লোহা তামার জমির উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়, বিষ্ঠা এবং কৃমি খেয়ে বাঁচতে হয়, ইত্যাদি। সব ধর্মেই পৃথিবীতে শাস্ত্রের অনুশাসন অমান্যের মাত্রা অনুযায়ী মানুষের পাপের মাত্রা নির্ধারিত হয়, আর সে অনুযায়ী আত্মার কমবেশি শাস্তির জন্য ভিন্ন ভিন্ন নরক থাকে। কিন্তু সমস্ত অকল্পনীয় রোমহর্ষক শাস্তির ফলেও আত্মা নরকে মারা যায় না, কারণ সে অমর। নরকে চিরকাল বেঁচে থেকে বারে বারে অন্তহীন ভয়ঙ্কর কষ্ট পেতে থাকে। 

পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলো পড়লে দেখা যায় যে সেখানে স্বর্গের বর্ণনা তুলনাক্রম অল্প ও অসচ্ছ। কিন্তু সব ধর্মগ্রন্থেই বিভিন্ন নরকের বর্ণনা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং সুস্পষ্ট। এর প্রধান কারণ এই যে কোন মানুষই প্রকৃতপক্ষে মরে গিয়ে স্বর্গবাস করতে উৎসুক নয়। মানুষ পৃথিবীতেই চিরযৌবন নিয়ে চিরসুখে বেঁচে থাকতে চায়। এই তার অমোঘ অনিবার্য জৈবিক প্রবৃত্তি। এমন কি পৃথিবীর সব দুঃখকষ্ট সহ্য করেও সে পৃথিবীতেই বেঁচে থাকতে চায়। কাজেই শাস্ত্রের অনুশাসনগুলো যদি তার ব্যক্তিস্বার্থের প্রতিকূল হয়, তাহলে মৃত্যুর পরে স্বর্গের বেশি সুখের আশায় মানুষ সেগুলো মেনে চলবে না। মৃত্যুর পরে পৃথিবীর জীবনের মতো জীবন আবারও পেলে তার খুব একটা আপত্তি থাকবে না। তাই শাস্ত্রের বিধান অমান্য করে যদি সে এ জীবনে সুখে থাকতে পারে, তবে মৃত্যুর পরে বেশি সুখের আশায় সে পৃথিবীতে জীবদ্দশায় শাস্ত্র মেনে কষ্ট পেতে চাইবে না। কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত জেনে নরকের ভয়ঙ্কর পরিণতির ঝুঁকি সে নিতে চায় না। এই আশায়ই শাস্ত্র রচয়িতারা স্বর্গের সুখের চেয়ে নরকের অসহনীয় কষ্টকে এত বেশি বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেছেন। এ ভাবে ইহলোকের অনিরাপত্তার সঙ্গে পরলোকের সম্ভাব্য মহাকষ্ট যুক্ত হয়ে পৃথিবীর মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছে। 

সে দিক থেকে ইহুদি-খ্রিস্টান-মুসলিম ধর্মগ্রন্থ রচয়িতাদের চেয়ে পাপপুণ্য পরলোকতত্ত্ব রচনা বিষয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ রচয়িতারা ছিলেন অনেক বেশি সুকৌশলী এবং বুদ্ধিমান। তারা বলেছেন যে কিছুকাল স্বর্গ অথবা নরক ভোগের পর আত্মার আবার পৃথিবীতেই জন্ম হবে। তবে এ জীবনে শাস্ত্র মেনে চললে সেই পুণ্যে নরকে যেতে হবে না, আর পরজন্মে আরো বেশি ভোগৈশ্বর্যে এবং সুখে দীর্ঘ জীবন লাভ করা যাবে। অন্যদিকে শাস্ত্র না মানলে সেই পাপে কিছুকাল নরকভোগের পর হীনতর পরজন্ম হবে, এমন কি পশু, কীটপতঙ্গ কিংবা উদ্ভিদ জন্ম হতে পারে। 

এভাবে পৃথিবীতেই পুনর্জন্মের তত্ত্বের মাধ্যমে মানুষের স্বাভাবিক জৈবিক প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হিন্দু-বৌদ্ধ শাস্ত্রকারেরা ধর্মগ্রন্থ রচনা করেছেন। সে কারণেই ভগবতগীতাতে শ্রীভগবানের মুখে আমরা শুনি যে মানুষের কৈশোর, জরা এবং বার্ধক্যের মতোই দেহান্তর প্রাপ্তি জীবনের একটি পর্যায় মাত্র, তাই ধীর ব্যক্তিরা মৃত্যুচিন্তায় মুহ্যমান হন না। আর কারো মৃত্যু আসন্ন হলে তার এবং প্রিয়জনের সান্ত্বনার জন্য এই শ্লোকটি বারে বারে আবৃত্তি করা হয়। মৃত্যুর উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তির আশা এবং কাল্পনিক ইচ্ছাপূরণের প্রবণতায় ব্যক্তিমানুষ এ ভাবেই ধর্মকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments