জ্বলদর্চি

পাতি মানুষের পাঁচালি-৮/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

পাতি মানুষের পাঁচালি::৮ 

সিদ্ধান্তের সিদ্ধান্তহীনতা
-----------------------------------
সিদ্ধান্ত বর্মনের মতিঝিল চত্বরে বড় মনের মানুষ হিসেবে খুব নামডাক। কাউকে চটান না উনি। আদার ব্যাপারি থেকে জাহাজের কারবারি, ক্লাবের দাদা থেকে অফিসের পেয়াদা,  অটোচালক থেকে দেশপালক সবার সঙ্গে তার অবাধ মেলামেশা। থাকেন ছােট একটি জমির উপর প্রায় ভেঙে যাওয়া পুরনাে এক একতলা বাড়িতে। পেশায় গৃহশিক্ষক। বউ একটা ছােটামােটা প্রাইভেট ফার্মে রিশেপসনিস্ট-এর কাজ করে। এক ছেলে, ক্লাস এইটে পড়ে মতিঝিল স্কুলে। হাঁটা পথ বাড়ি থেকে।  নিজেই যাতায়াত করে। লােকে বলে সিদ্ধান্ত স্যারের বিভিন্ন বিষয়ে যেরকম পড়াশােনা এবং দখল তার এরকম আস্তাকুঁড়ে পড়ে থাকার কথা নয়। কিন্তু যে মানুষেরা তাঁকে চেনে তারা ভাবে সিদ্ধান্তের এ দশা না হলে কার হবে? বর্মন যে বড় মনের মানুষ এ ব্যাপারে তাদের দ্বিমত নেই। কিন্তু এরকম গােটাজীবন ধরে, সিদ্ধান্তহীনতায় ভােগা মানুষের নাম বাবা-মা সিদ্ধান্ত রাখলেও, তিনি নিজেকে কোর্টে হলফনামা দিয়ে  কেন পালটে নিলেন না চর্চার বিষয়।  ব্যাপারটাতে অবশ্য সিধুর একার হাত  ছিল না। কথায় বলে কিছু দোষ বা গুণ আয়ত্ত করার দরকার নেই, বংশপরম্পরায় জিন দ্বারা তা প্রবাহিত হয়। সুতরাং বাবার জিনের দায় যে ছেলের ঘাড়েই বর্তাবে এবং তা নিয়ে যে সারা জীবন তাকে ভুগতে হবে এ আর বিচিত্র কি?

বাবা দিগন্ত বর্মনও হঠকারী, দিশাহীন বিভ্রান্ত এক মানুষ ছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে সেই দিগন্তও তাঁর বাবা দিনান্তের কাছে থেকে তিনি প্রচুর টাকাপয়সা, সােনাদানা ও জমিজায়গা পেয়েছিলেন । বাপের এক মাত্র ছেলে হওয়াতে অলসতায়, সখ-আহ্লাদ পূর্ণ করে, ভুল ব্যবসায় টাকা ইনভেস্ট করে বউ বাচ্চা সমেত যখন প্রায় কপর্দকশূন্য  হলেন দিগন্ত  তখন মেরে কেটে তার বয়স চল্লিশ বছর। এ হেন দিগন্তকে কাছ থেকে  দেখে, তার জীবনধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েই সিদ্ধান্ত বাবার দেখানাে পথে চলতে শুরু করেছিলেন হয়তাে বা। তাছাড়া তার মধ্যে যথেষ্ট 'মেধা'ও নিশ্চয় ছিল এ বিষয়ে, তা না হলে এমনি এমনি কেউ কি  কিছু হয়?  এ হেন দিগন্তের ঘরে সিদ্ধান্ত আসার পরে পরেই বটে, তাঁর স্ত্রী বহুকষ্টে তার সঙ্গে বছর পাঁচেক কাটানোর   পর একরাতে—'আমি সন্ন্যাসিনী হয়ে গৃহত্যাগ করলাম । আমাকে খোঁজার চেষ্টা করো না।',এরকম একটা কিছু  চিরকুটে লিখে পিটটান দিলেন বাড়ি থেকে। কোথায় গেলেন সেটা একটা ধোঁয়াশার বিষয় অবশ্য। অনেকেই পরে তাঁকে একজন মধ্যবয়সি সুদর্শন পুরুষ মানুষের সঙ্গে ইতিউতি দেখেছেন যাঁকে দেখে অন্তত সন্ন্যাসিনীর সঙ্গী বলে মনে হয়না। হয়তাে দ্বিতীয় বিয়ে বা লিভটুগেদারে ছিলেন। দিগন্তের আর বউ ভাগ্য হয়নি। ছেলেকে দেওয়ার মতাে সময়ও বার করা যায়নি। সুতরাং ছেলে নিজেই নিজের অভিভাবক হয়ে বড় হতে শুরু করেছিল। ষাটোর্ধ এক মােটা কাজের মাসি ছিল বটে সিদ্ধান্তকে দেখভাল করার জন্য , কিন্তু সিদ্ধান্ত তাকে পাত্তাই দিতেন না। তাঁর প্রথম সিদ্ধান্তহীনতার শুরু সে সময় থেকেই। যদিও কাজের মাসির তাঁর বড় হয়ে ওঠার পিছনে অনেকখানি অবদান ছিল, তবুও মাসির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটি ঠিক যে কী এটা অনুধাবন করতে না পেরে অকারণে মাসির সঙ্গে খারাপ ব্যাবহার করতেন তিনি।  পরে যখন একটু বড় হয়ে বুদ্ধি হয়েছে তখন মাসির কাছ থেকে তাঁর পুরনাে আচরণের কথা শুনে যারপরনাই দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি নিজেও। 

যখন ক্লাস সেভেনের ছাত্র  তখন স্কুলে পড়াশােনার বাইরের একটা পছন্দের জিনিসের কথা বলতে বলা হয়েছিল তাঁকে। সে বিষয়ে স্কুল তাঁকে আলাদা করে ট্রেনিং দেবে । সিদ্ধান্ত গানটা ভালাে গাইতেন, কিন্তু তিনি পছন্দ করলেন ছবি আঁকা। এ বিষয়ে পরীক্ষা ও নম্বর, প্রাপ্তি দুই-ই ছিল। হঠকারিতার কারণে তাঁর নম্বর তাে আশানরূপ হলই না, উল্টে গান শেখার সুবর্ণ সুযােগটাও হারাতে হলো।

মাধ্যমিকে পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালােই ছিল। টেস্টের নম্বরের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত ছিলেন ক্লাসে দ্বিতীয়। কিন্তু, প্রস্তুতি যথেষ্ট ভালাে নয় এই অযুহাতে, সেবার পরীক্ষা না দিয়ে 'প্রচুর পড়ে পরের বার পরীক্ষা দেব’—ভেবে একপ্রকার কিছু না পড়েই পরের বার পরীক্ষা দিয়ে অঙ্কে ফেল করতে করতে বেঁচে যান তিনি।
দিগন্তের এক দূর সম্পর্কের দিদি আগরপাড়ায় থাকতেন। শােনা যায় তাঁর থেকে পনেরাে বছরের বড় সেই দিদি মায়ের মতােই স্নেহ করতেন সিধুকে। তিনি একটা সময়ে দায়ীত্ব নিতে চেয়েছিলেন সিধুর পড়াশােনা ও ভরণপােষণের। বাবা রাজি থাকলেও সিদ্ধান্ত‌ তাঁর 'স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে’—সেখানে যেতে রাজি হননি। পরে বুঝেছিলেন ভুল হয়েছে, এবং আকারে ঈঙ্গিতে সে কথা বুঝিয়ে, যেতেও চেয়েছিলেন বড় পিসির কাছে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। মনক্ষুন্ন পিসি আর তাঁর দায়িত্ব নিতে রাজি হননি। ফলে চিরকাল স্নেহবঞ্চিত হয়ে ঠোক্কর খেতে খেতে বড় হতে হয়েছে তাঁকে।  পড়াশােনায় ?‌  খারাপ ছিল না। বড় বড় অঙ্ক তাে টপাটপ মুখে মুখে করে ফেলতেন। সেই করতে গিয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে মাধ্যমিকে ‘ফেল’-ও করে যাচ্ছিল প্রায়, সে তো আগেই বলেছি, আবার সেই সুবাদেই একবার অঙ্ক অলিম্পিয়ার্ডে ফার্স্ট হয়ে, রাশিয়া যাওয়ার সুযােগ পান বৃত্তি সহ নিখরচায়। কিন্তু ঘরকুনাে সিদ্ধান্ত একেবারে রাজি হননি রাজ্য ছেড়ে, দেশ ছেড়ে পরদেশে গিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে। এটা করলেই ভালাে করতেন। অনটনে পড়ে অনিচ্ছার সত্ত্বেও  ছাত্ৰ পড়ানাে ধরতে হতো না নিদেনপক্ষে। এ বিষয়ে শুনে, তাঁর থেকে অনেক বুদ্ধি কম মানুষও তাঁকে দেখে হাসাহাসি করত। এ নির্বোধের মতাে কাজ পরে বহুদিন পর্যন্ত তাঁকে যন্ত্রণা দিয়েছিল। মানুষের আবেগ, অনুভূতি এসবের মূল্য দেওয়ার বান্দা ছিলেন না  সিদ্ধান্ত। সুতরাং তাদের উপদেশ তাদের বিদ্রুপ দুইয়েরই কোনাে মূল্য ছিল না তাঁর কাছে। মানুষ প্রথমে গােবেচারা সিদ্ধান্তকে দেখে অতশত বুঝত না পরে বুঝে ধীরে ধীরে তার থেকে দূরে চলে যেত। এভাবে নিজের দোষে ক্রমশ তিনি নির্বান্ধব হয়ে গেছিলেন। পরে সে খােলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে অনেক কাঠখড় পােড়াতে হয়েছিল তাঁকে।
এর পরও সুযােগ এসেছে। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর বিশ্বভারতিতে জার্নালিজম নিয়ে পড়ার সুযােগ পেয়েছিলেন তিনি। আহা! রবীন্দ্রনাথের তৈরি ইউনিভার্সিটি! সেখানে পঠনপাঠন নিশ্চয় একদম অন্যরকম হবে! এ স্বপ্নে বিভাের হয়ে তিনি তাে পৌঁছলেন সেখানে। কিন্তু পৌঁছেই মােহভঙ্গ। তাঁকে বিভিন্ন জন তা সে বড়ই হােক বা ছােট বিভিন্ন ভাবে র‌্যাগিং করতে শুরু করল। কেউ পাজামার দড়ি টেনে খুলে দেয়, তাে কেউ বলে—গাছে উঠে ডাব পেড়ে খাওয়াও।' কেউ বলে শীতের রাতে খালি গায়ে হস্টেলের মাঠে পাঁচ পাক দৌড়ে এসে আইসক্রিম খেতে খেতে অতুলপ্রসাদের গান শােনাও । সুতরাং সে সুখও সইল না বেশিদিন। প্রত্যেককে মােটামুটি এ সিস্টেমের মধ্যে দিয়েই বড় হতে হয় ছাত্রজীবনে । বেশির ভাগই কষ্ট পেয়ে থেকে যায়। কেউ পালটা মার দেয়। কিন্তু র‌্যাগিং-এর তাড়নায় কেউ যে প্রথমেই ওয়াকঅভার দিয়ে পালিয়ে আসে সেটা সিদ্ধান্ত দেখিয়েছিলেন। এদিকে বয়স বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়ানাের ব্যাপারে কোনাে কাজই হচ্ছে না। ফলে সিদ্ধান্ত পড়লেন আতান্তরে। এই সময় হঠাৎ করে ‘মায়া মুহুরি’-র সঙ্গে তাঁর আলাপ এবং প্রেম। ঘটনাটা ইন্টারেস্টিং। কোনাে একটা কাজে সিদ্ধান্ত এসপ্লানেড যাবেন, তাই দমদম মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।  বেলা ১০টা ১৭-এর ট্রেনের আসার ঘােষণার পর ট্রেন স্টেশনে ঢােকে ঢোকে প্রায়, হঠাৎ সিদ্ধান্ত খেয়াল করলেন বছর তিরিশেকের প্যান্ট শার্ট পরিহিতা এক মহিলা ট্রেনের লাইনে ঝাঁপ দেয় দেয় আর কি! কোনাে রকমে প্যান্টের কোমড় টেনে ধরে সে যাত্রা সিদ্ধান্ত বাঁচান তাকে। চারিদিকে হই হই। প্রচুর মানুষের ভিড়। এর মধ্যে বাকরহিত মহিলা মুগ্ধবিস্ময়ে সিদ্ধান্তর দিকে তাকিয়ে আছে ত আছেই। এ সব দেখে সিদ্ধান্ত হঠাৎ খুব লজ্জা পেলেন। এবং তড়িঘড়ি সেখান থেকে সে যাত্রা পালিয়ে গিয়ে বাঁচলেন!  বাঁচলেন তাে সাময়িক ভাবে,  কিন্তু তারপর ঘটল অত্যাশ্চর্য সেই ঘটনা। মাস দুয়েক বাদে এক সন্ধ্যায় সে ভদ্রমহিলা খুঁজে পেতে তাঁর বাড়িতে এসে হাজির।  এসে তাঁর হাতে একটা লাল গােলাপ দিয়ে সটান প্রেম নিবেদন করে বসলেন তিনি। ঘটনার আকস্মিকতায়  এমন ঘাবড়ে যান সিদ্ধান্ত যে সাতপাঁচ  না ভেবেই  রাজি হয়ে যান তাঁকে নিজের জীবনে গ্রহণ করতে। পাঁচ বছর প্রেম, তারপরে বিয়ে। প্রতিবেশীরা অবাক হয়েছিল বইকি! সিদ্ধান্তের মতাে মেনীমুখাে একজন লােক কীভাবে এটা ঘটাতে পারে ভেবে তারা অবাকই হয়েছিল বেশি। কিন্তু হাজার হলেও সে তাে দিগন্ত বর্মনের ছেলে! গােদা গােদা চিন্তা করতেও যাঁর জ্বর আসে ঘুম পায় তিনি কি আর বিয়ের মতো জটিল বস্তুকে বেশিদিন ঝেলতে পারেন? সুতরাং যা হওয়ার তাই হলো। সিদ্ধান্তর আনরােমান্টিক একঘেয়ে আচরণে বাের হতে হতে একদিন ভদ্রমহিলা তাঁকে ফেলে পালিয়ে অনেক  পরে অন্য একজনকে বিয়ে করে বাঁচলেন। এরকম যে ঘটতে চলেছে তা আগেই আঁচ পেয়েছিলেন সিদ্ধান্ত, কিন্তু আটকানোর কোনো রকম চেষ্টা করেননি তাঁকে। শুধু তাই নয়, বউ পালিয়ে যাওয়ার দশমিনিটের মধ্যে পরম নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। ঘুম ভাঙে ঘন্টা দুয়েক বাদে। ঘুম থেকে উঠে ভাবলেন, বউকে কি ডাকবেন? তারপর মনে হল, যাকগে! কী আর হবে!’

জীবনের বিভিন্ন স্তরে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে নিতে হারতে হারতে সিদ্ধান্তর পিঠ যখন প্রায় দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে, সে সময় কাকতালীয় ভাবে কলকাতার এক নামি খবরের কাগজে সাব এডিটরের চাকরি পান তিনি। মাইনেপত্র ভালাে। প্রমোশনের সুযােগ আছে ।
 উপরওয়ালার নেকনজরে পড়লে উপরে ওঠারও সম্ভাবনা। এ সময়টা তার দরকারও ছিল তাঁর। ফলে তাঁকে মানায়না এরকম ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে শুরু করলেন তিনি। টুপ করে অকারণে খবরের বয়ান পালটে দেন। সেলিব্রিটিদের নিয়ে অকারণে ক্ষতিকর মিথ্যে কথা লেখেন। তাদের মুখে মনগড়া বিবৃতি বসিয়ে দেন। চরম ক্ষতিকর ব্যাপারটা সেদিন ঘটে গেল যেদিন জলজ্যান্ত এক আন্তর্জাতিক ধর্মগুরুকে স্ট্রিট অ্যাক্সিডেন্টে একদম মেরেই ফেললেন তিনি। তার পর কাগজের অফিসের সামনে বিক্ষুদ্ধ জনতার হই হই, অগ্নিসংযােগ , কাগজ তুলে দেওয়ার হুমকি। সে যাত্রা ক্ষমাটমা চেয়ে কোনােমতে তাদের থেকে পরিত্রাণ পেয়ে হাউসের বড়কর্তা হাতজোড় করে তাঁকে বিদেয়  করে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।

তারপর অবস্থা খুব করুণ। হাতে পয়সা নেই। পয়সা আয়ের উপায়ও নেই। 

দমদম মতিঝিলে সিদ্ধান্তর এক জ্যাঠুতুতাে দাদা থাকতেন। তুতো ভাইবােনেদের মধ্যে সবার বড়। তিনি শেষপর্যন্ত তাঁর কাছে পরামর্শ চাইতে গেলেন বিপদে পড়ে। বড়দা সব শুনে বললেন—

'তুমি যা করেছ তা যে ঠিক করনি তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। চাকরির মানসিকতা তােমার নেই। ব্যবসাও হবে তােমার দ্বারা। তাতে ভীষণ মানসিক চাপ। যতদূর পড়াশােনা করেছ তার উপর ভরসা করে স্কুলছাত্র পড়াতে শুরু কর। ওটাই তােমার ভালাে হবে। স্বাধীন পেশা। একদম মাসের প্রথমে মাইনে নেবে। খুব গবেট না হলে কাউকেই নিতে না করবে না। ওরাই তােমার লক্ষ্মী, ওদের সাফল্য তােমাকে আরও অনেক ছাত্রছাত্রী দেবে। আর একটা কথা, কোনাে পেশায় ছেলেখেলা নয় সুতরাং কোনােরকম অপেশাদার আচরণ করবে না। আজ পড়াব না, কাল এস, এসব খেয়ালখুশি মতাে বলে বাবা মায়েদের বিব্রত করবে না। মনে রাখবে যাঁরা সংসারী মানুষ, বাস্তববাদী মানুষ তাঁরা এসব পছন্দ করেন না।' সিদ্ধান্তের খামখেয়ালিপনা তবু কমল না। মাঝে-মাঝেই—'আজ অমুক কাজ! কাল তমুক বাহানা’–এ ভাবে অপেশাদারি মনােভাব দেখিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পড়লেন চরম আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে।   সে সময় এক বন্ধুর যােগসাজোশে  চিন্তা পালের সঙ্গে তার পরিচয় ও দ্বিতীয় বিয়ে। বুদ্ধিমতি 'চিন্তা’ এক বাচ্চা প্রসব করার পরেও সংসারের জোয়াল নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে পরম উৎসাহে তা টেনে যেতে থাকলেন।
এ ধরনের মানুষগুলি বড় অদ্ভুত। নির্বোধ নন, অথচ নিজের ভালাে বােঝেন না। এমনও হতে পারে যে নিজের অনিশ্চয়তাকে তাঁরা গুরুত্বই দেন না। কিছু মানুষ বুদ্ধি করে চলে,  ফলে এক সময় সাধারণ হয়েও একটা প্রাসাদের মালিক হয়। আবার  এক একজন অনিয়মের ঘূর্ণিজালে পড়ে ছেলেকে একটা সাধারণ খেলনাও কিনে দিতে পারে না, এ দুই-ই দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে আমার এক মনােবিদ বন্ধুর ব্যাখ্যা আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল। সে বলেছিল, বহুদিন ধরে চলে আসা এবং নিরাপদ বলে প্রমাণিত জীবনে চলার নিয়মগুলি মানুষ বিশেষ পছন্দ করে না। মনের থেকে তারা সবসময় সব পুরনাে মতবাদ ও চিন্তাধারাকে ভুল প্রমাণিত করে নতুন তথ্য খাড়া করে সমাজে নিজের শ্রেষ্টত্ব কায়েম করতে চায়। যারা ভেবেচিন্তে কাজ করে তারা নিজেদের বিপদে ফেলে না। নতুন ধ্যান ধারনা আমদানির নাম করে ধ্বংসাত্মক কাজ করে না। আর যারা অপরিণত তারা নিজেদের ভালােমন্দ না ভেবে সংসারিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়ে চরম বিপদে পড়ে।


সে সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসে মানুষ সেখানকার জীবনধারা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, সংস্কার এসব বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হয় পরের প্রজন্মে। এ প্রবাহের বাইরে বেরিয়ে অন্যকিছু করতে পারে যারা, তারা ব্যাতিক্রমী মানুষ। সিদ্ধান্ত একা নয়, সিদ্ধান্তহীনতায় ভােগা আরও অনেক মানুষ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে—আমরা খেয়াল করি না। তারা ভুল করে কষ্ট পায় কিন্তু আবার যাতে ভুল না হয় তার জন্য অতীত থেকে শিক্ষা নিতে জানে না। কতকিছু করে ফেলল চিকিৎসাবিজ্ঞান। কত অসম্ভব হল! কিন্তু এদের তাে এখনও হল না কিছু?  যদিও চেষ্টার অন্ত নেই। এ ধরনের মানুষদের নিয়ে একবার একটা ফোরাম’ তৈরি করার কথা ভেবেছিল এ রাজ্যের এক এন.জি.ও । এদের উদ্দেশ্য ছিল দিশাহীন মানুষদের বাঁচার যােগ্য করে প্রশিক্ষিত করে তােলা। কিছুদিনের মধ্যেই সব থেকে জোরদার প্রতিবাদ এসেছিল ওই সব শ্রেণিভুক্ত মানুষের কাছ থেকেই। তারা বলেছিল,  'তাদের অস্বাভাবিকতা নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে।', অবশ্য উল্টো ভাবনার মানুষও প্রচুর আছে। আসলে নিজের খামতিকে স্বীকারেই  আপত্তি বহু মানুষের। সে তার প্রতিবেশীর রােগযন্ত্রণার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে, তার ছােট ঘরের এ.সি.তে শুয়ে ছােট্ট জীবন কাটাবে। বাসের সিটে বেশি জায়গা নিয়ে বসে আরেক জনকে বসতে অসুবিধা দেবে।  অথচ তার সব চায়। সব সমৃদ্ধি সব সুখ, সব পূর্ণতা! তার জন্য চেষ্টাতে ভীষণ আপত্তি। বিচিত্র, অতি বিচিত্র মানুষের মন। অদ্ভুত ধোঁয়াশায় ঢাকা তাদের জীবনের কক্ষপথ ও মানসিকতা।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments