জ্বলদর্চি

অন্ত্যেষ্টি-৭/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/ সন্দীপ দত্ত

উপন্যাস।। অন্ত্যেষ্টি।। সন্দীপ দত্ত



"তুমি কি সবজান্তা?" চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পাপিয়া কথাটা হেসে বলল রাজীবকে। হেসেই বলল। আজ তো তাদের হাসারই দিন। এখন সময় যত গড়াবে,সুযোগটা ততই নিজে থেকে কাছে এসে ধরা দেবে। মহানুভবতা দেখানোর সুযোগ। হৃদয় উজাড় করে পাশে দাঁড়াবার নাগপাশটা শক্ত হবে যত,ততই বাড়বে বাহবা। গ্রামের লোকের কাছে সম্ভ্রম আদায় করে নেওয়ার এই তো সময়। এরকম কপাল ক'জন পায়?
"চুপ! আস্তে। কথাটা পাঁচকান করবে নাকি?" বলে নিজের চা শেষ করা কাপটা টেবিলে রাখে রাজীব। "সবজান্তার কী আছে? পেশেন্টের ওরকম সিরিয়াস কন্ডিশন। আমার তো কাল দেখেই মনে হয়েছিল,চয়নদা আর বাঁচবে না। ডিপ কোমায় চলে যাওয়া একটা রুগী কখনও বাঁচে নাকি? হ্যাঁ,বাঁচে। তবে সেটা খুব রেয়ার। লাখে এক। আর টাকার জোরেই হোক বা ভাগ্যের জোরেই হোক,কোনও উপায়ে বাঁচলেও পক্ষাঘাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি। আমার তো মনে হয়,চয়নদার টাকার জোর এখন আর তেমন নেই।"
"তুমি কী করে জানলে?" পাপিয়া জিগ্যেস করে।
"কালকে ওখানে গিয়েই খবর পেয়েছি,চয়নদা গাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে।" রাজীব বলল।
"সত্যি?" স্বামীর কথা শুনে চমকে গেল পাপিয়া। চোখদুটো খুশিতে চকচক করে উঠল। অদ্ভুত একটা ভাল লাগা শিহরন হয়ে বুলে গেল শরীর জুড়ে।
"সুখেনের সাথে কাল কথা বলে যা জানলাম,স্ট্রোকটা চয়নদার ব্রেনেই হয়। মাথার ভেতরের তিনটে শিরা ছিঁড়ে গেছে।"
"আর গাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার খবরটা তুমি কার কাছে পেলে?"
"সুখেনই বলল।"
"কেন?"
"কে জানে? হয়তো টাকার দরকার পড়েছিল কোনও কাজে। আর তো কিছু বলল না।"
রাজীব খোলা জানালার দিকে তাকাল একবার। আজ প্রচণ্ড রোদ। নির্মেঘ আকাশ। সকাল আটটাতেই অস্বস্তিকর পরিবেশ।
"ভাবছি অয়নদাকে কীভাবে রাজি করানো যায়। ওকে তো যেতে হবে সঙ্গে।" রাজীব বলল।
"সে তো যেতেই হবে। বড় দাদা। মায়ের পেটের আপন ভাই। ঋষভ ঐশীকে এখন সান্ত্বনা দেওয়া তো দরকার।" পাপিয়া বলে।
"কিন্তু অয়নদা যে যেতে চাইছে না। খবরটা পাওয়ার পর তখন সকালে গিয়ে কত করে বললাম। দাদা শুধু এক কথাই বলছে,আমরা গেলেই নাকি হবে। তাই কি হয়? চয়নদার বউ কী ভাববে? নিজের আপন দাদা থাকতে সে এল না! তুমি বলো,এটা কি ঠিক? এখানে দাহকাজের জন্য যা কিছু লাগে,আমরা তো দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি দু'একজনকে। বিকেলের মধ্যেই তো চয়নদার বডি নিয়ে আসছি।.....কিছুতেই শুনছে না অয়নদা।"
পাপিয়া কিছু বলতে যাওয়ার আগেই দরজায় মৃদু টোকা পড়ল।
"দাদা,ভেতরে আসব?"
ভাইয়ের গলা পেয়ে রাকেশকে ভেতরে আসতে বলল রাজীব। 
রাকেশ ঢুকল। সঙ্গে কাঞ্চনাও।
"দাদা,ভোম্বল চলে এসেছে। আমাদের মনে হয় এবার বেরোনো দরকার। এদিকে দেরি করলে ওদিকে দেরি হয়ে যাবে। বিকেলের মধ্যে এসে যেন শ্মশানে যেতে পারি।" রাকেশ বলল।
"ম্যাটাডোরটা ভোম্বল নিয়ে এসেছে তো?"
"হ্যাঁ দাদা।"
"বেচুকে বলেছিস? দ্যাখ,আর একবার ফোন কর।তাড়াতাড়ি যেন ওর কীর্তনদল নিয়ে আসে। ওদের সঙ্গে  নিয়েই যাব। চয়নদার বাড়ি থেকে বেরোবার সময় আর আমাদের এই গ্রামে ঢোকবার আগেটায় ওদের তো নামসংকীর্তন করতে হবে।"
"হ্যাঁ দাদা, বেচুও রাস্তায় ওর দল নিয়ে আসছে। একটু আগেই ও ফোন করেছিল। চলে এসেছে বোধহয়।"
"বেশ,তাহলে আমরা এবার বেরিয়ে পড়ব। তুই অয়নদার কাছে আর একবার যা না। ও গেলে খুব ভাল হত। ওখানকার প্রতিবেশীদের কাছেও ব্যাপারটা ভাল হত।"
"ঠিক আছে দাদা, আর একবার বলে দেখছি। মিলিটাও যদি সঙ্গে যায়।"
"না,না,মিলিকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। ওখানে গিয়ে কান্নাকাটি করবে খুব। আমরা তো সব এখানেই আসছি।" উঠে দাঁড়াল রাজীব।
কাঞ্চনা বলল,"একটা কথা বলব দাদা? না মানে ঐ ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে কিনা তাই ভয় পাচ্ছি।"
"কী কথা?" রাজীব তাকায় কাঞ্চনার দিকে। শুধু রাজীব একাই নয়,রাকেশও তাকাল নিজের বউয়ের দিকে আশ্চর্য দৃষ্টিতে। কোন্ কথা বলবে কাঞ্চনা?
"চয়নদার ছেলে যদি বাধা দেয়? যদি বলে,দাহকাজ ওখানে হবে?" সাহস করে কথাটা বলেই ফেলল কাঞ্চনা। যে কথাটা আধঘন্টা ধরে তাকে বড্ড জ্বালাচ্ছিল। এ ধরনের প্রশ্ন ওঠা কি অস্বাভাবিক? চয়নদার ছেলে আছে। যার বয়েস একুশ বাইশ। ও কি কিছু বলতে পারেনা? তখন কী হবে? আজ প্রায় চল্লিশ বছর চয়ন কলকাতায় আছে। নিজস্ব বাড়ি,সংসার, বউ ছলে মেয়ে....
"কী যে আবোলতাবোল বকছ তুমি! এটা তোমার কথা? আশ্চর্য !" বউকে ধমক দিল রাকেশ। তারপর দাদার দিকে তাকিয়ে বলল,"ওর কথা ছাড়ো তো। কল্পনা করে যা তা বলছে। ওরকম হবে নকি? চয়নদার ছেলে বড় হলেও একটা কথা ছিল। একুশ বাইশ বছরের ছেলে তো বাচ্চা। ও এসবের কী বোঝে? দাহকাজ কোথায় করতে হয়,অন্ত্যষ্টি কোথায় করতে হয় এসব জ্ঞান ওর আছে?"
"ছেলে ছোট হোক বা বড়,পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম সব তো পৈত্রিক ভিটেতেই হয়। এটাই তো চলে আসছে। নিয়ম তো এটাই। আমাদের বাবা মার বেলায় আমরা কি বাইরে অন্ত্যেষ্টি করতে গেছি? চয়নদার বাবা মার বেলায়? সবাই যেটা করে,সেটাই তো আমরা করব। ও বাইরে থাকতে পারে,তাবলে সব কিছু বাইরে হবে নাকি? আমরা ওদের কেউ না? ওদের কোনও দেশের বাড়ি নেই?" একটু বিরক্তই লাগল রাজীবকে। গলার স্বরটা তাই বোধহয় রুক্ষ লাগল।
"তোমরা আসলে কথা বলতেই জানো না।" গজগজ করতে করতে রাকেশ সামনে দাঁড়ানো কাঞ্চনাকে সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। এল রাজীবও। সজলের বাড়ি হয়ে অয়নদার কাছে যেতে হবে এখন। অয়নদাকে যেভাবেই হোক রাজি করাতেই হবে। ঋষভ হয়তো এ প্রশ্নটাই তুলতে পারে,জেঠু কেন এল না?

     অনেক বলেকয়ে অয়নকে রাজি করানো গেল। খবরটা আজ ভোর পাঁচটা পঁয়তাল্লিশে পেয়েছেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে দিতে বৈশাখীই বারণ করেছে ভাই সুখেনকে। বড়দা রোজ সাড়ে পাঁচটার আগে ঘুম থেকে ওঠেন না বৈশাখী জানে। তার ওপর গতকালের জার্নির ধকল ছিল। বয়স্ক মানুষ। অয়ন ফোন ধরতেই তাই সুখেন প্রথমে বলেছিল,"দাদা,উঠে পড়েছেন? শরীরটরীর ভাল আছে তো?" শেষে নিরুপায় হয়ে বলতেই হয়েছে সব। নিদারুণ সত্য কথাটা। "চয়নদা আর নেই। পাঁচটা কুড়িতে মারা গেছে।" বলে সুখেন কেঁদে ফেলেছিল ফোনে। বোনটা তার বিধবা হয়ে গেল!
     গ্রাম থেকে অয়ন,রাজীব,রাকেশ,সজল আর বেচুর কীর্তনদলকে নিয়ে ভোম্বল যখন তার খালি ম্যাটাডোরটা ছাড়ল,ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে আটটা।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments