জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব-২১/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -- পর্ব-(২১)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল


ধর্ম ও মানুষ

ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে কাল্পনিক ঈশ্বর ও দেবদেবীর উপর নির্ভরশীলতা মানুষের জীবনে শুধু যে এক ধরনের সান্তনা, তৃপ্তি ও আশ্বাস সৃষ্টি করে তাই নয়। ধর্মের বলে সে মনে করে,  জীবনের পথে সব বাধা দূর করতে সে আর একা নয়। তার পেছনে ঈশ্বর এবং দেব-দেবীদের বিরাট শক্তি রয়েছে। ঠাকুর তাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবেন, এই বলের প্রভাব থেকে তার যে শক্তি অনুভূতি হয়, তা থেকে সে অনেক সময় এক ধরনের শান্তি আর আনন্দ লাভ করে। অতএব ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত ধর্ম শাস্ত্রীয় বিধান এবং আচার-অনুষ্ঠান পালন এর মধ্যেও, সে শক্তি শান্তি আর আনন্দের সন্ধান পায়। ফলে তার ধর্ম বিশ্বাস আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সেই আত্মবিশ্বাস এবং আনন্দকেই মানুষ যখন ধর্মের সত্যতার প্রমাণ হিসাবে গণ্য করতে থাকে। 

সমাজবিজ্ঞানী 'এমিল দুর্কহাইম' যথার্থই বলেছেন -- The believer who has communicated with his God is not merely a man, who sees new truths of which the unbeliever is ignorant, he is a man who is stronger. he feels within him more force, either to endure the trials of existence, or to conquer them..... it is the cult which gives rise to these Impressions of joy, of interior peace, of serenity, of enthusiasm which are, for the believer, an experimental proof of his beliefs. The cult is not simply a system of signs by which the faith is outwardly translated, it is a collection of the means by which this is created and recreated periodically"

কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে এভাবে কল্পিত অপার্থিব সত্তার সাহায্যে ভাবযন্ত্রনা জয় করবার বাসনা প্রকৃতপক্ষে মানুষের আত্মশক্তি ইতিহাস চেতনা এবং সৃজনীশক্তিকে প্রতিহত করে। ও নিরাপত্তাবোধ এবং উৎকণ্ঠা মূলত মানুষের জাগতিক পরিবেশ, বিশেষত সমাজ ব্যবস্থার মধ্য থেকেই জন্ম নেয়। সে সমাজব্যবস্থা মানুষের সৃষ্টি। আর প্রধানত প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার মানবতা ও বিজ্ঞান ভিত্তিক ভবিষ্যৎমুখী পরিবর্তনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যক্তিমানুষের ঐতিহাসিক দায়িত্ব এবং মুক্তির পথ। ধর্ম মানুষের সৃষ্টি মহাজাগতিক ভূমিকাকেই স্তব্ধ করে দেয়। সে পৃথিবীতে মানুষের দ্বারা সৃষ্ট অন্যায়-অবিচার অমঙ্গলকে ঈশ্বরের লীলা এবং ছদ্দবেশী মঙ্গল রূপে গণ্য করে। নিপীড়িত শোষিত অবহেলিত মানুষ কে সমাজের প্রভু শ্রেণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে ঈশ্বর এবং দেব-দেবীদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে শেখায়। যা প্রকৃতপক্ষে শাসক-শোষক শ্রেণীর কাছে আত্মসমর্পণেরই নামান্তর। ধর্মের সান্ত্বনা ও আশ্বাস সম্পূর্ণ কল্পলোকের অলীক আশ্বাস, যা অসাম্য ও শোষণপীড়নে কলুষিত বাস্তব সমাজ ব্যবস্থাকে এক চুল নড়াতে পারে না। ধর্ম দলিতের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন পৃথিবীর হৃদয়। কিন্তু তথাপি ধর্ম অলীক দর্শনমাত্র। ধর্ম মানব মুক্তির প্রতিবন্ধক। 


নিরাপত্তার অভাব বোধ থেকে মুক্তি পেতে মানুষ যেভাবে ধর্মের আশ্রয় নিয়ে থাকে, তার মধ্যে মাতা-পিতার সঙ্গে মানুষের আশৈশব সম্পর্কের একটা বড় ভূমিকা আছে। শৈশবের সর্বব্যাপী অনিরাপত্তার মধ্যে মাতা-পিতাই শিশুকে নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন। প্রাথমিক পর্যায়ে মায়ের ভূমিকাই বেশি থাকে।  শিশু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তার ব্যাপারে ক্রমশ মায়ের চেয়ে বাবার ভূমিকা বড় হয়ে ওঠে। নিরাপত্তার জন্য মাতা পিতার উপর বাল্যকালের এই নির্ভরশীলতা   ক্রমশ মানুষের ব্যক্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়।

প্রাকৃতিক পরিবেশের অনিরাপত্তা মানুষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেকখানি জয় করতে পেরেছে। কিন্তু পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছে সামাজিক পরিবেশে অনিরাপত্তার অনেক কারণ আছে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা,  অস্বাস্থ্য, অসাম্য, শোষণ, বেকারি, রাজনৈতিক স্বৈরাচার, জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবিদ্বেষ, যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা, ব্যক্তিগত শ্রীবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা, অপরাধীদের তৎপরতা, প্রভৃতি অসংখ্য সামাজিক কারণে মানুষ আজও আজীবন নিরাপত্তার অভাব বোধ করে।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. ভালো লেখা। পর্বগুলি একটু বাড়ুক। মন দিয়ে পড়তে পড়তে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

    ReplyDelete