জ্বলদর্চি

খপ্পর-২ (উপন্যাস) /(উৎসব ১৪২৮) অনিন্দ্য পাল

উপন্যাস : খপ্পর 
পর্ব : দুই  

অনিন্দ্য পাল 
চিত্র- জাহ্নবী সেন


মোটরভ্যানে একটা কারখানার মাল বইতো রঘু। সবিতাও কয়েক বাড়ি রান্নার কাজ করতো। সংসার চলত সবিতার টাকা আর কাজের বাড়ি থেকে পাওয়া বাসি খাবারে। রঘুর যতক্ষণ ভ্যান চালানোর অবস্থা থাকতো, চালাতো। তারপর প্লাটফর্মের পিছনে চোলাই এর ঠেকে। সারাদিন। কখনও রাতে সবিতা গিয়ে ধরে এনেছে। সবিতা পোয়াতি হবার পর, একদিন তুমুল অশান্তি, --" আমি কি বোকা--, ও আমার বাচ্চা নয়, আমি তোর সঙ্গে শুলুম কবে রে খা--? যার মাল তার কাছে যা ----বাচ্চা। " ওর সামনে সেদিন সবিতা রঘুকে ঝাঁটা দিয়ে মেরেছিল। ভয়ে কেঁদে ফেলেছিল ব্যানা। বাবা -- মা কে এই ভাবে লড়তে এর আগে দেখেনি কখনও। 
       কয়েক দিন পর, কি যে হল সবিতার। যে দিন পেট খালি করতে গেল, আগের রাতে ব্যানার মাথায় অনেকক্ষণ হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে কেঁদে ছিল। ঘুমচোখে ব্যানা মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, 
-- মা, ভাই হবে না বোন হবে আমার? 
সবিতা ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলেছিল " ঘুমিয়ে পড় ", আর কিছু মনে নেই সে রাতের। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেছিল, মা আর বাবা চলে গেছে। 
আর ফিরে আসেনি সবিতা। 
     মাসখানেক যেতে না যেতেই রঘু, চম্পাকে যখন ঘরে তুললো, পাড়ার লোক খুব গালাগাল দিয়েছিল। ব্যানা শুনেছে, চম্পা নাকি খারাপ পাড়ার মেয়ে। প্রথমে না বুঝতে পারলেও, তারপর সুতোর কাছে শুনেছে। ঘেন্না পেত তার। ধারে কাছে ঘেঁসতো না চম্পার। তাতে লাভই হলো চম্পার। ব্যানাকে একদিন স্কুলে নিয়ে যাবে বলে রঘু নিয়ে এল এখানে, বাই- পাসের ধারে। একটা গুমটি হোটেল। দিনের বেলা খাওয়া-- খাওয়ানো আর রাতে মদের ঠেক। ভালোই আছে। বাসনপত্র মাজা দিয়ে শুরু, এখন দিনের বেলা টেবিলে খাবার আর রাতে মদ পৌঁছে দেয়। মাস গেলে দুশো টাকা আর খাওয়া দাওয়া। প্রথম মাসের টাকাটা নিতে এসেছিল রঘু। চোখমুখ ঢুকে গেছে কোটরে। সেদিন মদ খায়নি। ব্যানাকে সেদিন আদর করেছিল রঘু। অনেক দিন পর ব্যানা কেঁদে উঠেছিল সেদিন। বাবার বুকে মাথা গুঁজে ছোটবেলার গন্ধ পেয়েছিল। রঘুর চোখদুটো ছলছল করতে করতে কখন ভিজে উঠেছিল, সেটা বুঝতে পারেনি। যাবার আগে বলেছিল, "আর আসবো না। কাজ শেখ, বড় হ, বেঁচে থাক।" 
        কয়েক সপ্তাহ হল একটা নতুন কাজ জুটেছে। হোটেল মালিক রাসুর বান্ধবী কয়েকজন খদ্দের মাঝে মধ্যে রাতে খেতে আসে। তাদের মধ্যে একজন, বিরাট শরীর তার, ব্যানাকে দিয়ে পিঠ ঘাড় টিপিয়ে নেয়। গায়ে চড়া গন্ধ, চামড়া তেলতেলে। কষ্ট না হলেও কেমন যেন একটা অস্বস্তি হয় তার। জৈসা, অন্য দু'জন মহিলা ওই নামেই ডাকে সেই বিশালাকার মহিলাকে। যাবার আগে ব্যানাকে একশ করে টাকা দিয়ে যায়। আর একটা কাজ করে জৈসা। ব্যানাকে চেপে ধরে বুকের উপর। গন্ধ আর শরীরের গরমে ব্যানার দম বন্ধ হয়ে আসে তখন। কোন মতে হাঁচড়-পাঁচড় করে যখন বেরিয়ে আসে সেই মাংসের স্তুপের বাঁধন থেকে, তার সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে যায়। তারপরেই ব্যানার হাতে গুঁজে দিয়ে যায় টাকাটা। 
    ব্যানা সবে বোতল থেকে গ্লাসে ঢালতে যাবে, হঠাৎ রাসু বাইরে থেকে বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো --
এই বানা, এই শোন, বাইরে আয় । তাড়াতাড়ি। 
কোনো মতে বোতলটা বন্ধ করে কুদ্দুসের লুঙ্গির নিচে লুকিয়ে ফেলে বাইরে এল। রাসু সায়া আর ব্লাউজ পরে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানের সামনে একটা কালো কাচ দেওয়া গাড়ি। রাসু আলতো করে তার কাঁধে দুটো হাত রেখে বললো, 
 --- যা তো বানা, ওই জৈসা দিদিমণি এসচে, ওর ফেলাটে কি কাজ আছে, দুদিন ঘুরেও আসতে পারবি। ভালো টাকাও দেবে। আমি নেবো না। যা তো।
ব্যানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাসু তার হাত ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে এল। পিছনের দরজা খুলে গেল। ব্যানা দেখলো, হালকা নীল আলোতে ভিতরে জৈসা।
একটা শাড়ি আলতো করে জড়ানো গায়ে। সেই হাল্কা আলোতেও পরিস্কার ফুটে উঠেছে শাড়ির ভিতরের অন্য এক জৈসা। একটা ঘোরের মধ্যে গাড়িতে উঠে বসলো ব্যানা।
তিন#
=======
"মাসীমা, আপনি কোথায় নামবেন? "
চমকে উঠলেন বিজয়া! গভীর চিন্তায় ডুবে ছিলেন, তাই প্রশ্নটা শুনে প্রথমে কিছু বলে উঠতে পারলেন না। 
মনেই পড়ছিল না। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। এর আগে কখনো এই ভাবে একা একা এরকম অজানা অচেনা জায়গায় যাননি কখনও। অযোধ্যা পাহাড় আর মাওবাদী এই শব্দ দুটো ছাড়া এই পুরুলিয়া জায়গাটা সম্পর্কে খুব একটা কিছু এর আগে শোনেন নি কখনও। নিজে একটা উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। এই সদ্য অবসর নিয়েছেন। স্বামী ছিলেন বেসরকারী চাকুরে। মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে হঠাৎ হার্ট ফেলিওর। ছেলে তখন সবে চাকরি পেয়েছে সল্টলেকের একটা আই টি কোম্পানিতে। চিরকাল লাল রঙের শাড়ি, সালোয়ার পছন্দের ছিল বিজয়ার। নিজে কখনও কুসংস্কার বা চাপিয়ে দেওয়া প্রথা বিশ্বাস করেন নি। কখনও শাঁখা সিঁদুর পলা লোহা এসব পরে নিজেকে পতিব্রতা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন নি। তবু, সৌমেন মারা যাবার পর লাল রঙটা আর গায়ে তুলতে পারলেন না কিছুতেই। একটা অদ্ভুত অনিচ্ছা, সব ভালো লাগা গুলোকে দুমড়ে মুচড়ে কোথায় ছুঁড়ে ফেলে দিল, আর খুঁজে পেলেন না। 
--বরাভুম নামবো। 
বলেই জিভ কাটলেন। খেয়াল হল বসে আছেন বাসে। আসলে আজ সকাল থেকে এই বরাভুম যাওয়া নিয়ে যা হচ্ছে, তাতে রাজার হাটের বাসে বসে, বরাভুম নামবো বলাটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। মাথায় সারাক্ষণ ওই চিন্তাই ঘুরছে। নিজের এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য লজ্জা পেলেন একটু ।
সামান্য হেসে বললেন, 'লোকনাথে নামবো।' 
ছেলেটা একটু হেসে বললো , 'তাহলে এখানেই দাঁড়িয়ে পড়ি, আপনি নামলে বসে যাবো। আর দুটো স্টপেজ পর লোকনাথ।' 
           জানালা দিয়ে তীব্র গরম হাওয়া এসে লাগলো চোখে মুখে। বিজয়া দেখলেন বছর কয়েক আগে যেখানে ধুধু ধানজমি ছাড়া আর কিছুই নজরে আসতো না, এখন অর্ধনির্মিত বা নির্মিত বিভিন্ন ধাঁচের ফ্ল্যাট বাড়িতে ভরে উঠছে। কোলকাতা গিলে নিচ্ছে চারধারের গ্রাম বাংলার নিজস্বতা এবং প্রকৃতিকে। উপচে পড়া জনসমুদ্র থিতু হতে চাইছে এই সব সদ্য গড়ে ওঠা নাগরিক ঠিকানায়। এতে ভালো যেমন হয়েছে, খারাপও কিছু কম হয় নি। এই অঞ্চলের মানুষের হাতে যেমন টাকা এসেছে, তেমনি বেড়েছে দুষ্কৃতি দৌরাত্ম। জীবন যাত্রার মান যেমন খানিকটা শহুরে ঘেঁষা হয়েছে, তেমনি তোলাবাজি, সিন্ডিকেটের জুলুম এখন হাইরাইজের মতই আকাশ ছুঁয়েছে। 
           এই এক কামরার ফ্ল্যাটটা কিনে যেদিন প্রথম এলেন, প্রথম ধাক্কাটা এল সেদিনই। নিচে , যেখানে সিকিউরিটি গার্ড থাকার কথা, সেখানে জনা ছয়েক মুখ, একটা কমবয়সি ছেলেই শুরু করেছিল --
--" ম্যাডাম, আপনার সঙ্গে কথা ছিল। "
বিজয়া একাই ছিলেন। ফলে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। এই রকম স্ উচ্চারণ ও সামনের মানুষ গুলোর কিছুটা পরিচয় দিয়েই দেয়। উপরন্তু কয়েকজন ষন্ডাগোছের লোক দাঁড়িয়ে ছিল গেটের মুখটাতে। বাইরের কেউ আসতে পারবে এমন সম্ভাবনা নেই। তবু ত্রিশ বছর ছাত্রী সামলে যেটুকু সাহস, আত্মবিশ্বাস ছিল তার জোরে মুখোমুখি হয়েছিলেন এই অপরিচিত লোকগুলোর। 
-হ্যাঁ বলুন। কী ব্যাপার? 
-- আপনি এই কমপ্লেক্সে থার্ড ফ্লোরে একটা ওয়ান বেডরুমের ফ্ল্যাট নিয়েছেন তো? আপনার নাম বিজয়া নাথ তো। 

এবার এগিয়ে এল একজন মাঝবয়সি রোগা পাতলা লোক। মাথার চুল গুলো লালচে খয়েরি ডাই করা। গায়ে হালকা হলুদ পাঞ্জাবী,চোঙা জিনসের প্যান্ট। লোকটা গুটকার থুতু ফেলে, শুরু করলো 
-- দিদি, আস্-লে আমরা এই রোদ্দুর কেলাবের, বুঝলেন। আপনাদের ভালো মন্দ দেখতে হয়।  খাতির, তরফদারি করতে হয়। এলাকার সবাই আমাকে কাল্লুস বলে চেনে। আপনিও চিনে যাবেন। ওই আমরা একটা সেলামি পাই তো সবার থেকে, সেটাই বলতে এসছিলাম আরকি। এই নুতো ম্যাডাম কে কাগজটা দে না। 
   লোকটা চিবিয়ে চিবিয়ে কথা গুলো বলে সেই কম বয়সী ছেলেটার দিকে ইসারা করলো। একটা বিল এগিয়ে ধরলো নুতো নামে সেই কম বয়সী ছেলেটা। বিলটা রোদ্দুর ক্লাবের নামে। ক্লাবের উন্নতি কল্পে পঁচিশ হাজার টাকা বিজয়া নাথ দিচ্ছেন, এবং সেটা ধন্যবাদ সহকারে গ্রহণ করা হচ্ছে। 
"মাসিমা, লোকনাথ এসে গেছে। নামবেন না "
সময়ের মঞ্চ থেকে যেন একটা ধাক্কা দিয়ে কেউ নামিয়ে দিল, বিজয়া দেখলেন স্টপেজ এসে গেছে ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments