জ্বলদর্চি

বিরহ গাথা/(উৎসব ১৪২৮)/সুরশ্রী ঘোষ সাহা

বিরহ গাথা
সুরশ্রী ঘোষ সাহা 


'শোনো, স্যুটকেসে তোমার জামাকাপড়ের তলায় অফিসের ফাইলগুলো দিয়েছি। আর ওষুধ পত্র - খাবার সবকিছু ওই লাল ব্যাগে ভরেছি।' ফোনে উশ্রী জানায় সুবলকে। ক'দিনের জন্য অফিসের কাজে পুনে যাচ্ছে সুবল। রাতের হাওড়া মুম্বই মেল ছেড়ে দিয়েছে। ব্যাগপত্র জায়গা মতো গুছিয়ে রেখে তারপর ফোন করেছে উশ্রীকে। 'তোমরা সাবধানে থেকো, বুঝলে। এখন শুয়ে পড়ি। টায়ার্ড লাগছে খুব। কাল সকালে ফোন করব।' বলে সুবল ফোন রেখে লাইট অফ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। 

উশ্রী ছেলে নিয়ে ঘরে একা। ওদের ছোট্ট আড়াই জনের সংসার প্রায়শই এমন দেড় জনের হয়ে যায়। সুবলকে অফিসের কাজে নানা দিকে যেতে হয়। উশ্রী এখন একা থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। খুবই ঘরোয়া লাজুক ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের মেয়ে সে। সাত বছর আগে সুবলের সাথে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছিল। বিয়ের দু'বছর পর সন্তান ঋক জন্মেছে। তারপর থেকে ছেলেকে নিয়েই কেটে যাচ্ছে জীবন। অন্যদিকে সুবল আবার কাজ পাগল ছেলে। তবে বৌ-ছেলের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যে কোন ত্রুটি রাখে না। 

তখন বেলা ন'টা কী সাড়ে ন'টা। ছেলে মর্নিং স্কুলে। উশ্রী নিজের জলখাবারটা নিয়ে ডাইনিং হলের টিভিটা চালিয়ে বসেছে। সকালের দিকে রোজ খবর দেখা স্বভাব। টিভিতে একটা ট্রেন অ্যাকসিডেন্টের খবর চলছে। বিহারের কোন এক জায়গায় অ্যাকসিডেন্টটা ঘটেছে। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। যে ট্রেনে সুবল আছে, সেই ট্রেনটাই অ্যাকসিডেন্টের কবলে পড়েছে। অস্থির হয়ে পড়ে। ফোনটা বেডরুম থেকে নিয়ে এসে সুবলকে ডায়াল করে। দা নম্বর ইউ হ্যাভ ডায়ালড্ ইজ় সুইচড অফ, বারবার রেকর্ড চলতে থাকে। খবরের সঞ্চালিকা বলে চলেছে দু-তিনটে বগি উল্টে গেছে। কী কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। 

একটু বেলা হয়েছে। ছেলে পুলকার থেকে নেমে দৌড়তে দৌড়তে দরজা ঠেলে ঢোকে। উশ্রী ততক্ষণে এদিক ওদিক নানা জনকে ফোন লাগিয়েছে। কোন কিছু খবর পায়নি। সুবলের ফোন এখনও সুইচড অফ, সেখানেও যোগাযোগ করা যায়নি। 

উদ্বিগ্ন হয়ে উশ্রী ফোন করেছে ভাইকে। ঠিক করেছে, সে আর ভাই অরূপ যাবে বিহারের ট্রেন অ্যাকসিডেন্টের স্থানে। রেল কর্তৃপক্ষ আহত নিহতদের লিস্ট টাঙিয়েছে, বাড়ির লোককে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। বেরুনোর আগে একটা ফোন আসে অচেনা নম্বর থেকে। প্যাসেঞ্জার নাম সুবল মিশ্রর বাড়ির লোককে বডি সনাক্ত করার জন্য তারা ডেকে পাঠায়। উশ্রী অজ্ঞান হয়ে পড়ে। অরূপ মাকে বলে, 'আমি জামাইবাবুর কাছে যাচ্ছি। দেখে আসছি। তুমি দিদিকে সামলাও। অমন ভেঙে পড়ো না। ভগবানকে ডাকো যেন ভুল খবর হয়'। 

সন্ধ্যার অন্ধকারে অসংখ্য আহত নিহত মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে অরূপ দেহ সনাক্ত করে আসে। মুখ একেবারে বীভৎস হয়ে গেছে অ্যাকসিডেন্টে। চেনার উপায় নেই। তবু শরীরের গড়ন, হাইট ট্রেনের সিট নং সব কিছু প্রমাণ দেয় ওটা সুবলই।

সুবল মারা যাবার পর রেল কর্তৃপক্ষ উশ্রীকে রেলে চাকরি ও সুবলের জীবনের ক্ষতিপূরণ বাবদ সাড়ে তিন লাখ টাকা দেয়। উশ্রী শুনে প্রথমে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। 'মানুষ রইল না, টাকা নিয়ে কী করব!' ভাই বোঝায়, 'বোকার মতন কথা বলিস না দিদি। টাকা নিয়ে কী করবি মানে? মানুষটাকে ওরা ফিরিয়ে দিতে পারবে না, তাই এই ক্ষতিপূরণ। তোর ভবিষ্যৎ এটা। ঋকের ভবিষ্যৎ।' 

এখন নতুন জীবনে উশ্রী অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তার মা এখন মেয়ের কাছে থেকে নাতিকে দেখাশোনা করে। উশ্রীর চাকরির জায়গা ভালই লাগছে। সকালে রোজ ধাক্কাধাক্কি করে নৈহাটি-শিয়ালদহ লোকালের লেডিস কম্পার্টমেন্টে ওঠে। যত মানুষ, ততই তাদের ভিন্ন জীবন। অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে। ট্রেনের বন্ধুদের একটা আলাদা গ্রুপ। অফিস কলিগদের আলাদা গ্রুপ। সবার সাথে মিষ্টি ব্যবহার রাখে সে। তাদের সাথে ফোনে চ্যাটে যোগাযোগ রক্ষা করে। পিকনিক যায়। প্রায় দিনই এটা ওটা পার্টি লেগে থাকে। কিছু না থাকলে উইকেন্ডে আড্ডা দেয়। উশ্রীকে কলিগরা কেউ হিংসা করে না। একটা সিমপাথি কাজ করে সবার মনে। শাখা সিঁদুর খোয়ানোর সিমপাথি। সবাই ওকে ভালবাসে। বাকিদের মধ্যে পদের উন্নতি নিয়ে ঈর্ষার লড়াই চলে সর্বদা। 

সুবলের মৃত্যুতে সরকার থেকে পাওয়া পুরো টাকাটাই ফিক্সড ডিপোজি়ট করে রেখেছে ব্যাঙ্কে। সুবলের অফিসও কিছু দিয়েছিল, সেইসব মিলিয়ে পুরো পাঁচ লাখ মতন টাকার মালিক এখন উশ্রী। 
আগের চেয়ে এখন সে অনেক বেহিসাবি। যখন ইচ্ছা হয় পছন্দের শাড়ি - জুতো - ঘড়ি কেনে। ঘনঘন মোবাইল বদলায়। স্বামীর রোজগারের পয়সায় এইসকল সুখ কোনদিনই পায়নি। ইচ্ছে হলেও বেশি কিছু চাইতে পারত না। কোথায় যেন বাঁধত। তখন উশ্রীর জীবনে প্রয়োজনটাও ছিল সীমিত। ঘর থেকে বেরুনো ছিল হালেকালে। এখন ঘরে থাকা আর ছেলেকে সময় দেওয়ারই সময় নেই তার হাতে। 

সেদিন অফিস থেকে কলিগদের সাথে একটা রুফ কনসার্টে গিয়েছিল উশ্রী। অল্পবয়সী ছেলে মেয়েরা পুরনো দিনের গানগুলোকে নতুন করে গাইছিল। শচীন দেব বর্মনের 'বিরহ বড় ভাল লাগে' গানটা শুনে এসে থেকে মনের মধ্যে বাজছে। সেটাই গুনগুন করছিল উশ্রী। হঠাৎ কলিংবেলটা ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল। রাতের নাইটির উপরের পার্টটা জড়িয়ে ফিতে বাঁধতে বাঁধতে উশ্রী দরজা খুলতে গেল।

দরজা খুলে সামনের মানুষটাকে দেখে মাথাটা ঘুরে গেল। সুবল এক মুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 'কেমন? চমকে গেলে তো?' জড়িয়ে ধরল উশ্রীকে। দরজা বন্ধ করে ডাইনিং হলের দিকে এগোল তারা। 'কে রে?' বলে নাতিকে নিয়ে উশ্রীর মা অন্যঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ডাইনিং হলে। ছেলেটা চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে সুবলের দিকে। শাশুড়ি মা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেন আর আনন্দে কাঁদেন। 'আর কাঁদবেন না মা, আমি পুনর্জন্ম পেয়ে ফিরেছি। চোখের জল ফেলার দিন শেষ', ছেলেকে চুমু খেতে খেতে বলে সুবল। 
'কিন্তু কীভাবে এমনটা হল বাবা?' প্রচন্ড বিস্মিত মুখে জানতে চান শাশুড়ি। 
'ট্রেনে ওঠার পরদিন ভোররাতে বাথরুমে গিয়েছি, হঠাৎ দেখা ব্যাচমেট সঞ্জয়ের সাথে। ওর অন্য কামরায় সিট ছিল। আমাকে টেনে নিয়ে গেল ওর জায়গায়। বলল, খুব ভাল হয়েছে তোর সাথে দেখা হয়ে। বেশ গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। এক বছরের ছোট ভাই রূপমকে পাঠিয়ে দিল আমার সিটে। আর আমরা দুই বন্ধু ওদের দুই ভাইয়ের সিটে বসে গল্প করতে করতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই শরীরে ভীষণ ঝাঁকুনি অনুভব করি। তারপর কী ঘটে আমাদের সাথে জানতে পারি না। কয়েকদিন আগে আমার জ্ঞান ফিরলে জানতে পারি আমি হাসপাতালে ভর্তি আছি। ট্রেন অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। আমি মরিনি কিন্তু কোমায় চলে গিয়েছিলাম। জ্ঞান ফিরতে হাসপাতাল থেকে আমাকে বলেছিল আপনার ঠিকানা বলুন, আমরা খবর পাঠাচ্ছি। আমিই কিছু বলিনি। একেবারে সশরীরে ফিরে সারপ্রাইজ দেব বলে। কাল ডিসচার্জ হয়েছি। তারপর ট্রেন ধরে ফিরলাম আজ।' কথাগুলো বলে দুর্বল শরীরে বেশি করে দম নিল সুবল। তারপর টেবিল থেকে জলের জাগ তুলে ঢকঢক করে চুমুক দিল। 
'তাহলে তোমার সিটে যে বসেছিল... ' শাশুড়ি সন্দিগ্ধ হলেন। 
'হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে মা। আমার সিটে বসে থাকা সঞ্জয়ের ভাই কি তাহলে সেদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল? আর আমি তার পরিচয় নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় আশ্রয় নিয়েছিলাম! জীবনটাই কেমন যেন ধোঁয়াশা হয়ে উঠেছে।'
'যার যা পরমায়ু বাবা, বাদ দাও ওসব কথা। মা করুণাময়ীর কৃপায় তুমি যে ফিরে এসেছো' বলে কপালে দু'হাত তুলে নমস্কার করলেন উশ্রীর মা। 
'আমার বন্ধুর কী হল জানতে ইচ্ছে করছে খুব। ওর সাথে দেখা না হলে তো ...' 

উশ্রী নদীর মতন উশ্রীর চোখের জলের ধারা সারা রাত বয়েই চলল। সুবল পিঠে হাত দিয়ে বলে, 'আমি তো এসে গেছি, আর কখনো কোথাও তোমায় ছেড়ে যাব না, দেখো'। 

সুবল জানতে পারল না, স্বামীর জীবনের চেয়েও তার মৃত্যুতে পাওয়া নতুন স্বাধীন জীবন হারানোর দুঃখ-বেদনা চাকুরিরতা উশ্রীর বুকে তখন অনেক বেশি তোলপাড় তুলেছে। 

আরও পড়ুন 


Post a Comment

0 Comments