জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে 'অসাধারণ'-এ উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী -৮/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৩৯


মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে 'অসাধারণ'-এ উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী ― ০৮

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ― ০১ 

ধোঁয়া ওঠা পাহাড়ী ঢাল বেয়ে সোজা নিচে নেমে গেছে পাকা রাস্তা; দোতলা সাদা বাড়ির উঠোন থেকে। ঢালু প্রসস্থ সড়ক। ঢেউ খেলানো। শহুরে কোলাহল বর্জিত পথের দু'পাশে অরণ্যের আদিম নৈঃশব্দ্য। রাস্তায় বিছানো শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি। ওক, পাইন, দেবদারু আর লাল চিনার পাতার খসখস মড়মড় শব্দ খালি। রাস্তার দু'পাশে ঘন জঙ্গল, সবুজ বনানীর আচ্ছাদন। অরণ্যে ঘুরে বেড়ায় বনজ জীবজন্তু, পশুপাখি। পাহাড়ের কোলে খোলা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় হরিণ। ইত্যবসরে দিনের আলো নিভলে হানা দেয় চিতাবাঘ। এ যেন বন্য জন্তুর আদর্শ মৃগয়াভূমি।

এ হেন আরণ্যক নির্জনতার ভেতর পাহাড়ের কোলে গড়ে উঠেছে এক ন্যানো-সেন্টার, ওই দোতলা সাদা বাড়িতে। সে-সাদা বাড়িই কুমায়ুন ইউনিভার্সিটির ন্যানো সায়েন্স ল্যাবের ঠিকানা। উত্তরাখণ্ড রাজ্যের প্রথম ন্যানো-টেকনোলজি গবেষণা কেন্দ্র। পাহাড়ের এত উপরে যে, এখান থেকে গোটা নৈনিতাল শহর, লেক একলপ্তে চাক্ষুষ করা যায়। নৈসর্গিক প্রাকৃতিক দৃশ্যপট। গ্রীষ্মে দরজা জানালা খোলা পেয়ে ঘরের মধ্যে মেঘবালিকারা ঢুকে পড়ে, খেলা করে। বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিয়ে নিমেষে অন্তর্হিত হয় অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে! প্রচণ্ড শীতে হানা দেয় গুঁড়ো গুঁড়ো স্নো; বরফের মোটা চাদর জড়িয়ে ধরে রাখে গোটা বিল্ডিং, পাঁচ-ছয় দিন। অরণ্যের যত চিতা, হরিণ; সব খোঁজ নিয়ে যায় গবেষণার আপডেট।

শূন্য থেকে শুরু হল গবেষণা; সাদা বাড়ি থেকে। ন্যুনতম পরিকাঠামোর বালাই ছিল না। প্রথমদিকে গবেষণাগার গড়ে তোলার যাবতীয় ফান্ডও অমিল। অথচ শূন্য থেকে শুরু করে আজ ন্যানো-সেন্টার গবেষণাগারে পর্যাপ্ত সব যন্ত্রপাতি, মেশিন। এত সব উত্থানের পশ্চাৎ ইতিহাস কম রঙিন নয়! রঙিন কুমায়ুন বিশ্ববিদ্যালয়ে নন্দগোপাল বাবুর অতিবাহিত শেষ দ্বি-বৎসরাধিক কাল। শুরুটা হয়েছিল সে-ই ২০১৩ সালের জুলাই-আগস্টে।

(দুই)
তখনও অব্যাহত টালবাহানা। দোদুল্যমানতা। অসহায় মনের দোটানা। খাতা-কলমে আত্মমর্যাদা, আত্মসম্মান আর স্বাধিকার অটুট রইল ষোলআনা; তবে শরীরে, মনে দারুণ ক্লান্ত তিনি। দিল্লী-নৈনিতাল-কোর্ট-ইউনিভার্সিটির চক্কর কাটতে কাটতে সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত প্রায়। হৃদয়ে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে। ভালো নয়, বিরূপ মনোভাব ছেয়ে আছে চিন্তনে। সংশয়ের লম্বা ফিরিস্তি। মাথার মধ্যে অঙ্কের জটিল সমীকরণ। মনের মধ্যে আশঙ্কার ঘন কালো মেঘ― কুমায়ুন বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে টেনশন-শূন্য গবেষণার কাজ করতে পারবেন কি-না। বিরোধিতার যে-প্রাচীর তিনি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, তা হিমশৈলের চূড়া মাত্র নয় তো! কে জানে― আসল লড়াই হয়তো পরে অপেক্ষা করে আছে! তো, আপাতত অতীত সে-যুদ্ধ জয়। এখন অনেক বেশি রিলাক্সড তিনি। এ কথা সর্বৈব সত্য― কষ্টার্জিত ফল সর্বদা মিঠা হয়। সাফল্যের রাস্তা কুসুমাস্তীর্ণ নয়, সবসময় কঙ্কটাকীর্ণ। সাফল্যের পথে, অগ্রগতির পথে দু-এক ঝোল চোনা, বাধা থাকবেই। সে-বাধা কাটিয়ে ওঠার নামই জীবন। বাস্তবের রুক্ষ জমিতে দাঁড়িয়ে অশুভ আঁতাতের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যথেষ্ট মনোবল তাঁর রয়েছে। কিন্তু মনের মধ্যে সংশয়ের তীর চলে গিয়েও যাচ্ছে না! থেকে থেকেই ফণা তুলছে― ভারতে ফিরবেন, না-কি রিফিউজ করবেন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের সম্মানিত চাকুরী।

কলিদেবীর খাঁটি পরামর্শ― যা হবার হয়েছে। চল, দেশে ফিরে যাই।
শান্তিদা আর লক্ষ্মীদারও একই মত― এত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সব যখন ঠিকঠাক এগোচ্ছে, তখন তুই দেশে চলে যা।
২০১৩ সালের আগস্ট মাস। সিঙ্গাপুরের পাততাড়ি গুটিয়ে সপরিবার ইন্ডিয়া প্রত্যাগমণ করলেন নন্দবাবু। কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি যোগ দিলেন। ফিরে আসা অব্দি মনে ফুরফুরে আমেজ। দারুণ অভিজ্ঞতা। প্রত্যেক ফ্যাকাল্টির উষ্ণ ব্যবহার, মিষ্টি অভ্যর্থনা, আন্তরিকতা আর সাহায্যের আকুল প্রয়াস নজর কাড়ে। তাঁকে কেন্দ্র করে আর কোনও সমস্যা নেই ক্যাম্পাসে। টেনশনের লেশমাত্র শূন্য।

নাহ, অমূলক তাঁর এত দিনের ভাবনা। অকারণ তাঁর সন্দেহ। নিয়োগ পূর্ববর্তী সে-লড়াই এখন অতীত। কুমায়ুন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের উত্তম পরিবেশ। সকলের সঙ্গে দুর্দান্ত সৌহার্দ্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠে নন্দগোপাল বাবুর। ভালো কাজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। তাঁর দিকে একগুচ্ছ সাহায্যের লম্বা হাত সবসময় বাড়ানো। শুধু ধরার অপেক্ষা মাত্র। যারপরনাই খুশি নন্দগোপাল বাবু।

বিশ্ববিদ্যালয় জয়েনিং-এর সময় কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে যেন চাঁদের হাট। প্রায় তেরো জন অধ্যাপক ডিপার্টমেন্টে। বিভাগীয় প্রধান এক মাতৃসমা স্নেহময়ী মহিলা। প্রফেসর শ্রীমতি গঙ্গা বিস্ত ম্যাডাম। ছেলের মত ভালোবাসেন নন্দগোপাল বাবুকে; সে-ই প্রথম দিন থেকে। আর ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর এইচ এস ধামি স্যারের মতো ভালো মানুষ আর হয় না। সাক্ষাতের সময় থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর উপকার ভোলার নয়। মনে প্রাণে তিনিও আশাবাদী― ড. নন্দগোপাল সাহু কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি জয়েন করুক। এর পরের ঘটনা আজ অতীত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম― চাকুরী এক বৎসর সম্পূর্ণ না হওয়া অব্দি রিসার্চ স্টুডেন্ট পাবে না কোনও অধ্যাপক। মহা মুশকিল ব্যাপার! তাহলে এই এক বৎসর কাল তাঁর কীভাবে কাটবে? এক বছরের অজ্ঞাত বাসে মাস্টার ডিগ্রির ক্লাস নিয়ে কাটাতে হবে তাঁকে! ডিপার্টমেন্টের যুতসই পরিকাঠামো নেই যে পুরো সময় গবেষণায় ডুবে থাকবেন। বিশ্বমানের না হোক, নিদেনপক্ষে মাঝারি মানের ল্যাবরেটরির বড্ড আকাল। আসলে তাঁর সাধ আর সাধ্যের মাঝখানে বিস্তর ফারাক। অভাব উদ্যমের নয়; ল্যাব-এর জন্য দরকারী অর্থের জোগানে টান।

এম এস সি'র পাঠক্রমের ক্লাস নেওয়া দিয়ে শুরু তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলি। কিন্তু প্রতি পদে ঠক্কর খান হিন্দি বলার জন্য। হিন্দি ভাষায় তিনি তত সড়গড় নন কিনা! উত্তরাখণ্ড-সহ সমগ্র উত্তর ভারতকে বলা হয় 'হিন্দি বলয়'। বিস্তীর্ণ এ অঞ্চলের কথ্যভাষা হিন্দি। ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় কথা বলতে যতটা স্বচ্ছন্দ বোধ করে এ অঞ্চলের আবালবৃদ্ধবণিতা, অন্য ভাষায় ততটা নন। এম এস সি'র ক্লাসে মাঝেসাঝে স্টুডেন্টরা বায়না করে― হিন্দি অথবা ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিন, প্লিজ। হিন্দি লেকচারে নন্দ স্যারের আড়ষ্টতা আছে ঠিকই, নিয়মিত কথোপকথনে সে-বাধাও অচিরে দূর হল।

(তিন)
২০১৪ সালের জানুয়ারি'র কনকনে ঠাণ্ডা। এক মাসের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার কনকুক ইউনিভার্সিটি রওনা হয়ে গেলেন তিনি; এবার ভিজিটিং প্রফেসরের বেশে। তীব্র শীতের ভেতর গরমাগরম খবর এল। ইন্দো-আমেরিকা বৃত্তির সুখানুভূতি প্রাপ্তির টাটকা খবর। ইন্দো-ইউ এস এ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফোরাম (Indo-USA Science & Technology Forum)-এর উদ্যোগে সোলার এনার্জির উপর একটি ফেলোশিপ 'ভাস্করণ অ্যাডভান্সড সোলার এনার্জি' (Bhaskaran Advanced Solar Energy বা।সংক্ষেপে, BASE) বৃত্তি। খুব সম্মানের ফেলোশিপ। মূলত ভারতীয় বৈজ্ঞানিকগণের ভালো কাজের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে সিলেকশন চূড়ান্ত করা হয়। কোরিয়ায় থাকার কালে এই শুভ সংবাদ পেলেন। স্বভাবতই বেশ উৎফুল্ল তিনি। এক মাস পর পয়লা ফেব্রুয়ারি নৈনিতালে ফিরে এসে কিছু দিন ইউনিভার্সিটির ক্লাসে ব্যস্ত রইলেন।
     

এভাবে কেটে গেল মাস ছয়েক। ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে ফের রওনা হয়ে গেলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটি। ইউনিভার্সিটির একজন প্রথিতযশা অধ্যাপক প্রফেসর জেমস টি ম্যাকক্লাস্কি (Prof. James T. McClusky) স্যার। তাঁর অধীনে ছয় মাস ধরে চলল পোস্ট-ডক্টরেট গবেষণা। আমেরিকার সফর শেষ হয় ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে। ফিরে আসার দু'মাস পরে নৈনিতালে তাঁর জন্য আবার দারুণ খবর। নিজের ল্যাব তৈরির জন্য পঞ্চাশ লক্ষ টাকার অনুদান ব্যবস্থা হয়েছে। অভাবনীয় ব্যাপার! এ যে জল না চাইতেই বৃষ্টি! এতদিনে ভাগ্যলক্ষ্মী সুপ্রসন্ন হয়েছেন। তাঁর দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। তাঁর এতদিনের স্বপ্ন সার্থক হওয়ার দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। ক্ষীণ সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলোকের সুলুক সন্ধান!

নৈনিতালের স্থানীয় সাংসদ শ্রী তরুণ বিজয় স্যার। রসায়নের অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি গড়ে তুলতে তিনি দিয়েছেন পঞ্চাশ লক্ষ টাকার চেক। টাকা তো জোগাড় হল! গবেষণাগার হবে কোথায়? তেমন যুতসই বিল্ডিং কোথায়? উপযুক্ত কক্ষের বড্ড আকাল। অনেক ভেবে চিন্তে স্থির হল― ইউনিভার্সিটির মূল বিল্ডিং-এর ওপরে চড়াই পেরিয়ে পুরোনো ফাঁকা মতন যে ঘরটিতে এম এস সি কেমিস্ট্রি'র ক্লাস হত, গবেষণার জন্য সেটাই হবে আদর্শ জায়গা। শহুরে কোলাহল থেকে দূরে; বেশ নিরিবিলি। অনেক টালবাহানার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবুজ সংকেত মিলল। গড়ে উঠল রসায়নের একটি পৃথক বিভাগ 'ন্যানো-সায়েন্স অ্যান্ড ন্যানো-টেকনোলজি' (Nano-Science & Nano-Technology)। এ হেন ন্যানো-সেন্টারের পথ চলা শুরু হয় ২০১৫ সালের মার্চ মাসের শেষার্ধে। গোটা উত্তরাখণ্ড রাজ্যে এমন ন্যানো-সেন্টার সে-ই প্রথম।

ওই বছরের জুন-জুলাই মাস নাগাদ রিসার্চ স্টুডেন্ট এল ন্যানো-সেন্টারে গবেষণা করতে।

(চার)
ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস এক জায়গায় গোছানো নয়। পাহাড়ের কোলে বিক্ষিপ্তভাবে ইতস্তত ছড়ানো-ছেটানো বিল্ডিংগুলি। মূল ক্যাম্পাস থেকে ন্যানো-সেন্টার মিনিট কুড়ির হাঁটা পথ। পাহাড়ের বেশ কিছুটা উপরে; চড়াই ভেঙে উপরে উঠতে হয়। ন্যানো-সেন্টারের নিচে সামান্য উতরাই পেরিয়ে রাজভবন; রাজ্যপালের বাসস্থান। রাজভবনের সামনের রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছনো যায় ন্যানো-সেন্টারের সাদা বাড়িতে। 

প্রথম প্রথম এই সাদা বাড়িতে এম এস সি'র ক্লাস হত। এখন বন্ধ। মাস্টার ডিগ্রির ক্লাস নিচের মূল ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়েছে। ফলে উপরের সাদা বাড়িটি পুরোপুরি ফাঁকা পড়ে ছিল। এ হেন বাড়িতে গড়ে উঠল বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যানো-প্রযুক্তি। সেটা ২০১৫ সালের মার্চ মাসের কথা। জুন-জুলাই মাস নাগাদ রিসার্চ স্টুডেন্ট আসে। বাড়ির একটা অংশে চারখানা রুমে ন্যানো-পারটিক্যাল গবেষণার মেশিন পত্র, ইনস্ট্রুমেন্টে ঠাসা। অপর একটা রুমে নন্দবাবুর নিজস্ব ল্যাবও আছে। বাড়ির বাকি অংশে আরও দুজন প্রফেসরের ল্যাবরেটরি।  এ হেন সাদা বাড়িতে মাঝেসাঝে রাতের অন্ধকারে হানা দিত চিতা।
        

পাহাড় চূড়ায় গবেষণার দারুণ ঝক্কি! প্রাকৃতিক দূর্যোগ হোক কিংবা কোনও অচ্ছুৎ কারণ, হামেশাই দুই-তিন দিন ইলেকট্রিকের দেখা মেলে না। তখন সব কাজকর্ম শিকেয় ওঠে। হাত-পা গুটিয়ে কারেন্টের জন্য জপ করা ছাড়া অন্য গত্যন্তর থাকে না। শীতে সমস্যা আরও প্রকট হয়। তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নেমে যায়। বরফ পড়ে। বরফ জমে থাকে পাঁচ-ছয় দিন। কাজ করতে বেশ বেগ পেতে হয়।

(পাঁচ)
ন্যানো-সেন্টারের জন্য আলাদা করে কোনও গ্র্যান্ট নেই ইউনিভার্সিটির তরফে। অনুদান ছাড়া গবেষণার কাজ এগোবে কীভাবে? ফান্ড জোগাড় করা মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমন সময় ল্যাবে এক বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। ল্যাবের ভেতরে কোণায় কিছু প্লাস্টিক জড়ো করা ছিল। না জানি কোত্থেকে, হঠাৎ প্লাস্টিক পোড়ানোর বিকট গন্ধে ম ম করছে গোটা ল্যাব। ঠাহর হল― প্লাস্টিকে আগুন লেগেছে। আগুনের তীব্রতা খুব বেশি নয়। তবে ঘরময় ধোঁয়ার কুণ্ডলী।

মজার বিষয় হচ্ছে― এমন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা থেকে সঠিক ভবিষ্যৎ কাজের দিশা পেল ল্যাবরেটরি! সে-দিন প্লাস্টিকগুলো পুড়ে গিয়ে কালো যে অবশেষ পাওয়া গেল, তা-ই 'ব্ল্যাক-পাউডার'। ব্ল্যাক-পাউডার কী? ব্ল্যাক-পাউডার হল কার্বনের ছাই। প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ হল প্রকৃতপক্ষে বহুরূপী কার্বনের জটিল জৈব-যৌগ। সে-প্লাস্টিক আগুনে পুড়ে কালো রঙের যে-ছাই মেঝেতে পড়ে থাকে, তা কার্বনের এক ধরনের রূপভেদ; প্রধানত বহুস্তরীয় গ্রাফাইটের অংশবিশেষ। এ হেন কালো কার্বন দেখে বৈজ্ঞানিকের মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল― প্লাস্টিক থেকে গ্রাফিন তৈরি করা যাবে না কেন?

ইতিপূর্বে ২০০৪ সালে গ্রাফিন আবিষ্কৃত হয়েছে। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনিভার্সিটির দুই পণ্ডিত প্রফেসর আন্দ্রে গেইন (Prof. Andre Gein) আর প্রফেসর কনস্ট্যান্টিন নোভোসেলভ (Prof. Konstantin Novoselov) গ্রাফিন আবিষ্কার করে হুলস্থুল বাঁধিয়ে দিয়েছেন। অসাধ্য সাধন করেছেন তাঁরা। এ হেন কাজের স্বীকৃতি হিসাবে ফিজিক্সে ২০১০ সালের নোবেল পুরস্কার সম্মানে ভূষিত করা হয় বৈজ্ঞানিকদ্বয়কে। 

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে― গ্রাফিন কী? খায়, না মাথায় মাখে? কী কাজে লাগে? এর উপযোগিতা কী? প্রপার্টি কেমন? পরিবেশের কী লাভ হবে, যদি সস্তায় গ্রাফিন আবিষ্কার হয়? হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।

কার্বনের একটি রূপভেদ হল গ্রাফাইট। গ্রাফাইট তড়িতের সুপরিবাহী আর প্রচুর কার্বন-লেয়ার বা কার্বন-স্তর দিয়ে তৈরি। এক একটি কার্বন-স্তরে লাখো লাখো কার্বন পরমাণু। বহুস্তরীয় এই গ্রাফাইট থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় গ্রাফিন। গ্রাফিনে কার্বন পরমাণুর একটি মাত্র স্তর থাকে। অর্থাৎ গ্রাফিন একস্তরীয়। এখানে কার্বন পরমাণুগুলি দ্বিমাত্রিক দেশের ন্যানো-স্কেলে মৌচাক জালের ন্যায় সজ্জিত থাকে। উল্টোভাবে বললে, প্রচুর সংখ্যক গ্রাফিনের সমন্বয়ে গ্রাফাইট তৈরি করা যেতে পারে। পার্থক্য হচ্ছে― যত সহজে গ্রাফিন জোড়া লেগে গ্রাফাইট উৎপন্ন করা যায়, তার চাইতে হাজার গুণ বেশি কষ্টকর গ্রাফাইট ভেঙে গ্রাফিন পাওয়া। গ্রাফিনের একগুচ্ছ লাভদায়ক প্রপার্টি। এর মেকানিক্যাল প্রপার্টি খুব আকর্ষণীয়। শক্তিশালী স্টিলের চাইতেও গ্রাফিন বেশি শক্ত। গ্রাফিনের তড়িৎ-পরিবাহিতা উত্তম ধাতব পরিবাহী তামার চেয়েও কয়েক কদম এগিয়ে। ইলেকট্রনিক থেকে বায়ো-মেডিক্যাল যেকোনও ক্ষেত্রে এর বহুল প্রচলন। স্যামসাং মোবাইল-সহ বিভিন্ন কোম্পানির নামীদামি মোবাইল ফোনে এর ব্যাপক ব্যবহার। স্যামসাং হ্যান্ডসেটে যে 'গ্রাফিন-বল' নামক নতুন ব্যাটারি ব্যবহৃত হচ্ছে, অন্যান্য কোম্পানির হ্যান্ডসেটে ব্যবহৃত লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির তুলনায় তার ক্যাপাসিটি (৪৫% বেশি) এবং চার্জিং রেট (পাঁচ গুণ বেশি) অনেক গুণ বেশি। সুতরাং স্মার্টফোন ইন্ডাস্ট্রিতে বিপ্লব এনেছে গ্রাফিন।
        

গ্রাফিন ব্যবহারের একটাই অসুবিধা। এর বাজার মূল্য প্রচুর। এমন অগ্নি-মূল্যের কারণে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাপ্লিকেশন খুব একটা দেখা যায় না। বৈজ্ঞানিক নন্দগোপাল বাবুর মাথায় ছিল এ হেন বিষয়টি। সেজন্যে তাঁর নজর পড়ে পরিবেশের পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের উপর। অব্যবহৃত প্লাস্টিক থেকে সস্তায় গ্রাফিন আবিষ্কার সম্ভব হলে এক ঢিলে দুই পাখি মারবেন তিনি। প্রথমত, দুর্মূল্য গ্রাফিনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাপ্লিকেশন সহজতর হবে। আর দ্বিতীয়ত, বর্তমান বিশ্বের বৃহৎ অভিশাপ প্লাস্টিক দূষণ থেকে মুক্তি পাবে মানবজাতি। এমন ভাবনা মাথার মধ্যে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে। তাঁর সে-ভাবনা ফলপ্রসূ করতে ইনস্ট্রুমেন্টালি বাস্তব রূপায়ণ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন নন্দবাবুরা। প্রচেষ্টার প্রথম ধাপ― ল্যাবরেটরি স্কেলে গ্রাফিনের উদ্ভাবন।

সমস্যা বাধল অন্যত্র। তার জন্য প্রয়োজন এক বিশেষ প্রকার যন্ত্র। রিঅ্যাকটর যন্ত্র। মার্কেটে এমন রিঅ্যাকটর যন্ত্র সত্যিই অপ্রতুল। তাহলে উপায় কী? নিরুপায় নন্দগোপাল বাবু মার্কেটে স্থানীয় মিস্ত্রিকে বুঝিয়ে-পড়িয়ে-নির্দেশ দিয়ে বানালেন এই বিশেষ 'রিঅ্যাকটর যন্ত্র'। এই যন্ত্রে যেমন পাঁচ কেজি ওজনের প্লাস্টিক গলানোর বন্দোবস্ত আছে; তেমনি যন্ত্র বানানোর খরচও সাধ্যের মধ্যে, সর্বসাকুল্যে পাঁচ হাজার টাকা মাত্র। প্রথম চেষ্টা চলল― পাঁচ কেজি প্লাস্টিক তাপে গলিয়ে কতখানি গ্রাফিন পাওয়া যেতে পারে, তার সন্ধান করা? আপাতত মিলল আশানুরূপ ফলাফল। হাতের মুঠোয় এল সাফল্য।

সে-সাফল্য তুলে ধরে আবেদন করলেন 'মিনিস্ট্রি অফ এনভায়রনমেন্টাল ফরেস্ট ক্লাইমেট চেঞ্জ' (Ministry of Environmental Forest Climate Change) অফিসে। কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে তাঁদের রিসার্চ প্রপোজাল জমা দিলেন। সে-টা ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাস। প্রপোজাল অনুমোদন পেয়ে ফিরে আসতে আসতে এপ্রিল মাস এসে যায়। অনুদানের পরিমাণ শুনলে চক্ষু নির্ঘাৎ কপালে উঠবে। দুই দশমিক দুই চার কোটি টাকা মাত্র! অর্থাৎ দুই কোটি চব্বিশ লক্ষ টাকা। তাঁদের সামনে গবেষণার নব দিগন্ত গেল খুলে। সাফল্যের দিকে আরও এক ধাপ এগোল সাদা বাড়ি। (চলবে)

তথ্য-ঋণ :
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের রত্নগর্ভা মাতা বিমলাদেবী
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের জ্ঞাতিখুড়ো শ্রী নগেন্দ্রনাথ সাহু
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের মেজদা শিক্ষক শ্রীঅসিত কুমার সাহু
পরম শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিক-গবেষক ড. নন্দগোপাল সাহু, কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি, নৈনিতাল, উত্তরাখণ্ড
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের সেজদা শ্রী ননিগোপাল সাহু
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের বন্ধুস্থানীয় দাদা শিক্ষক শ্রী দেবাশীষ মান্না

আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments

  1. ওনার আবিষ্কার পরিবেশকে রক্ষা করতে পারবে।প্লাস্টিক দূষণ থেকে পরিবেশ রক্ষা পাবে, ভাবতে খুব ভালো লাগছে।সারা পৃথিবী ওনার আবিষ্কারে উপকৃত হবে।

    ReplyDelete
  2. ওনার আবিষ্কার পরিবেশকে রক্ষা করতে পারবে।প্লাস্টিক দূষণ থেকে পরিবেশ রক্ষা পাবে, ভাবতে খুব ভালো লাগছে।সারা পৃথিবী ওনার আবিষ্কারে উপকৃত হবে।

    ReplyDelete