জ্বলদর্চি

পাতি মানুষের পাঁচালি-১১/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

পাতি মানুষের পাঁচালি::১১
--------------------------------------
বসন্ত মালাকারের গল্প
--------------------------------
ইংরেজি দু হাজার চোদ্দ সনের এক সফল প্যাথােলজিক্যাল ল্যাবরেটরির মালিক বসন্ত মালাকার। তার অতিব্যস্ত পেশায় সে জীবনে অবকাশ পায় না প্রায়। কোনােক্রমে তা পেলে ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে অতীতটাকে নিয়ে  বুঁদ হয়ে থাকা এখন তার  টাইমপাশ। এতে তার ভালাে লাগে না মন্দ, সে বিচার করতে গেলে ব্যাপারটায় ঘোঁট পাকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, কারণ বেচারা বসন্ত মালাকার মাঝে মাঝে নিজেই বুঝতে পারে না তা। আর ভালাে-মন্দ, হার-জিত, সুখ-দুঃখের ব্যাপার যা যা, সেগুলির পুরােটাই আপেক্ষিক। মানুষের জীবনদর্শন তৈরি হয় তার মানবিক গঠন ও চিন্তার বিষয়ের অগ্রাধিকারের  ভিত্তিতে।  সুতরাং ওসব বিষয়ে না গিয়ে পুরাে ঘটনাটা জেনে নিয়ে বিচারকের আসনে বসাটা  বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
জন্মের পর থেকেই বসন্ত, যাকে বলে গােদা মানসিকতার একজন মানুষ। সূক্ষ্ম এবং আবেগ অনুভূতিহীন বড় মানুষ আকছার দেখা গেলেও আবেগ অনুভূতিহীন শিশু ব্যাপারটা খুব দুর্লভ। দুর্লভ এই কারণেই যে জীবনের বুলডােজারের নীচে পড়ে ঘাত-প্রতিঘাত, আঘাত-আক্রমণে মানুষের অনেক অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়। এতে বেঁচে থাকতে সুবিধা হয়। সফল চাকরবাকরেরা তাদের প্রভুদের কাছে ভোঁতা। জমিদারের কাছে ধূর্ত নায়েব মশাই ভোঁতা। অত্যাচারি রাজার কাছে প্রজারা ভোঁতা । পরাজিত সৈনিকেরা জয়ী সৈনিকদের কাছে ভোঁতা। তলিয়ে দেখতে গেলে এই ভোঁতা হয়ে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল যারা ভোঁতা তারা তাদের এই বুদ্ধির ব্যাপারটা কখনও টের পায় না। পেলে বস্তুবাদের বিষয়ে গর্বিত ছাড়াও অন্য ব্যাপারেও গর্বিত হতে পারত তারা, এবং তথাকথিত বুদ্ধিমানেদের কাছে অন্তঃসারশূন্য মানুষ হিসেবে পরিচিতি জুটত না তাদের।  বসন্তের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা ততখানি জটিল নয়। তার জন্মকালীন সমস্যাই যে তার স্বল্পবুদ্ধির কারণ একথা অনেকেই জানে। এ ব্যাপারে কোনাে তর্কের অবকাশ নেই।
বসন্তের বাবা বামনগাছির  সৎ ও সম্পন্ন  উকিল ছিলেন। বারাসত কোর্টে বিশাল প্র্যাকটিস ছিল তাঁর। আর ছিল  অঢেল জমি-জিরেত, যাতে পর্যাপ্ত ফলন  হতো এবং গােটা বছর জুড়ে, সেই অর্থে, বসে খেলেও তাঁর পয়সায় টান পড়ত না। কিন্তু বসন্তের বাবার কাছে ওকালতি কেবল পেশা নয়, নেশাও ছিল। তা ছাড়া উদ্যমী মানুষেরা কখনও বসে থাকেন না, সব সময় কিছু না কিছু করে বাস্তবিক পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে উন্নততর করতে তাঁদের প্রচেষ্টা চলতেই থাকে।  সব সাধারণ মানুষই জীবনকালে কিছু তাদের সাধ্য মতো না কিছু করে। কেউ নিজের জন্য। কেউ অন্যের জন্য । কেউ নিজের ভালাে করতে অন্যের ক্ষতি করে । আবার কেউ অন্যের ভালাে করতে নিজে গাড্ডায় পড়ে।
অর্থাৎ পুরাে জীবনযাত্রাটাই সংক্ষেপে ভালাে কাজ, মন্দ কাজ, বাঁশ খাওয়া কাঠি দেওয়া ইত্যাদি। উকিল ভদ্রলােকের নামটা বললে তল্লাটের সবাই একডাকে চিনে ফেলবে। সুতরাং তা উহ্যই থাক বরং। তাঁর জীবনের ট্র্যাজেডি হল ব্যক্তিগতভাবে ভালােমানুষ হওয়া সত্ত্বেও পেশার কারণে বেশিরভাগ সময় এমন সব ঝামেলার কেসে জড়িয়ে থাকতেন যে তাঁর জীবন মাঝে মাঝে দুর্বিসহ হয়ে উঠত। যত বড় উকিল, তত জটিল সমস্যা। এ রকমই একটা সমস্যা ছিল গগন জোয়ারদার জমি কেস। গগন জোয়ারদার মানুষটার বামনগাছি স্টেশনের পুবপারে পঞ্চাশ বিঘে মতাে ধানি জমি ছিল। জমির কাগজপত্র ছিল না বিশেষ কিন্তু পুরুষানুক্রমে গগন তা ভােগ করে আসার কারণে প্রকৃত গল্প কী এ নিয়ে কেউ কখনাে মাথা ঘামায়নি। কিন্তু সমস্যাটা হল প্রমােটার ব্রিজেশ খাঁড়া তার জমি দখল করে নেওয়ার পর থেকে। ব্রিজেশ দোর্দন্ডপ্রতাপ প্রমােটার ওই চত্বরে। এমনিতে মানুষ খুব ডাকাবুকো। পেশার কারণে তার এক বিশাল মারকুটে বাহিনীও ছিল। যে কোনাে ছুতােনাতায় মানুষকে 'নামিয়ে' দেওয়া যাদের কাছে কোনাে ব্যাপারই নয়। সেই ব্রিজেশ খাঁড়া উক্ত জমির ‘অরিজিনাল’ কাগজপত্র জোগাড় করে একদিন রাতে স্থানীয় ইনফ্লুয়েন্সিয়াল মানুষজনের সহযােগিতায় সে জমির দখল নেয়। পুলিশ, প্রশাসন যে কোনাে কারণেই হােক তার পিছনেই ছিল। সুতরাং তাড়াতাড়ি তা গগন জোয়ারদারের থেকে বেহাত হয়ে যায়। গগন তখন বসন্তের বাবার শরণাপন্ন হন। জমি পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে উকিল ভদ্রলােক খুবই বিচক্ষণ এবং কর্মকুশল ছিলেন। মাস খানেকের মধ্যে তিনি যাবতীয় কাগজ, নথিপত্র বানিয়ে  কেস গগনের সপক্ষে নিয়ে আসেন। কিন্তু মামলার ফল ঘােষণার আগের দিন রাতে অজ্ঞাত পরিচয় দুই বন্ধুকবাজ তাঁর বাড়িতে চড়াও হয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে বিনা বাধায় চম্পট দেয়।
তল্লাটের সকলেই জানত এ ঘটনায় ব্রিজেশ খাঁড়ার হাত আছে, কিন্তু তথ্য প্রমাণের অভাবে সে বেকসুর খালাস হয়ে জমির দখল নিয়ে সেখানে বিরাট একটা প্রােজেক্ট বানানাের তােড়জোড় শুরু করে। এ ঘটনা যখন ঘটে, বসন্ত তখন নিতান্তই বালক। ব্যাংক ব্যালেন্স নেই । বেহিসাবী বাবার কারণে সর্বস্বান্ত মা কি ভাবে তার দুই সন্তানকে মানুষ করেছিলেন তা তিনিই জানেন! এ লড়াইয়ের সাক্ষী যদিও, তবু দুই ছেলের কারাের স্মৃতিভাণ্ডারেই সে স্মৃতির  কিছুমাত্র জমা নেই। যাই হােক, ব্রিজেশ খাঁড়ার ভবিষ্যৎও বিশেষ সুখের হয়নি। বসন্তের বাবার মৃত্যুর দশ বছর পর ঠিক একইভাবে রাত দেড়টা নাগাদ তার নিজের বাড়িতে অজ্ঞাত পরিচয় হানাদারের গুলিতে ব্রিজেশ খুন হয়। অপারেশন এতটাই নিখুঁত ছিল, যে সে সমস্যার এখনাে সমাধান হয়নি। এ ঘটনার পর রাতারাতি বসন্ত ভাগ্য অন্বেষণে ও পেশার সন্ধানে দুর্গানগরে এসে ডেরা বাঁধে। বয়স তখন একুশ বছর। এর ঠিক দু বছর বাদে রোগ ভোগে  তার মা মারা যান। তিনি দেশের বাড়িতেই থাকতেন। যাওয়ার আগে সদ্য সাবালক হওয়া প্রশান্তর (বসন্তর ছােট ভাই) বিয়ে দিয়ে গেছিলেন তিনি। সেই বাড়ি এবং জমিজমা দেখাশােনা করে কোনােরকমে দিন গুজরান করত সে। বসন্তর ওসব বিষয়ে কোনাে লােভ বা আগ্রই ছিল না। কপাল গুনে ইস্টার্ন রেলের শেয়ালদা শাখায় ক্যাজুয়াল টি.টি. ই'র-এর কাজ জুটে যায় তার এই সময় এবং কোনােরকমে দিন গুজরাণ শুরু করে সে।  চাকরি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি অবশ্য। কেস কামারির চক্করে পড়ে অচিরেই তা যাওয়ার পর সত্যি সত্যিই বেকার হয়ে পড়ল বসন্ত। তার উপর এর মধ্যে একটা বিয়ে করে ফেলেছে সে। তার একটা মেয়েও হয়েছে।
পাশ কোর্সে বি.এ. পাশ করেছিল বসন্ত। অর্থাৎ সেই অর্থে সে শিক্ষিত ছিল বলা যায়। সুতরাং সংসার চালানাের জন্য প্রাইভেট টিউশনি শুরু করল সে তখন। ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের পড়াত। মাসের শেষে কখনাে মাইনে জুটত, কখনাে জুটত না। কখনাে মাস শেষ হওয়ার আগেই অভিভাবকরা ছুতােনাতায় ছাড়িয়ে দিত তাকে। কখনাে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ফল খারাপ হলে মাইনে না জুটে গালাগালি জুটত। মানুষ এরকমই। সে সব সময় সফল ব্যক্তিদের পিছনে ছােটে, তেলা মাথায় তেল দেয়। ব্র্যান্ড বা খ্যাতিমানের বাইরেও যে ভালাে কিছু হতে পারে এ ব্যাপারটা  মানতেই চায় না তারা।
বসন্তের সংসারের অভাব ঘোঁচানাের জন্য তার বউ মালতিকেও এগিয়ে আসতে হয়েছিল সে সময়। ব্লাউজ সেলাই করে, ফলস পিকো করে এবং ছােট বাচ্চাদের পড়িয়ে পয়সা রােজগারের চেষ্টা করত সে। কিছুটা সফল ও হয়েছিল এ ব্যাপারে। এতে অল্প হলেও কিছুটা সুরাহা হয়েছিল অনটনের সংসারে।
মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে উনিশশাে ছিয়ানব্বই সালে শিশুবিশেষজ্ঞ প্রমথেশ দাসমুন্সির সঙ্গে বসন্তর আলাপ। প্রমথেশ নতুন ডাক্তার তখন। বিয়ে করে তিনিও দুর্গানগরে একটা ভাড়াবাড়িতে এসে উঠেছেন। দুজনেই আদতে কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা। কলকাতায় পড়াশােনা চলাকালীন দুজনের মধ্যে আলাপ তারপর তা শেষে বিয়েতে এসে দাঁড়ায়। একেই নতুন পাশ করা। তাতে চাকরি নেই। বউ উচ্চশিক্ষিতা হলেও কিছু করে না। সুতরাং প্রথম থেকেই হালত খুব খারাপ। তবে প্ৰমথেশ চিকিৎসাটা ভালাে করেন। পসার জমা তাই শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। বসন্ত ডাক্তারবাবুর কাছে যাতায়াত করতে করতে একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে তার ইচ্ছায় কথাটা বলেই ফেলল তাঁকে।  সে তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করতে চায়। একথা শুনে তাে ডাক্তারবাবুর মাথায় হাত। ছোকরা বলে কী? নিজের ঠিক মতাে ভাত জোটে না ! তার উপর আবার  দোসর !  বসন্ত বােধহয় ডাক্তারবাবুর মনের ভাবটা বুঝতে পেরেছিল। তাই সে কিছু বলার আগেই বসন্ত বলল—“পয়সাকড়ি দেওয়া নিয়ে আপনি কোনােরকম চিন্তা করবেন না।
যদি পেশেন্ট হয় তাহলে কিছু দেবেন, নইলে দেবেন না! ব্যাস ফুরিয়ে গেল! এ এক অদ্ভুত শর্ত! তবুও সন্দেহ ছিল! এরকম ভাবে হয় ? পরে ব্ল্যাকমেল করবে না তাে লােকটা? তার পর সাতপাঁচ ভেবে রেখেই দিলেন বসন্তকে। হাজার হােক স্থানীয় ছেলে। কিছু চেনা পরিচিতি তাে আছে! সেই সূত্র ধরে যদি কোনো রুগিপত্র পাওয়া যায়! প্রথম যখন প্র্যাকটিস করতে শুরু করলেন তিনি তখন তাঁর ভিজিট ছিল কুড়ি টাকা। বাচ্চা, বুড়াে সবই দেখেন। প্রেসার মেপে দিতে বললে তা-ও দেন। এভাবে প্রথম মাসের প্র্যাকটিশে আয় হল পাঁচশাে কুড়ি টাকা। বসন্ত পাঁচ টাকা রােজ! পরিস্থিতি অবশ্য পালটালাে দ্রুত। ধীরে ধীরে প্রমথেশের পসার জমাতে শুরু করল। রােগী রােগী আনে। ফলদায়ী চিকিৎসা হলে মানুষের আস্থা বাড়ে। বিশ্বাসটা প্রাথমিক শর্ত। সেটা অর্জন করতে পারলে  আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় না। বসন্ত ডাক্তার প্রমথেশের চেম্বার অ্যাসিস্ট্যান্ট কেবল ছিল না, বাড়ির অন্যান্য কাজকম্মও করত। এ ব্যাপারে তার দায়ীত্ব ছিল একদম নিখুঁত। এরপর প্রমথেশ সরকারি চাকরি পান। প্রথম পােস্টিং পান্ডুয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তাতে অর্থকরি সুবিধে হলেও প্রমথেশের নতুন বিয়ে করা বউয়ের খুব অসুবিধা হয়েছিল এদিকে ধীরে ধীরে পসার জমে যাওয়ার কারণে চাকরিটা আর  তাঁর করা হয়নি প্রমথেশের । তাতে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লােকেরা এবং বউ টেনশন করলেও মােটের উপর খারাপ কিছু হয়নি। মানুষ তাঁকে চাইত, সুতরাং দু হাত তুলে, আশীর্বাদ করেছিল তাঁকে। ওদিকে সেই অনুপাতে বসন্তরও মাইনে বাড়তে শুরু করল। আরাে উপরি আয়ের চেষ্টা করতে শুরু করল সে। প্যাথলজি স্যাম্পেল জোগাড় করত বাড়ি বাড়ি গিয়ে। এটা সম্ভব হয়েছিল চেম্বারে  পেশেন্টদের সঙ্গে তার পরিচিতি হওয়ার দরুণ।  এরকম ভাবে আস্তে আস্তে নিজের চেষ্টায় সে-ও রক্ত নিতে শিখে গেল নিপুন ভাবে। ব্লাড স্যাম্পেল বেশি করে আসতে শুরু করল আস্তে আস্তে । তখন সে সব ল্যাবরেটারিতে  পরীক্ষা করিয়ে আয়টা মোটের উপর খারাপ হতো না বসন্তের।  অবশ্য  তা এতখানি নয় যাতে সংসারটা ঠিকঠাক চলে। মাথায় আরাে উপার্জনের চিন্তাভাবনা, সুতরাং রয়েই গেল।
সেই সময় অপরেশ সেন বলে আরাে একজন ডাক্তারবাবু সবে প্র্যাকটিস শুরু করেছেন ওই চত্ত্বরে। অপরেশ সেন এক্স আর্মি। তারও প্রাথমিক অবস্থা প্রথমেশের মতাে। তার উপর একটা বাচ্চাও হয়েছে সদ্য। তবে পরিজনহীন নন প্রমথেশ যেমন। বাবা, মা, কাকা জ্যাঠা, নিয়ে একান্নবর্তী পরিবার তাঁর সে চত্তরে। তার সুবিধার্থে সবাই মহিষগােটের গ্রামের বাড়ি থেকে এখানে চলে এসেছে। জমিজমা পুরনাে কাজের মানুষের দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে। বসন্ত তাঁর সঙ্গে  জুতে গেল। সুতরাং অবস্থার আরও একটু উন্নতি হল। এরকম চলতে চলতে বেশ কিছু আয় হল তার বছর চারেকের মধ্যে এবং সঙ্গে কিছু সঞ্চয়ও। বসন্ত বসে থাকার লােক নয়। উদ্যমী পুরুষ। জমানাে টাকা থেকে টাটার একটা ছােট মালবাহী গাড়ি কিনল ভাড়ার খাটানাের জন্য। বেসরকারি ব্যাংক থেকে খানিকটা লােন নিতে হয়েছিল অবশ্য। এ কাজটা দেখাশােনার জন্য তার নিজের সময়  হয়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হল। সে গাড়ি থেকে লাভের মুখ দেখা তাে দূরের কথা লােকসানের বােঝা এবং বহর এমন হল যে তড়িঘড়ি জলের দামে  তা অন্যের কাছে বেচে দিয়ে ব্যাপারটাতে সামাল দিল সে। ক্ষতি সামলাতে সময় লেগেছিল একবছর। তার পর আবার অন্য ভাবনা, অন্য চিন্তা। একদিন সকালে খবরের কাগজের পাতায় চোখ বুলােতে বুলােতে হঠাৎ নজরে পড়ল হাড়ােয়া চত্তরে এল. পি.জি'র দুর্গানগরের একজন মেন ডিলার, সাবডিলার নিয়ােগ করতে চায়। খরচা বলতে সামান্য। লভ্যাংশের ভাগ আছে। ব্যাপারটা বসন্তের পক্ষে সুবিধেজনক, কারণ সেখানে তার মামার বাড়ি। ছােটো ভাগ্নেকে তদ্বিরের দায়িত্ব দিয়ে সে কাজটাও শুরু করল সে। কিন্তু সেখানে সমস্যাটা দাঁড়াল অন্যরকম। পাশেই আর একজন ডিলার, অন্য এক কোম্পানির । এলাকাতে তার ভালাে পরিচিতি। কিছুটা প্রচ্ছন্ন হুমকি এবং কিছুটা তার জনপ্রিয়তার কারণে খুব একটা জমল না সে কারবার। সুতরাং পাততাড়ি গােটাতে হল সেখান থেকেও।
ততদিনে সে প্যাথলজির ব্যাপার স্যাপার এবং ঘাঁতঘোঁতগুলি জেনে গিয়েছে। সুতরাং সাহস করে এবার নিজের একটা ল্যাবরেটরি করার দিকে ঝাঁপালাে সে। কিন্তু করব বললেই তাে আর হয় না। তারজন্য রেজিস্ট্রেশন নাম্বার, লাইসেন্স এরকম অনেক সরকারি লালফিতের ফাঁস ছাড়াও স্পেশ জোগার করা প্যাথেলজিস্ট, টেকনিশিয়ান জোগাড় করা এসব ব্যাপার গুলিও আছে। আরাে আছে স্থানীয় অন্যান্য লাবরেটরির মালিকদের সহযেগিতা বা ব্যাকবাইটিং।এসব কোনােকিছুই ধােপে টিকল না অবশ্য। বসন্তর সেই ভাগ্নে যে হাড়ােয়ার তার গ্যাসের ব্যবস্থা দেখাশােনা করত, তার ততদিনে শাসকদলের সঙ্গে ভালাের ঘনিষ্ঠতা হয়েছে একটা। ফলে উপরমহলের তদারকিতে লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন নাম্বার এসব বানিয়ে নিতে তার অসুবিধে হল না। প্রচেষ্টা শুরুর দেড় মাসের মধ্যে সমস্ত প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র হাতে পেয়ে এক শুভ দিন দেখে বড় রাস্তার ধারে একটা বড় দোতলা বাড়ির একতলার ডাক্তার প্রথমেশের চেম্বারের পাশে ল্যাবরেটরির উদ্বোধন করল বসন্ত। জমি তৈরিই ছিল। সুতরাং জমতে দেরি হল না। এর পর শুরু হল অন্য খেলা। সাধারণ নির্বোধ মানুষের সমস্যা হল এই যে তারা অতীত মনে রাখে না। ফলে অতীতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিপদের দিনে কাজে আসা মানুষদের তখন আর তাদের মনে থাকেনা।
ড. প্রমথেশের কাছ থেকে যাবতীয় সুবিধা ভােগ করার পর তার সঙ্গে পরিত্যাগ করে তাকে ভুলে যেতে, সুতরাং বসন্তের কোনাে অসুবিধে হয়নি। আর সে সব মানুষদের কাছে অর্থ উপার্জনই জীবনের সব ,অর্থই যাদের মতে পৃথিবীতে শেষ কথা বলে, তাদের সঙ্গী করা এই এক বিপদ। তার উপর আগেই বলেছি সে ছিল মোটা দাগের একজন মানুষ। সুতরাং প্রমথেশের যন্ত্রণা সে ভেবে দেখেনি। প্রমথেশের অবশ্য কিছু আসে যায়নি তাতে। কারণ জীবন চলে জীবনের মতােই তাছাড়া প্রমথেশের আর কিই বা পাওয়ার থাকতে পারত তার কাছ থেকে! 


 এখন বসন্তর ওজন বেড়েছে। পাড়ার পুজোতে মােটা টাকা চাঁদা দেয়। কারণে অকারণে মানুষকে তেল দেয়, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যাবহারও করে। ছুতােনাতায় কর্মচারীদের তাড়িয়ে দেয়। তুঘলকী হাবভাব খানিকটা। সে ভাবে জীবন যখন চলছে, ঈশ্বর যখন দিয়েছেন দুহাত ভরে তখন তাে সে চলতেই পারে নিজের ইচ্ছে মতাে ! এ কথা যেমন আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মনে থাকে না, বসন্তেরও মনে নেই সে এই তুচ্ছ স্বল্পকালীন জীবনে টাকাকড়ির মূল্য নেই। তাঁর আশীর্বাদে চূড়ায় ওঠা যায় যেমন তার রােষে নীচে আছড়েও পড়তে হয় মুহূর্তের মধ্যে। তখন হাজার ডেকেও পাওয়া যায় না পুরনাে মানুষদের। বসন্ত সে সবের পরােয়া করে না অবশ্য। তার বড ভালাে লাগে অতীত ঘেঁটে তৃপ্তি পেতে। তাই করে চলেছে এখন। ভবিষ্যৎ ভাবার অবকাশ কোথায় তার ?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. ধন্যবাদ জ্বলদর্চি। আমার আগামী আশা এই ধারাবাহিকটি বইয়ের আকারে প্রকাশ করা। সেদিকেই তাকিয়ে বসে আছি।

    ReplyDelete