জ্বলদর্চি

সুতোয় বাঁধা পুতুল- ৪(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/সুমন মল্লিক

সুতোয় বাঁধা পুতুল
সুমন মল্লিক

পর্ব – ৪


চতুর্থ অধ্যায়

১০
একটা কফিশপে বসে আছে বিহান৷ সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ হলো৷ অপেক্ষা করছে রূপকের জন্য৷ রূপকও একই কলেজ থেকে একসঙ্গেই ইংরাজি অনার্স নিয়ে পাস আউট হয়েছে৷ মাস্টার্স করছে৷ বিহান করছে বি এড৷ রূপকও বিহানের মতোই এস এস সি-র প্রিপারেশনও নিচ্ছে৷ প্রতি রোববার ওরা সন্ধ্যায় দেখা করে৷ সারা সপ্তাহের পড়াশুনো নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে৷ কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে একে অন্যের কাছ থেকে বুঝে নেবার চেষ্টা করে৷ রূপক বরাবরই একটু লেট লতিফ৷ কিন্তু আজ অনেকটাই দেরি করছে৷ বিহান প্রথম কফির কাপ শেষ করে এখন আরেকটা কাপ নিয়ে বসে আছে৷ ফোনে ধরার চেষ্টা করছে রূপককে৷ রিং হচ্ছে, ধরছে না৷ হয়তো সাইকেলে আছে৷ 
     কফিশপের সামনে হঠাৎ একটা এস ইউ ভি এসে দাঁড়ালো৷ দরজা খুলে গেল৷ আর তারপর বিহান যেন পাথরের মূর্তি হয়ে গেল৷ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ টেবিল, কফি, দোকান, রাস্তা, আলো, বইপত্র সব যেন একমুহূর্তে উধাও৷ এক তীব্র মোহময় আঁধারে যেন বসে আছে বিহান আর ওর দিকে এগিয়ে আসছে অলৌকিক কোন আলোর শিখা৷
     প্রায় দেড় বছর পর তৃষাকে দেখলো বিহান৷ তৃষা এগিয়ে আসছে৷ পাল্টে গেছে পুরোপুরি তৃষা৷ তৃষা এগিয়ে আসছে৷ দামী সিল্কের শাড়ি, গলায় সীতাহার, আঙুলে হীরের আংটি৷ তৃষা এগিয়ে আসছে৷ আইফোনে কথা বলছে তৃষা৷ সিঁথিতে সিঁদুর৷ তৃষা এগিয়ে আসছে৷ যত এগিয়ে আসছে তৃষা ততই বিহানের বুকের শেষ স্পন্দনটুকুও যেন থেমে যাচ্ছে আস্তে আস্তে৷ তৃষা কফিশপে ঢুকতেই বিহান মুখ নামিয়ে একটা বই খুলে বসলো৷ 

     “কেমন আছিস বিহান?” তৃষা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ কণ্ঠে ও নজরে কোন আড়ষ্টতা বা ইতস্তত বোধ নেই৷
     “আরে তুই! আমি খেয়াল করিনি৷ বোস বোস৷” জোর করে ঠোঁটে একটা কৃত্রিম হাসি রেখে বলে বিহান৷ বুকের ভেতর সবকিছু থেমে গিয়ে তখন শুধু এক অসহ্য দহন৷
     “মিথ্যেটা আজও ঠিক করে বলতে শিখিসনি তুই৷ কেমন আছিস বল?”
     “ভালো আছি৷ তুই? বিয়ে কবে করলি?”
     “এই তো তিন মাস হলো৷ মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না৷ খুব জোর করলো৷ তুই কী করছিস এখন?”
     “বি এড৷ এস এস সি-র পড়াশুনো৷ হাসবেন্ট কী করে?”

     “ইঞ্জিনিয়ার৷ ব্যাঙ্গালোরে৷ ছুটিতে এসেছি৷’
     “বাহ্, খুব ভালো৷ ভালো আছিস দেখে ভীষণ খুশি হলাম৷ কাকু চলে যাবার পর শুনেছিলাম তুই অসুস্থ ছিলি৷ ফোন করেছিলাম৷ তুলিসনি৷ কলেজের শেষ দিন দেখা হলো৷ ভেবেছিলাম কথা হবে৷ দুম করে চলে গেলি৷”
     “ওসব কথা এখন থাক৷” বিহানকে থামিয়ে দিলো তৃষা৷ “কাকু কাকিমা কেন আছে?”
     “বাবা রিটায়ার করেছে কয়েক মাস হলো৷ মা আজ সুস্থ তো কাল অসুস্থ৷”
     “ভালো করে প্রিপারেশন নে৷ হাইস্কুলে হয়ে যাবে তোর৷ একবার চাকরিটা হয়ে গেলে আরও অনেক দরজা খুলে যাবে৷”
     “সেই চেষ্টাই করছি৷ বাড়িতে যা অবস্থা, চাকরি তো একটা পেতেই হবে৷”
     “কবিতা লিখিস না এখন?”

প্রশ্নটা তীরের মতো বুকে এসে বেঁধে বিহানের৷ রূপক চলে এসেছে৷ তৃষার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে রূপক৷ বিহানের কানে সেসব কিছুই ঢুকছে না৷ বিদ্যুতে মতো একটি কবিতার লাইন আছড়ে পড়ে বিহানের ওপর–
কেন এলে, কেন এলে সামনে আবার?

১১
তৃষার সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে বিহানের মধ্যে পুরোনো অস্থিরতা ফিরে এসেছে৷ পড়ায় মন একেবারেই লাগছে না৷ চোখ বন্ধ করলেই একবার কলেজের তৃষা, একবার সেদিনের বিবাহিতা তৃষা সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে৷ কিছুটা বিস্মৃতির মধ্যে ভালোই তো ছিল বিহান৷ পড়াশুনোয় ডুবে ছিল৷ কিন্তু স্মৃতি আবার জেগে উঠেছে৷ কিছু কিছু স্মৃতি পুরোনো মদের মতো হয় – সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নেশা বাড়ে৷ বিহান একটা নেশাঘোরেই যেন এখন৷ বেরিয়ে আসার উপায় নেই৷
     এদিকে কবিতার শুকিয়ে যাওয়া গাছে পুনরায় সবুজ পাতা বেরোচ্ছে, ফুল ফুটছে, সঙ্গে কাঁটাও৷ পড়া থেকে আজকাল হঠাৎ হঠাৎ উঠে যাচ্ছে বিহান৷ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ সিগারেট ধরাচ্ছে৷ চাঁদ গলে নেমে আসছে কবিতার লাইন৷ কুয়াশায় ভেসে এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে বিহানকে৷ নোটস-এর পাতার ফাঁকে ফাঁকেই আবার জমে উঠছে একের পর এক কবিতা৷ কবিতা নয়, যেন একেকটি গনগনে অঙ্গার৷ আর তার ওপরই নীরব বসে আছে বিহান৷ এমনভাবে বিহান আগেও বসে থাকতো৷ দিন কাটছে৷ দিন আবার বিহানকে কাটতে কাটতেই এগিয়ে চলেছে৷           

১২
জীবনের প্রথম চাকরির পরীক্ষায় সফল হতে পারে না বিহান৷ সে অনেকেই হতে পারে না৷ এবার শেষদিকে একটু গন্ডগোল হয়ে গেছে৷ পড়ায় মন বসাতে পারেনি বিহান৷ কবিতাই লিখে গেছে রাত জেগে, সাকালে, দুপুরে, যখন তখন৷ 
     বাবার বয়স বাড়ছে৷ মা মাঝে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল৷ হাসপাতালে ভর্তি ছিল সপ্তাহখানেক৷ ভেতরে ভেতরে নিজের প্রতি খুব রাগ হয় বিহানের৷ বয়স্ক বাবা-মা শেষ বয়সে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে, ছেলের চাকরি পাবার অপেক্ষায় বসে আছে৷ এদের বিহান কোনভাবেই আশাহত করতে পারে না৷ বিহান মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, সবকিছু মুছে ফেলবে, শুধু পড়াশুনোয় ডুবে থাকবে৷ এস এস সি-তে পরের পরীক্ষায় চাকরিটা পেতেই হবে৷ বি এড-এর সার্টিফিকেটও কয়েকদিনের মধ্যেই হাতে পেয়ে যাবে৷


পঞ্চম অধ্যায়

১৩
     “সবটা জানার পারও তুমি বিয়ে করতে চাও আমাকে?” রূপাঞ্জনার চোখে জল৷
     “হ্যাঁ চাই৷ তুমিও আগের সবকিছু ভুলে যাও৷ চলো নতুন করে সব শুরু করা যাক৷” বিহান রূপাঞ্জনার হাত দু’টো চেপে ধরে৷
     “কিন্তু তোমার বাবা-মা? তারা কি আমাকে গ্রহণ করতে পারবেন সবটা জানার পর? তাছাড়া আমাদের কাস্ট আলাদা৷ তোমার বাবা-মা কাস্ট নিয়ে যদি আপত্তি করেন? আমার বাবা-মায়ের অবশ্য কাস্ট নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই৷”
     “আমি বুঝিয়ে বলবো৷ মা তো মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস করে আমার জীবনে কোন মেয়ে আছে কিনা৷ বিয়ের কথাও বলছে৷ সবটা বুঝিয়ে বলবো মা-কে৷ আমার বাবাও খুবই ভালো মনের মানুষ৷ কাস্ট নিয়ে সমস্যা হবে না৷”
     “তুমি তাহলে তোমার বাড়িতে আগে কথা বলো৷ যদি সব ঠিক থাকে তাহলে আমিও বাড়িতে বলবো৷”

বিহানের কাঁধে মাথা রাখে রূপাঞ্জনা৷ বিহান আরেকটু টেনে নেয় ওকে বুকের কাছে৷ গোধূলির আলো মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে৷ গোটা পার্কটাই ঢেকে গেছে ঘন কুয়াশার চাদরে৷ হিমেল বাতাস৷ কিন্তু তা শীতল করতে পারছে না ওদের৷ এই মুহূর্তে ওরা দু’টো চকমকি পাথর – অদৃশ্য এক আগুনের স্ফুলিঙ্গ ভেসে বেড়াচ্ছে কুয়াশার ভেতর৷ রূপাঞ্জনার সমস্ত দ্বিধা ও দুঃখ শুষে নিচ্ছে বিহান৷ বিহানের অনুরক্তি গ্রহণ করে রূপাঞ্জনার যেন এই মুহূর্তেই পুনর্জন্ম ঘটে গেল৷

১৪
অনেকদিন পর দুই বোনের দেখা হয়েছে৷ রূপাঞ্জনার দিদি প্রিয়াঞ্জনা বাবার বাড়ি এসেছে ছেলেকে নিয়ে৷ ছেলের উইনটার ভ্যাকেশন চলছে৷ ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে প্রিয়াঞ্জনা পাশে এসে শুলো রূপাঞ্জনার৷ কথা শুরু করলো প্রিয়াঞ্জনাই – “ঘুমিয়ে পড়েছিস?”
     “না৷ জানিসই তো রাতে আমার ঘুম আসতে দেরি হয়৷”
     “হুম৷ ছেলেটা কেমন? দেখতে তো ভালোই শুনেছি৷ অন্যান্য দিক দিয়ে?”
     “খুবই ভদ্র৷ কেয়ারিং৷ কথাবার্তা, ব্যবহারও খুবই ভালো৷”
     “তোর ঘটনা সব জানে? ওর কোন অসুবিধে নেই? কোন কন্ডিশন বা ডিমান্ড?”
     “না দিদি৷ ও ভীষণই ভালো৷ ও বলেছে আমাদের মধ্যে ওই বিষয়টা কোনদিনও আসবে না৷ কোন কথা হবে না ওসব নিয়ে৷”
     “বাহ্, তাহলে তো ভালোই৷ কথা বলাস একবার৷”
     “এখন বলবি? ফোন করবো?”
     “না৷ কালকে৷ এখন আমি কাবাবে হাড্ডি হতে চাই না৷” প্রিয়াঞ্জনা মুচকি হাসে৷
     “আরে না না৷ রাতে সেরকম কথা হয় না ওর সঙ্গে৷ বাবু রাতে কবি হয়ে যান৷ লেখেন৷ রাতে খাওয়া হয়ে গেলে মিনিট পনেরো বা বড় জোর আধঘন্টা কথা হয়৷”
     “কবি! দারুণ তো! বইটই আছে?”
     “না বই এখনও হয়নি৷ তবে অনেক বড় বড় পত্রিকায় ওর কবিতা ছেপেছে৷”
     “তাহলে বই হতে আর দেরি নেই৷ তোকে নিয়ে কতগুলো কবিতা লিখেছে এখনও?”
     “জানি না৷ বলে না কিছু লেখালেখি নিয়ে৷”
     “কবিরা কিন্তু ভীষণ রোমান্টিক হয়৷ ঘন ঘন প্রেমে পড়ে শুনেছি৷ দেখে রাখিস৷” 


দুই বোনই হেসে ওঠে৷ গল্পে গল্পে অনেক রাত হয়ে যায়৷ সকালে উঠেই রূপাঞ্জনাকে নার্সিংহোম ছুটতে হবে৷ ঠান্ডার মধ্যে সকাল সকাল ওঠাটাও খুব মুশকিল৷ প্রিয়াঞ্জনা ছেলের কাছে চলে গেছে৷ এবার আর কথা নয়৷ শুধু ঘুম৷ ঘুমের ভেতর আগামীর সোনালি স্বপ্ন৷ রূপাঞ্জনা কম্বলে ঢুকে আলো নিভিয়ে দিলো৷

১৫
তিন মাস পর বিয়ের দিন ঠিক হলো৷ রূপাঞ্জনা ও বিহান দু’জনেরই বাবা-মা ভীষণ খুশি৷ রূপাঞ্জনাদের ফ্ল্যাটেই ছোট্ট করে একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলো৷ 
     পরদিন দু’জনই ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ঘুরতে৷ কোথাও হয়তো বেজে উঠল ‘এই পথ যদি না শেষ হয়...৷’ প্রচুর কেনাকাটা করলো দু’জন মিলে৷ সবই বিয়ের জন্য৷ দুপুরে খুব ভালো একটা রেস্তোরাঁয় খেলো ওরা৷ ওই রেস্তোরাঁয় বিহান অকেশনালি আসে মাঝে মধ্যেই৷ পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম, সুন্দর৷ 
     আগে থেকেই সিনেমার টিকিট কাটা ছিল বিকেলের৷ শপিং মলটা নতুন চালু হয়েছে৷ সেখানেই আইনক্সে নতুন সিনেমা৷ ভেতরের শীতল বাতাস একটু পর পরই ভেসে আসছে৷ বিহানের একটা হাত জড়িয়ে ধরলো রূপাঞ্জনা৷ কাঁধে মাথা রাখলো৷ আলো আস্তে আস্তে নিভে আসছে৷ বিহান রূপাঞ্জনাকে আরও কাছে টেনে নিলো৷ বিয়ের আগের এই ক’টা দিন বড়ই মধুর৷

(ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments