জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৫২/(উৎসব -১)


সম্পাদকীয়,
আজ ছোটোবেলার ত্র‍্যহস্পর্শ। এটি ছোটোবেলার বর্ষপূর্তি সংখ্যা। তাই আজ থেকে উৎসব শুরু। বাঙালির প্রধান উৎসব দুর্গাপুজো। বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজোর ইতিহাস শুনে নেব মুক্তি জেঠুর লেখা পড়ে। আর তন্ময় আঙ্কেলের ছড়া পড়ে দুর্গার পরিবারের মনের খবর পেয়ে যাবে। উৎসব মানেই সকলে একত্রে মিলিত হওয়া। সেইজন্যই, সুকুমার জেঠু যেমন অসাধারণ এক না-মানুষদের সুন্দরী মায়ের গল্প শুনিয়েছেন, তেমন সর্বাণী পিসি উৎসবের আনন্দে ময়নামতির রূপকথার গল্প বলেছেন। ময়না উৎসবে মাতবে আর তোতা মাতবে না। তা হয় কখনো? তাই সুব্রত আঙ্কেল রবীন্দ্রনাথের তোতা কাহিনি থেকে নাটক লিখেছেন। না না এত টুকুতে উৎসব জমবে কেন? উৎসবে কার্টুন না হলে চলে? এ আবার যে সে কার্টুন নয়। সবার প্রিয় টম এন্ড জেরি। তারা নাকি জিও প্ল্যানেটে! ভাবতে পারছো? আরে এটা একমাত্র ভাবতে পারে তৃষ্ণা আন্টি। কি যেন বাদ পড়ে যাচ্ছে? ঠিক ঠিক।  তোমাদের প্রিয় ভূতের গল্প। তাও আছে। রামকিশোর জেঠু পুজোর আগেই ভূতের প্রিয় খাবারের তালিকা ছড়ায় লিখে পাঠিয়েছেন। ভূতেদের মজা আর দেখে কে। কিন্তু চুপি চুপি একটা কথা জানিয়ে রাখি, ভূতেরা এই করোনায় খুব  ভয় পেয়েছে। কেন? সেটা জানতে পড়তে হবে গৌর জেঠুর উপন্যাস। এবার মনে করিয়ে দিই, আমি তো তোমাদের বলেছিলাম, উৎসব সংখ্যা সাজিয়েছি তোমাদের জানা-অজানার কথা দিয়ে। তোমরা কি জানো? আজ বিদ্যাসাগরের জন্মদিন? না জানলে জেনে নাও তোমাদের বন্ধু শ্রীপর্ণার গল্প পড়ে। প্রবাহনীলের মজার ছড়াও কিন্তু অঙ্ক খাতা নিয়ে। অর্থাৎ, উৎসবে যতই মাতামাতি করো ভুলে যেওনা পড়াশোনার কথা। ভুলে যেও না যারা দুর্গার মূর্তি বানান তাদের পরিবারের কথা। হ্যাঁ, তাদের কথা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন ঋপণ কাকু, তার তোলা অপূর্ব ছবিটি পাঠিয়ে। তাহলে, ছোটোবেলার ৫২ তম সংখ্যা - বর্ষপূর্তি সংখ্যা, উৎসব সংখ্যা  আর বিদ্যাসাগরের জন্মদিন - হলো কিনা ত্র‍্যহস্পর্শ!  পরিশেষে জানাই কাজী নাসির, বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী, শ্যামাপ্রসাদ ব্যানার্জী, চোইন রায়ের মতো চিত্রশিল্পী ও ছয় খুদে শিল্পীর আঁকায় আমাদের ছোটোবেলার উৎসব সংখ্যা রঙীন। ঠিক কিনা তা তোমরা লিখে জানিও কিন্তু.... মৌসুমী ঘোষ।




বাংলার প্রথম দুর্গাোৎসব
মুক্তি দাশ 


শরৎকালে দেবী দুর্গার আগমন। দেবীর এই শুভাগমন-বার্তা সর্বপ্রথম কে বহন করে নিয়ে আসে বলতো? শরৎ-প্রকৃতি। শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশে যখন সাদা পেঁজা-তুলোর মতো মেঘ ও রোদ্দূরের লুকোচুরি খেলা চলে, ভোরবেলায় শিউলিফুল যখন ঝরে ঝরে পড়ে পথের ধুলোয়, শুভ্র কাশের গুচ্ছ যখন হাওয়ার সংগে তাল দিয়ে মাথা দোলায়, সদ্যপুষ্ট ধানগাছের ঘন সবুজে যখন বাতাস ঢেউ খেলে যায়, দু-কুল উপচানো নদী যখন কুলু কুলু বয়ে চলে – তখনই মনে হয়, মা আসছেন। এবং প্রকৃতি তার যাবতীয় শরৎ-সম্ভার নিয়ে সেই দুর্গতিনাশিনী মায়ের আবাহনে প্রস্তুত।

শরৎকালে দেবীর অকালবোধন পূজার কথা আমরা তো জানি। ধরে নেব, তোমরাও সবাই জানো। সীতা উদ্ধারের জন্যে অকালে এই পূজার আয়োজন করেছিলেন রামায়ণের অবিসংবাদিত নায়ক স্বয়ং রামচন্দ্র। কালিকাপুরাণ, দেবীপুরাণ প্রভৃতি অনেক পুরাণেই এর সমর্থন পাওয়া যায়। এমনকি, আদিকবি কৃত্তিবাসকৃত বাংলা রামায়ণেও রামচন্দ্র যে দশভূজা দুর্গার অকালবোধন করেছিলেন, তার সবিস্তার উল্লৈখ রয়েছে।

কিন্তু মজার ব্যাপার, বাল্মীকি-বিরচিত সংস্কৃত ভাষায় লেখা মূল রামায়ণে আবার ভিন্ন কথা বলা হয়েছে। এখানে রামচন্দ্রের সূর্যপূজার উল্লেখ রয়েছে, দুর্গাপূজার নয়। কেবল বাল্মীকির সংস্কৃত রামায়ণেই নয়, তুলসীদাসের হিন্দি রামায়ণে বা কম্ব-র তামিলভাষায় লিখিত রামায়ণেও (যার নাম “রামাবতারম”) রাবনবধের জন্যে শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনের কথা কোত্থাও লেখা নেই। না থাক। আমরা মোটামুটিভাবে এটুকু জেনে নিশ্চিত হয়েছি যে, রামচন্দ্রই শরৎকালে দেবীদুর্গার অকালবোধনের এবং এর সংগে সম্পর্কিত যাবতীয় শারদোৎসবের প্রথম প্রবর্তক।

এর বহু বহু যুগ পরে বাংলাদেশে শরৎকালীন দুর্গোৎসবের প্রচলন হয়। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করে না,  কে বা কারা এর প্রথম উদ্যোক্তা? এর উত্তর কিন্তু রহস্যাবৃত। তবে ইতিহাস ঘেঁটে, নানা স্থান থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে, গবেষকদের যুক্তিগ্রাহ্য অনুমানের আনুকুল্যে যেটুকু জানতে পারা গেছে, তা থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে, ষোড়শ শতাব্দীতে শাহানশা আকবরের রাজত্বকালে তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বঙ্গদেশে প্রথম শরৎকালীন দুর্গাপূজা প্রচলনের দাবিদার।

রাজা কংসনারায়ণ ছিলেন তাহেরপুরের অন্যতম ভুঁইয়া। এবং তৎকালীন বাংলার অস্থায়ী সুবেদার। বয়েসকালে রাজা কংসনারায়ণের হঠাৎ মতিগতির পরিবর্তন হয়। বিষয়-আশয়ে ঘোর অনাসক্তি দেখা দেয়। অতএব বাংলার সুবেদারের পদে ইস্তফা দিয়ে তিনি মনস্থ করলেন, এবার থেকে এই বৃদ্ধবয়সে তিনি কেবলই পরহিতকর জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে উৎসর্গীকৃত এবং নিয়োজিত করবেন। ভালো কথা। উদ্দেশ্যও নিশ্চয়ই মহৎ। কিন্তু কোন উপায়ে তিনি তা করবেন?

রাজা কংসনারায়ণ তখন করলেন কি, দেশের নামী-দামী যশস্বী পন্ডিত ব্যক্তিদের এক জায়গায় জড়ো করে নিজের বাসনার কথা অকপটে ব্যক্ত করলেন এবং কিভাবে, কোন উপায়ে তিনি এই মহৎকার্যে অগ্রসর হবেন, কিভাবে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করবেন – সে বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন।

নানা মুনির নানামতের মধ্যে একটি প্রস্তাব কিন্তু রাজা কংসনারায়ণের বেশ মনঃপুত হলো। এই প্রস্তাবটি এসেছিল শাস্ত্র-বিশারদ পন্ডিত রমেশ শাস্ত্রী মহাশয়ের কাছ থেকে – যিনি আবার রাজা কংসনারায়ণের কুলপুরোহিতও। তাঁর মতে, রাজা যদি শরৎকালে রামচন্দ্রের অকালবোধন দেবীপূজা পুনরায় নতুনভাবে প্রবর্তন করেন, তাহলে তাঁর সকল অপূর্ণ মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে এবং সারারাজ্যের মঙ্গল হবে, রাজ্যজুড়ে নেমে আসবে সুখ ও শান্তি।

শুধু এটুকুরই বুঝি অপেক্ষা। সারা বাংলাদেশ উথাল-পাথাল। রাজ্যবাসীরা আনন্দে মেতে উঠলো। চারিদিকে রাজা কংসনারায়ণের ধন্যি ধন্যি পড়ে গেল। রাজা প্রভূত অর্থব্যয় করে এই পূজা সম্পন্ন করেন। সেযুগের হিসেবে কমবেশি প্রায় সাড়ে আটলক্ষ টাকা এই পূজা এবং তার আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ ব্যয় হয়েছিল।

ভাগ্যিস রাজা কংসনারায়ণ আমাদের এই বাংলাদেশে শরৎকালে দেবীদুর্গার এই পুজোটা চালু করে গিয়েছিলেন, তাই আমরা ক’টা দিন অন্তত সারাবছরের একঘেয়েমির ক্লান্তি ভুলে সবাই মিলে একটু আনন্দ-ফূর্তিতে মেতে উঠি।






ভোজ্য ভুতের ছড়া
রামকিশোর ভট্টাচার্য

টাটকা তাজা মামদো ভাজা, দার্জিলিং-এর চা
সঙ্গে দুটো স্কন্ধকাটা
ছমছমিয়ে উঠছে গা টা?
আকাশকুসুম ভোজ্য এসব মিথ্যে ভেবো না।

হালহকিকৎ বলবো কিভাই বাচ্ছা ভুতেরকারি
চিংড়িপোতার রাইস মেখে -
লাঞ্চে প্রায়ই দেখছি চেখে
লাগছে কেমন? বলবো কেন! বলাটা দরকারি?

বর্ষা এলে রোজ বিকেলে জুজুবুড়ির চাউ
খায়নি যারা জিনের বড়া
ফুচকা তেঁতুল পেঁচোয় ভরা
আমার কাছে চায় কেউ যদি দিতেই পারি ফাউ।

পেতনি...পিশাচ...দত্যিদানোর মুড়কি করি রোজই
পেঁয়াজ দিয়ে পেঁচোর দমে
অন্ধকারে ভালোই জমে
নিশির ডাকের বাজনা শুনে মধ্যরাতের ভোজই





বলো দুর্গা মাঈকি, জয়
তন্ময় চক্রবর্তী

মা-ঠাকুর

দুর্গা আসে আকাশ ঘোড়ায়
কৈলাস এয়ারপোর্ট।
হাতির পিঠে নাগরদোলায়
জলে নৌকো বোট।

গ্রামে দুর্গা শহরে দুর্গা
কাশের বনে বাড়ি।
শিউলি তলায় ভোগের প্রসাদ
ভাসান ছাড়াছাড়ি।

নিভছে আলো প্যান্ডেলে সব
ফিরছে ঢাকির দল।
ফুরিয়ে এল পুজোর ছুটি
জয় মা দুর্গা বল।


অসুরের কান্না

ময়দানেতে মুগুর ভাঁজে
ভয়ঙ্কর এক অসুর।
বাইসেপস ট্রাইসেপস
ভঙ্গি যে তাঁর পশুর।

কালো মোষ, চোখ লাল
তাঁর পিঠে চড়ে সে।
আসুরিক গান গায়
সুর তাল ভুলি যে।

খবরের কাগজে
তাঁর ছবি ছাপে যেই।
বড় বড় দাঁত খুলে
খিলখিল হাসে সেই।


সেও থাকে কৈলাসে?
জানে নাকি 'ঘনাদা'।
স্বর্গের প্রাসাদে
তাঁর ঘর আলাদা।

একদিন দেখি বসে
একা একা কাঁদছে।
ফিসফিস করে বলে
মা'কে মনে পড়ছে।

নবমীতে ধুমধাম
ভোগ হবে রান্না।
হঠাৎই পড়ল মনে
অসুরের কান্না।


সব মেয়েরাই লক্ষী

টাকা পয়সা হিসেব জটিল
ক্লাস সেভেনের টিনটিন ।
কিলোর হিসেব যাওবা পারে
সাতশো হলেই হিমশিম।

টুম্পা জানে লক্ষ্মীপুজো
মানেই খাওয়া দাওয়া।
প্রসাদ নিয়ে পাশের বাড়ি
এদিক ওদিক যাওয়া।

পূর্ণিমা-চাঁদ, মায়ের মতন সত্যি
দাদু বলে, সব মেয়েরাই লক্ষী।



সরস্বতীর ল্যাপটপ

ল্যাপটপে সরস্বতী
কষছে জটিল অংক ।
কোন ওষুধে করোনাসুর
পালাবে দিয়ে লম্ফ।

হাঁসের পিঠে উড়তে উড়তে
ফর্মুলা সব খুলছে।
আগামী দিনে ভ্যাকসিন চাই
বীণার সুরে বলছে।

বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে রাখা
সরস্বতীর ফুল।
তাঁর ছোঁয়াতে পরীক্ষাতে
অংকে হয় না ভুল।


জয় গনেশ

পাড়াতে সবাই চেনে গণেশের বাড়ি 
রোজ জিম হিমসিম, কমছে না ভুঁড়ি।

কচুরি জিলিপি আর ঘন দুধ চায়ে 
ভুঁড়ির দোষ কি আর, বাড়ে ডানে-বাঁয়ে।

লাড্ডু খাওয়ার লোভ, সেই ছোটবেলাতে
ভুঁড়িও বাড়তে থাকে, শুধু হেলাফেলাতে।

পুজো তাঁর ধুমধাম, বুদ্ধির মাথা
সব কাজে তাঁকে চাই, তিনি সিদ্ধিদাতা।


কার্তিকেয়

চুলের বাহার দেখলে কেন
ভীষণ বকে বাবা।
টেরি কাটাই ফ্যাশন এখন
ট্যাটু "সিংহ-থাবা"।


যুদ্ধরা সব শান্তি চাইছে
ঘুমোয় কত বীর।
শান্তিকামী কার্তিকেয়
গুছিয়ে ধনুক তীর।

ময়ূর চড়ে  দেশ ভ্রমণে
যদিও বা কার্তিক...
পুজোর আগে  এ চার দিনে
আসবে ফিরে ঠিক। 






বিদ্যাসাগর, কথাকলি ও গোয়েন্দা রিমিল
শ্রীপর্ণা ঘোষ
সপ্তম শ্রেণী, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়
পশ্চিম মেদিনীপুর


এই যা সব গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। কিচ্ছু ঠিক হচ্ছে না বরং আরও বিগড়ে যাচ্ছে। আমার মাথা কাজ করছে না। আমার চার্জার টা কোথায় গেল? পেনড্রাইভ টাই বা কোথায় গেল? কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা। ধ্যাৎ, ভালো লাগেনা। "মা, মা, আমার চার্জারটা কোথায় গো?" ব্যাস্, বলতে না বলতেই হাতে লেগে জলের গ্লাস উলটে গেল। আর জলটা সারা বাড়িতে আর কোথাও পড়ার জায়গা খুঁজে পেল না, ওকে ল্যাপটপের ওপর পড়তে হলো। একটা বিকট চিৎকারে সারা বাড়ি মাথায় করল কথাকলি। 

প্রত্যেকবার এই দিনটায় কথাকলির সব গন্ডগোল হয়ে যায়। কারণ আজ হল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর জন্মদিন। সবাই ভাববে এটা আবার কী বিশেষ দিন! এই দিনে গন্ডগোলের বা কী আছে? কিন্তু কথাকলির জন্য সারা বছরের মধ্যে এই দিনটি সবচেয়ে গন্ডগোলের। যখনই তাদের বাড়িতে নতুন ক্যালেন্ডার আসে তখনই কথাকলি ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখটি কেটে দেয়। এর জন্য সে চরম বকা খায়, তাও সে শুধু নিজের মনের শান্তির জন্য এটা করে। 

কথাকলি এরকম করে কারণ প্রতিবার স্কুলে এই দিনে তাকে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে স্টেজে কিছু করতে বলা হয়। আর প্রতিবার সে কোনো গন্ডগোল করে আসে। যেমন, একবার তাকে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বক্তৃতা দিতে বলা হয়েছিল। সে সুন্দর করে একটা বক্তৃতা তৈরি করেছিল এবং জলের মতো করে মুখস্থ করে ফেলেছিল। স্টেজে যখন তার নাম ডাকা হয়েছিল সেই অব্দি সব ঠিকই ছিল। যেই সে মাইকে বলতে যাবে অমনি তার সব কিরকম গুলিয়ে গেছিল। তার কিছু মনে পড়ল না। এর মানে এই নয় যে, সে বক্তৃতা দিতে ভয় পায়। সে রীতিমত স্কুলে র‍্যাঙ্ক করে। সে দিল্লিতে গিয়েও বক্তৃতা  দিয়ে এসেছে। কিন্তু সেদিন কথাকলি কোন রকমে এটা-ওটা ভুলভাল বলে বক্তৃতাটা শেষ করেছিল। 

পরেরবার সে আর কোন রিস্ক না নিয়ে কাগজে বক্তৃতাটা লিখে নিয়ে গেছিল। ঠিক করেছিল কাগজ দেখেই বলবে। সেদিন দু-এক মিনিটের জন্য সে কাগজটাকে টেবিলে রেখে টয়লেটে গেছিল। ব্যাস, এসে দেখেছিল কে তার কাগজটার  ওপর চা উল্টে দিয়েছে। আর কথাকলি তো রাগে তেলে বেগুন না হয়ে তেলে বেগুনি হয়ে গেছিল। সে রেগেমেগে সব বন্ধুদের জিজ্ঞেস করেছিল, কে এই কাজ করেছে? সবাই তাকে দোষীর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। সে মানে তিনি ছিলেন অঙ্ক ম্যাডাম। তার সামনে গিয়ে কথাকলি ভয়ে ইঁদুর হয়ে গেছিল, কিচ্ছুটি বলত পারেনি। আবার সেই আগেরবারের মতই চার-পাঁচজন মহাপুরুষের জীবনী মিশিয়ে কোনোরকমে বক্তৃতা দিয়েছিল সে। 

পরেরবার কথাকলি বক্তৃতার দিকে গেল না। ঠিক হল সে আর ইমন একসঙ্গে অ্যাংকারিং করবে। এবারে সে সঞ্চালনায় কোন গণ্ডগোল করল না ঠিকই কিন্তু ওই যে, গন্ডগোল তো হবেই। আর হলও। ইমন এলো না তার পেট খারাপ হয়েছে। 

সঞ্চালনার স্ক্রিপ্ট ছিল বাংলা আর ইংরাজিতে। ইমনের বাংলা লেখাগুলো পড়ার কথা ছিল। সেগুলো এখন কথাগুলিকে পড়তে হবে কিন্তু সে তো বাংলা ঠিকমতো পড়তেই পারে না, তাই সেদিন সে অর্ধেক ইংরাজিগুলোই শুধু পড়ল। 

সবাই ভাবছ, যদি কথাকলি প্রতিবার এতই গন্ডগোল করে তাহলে তাকে প্রতিবার স্কুলে কিছু-না-কিছু কেন করতে দেয়া হয়? কারণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন কথাকলিদের পূর্বপুরুষ। তাই কথাকলিদের একটা সম্মান আছে। ঐদিনগুলোতে সে না যাওয়ার জন্য কতবার পালিয়ে গেছে, কতবার অসুখের ভান করেছে। তাও শুধু পারিবারিক সম্মান রক্ষার জন্য প্রতিবার তাকে ঐদিন স্কুলে যেতেই হয়েছে। 
আজ কথাকলি ঠিক করেছিল বিদ্যাসাগরকে নিয়ে একটা PPT বা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন করবে, কারণ যতই স্কুল বন্ধ হোক, অনলাইনে অনুষ্ঠান তো হবেই  — তার হাত থেকে তো নিস্তার নেই। 

  আগের দিন সারা রাত খেটে একটা পিপিটি বানায়। সকালে উঠে একবার টেস্ট করার জন্য পিপিটি ফাইলটা খোলার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই খোলে না। বারে বারে ল্যাপটপ হ্যাং করে যাচ্ছে। তারপর ল্যাপটপটা বন্ধ হয়ে গেল। কথাকলি ভাবল হয়তো চার্জ নেই তাই চার্জারটা খুঁজতে গিয়ে জল উল্টে ল্যাপটপটা ভিজে গেল।
 
এখন কথাকলিদের বাড়িতে দারুণ গম্ভীর মিটিং শুরু হলো। 

কাকিমা বলল, “ড্রায়ার দিয়ে ল্যাপটপটা শুকিয়ে দেখ না, শুকিয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।” 

কাকা বলল, “ল্যাপটপ কি কোন কাপড় জামা নাকি ভিজে গেলে শুকোতে দিলে আবার শুকিয়ে যাবে?” 

মা বলল, “ল্যাপটপ চলছে না তো কি হয়েছে তুই ফোন দিয়ে অনুষ্ঠানের ঢুকে যাবি।” 
কথাকলি বলল, “ল্যাপটপের তো পিপিটি-টা আছে ওটা না থাকলে কী দেখাব?” 

তখন কথাকলির মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি এল। গোয়েন্দা রিমিল কে ডাকলে ভাল হতো। রিমিল কম্পিউটার দারুণ জানে, ওই এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে। 

রিমিল কথাকলিদের বাড়ির পাশে থাকে ওরা একই স্কুলের একই ক্লাসে পড়ে। গোয়েন্দা রিমিলকে সব বলা হলো। 

রিমিল কথাকলিদের বাড়ি গিয়ে ল্যাপটপটা ভালোকরে দেখল। তারপর বলল, “না এই ল্যাপটপ-টা চলবে না অন্য কোনো ব্যবস্থা করতে হবে।” 

এই কথা বলবার পর কথাকলির এমন পরিবর্তন দেখবে তা রিমিল আশা করেনি। কথাকলি যেন পাগল হয়ে গেল, হা হা করে কাঁদতে লাগল, মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে লাগল, “আজ সন্ধেবেলা অনুষ্ঠান এবার আমি কী করি। বিদ্যাসাগরের উত্তরপুরুষ হওয়া এতটা কঠিন তা আমি কোনদিনও ভাবিনি।” 

রিমিল ওকে শান্ত করে বলল, “সকাল থেকে যা যা করেছিস সব বল।” 

একবার শুনেই রিমিল বুঝতে পেরে গেল, কথাকলিকে বলল, “এই বোকার মত কাঁদছিস কেন? তুই তো পেনড্রাইভে সব তুলে রেখেছিলিস?” 

কথাকলি নিজের এত বড় বোকামি দেখে নিজেই হেসে ফেলল। কিন্তু পেনড্রাইভ-টা কোথায় গেল? খুঁজতে হবে তো! বেলা তো বেড়েই চলেছে। তখনই ঝিমিল এল, বলল, “কী হয়েছে রে?” 

কথাকলি বলল, “আমার পেনড্রাইভ-টা খুঁজছি।” 

ঝিমিল বলল, “ও দিদি একা খুঁজে পাবেনা আমিও খুঁজছি।” 

রিমিল বলল, “আমি পাব না?” 

ঝিমিল বলল, “তুই যতই না পাকা পাকা গোয়েন্দা বই পড়িস আর সিরিজ দেখে ভালো গোয়েন্দা হোস, তোর খুব কমন-সেন্স কম আছে।” 

কথাকলি, ঝিমিলের কথায় মিটিমিটি হাসতে লাগল। রিমিল বড় বড় চোখ করতে লাগল। তারপর বলল, “শোন কথাকলি তুই সারারাত ঘুমোসনি চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে তুই বরং ঘুমোগে যা আমরা দু'বোন মিলে ঠিক খুঁজে দেব।”

রিমিল আর ঝিমিল খুজতে লাগল পেনড্রাইভ-টা। রিমিল বলল, “আমরা যে জায়গায় বেশি জিনিসপত্র রেখে থাকি সেই জায়গাগুলো ভালো করে দেখ।” 

ঝিমিল, রিমিল এর কথা অনুসারে খুঁজতে থাকল কিন্তু পেল না।  তারা ঘাঁজে-ঘোঁজে খুজে দেখতে লাগল তাতেও পাওয়া গেল না। 

ঝিমিল বলল, “বাড়িতে তো সব এক সেকেন্ডে খুঁজে দিস! এখন কী হলো?”  

রিমিল বলল, “ওটা তো নিজের বাড়ি কোথায় কী জিনিস থাকে বা কোথায় কী জিনিস আমরা রাখতে পারি তা আমি জানি, কিন্তু অন্যের বাড়িতে…” 

হঠাৎ রিমিলের কীএকটা মনে পড়তেই ঝিমিলকে বলে উঠল, “আমরা পেনড্রাইভ কোথায় লাগিয়ে রাখি বলতো?”
বলতে না বলতেই ঝিমিল ছুট্টে গিয়ে ভিজে ল্যাপটপের সাইড থেকে পেনড্রাইভ-টা টেনে বের করল। ওটা পেয়ে ওদের হিরে  খুঁজে পাওয়ার মতো আনন্দ হল। হঠাৎ কথাকলি আধঘুম চোখে হাউমাউ করতে করতে ছুটে এল। রিমিল বলল, “কিরে তুই ঘুমলই না?” 

কথাকলি বলল, “ঘুমোচ্ছিলামই তো! কিন্তু ওই বিদ্যাসাগর!” 

রিমিল আর ঝিমিল  একসঙ্গে বলে উঠল ‘বিদ্যাসাগর’! 

কথাকলি বলল, " বিদ্যাসাগর আমার কাছে এসে বললেন, 'ঠিক হয়েছে, তুমি যতদিন না বর্ণপরিচয় এর সবকটা ভাগ পড়ে শেষ করবে ততদিন তুমি প্রতিবার এই দিনে গন্ডগোল করে ফেলবে।'বল এবার আমি কী করব?” 

রিমিল আশ্চর্য হয়ে বলল, “তুই বাংলা পড়তে পারিস না?” 

কথাকলি বুঝতে পারল যে সে ভুল করে বলে ফেলেছে। কথাকলি খুব দুঃখের সঙ্গে বলল, “আমি প্রত্যেকবার স্কুলে র‍্যাঙ্ক করি। এরপর যদি আমি স্কুলে কাউকে বলতাম আমি বাংলা ঠিকঠাক পড়তে পারি না। সবাই আমার ওপর হাসত। আর বাড়িতে বললে সবাই বলতো ছিঃ ছিঃ বিদ্যাসাগরের উত্তরাধিকারী বাংলা জানেনা!! কলঙ্ক!!” 

রিমিল বলল, “এতে লজ্জার কিছু নেই। তুই বিদ্যাসাগরের উত্তরাধিকারী মানে এই না তাঁর যা যা গুণ ছিল তোরও সব থাকতে হবে। নিজে নিজেকে যোগ্য হয়ে উঠতে হয়। কারুর বংশ বা পদবী আমাদের পরিচয় নয়। আমরা আমাদের পরিচয় নিজে গড়ব। আজ তুই ইংরাজিতেই বলবি। তোর মধ্যে যা ক্ষমতা আছে তুই সেটাই কর।” 

সন্ধেবেলা, কথাকলি খুব সুন্দর প্রেজেন্টেশন করল। তার সঙ্গে ইংরাজিতেই এমন এক অপুর্ব বক্তৃতা দিল যে, সবাই অনলাইনেই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে লাগল। তার বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাদের ক্লাসের এক ছাত্রীর কাকা, যিনি আমেরিকায় থাকেন, তাকে ফোন করে বললেন বক্তৃতাটা লিখে পাঠাতে। তিনি আমেরিকায় ছোটোদের একটা পত্রিকায় ছাপবেন। একদিন আমেরিকা থেকে ডাকযোগে সেই পত্রিকাটা চলেও এল। কথাকলির উপলব্ধি হল ‘বিদ্যাসাগর’ তার ‘পরিচয়’ নয় ‘বিদ্যাসাগর’ তার ‘গর্ব’। তার পরিচয় তাকে নিজেকেই গড়তে হবে। সে হবে ‘কথাকলি’।




হারানো খাতা
প্রবাহনীল দাস
সপ্তম শ্রেণী, একমি একাডেমী, কালনা

বুম্বা সেদিন পৌঁছে স্কুলে শুনল কথা দারুণ, 
অঙ্কের স্যার আসবে না আজ, ঝড় বৃষ্টির দরুণ।
বুম্বা ভাবে, “আজ বাঁচোয়া!”
অঙ্ক খাতা গেছেই খোয়া।
খোঁজার আগেই স্যার যদি চান, হবে অবস্থা করুণ।

হঠাৎ হল জুতোর আওয়াজ, দরজা গেলো খুলে।
চেয়েই খাতা সবার কাছে, স্যার বসলেন টুলে।
স্যার গুনলেন, একটা খাতা
কম পড়ছে, ঘুরিয়ে মাথা –
চেঁচিয়ে বলেন, “আয় বুম্বা, বাজ ফেলি তোর চুলে”।






না-মানুষের মা
সুকুমার রুজ 

 পাহাড়ের নাম নীলপাহাড়। নীল আকাশের মতো রঙ বলেই হয়তো! এখন অবিশ্যি পাহাড়ের মাথাটা সোনালি।          সূর্য-ডোবা আলো ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের গায়ে-মাথায়। তাই সোনার বরন ধারণ করেছে নীলপাহাড়। পাহাড়ের বুকে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা প্রাণভরে সে আলোর রেণু মাখছে। গাছেদের কোলে আশ্রয় নেওয়া অজস্র পাখি এখন কোলাহলে মত্ত। আর একটু পরেই সোনালি আলো নিভে যাবে। পাহাড় আবার নীল রঙের হয়ে যাবে।   পাখিরাও তখন তাদের কিচিরমিচির থামিয়ে বিশ্রাম নেবে। নীলপাহাড় তখন ওর পায়ের কাছে পড়ে থাকা  অন্ধকারের চাদরটা টেনে নিয়ে সারা শরীরে জড়াবে।              
  এই অন্ধকারের অপেক্ষাতেই বসে রয়েছে সুন্দরী। পাহাড়ের কোলে বেত-ঝোপের আড়ালে গুটিসুটি মেরে চুপ।   ওর গায়ে পড়েছে শেষ বিকেলের সোনা রোদ। এতে ওকে আরো সুন্দরী লাগছে। কালোর মাঝে হলুদ রং যেন  ঝলমল করছে! সুন্দরী এখন শান্ত হয়ে বসে থাকলেও ওর মনের মধ্যে ছটফটানি। কেননা, বুনাতগাছের ঝোপের ওপাশে কচিদুটোকে ফেলে রেখে এসেছে। ছানাদুটোর বয়স মাত্র একদিন। এখনও চোখ ফোটেনি। কিন্তু       ওদের ছেড়ে না এসেও তো উপায় নেই। প্রায় সপ্তাহখানেক সুন্দরীর পেটে কিছু পড়েনি। বাচ্চা হওয়ার যন্ত্রণায় কষ্ট  পেয়েছে ক'টা দিন। এর মাঝে শিকার ধরা, খাওয়া, এসবের ইচ্ছেও হয়নি, পেরেও ওঠেনি। কাল তো সারাদিন সদ্য-জন্মানো ছানাদুটোর গা চেটেছে, তলপেটের ওম দিয়েছে, আর বুকের দুধ দিয়েছে। এখন নিজে কিছু খাবার   না খেলে যে ওদের জন্য বুকের দুধেও টান পড়বে। তাই ওদের ছেড়ে সুন্দরী শিকারের সন্ধানে।       
  বুনাত-ঝোপের মাঝে ছানাদুটো রয়েছে বলে সুন্দরী কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত। ও গাছের বিষাক্ত কাঁটাকে শেয়াল,  হায়না বা অন্য প্রাণীরা এড়িয়ে চলে। ও কাঁটা মুখে ফুটলে বিষাক্ত ঘা হয় যে! বুনাত-ঝোপ এখন ওদের রক্ষা  করুক। এই ফাঁকে ও যদি একটা বড়সড় শিকার ধরতে পারে!     
  নরম মাংস ও রক্তের স্বাদ পেতে ক্ষুধার্ত সুন্দরীর এখন মন আনচান। অন্ধকার নামলেই ও এগোবে দূরে ঐ   অংলাঘাস-ভর্তি জমিটার দিকে। শিকার ধরার জন্য নিজেকে লুকিয়ে ফেলার ওটাই আদর্শ জায়গা। রোদ গরমে অংলাঘাসগুলো পেকে হলুদ হয়েছে। কালো-হলুদ শরীরখানা ওই ঘাসের সঙ্গে বেশ মিলেমিশে যায়। ওখানেই  আসে সম্বরগুলো।              
  দিনের আলো নিভু নিভু। সুন্দরী অংলা ঘাসের জমিটার ওপাশে তীক্ষ্ণ নজর রাখে। ওপাশে জলার পরেই  নোনাপাহাড়। জলার ধারে গোটা কতক হাতি দেখা যাচ্ছে। একটা দাঁতাল ও গোটা-সাতেক মাদি। ছানাও রয়েছে    গোটা দুই। গরমে মজে যাওয়া জলার জলকাদায় দাপাতে এসেছে ওরা। নাকি নোনাপাহাড়ের গা চেটে নুন খেতে   এসেছে! হ্যাঁ, ওই তো দাঁতালটা পাহাড়ের পাথরে দাঁত দিয়ে খোঁচা মারছে। একটু পরেই মাদিগুলো ওখানে গিয়ে  ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাথর চাঁটবে। ছানারা নুন চাঁটে না। এসময় ওদের শিকার করার সহজ। সুন্দরী ওদের দেখে  মাটিতে নখের আঁচড় কাটে। জিভ বের করে মুখের কিনারা চাঁটে। ওর পেটের খিদেটা চনমনিয়ে ওঠে। তবুও সুন্দরী কিন্তু ওদিকে এগোয় না। দাঁতালকে ও খুব ভয় পায়। যত খিদে পাক না কেন, সুন্দরী এখন কোনও ঝুঁকি    নিতে চায় না। ওর যে এখন দুটো কচি ছানা রয়েছে। তাছাড়া ওর এখন হাতির ছানাকে আক্রমণ করতেও মন         সরে না। ওদেরও তো মা রয়েছে। তার মনে যে কষ্ট হবে। ছানার জন্য মায়ের মনে যে কী হয়, তা এখন বোঝে  সুন্দরী। তাই ও হাতির ছানা থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। ইচ্ছে করলে এতক্ষণে একটা মারতেই পারতো। কিন্তু তাতে এখনকার মতো পেটভর্তি হতো। ছানা রেখে বারবার তো শিকার করতে আসা যাবে না! সুযোগ পেলেই বজ্জাত শেয়াল কিংবা হায়না ঘুরপথে গিয়ে ওখানে দেবে হানা। ব্যাটারা এই জলার ধারেই তো ঘুরঘুর করে। মজে যাওয়া জলার পাঁকে ছটফটানো মাছ কিংবা কাঁকড়ার লোভে ঘোরে ফেরে। ওকে এখানে দেখে সুযোগ বুঝে ওর ছানাদের কেউ যদি...!     
  সুন্দরীর ইচ্ছে, একটা বড়সড় সম্বর শিকার করবে। ওদের ধরতে বিপদ কম। একটা ধরলেই দিন চারেকের নিশ্চিন্তি। কিছুটা খাবে, বাকিটা পরে খাওয়ার জন্য মাটিচাপা দিয়ে রাখবে। তার পাশে পাহারায় থেকে ঠ্যাং ছড়িয়ে শুয়ে ছানাদুটোর গা চাঁটবে আর চুকুস চুকুস দুধ খাওয়াবে। এসব ভাবতে ভাবতেই সন্ধে নামে।   
  সূর্য ডুবতেই ঝলমলে চাঁদ উঠেছে। জোছনার আলো খেলা করছে নীলপাহাড়ের চুড়োয়, চুইয়ে পড়ছে গাছের ডালে-পাতায়। জোছনা গুলে যাচ্ছে জলার কাদা-জলে। এখন অংলাঘাসের জমির ওপাশটা বেশ নিঝঝুম। শুধু কাঁচপোকার একটা হালকা ভনভনানি। আর ঘাসজমিতে বাসা বেঁধে থাকা হিতুপাখির ডানা ঝাপটানি। 
  শুকনো ঘাসের মাথায় থোকা থোকা জোনাকি আলো বিলোচ্ছে। এমন সময়েই আসে সম্বরের দল। জলার জল  আর কচি ঘাসপাতার লোভে দল বেঁধে আসে। সুন্দরী কান খাড়া করে লম্বা শ্বাস টানে। পরিচিত গন্ধ পায়। ওরা  তাহলে এসে গেছে। না, আর দেরি নয়! ওর শরীরে উত্তেজনা ফুটে ওঠে। থাবা ও ঘাড়ের মাংস পেশিতে থিরথিরে কাঁপন। এবার এগোনো যাক, এমন ভেবে সুন্দরী থাবায় শব্দ না তুলে সিম সিম করে এগোতে থাকে অংলাঘাসের  জমিটার দিকে। 
  ঐ তো দেখা যাচ্ছে একটা নধর সম্বর। দলের অন্যান্যরা কোথায় গেল! বোধহয় জলার ধারে এগিয়েছে। ওখানে এখনো কিছু সবুজ ঘাস রয়েছে, সেগুলোর লোভেই হয়তো...! এটা বোধহয় বোকার হদ্দ! তাই মাথা নিচু করে শুকনো ঘাস চিবিয়ে চলেছে। এখন ও দলছুট হয়ে গেছে। এখনই সুবর্ণ সুযোগ। অংলাঘাসের জমিটার ধারেই রয়েছে সম্বরটা। আর একটু এগোলেই নাগালের মধ্যে এসে যাবে। তাই ঘাসের মধ্যে দিয়ে  হামাগুড়ি দিয়ে সুন্দরী এগোয়। এগোতে এগোতে ওর মনে আসে ছানাদুটোর কথা। দুধের বাছারা অনেকক্ষণ মা-ছাড়া। অন্ধকার নামার  আগে একবার ফিরে গিয়ে দুধ দিয়ে এলে ভালো হতো। দুধের ভারে টনটন করছে বুক।  ওরা হয়তো খিদের জ্বালায় কুঁইকুঁই করছে। না, এখন আর ফেরা যাবে না। নিজের পেটেও যে আগুন জ্বলছে। শিকার সামনেই। আর দেরি নয়। ও লাফ মারার জন্য তৈরি হয়। সুন্দরী আট ফুটের হলদে-কালো ডোরাকাটা শরীরটা একবার টানটান  করে নেয়। তারপর চার পা এক জায়গায় এনে স্প্রিংয়ের মতো ছিটকে দেয় শরীরটাকে। ঠিক যেন কামানের নল থেকে এক ঝলক হলুদ আগুনমাখা গোলা বেরিয়ে গেল। ঝুপ করে শব্দ হলো। সেইসঙ্গে আরও একটা শব্দ হলো - - ক্র্যাট-ঠং। ধাতব শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরীর তীব্র চিৎকার। না, শিকার ধরার আনন্দে গর্জন নয়, শিকার হওয়ার যন্ত্রণায় পরিত্রাহি চিৎকার। সুন্দরী নিমেষে বুঝে যায়, কী ভুলটা করেছে ও। ছানাদুটোর বাপও শিকারের লোভে এই একই ভুল করেছিল। একটামাত্র সম্বর দেখে ওর সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পেটে আগুন জ্বলতে থাকায় তখন এত কিছু ভাবতে পারেনি। লাফ দেওয়ার আগের মুহূর্তে নিশানা অব্যর্থ করতে সম্বরটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিল। ঠিক তখনই চোখে পড়েছিল, সম্বরের পায়ে দড়ি। কিন্তু তখন আর থামার উপায় নেই। তবে শেষ মুহূর্তে বিপদের আঁচ পেতে লাফটা একটু ছোট হয়েছিল। তাই লোহার দাঁতওয়ালা বাঁকানো পাতদুটো ওর শরীরের মাঝ বরাবর কামড় বসাতে পারেনি। ফাঁদের মধ্যে পৌঁছনো সামনের ডান-পায়ের থাবায় কামড় বসিয়েছে। কয়েকদিন ধরে না খাওয়া দুর্বল শরীরে সুন্দরী আবার মেরেছে লাফ। তাতে চোরাশিকারির ফাঁদের দাঁত থাবায় আরও চেপে বসেছে। 
  ততক্ষণে চারদিকে জোরালো আলো জ্বলে উঠেছে। সুন্দরী বুঝে যায়, আর নিস্তার নেই। ছানাদুটোর বাপের যে দশা হয়েছে, ওরও সেই দশা হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমপাড়ানি গুলি-বন্দুক নিয়ে ছুটে আসবে দু'পেয়ে জানোয়ারেরা। তারপর ধারালো ছুরির ঝলসানি। অল্প সময়ের মধ্যেই ঝলমলে ছাল, চাপ চাপ মাংস আর শক্তপোক্ত হাড় আলাদা করে ফেলবে। ঠিক ছানার বাপের যেমন অবস্থা করেছিল।  
  অসহায় সুন্দরীর মনের মাঝে কচি ছানাদুটোর মুখ। মা-হারা হয়ে যাবে সে-দুটো। খিদের জ্বালায় কুঁইকুঁই শব্দ করে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনবে। ক্ষুধার্ত ছানাদুটো দিয়ে শেয়াল কিংবা হায়না নিজেদের খিদে মেটাবে। 
  সুন্দরীর মন আনচান করে ওঠে। বুক ফেটে কান্না আসে। কিন্তু ও কাঁদে না। ওর ভেতরে লুকিয়ে থাকা মা-টা  মুক্তির আশায় তীব্র চিৎকার করে ওঠে। কোনমতেই ও দু'পেয়ে জানোয়ারদের কাছে হার মানতে রাজি নয়। তাই  ও নিজের ডান-পায়ের আটকে পড়া থাবার ওপর তীব্র কামড় বসাতে থাকে। ওরা পৌঁছনোর আগে থাবাটাকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতেই হবে। লোহার দাঁতের কামড়ে আটকে থাক একটা থাবা। বুকের দুধ নিয়ে,  তিন পায়ে ঠিক পৌঁছে যাবে ছানাদুটোর কাছে। 
  একসময় সত্যি সত্যিই সুন্দরী আটকে থাকা থাবা থেকে শরীরটাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। তারপর   জীবনের সবচেয়ে বড় লাফখানা দেয়। অংলাঘাসের জঙ্গলে ছিটকে পড়ে হলুদ শরীর আর এক ঝলক রক্ত। 
  দু'পেয়েরা যখন ফাঁদের দাঁত-করাতের কাছে পৌঁছেছে, তখন লোহার দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা সুন্দরীর ডান  পায়ের থাবাটা তুড়ুক তুড়ুক নড়ছে। আর ততক্ষণে বুনাত-ঝোপের আড়ালে চোখ না-ফোটা ছানাদুটো তাদের মা- কে কাছে পেয়ে চুকুস চুকুস দুধ খাচ্ছে। সুন্দরীর শরীর জুড়ে থাবা হারানোর যন্ত্রণা, আর মন জুড়ে সন্তানকে বুকের দুধ দেওয়ার তৃপ্তি। সুন্দরী কখনো যন্ত্রণার চোটে ক্ষতবিক্ষত পা চাঁটে। আবার কখনো মায়ের স্নেহে ছানাদের গা চাঁটে। 
  ক্লান্ত চাঁদটা এক সময় টুপুস করে নীলপাহাড়ের আড়ালে লুকোয়। সুন্দরীর ছানাদুটোর চোখে নেমে আসে ঘুম। আর মা-সুন্দরী জেগে থাকে, যেন অতন্দ্র প্রহরী!





এক যে ছিল রাজকন্যা 
সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়     

                                                                                  সে এক সময় ছিল। যখন ঘন নীল রঙের আকাশ, কালো ধোঁওয়ায় এমন ছাই ছাই হয়ে যায়নি। জলে মাছেরা শান্তিতে সাঁতার কাটত। অসময়ের বিষে কেউ তাদের প্রাণ কেড়ে নিত না। গাছেদের রঙ ছিল ঝকঝকে সবুজ। তারা মনের আনন্দে আকাশের দিকে তাদের ডালপালা ছড়াত, সেসব কাটার কোন অনুমতি  ছিল না। আর সবচেয়ে অদ্ভুত কথা গাছপালা, পশুপাখি, জলের সব প্রাণী, এমনকি কীটপতঙ্গের দলও মানুষের ভাষা বুঝত। সবাই একই ভাষায় কথা বলত। 
কিন্তু তখনও মানুষের দুর্দশা ছিল। কিছু  কিছু গরীব মানুষের ঠিকঠাক খাবার জুটত না। বুধুর বাবা ক্ষেতে চাষ করতেন। তিনি মারা যাবার পর মা, ছেলের দুর্গতির অন্ত রইল না। দিন কতক যা ছিল বেচে খেয়ে, হাত একেবারে ফাঁকা হয়ে যেতে বুধু আর তার মা ঠিক করল তাদের গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে যাবে। সেখানে অনেক কাজ, নিশ্চয়ই তাদের না খেয়ে মরতে হবেনা। তারা বাস করত টালির চালের একটা পুরনো ঝরঝরে বাড়িতে। জিনিসপত্র তেমন ছিল না। তাই বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় তারা শুধু সঙ্গে নিল খাঁচায় ভরা ময়নাকে। প্রায় বছরখানেক আগে ওদের বাড়ি্র উঠোনে উড়তে উড়তে এসে ডানায় আঘাত পেয়ে পড়ে যায় ময়নাটা। সেবাশ্রুশুষা করে ওরাই বাঁচিয়ে তোলে। সেই থেকে পুরনো এক খাঁচায় ওদের একজন হয়েই  ছিল সে। ওদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ওদের সব বিপদে আপদে ওই ময়নাটাই বুদ্ধি যোগাত। 
শহরে যাবার কথা শুনে ময়না বলল, “বুধু, শুধুশুধু তুমি আমার খাঁচাটাকে নিয়ে যাবে কেন? পুরনো বাড়ির বারান্দায় রেখে যাও। আর আমাকে খুলে দাও। আমি উড়ে উড়ে তোমাদের পথ দেখাব।”
দরজায় তালা দিয়ে বেরোবার সময়, ময়নার কথামত ওকে খুলে দিল বুধু। খাঁচা থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বুধুর ছোট্ট কাঁধে ভাল রকম জিরিয়ে নিল সে। তারপর ওদের মাথার ওপর উড়তে লাগল। ময়নাকে নিয়ে নদীর পাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওরা সন্ধেবেলায় এসে পৌঁছল গভীর এক জঙ্গলের মুখে। সেই জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে আসছে বাঘের হালুম হালুম ডাক, সিংহের তীব্র গর্জন,আরো কত কী? এ নদী ওদের গ্রামের পাশ দিয়ে জঙ্গলের বুক চিরে অবশেষে শহরে গিয়ে পৌঁছেছে। নদীটি শান্ত, তার টলমলে জলে  মেঘের ছায়া পড়েছে।
বুধুর মা থমকে গিয়ে ভয় পেয়ে বললেন, “চল বুধু আমরা ফিরে যাই। এই বনে ঢুকলে বাঘ, সিংহের পেটে যাব। তার থেকে নিজের বাড়িতে না খেয়ে মরাই ভাল।”
ময়না বলল, “এতদূর এসে ফিরে যাবে কেন?আমি উপায় দেখছি। তোমরা এখানেই বসো, বিশ্রাম নাও, কিছু খাও দাও। আমি ততক্ষণ একটু চক্কর মেরে আসি।দেখি কোন উপায় পাই কিনা।”
ওরা পুঁটলি খুলে গুড় আর শুকনো রুটি বার করল। নদীর জলে মুখহাত ধুয়ে ঘটি করে ওই নদীর জল নিয়ে দুজনে রূটি খেতে বসল।
বুধু বলল, “মা ,আমাদের ময়না কী খাবে? একটু রুটি গুড় ওর জন্য রেখে দাও।জলে ভিজিয়ে ওকে খাইয়ে দেব।”
মাথার ওপর থেকে ময়নার গলা ভেসে এলো, “আরে ,কর কী? বনে কখনও পাখির খাবারের অভাব হয়? আমি তো গাছে গাছে কত ফল দেখে এলাম। সেসবই খেতে চললাম। তোমাদের জন্য গাছের তলায় ঠোক্কর দিয়ে ফেলে রাখব।যাবার পথে কুড়িয়ে নেবে।”
বুধুর মা বললেন, “ওই ভয়ংকর বন পার হয়ে আমি শহরে  যাব না বাছা। আর আমার বুধুকেও প্রাণে ধরে যেতে দিতে পারব না। তুমি বরং সঙ্গে চল, ফল পাকুড় কুড়িয়ে আমরা বাড়ি ফিরে যাই।”
ময়না কথাটি না বলে উড়ে গেল বনের দিকে। পিছু পিছু গেল বুধু আর তার মা।
নানা গাছের নীচে ময়না ঠুকরে ফেলেছে নানা রকমের ফল। আম,জাম, পেয়ারা, লিচু, আরো কত কী! কুড়োতে কুড়োতে বেলা শেষ। সূর্যি পাটে বসেছে অনেকক্ষণ। বনের অনেক ভেতরে চলে এসেছে ওরা। খেয়াল হতেই দুজনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল।এবার কী হবে? বাঘ, সিংহের হাতে মারা পড়বে তো।
ময়না সবশুনে বলল “দাঁড়াও দেখছি। আমি গান গাই। বটগাছ দাদার মন ভোলাই। দেখি, তাতে তোমাদের কিছু ব্যবস্থা হয় কিনা।” 
ময়না তখন সুর করে গাইল, “কে কোথায় আছো বাঁচাও, বাঁচাও/আমরা পড়েছি ভারি বিপদে,/এ বনের শুরু আছে, শেষ কোথা জানি না,/মোদের রক্ষা কর হে।”
গান শেষ হতেই এক গম্ভীর আওয়াজ ভেসে এলো, “আঃ, কতদিন আমায় কেউ গান শোনায় নি। প্রাণটা হাঁফিয়ে উঠেছিল একেবারে। তোমার মিষ্টি গলার গান শুনে ভারী খুশি হলাম ময়না। কী বর চাই বলো।”
ময়না বলল, “বট দাদা আর কিছু না। এই বুধু আর ওর মায়ের রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দাও যদি।”
“তথাস্তু।” বলে বটগাছ তার গুঁড়ির গা চড় চড় করে খুলে ফেলল। বুধু আর তার মাকে ঢুকিয়ে আবার সব বন্ধ হয়ে গেল। 
সারা রাত বট গাছের আশ্রয়ে নিরাপদে রইল বুধু আর তার মা। ময়না বটগাছের ডালে বসে খানিক ঘুমিয়ে নিল। অন্ধকার বনের হিংস্র জন্তুদের আসাযাওয়া, তাদের শিকার করা, চোখ খুললেই চোখে পড়ছিল, আর সে শিউরে উঠছিল। মনে ভাবছিল, বটদাদা ওইভাবে আশ্রয় না দিলে ওই বুনো জন্তুদের হাত থেকে সে কিছুতেই বুধু  আর তার মাকে বাঁচাতে পারত না।
দিনের আলো ফুটতেই বটবৃক্ষ তার গুঁড়ি ফাঁক করে বুধু আর তার মাকে বার করে দিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বন পার হয়ে যাও বাছারা।সারা রাত ঘোরাফেরা করে বনের পশুপাখির চোখে এই ঘুম নেমেছে। আবার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই তোমাদের এই বন পার হয়ে যেতে হবে। তোমরা ময়নার ভালবাসার লোক। তোমাদের জন্য অ্নেক শুভেচ্ছা।”

 ওরা চলেছে তো চলেছে। পথ আর ফুরোয় না।এদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। বুধুর মা কাঁধ থেকে ঝোলা নামিয়ে মাটিতে বসে বললেন, “আমি আর পারছি না।পায়ে খুব লাগছে। বুধু তুই ময়নার সঙ্গে যা। আমার কথা ভাবিস না।”
বুধু বলল, “সে হয়না মা, তোমাকে ফেলে আমি কোথায় যাব? বাবা নেই। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি আর বাঁচতেই চাই না।” সে মায়ের পাশে বসে মায়ের পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
ময়না পড়ল ফাঁপরে! সে ঘাড় বেঁকিয়ে ওদের দেখতে লাগল,আর ভাবতে শুরু করল কী করে ওদের বাঁচাবে।
এমন সময় সেই পথে যাচ্ছিল মস্ত বড় এক সাদা হাতি। বনে গাছপাতা খেতে এসে সে ওদের কথা শুনতে পেল। যেমন সুন্দর তার দেহ, তেমনি সুন্দর তার মন। ধীরে ধীরে এসে সে বুধুর মাকে শুঁড় তুলে অভিবাদন করে বলল, আমি সবকথা শুনেছি। চল, তোমাদের শহরে পৌঁছে দিই।” 
এই বলে সে শুঁড়ে জড়িয়ে এক এক করে পিঠে তুলে নিল বুধু আর তার মাকে। তারপর বনের পথে পা ফেলে বলল, “আমার পিঠটা তোমরা চেপে ধরে থাকো। আমি তোমাদের ধীরে ধীরে পৌঁছে দেব।” 
ময়না মনের আনন্দে শিস্‌ দিতে দিতে গাইল, “হাতি দাদার মনটি সাদা/ঘাসপাতা খায় গাদা গাদা/গায়ের রঙেও জেল্লা বাঁধা/ময়না বলে, সেলাম দাদা।”
বনের পাখিরাও ময়নার সুরে সুর মেলাল। হাতি মুচকি মুচকি হেসে গানের তালে তালে, ছন্দে ছন্দে পা ফেলে দীর্ঘ বনপথ পার করে শেষে শহরের মুখে পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়ল।
বুধুরা ঝোলা থেকে ফল বার করে তার মুখে দিতে সে বেজায় খুশি হয়ে শুঁড় তুলে অভিবাদন  করল। কয়েক ঘন্টায় সে ও ওদের  দলের একজন হয়ে পড়েছিল। তাই যখন সে বিদায় নিয়ে চলে গেল, ময়না ল, বুধু আর তার মা, কেমন মুষড়ে পড়ল।

শহরে গিয়ে বুধু আর তার মা দিশাহারা হয়ে গেল।সারাজীবন তারা গ্রামেই থেকেছে। শহরের মুখ দেখেনি। শহরের বড় বড় বাড়ি, দোকানপাট, এমন কী নানা রকমের গাড়ি বা নানা পোশাকের মানুষজনকে দেখে তারা পথেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। শহরের সব আছে, কিন্তু হাওয়া ভালো নয়।সবকিছু কেমন যেন থম্‌থম্‌ করছে। ওরা কোথায় যাবে,কি করবে, কিছুই বুঝতে পারছিল না। শেষে ময়নার কথামত অনেক পথ ঘুরে তারা এক জীর্ণ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। তখন ভরা দুপুর। দরজা খুললেন পুরুত মশায়ের বউ। তারপর ময়নাকে দেখে চিৎকার জুড়লেন। “ওগো, দেখে যাও, কে এসেছে।”
ময়না তখন তার পুরনো মালকিনের হাতের ওপর বসে তার আদর খাচ্ছে। ময়নার কাছে ওদের কথা শুনে পুরুতমশায়ের বউ বললেন, “ওই কূয়োতলায় বালতি আছে। হাতে পায়ে জল দিয়ে এসে দাওয়ায় পাতা মাদুরে বসো ভাই।আমি জল দিই,খাবার দিই।”
ওদের আপ্যায়ন করে মাদুরে বসিয়ে ঠান্ডাজল, খাবার, সব খাওয়া্লেন তিনি। একটু পরেই বাড়ি ফিরলেন পুরুতমশাই। ময়নাকে দেখে খুব খুশি হয়ে বললেন,“তুমি একেবারে সময়মত এসেছ। প্রজারা এতদিনে তৈরি হয়েছে।আমাদের কাজ শুরু করতে হবে।”
বুধু আর তার মা কিছুই না বুঝে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। পুরুতমশাই তখন তাদের বললেন “এই শহর হল এ রাজ্যের রাজধানী। তবে রাজা এখন বন্দী। এক দস্যুদল তাদের দলবল নিয়ে রাজাকে বন্দী করে সিংহাসনে বসেছে। প্রজাদের ওপর তারা খুব অত্যাচার করছে। বিশেষ করে নারীজাতির ওপর তাদের খুব আক্রোশ। কোন মহিলার পথে বেরোন বারণ,বাইরের কাজেকর্মে এমন কি শিক্ষালয়ে যাওয়াও তারা নিষিদ্ধ করেছে। প্রজারা ফুঁসছে।বিদ্রোহ আসন্ন। এই পরিস্থিতিতে আপনাদের আমি কোথাও ছাড়তে পারিনা। আপনারা আমার বাড়িতেই থাকুন,খান-দান।বিপদ মিটলে আমিই আপনাদের সব ব্যবস্থা করে দেব।”
পুরুতমশায়ের বাড়িটি ভারী সুন্দর। পেছনে বাগান, পুকুর সব আছে। ওই বাড়ির একটি ঘরে পুরুতমশায়ের গিন্নি তাদের থাকার ব্যবস্থা করলেন।বুধুর মা সংসারের কাজে সাহায্য করতে লাগল। আর বুধু বাগানের গাছপালার তদারকি করে, পুকুরের মাছ ধরে, গোয়ালের গরুদের দেকভাল করে, রান্নার কাঠ টুকরো টুকরো করে কেটে সংসারের সাশ্রয় করতে লাগল। তারা খালি পুরুতমশায়ের নিয়ম মেনে বাড়ির বাইরে যেতনা।
এভাবে দিন যায় রাত যায়। বুধুদের মনে হয় কী যেন একটা ঘটতে চলেছে। তার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।রাতের অন্ধকারে একজন দুজন করে লোক আসে।কিসব কথাবার্তা চলে। আবার ভোরের আলো ফোটার আগেই তারা চলে যায়। সেদিন ছিল অমাবস্যার রাত, ময়না রাতেই এলো তাদের ঘরে।বলল, “বিদায় বন্ধু,যুদ্ধে যাচ্ছি। ফিরলে দেখা হবে।”
বুধু ময়নাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে আদর করল। বুধুর মা ময়নাকে আদর করতে করতে অঝোরে কাঁদতে লাগল। শেষে দুজনেই তারা ময়নাকে বিদায় দিল বটে কিন্তু নিজেরা উৎকন্ঠায় সারা রাত জেগে রইল।
সেদেশের রাজারানী ছিলেন সবার প্রিয়। তাই প্রজা বিদ্রোহের কথা ভেবে দস্যুদলের নেতা তাদের মারার সাহস করেনি। বন্দী করে রেখে দিয়েছিল প্রাসাদের চূড়ার নির্জন কুঠুরিতে। সেখানে দস্যুরা ছাড়া কেউ যেতে পারত না। তবে রাজকন্যাকে  বন্দী করতে পারেনি। মৃগয়া করতে গিয়ে ফেরার পথে রাজধানী দস্যুদের কবলে পড়েছে শুনে সে আর ফেরেনি। কোথায়  উধাও হয়েছে, কেউ জানে না। একে বন্দী, তায় তাদের একমাত্র কন্যার  কোন খবর নেই। তাদের দিন কাটছিল বড় দুঃখে যন্ত্রনায়।     

 সেদিন রাতে আবার চাঁদ ওঠেনি। অমাবস্যার অন্ধকার রাত। রাজা আর রানী তাদের ঘরের গবাক্ষে চোখ রেখে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলেন।
রানী বললেন, “এভাবেই বন্দী অবস্থায় একদিন আমাদের মৃত্যু হবে। দুঃখ একটাই, এজন্মে প্রিয় কন্যার মুখ আর দেখতে পেলাম না।”
রাজা বললেন, “আমার তা মনে হয়না।দেখা আমাদের হবেই।”
তখুনি খোলা গবাক্ষপথে সেই ময়না এসে রানীর কাঁধে বসল,আর বলল, “রাজকন্যা আসছে ওই/বরণডালা তৈরি কই?”
হঠাৎ চারপাশে বেজে উঠল কাড়া নাকাড়া। অবাক হয়ে রাজা রানী দেখলেন তাদের বন্ধ দরজা খুলে গেল। মন্ত্রী ,সেনাপতি আর তাঁদের রাজপুরোহিত এগিয়ে এসে বললেন, “মহারাজ চলুন। সিংহাসনে আপনি বসলে দেশের শান্তি দশের শান্তি।”
তারপর তারা বললেন কিভাবে কৌশলে দস্যুদের নেতাকে বন্দী করে, তার সাঙ্গোপাঙ্গকে দেশ ছাড়া করে, দেশের মানুষ অত্যাচারের প্রতিশোধ নিয়েছে।
রানী বললেন, “কিন্তু রাজকন্যা? সে কোথায়?”
পুরোহিত বললেন “যথাসময়ে তার সাক্ষ্যাৎ পাবেন রানীমা।” 

ওদিকে পুরোহিতের বাড়িতে তখন মহা ধুমধামের আয়োজন চলছে। পুরোহিত নাকি একেবারে রাজকন্যাকে সঙ্গে নিয়েই বাড়ি ফিরবেন।
রাজপ্রাসাদ থেকে ফেরার পথে পুরোহিত চললেন নদীর ধারে। সেখানে ঘাটের পাশে এক গাছের ডালে চুপ করে বসেছিল সেই ময়না পাখি।
পুরোহিত ডাকলেন তাকে, “ময়না আমার ময়না/আর তো দেরি সয়না।” 
পুরোহিতের ডাকে ময়না এসে নদীতে তিন ডুব দিয়ে উঠল।পুরোহিত তার মাথায় মন্ত্রপূতঃ জল ছড়িয়ে দিতেই, কোথায় ময়না,এতো এক ঝলমলে রাজকন্যা!যেমন তার রূপ,তেমনি তার গুণ।
পুরোহিত বললেন, “চল মা,তোমাকে রানীর কাছে রাজবাড়িতে নিয়ে যাই।”
রাজকন্যা ময়না্বতি মধুর কন্ঠে বললেন, “এখন না।আগে আমি প্রজাদের কাছে যাব। তাদের অভাব অভিযোগের কথা জানব।তারপর যাব বুধু আর তার মায়ের কাছে। সে আমার বন্ধু আর তার মা আমায় অসময়ে আশ্রয় দিয়েছেন। সবশেষে আমি যাব রাজপ্রাসাদে, পিতা মাতার কাছে।”
পুরুত মশাই বললেন,তবে তাই হোক। তখন পুরুতমশায়ের ডাকে সুসজ্জিত ঘোড়া এলো। তার পিঠে চেপে রাজকন্যা ময়নাবতি তার যাত্রা শুরু করলেন।





টম অ্যান্ড জেরি রিটার্ন্স
তৃষ্ণা বসাক


এই নতুন জায়গাটার সব ভালো, শুধু ইঁদুর পাওয়া যায় না। অন্তত এসে ইস্তক, একটা ইঁদুরের লেজও দেখেনি বিবি। বিবি মানে বেড়াল বাহাদুর। সেই যে সেবার পৃথিবী ছেড়ে আসার হিড়িক পড়ে গেল, পৃথিবীর হাল নাকি খুব খারাপ, সুযযি নাকি নিবে আসছে, মাথার ওপরে কী একটা চাদর থাকে, তার ফুটোটা দিনদিন বাড়ছে,চারদিকে নোংরা, স্বচ্ছতা অভিযান করে নাকি এক দোরের নোংরা অন্য দোরে ফেলা হচ্ছে- বিবি ভেবে পায় না একটা জায়গা ছেড়ে যাবার এগুলো কীকরে কোন কারণ হতে পারে? মানুষগুলো যাই বলো, বড্ড স্বার্থপর, সবসময় শুধু নিজেদের কথা ভাবে, আরে বেড়ালদের কথাও তো একটু ভাববি? অমন পুরুষ্টু ইঁদুরগুলো ফেলে আসতে হল! এসে ইঁদুরদের শোকে সাত সাতটা রাত ঘুম হল না বিবির। তারপর সে শোক টোক ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল। কথায় আছে বেড়ালের নটা জীবন। তাহলে তো নটা জীবনের আশা মিলিয়ে কী বিরাট আশা তার! আর সে কিনা এত সহজে ভেঙে পড়বে?  
বিবি থাবার ওপর থাবা পেতে ভাবতে শুরু করে এখানকার ভালো দিকগুলো কী কী। থিঙ্ক পজিটিভ। কে যেন বলেছিল কথাটা। ঠিক মনে পড়ল না এই মুহূর্তে। দূর হোক গে, যেই বলে থাক, কথাটা খাসা। আর এখানে টিঁকে থাকতে গেলে পজিটিভ ভাবনা চিন্তা করতে হবে তাকে।
এক নম্বর ভালো দিক হল- এখানে খাওয়াদাওয়ার ঝামেলা নেই। কি মানুষ, কি কুকুর বেড়াল , যে যার ক্ষমতা অনুযায়ী টপ-আপ ভরে নেয়। পোষ্যদের টপ-আপ অবশ্য তাদের মালিকরাই ভরে, কেউ একমাস, কেউ ছ মাস, কেউ এক বছর, আপাতত এই তিনরকম টপ-আপই পাওয়া যায়। একবার ভরে নিলে বেশ কিছুদিন নিশ্চিন্ত, খাওয়াদাওয়ার ঝামেলা নেই। বিবি মাথা চুলকে ভাবল এটাকে কি সত্যিই ভালো বলা যায়? খাওয়াদাওয়া ব্যাপারটাই হাওয়ায় হাওয়ায় হয়ে যাচ্ছে! মাছের কাঁটা চিবোলাম না, শিকেয় ঝোলানো মাছভাজার দিকে করুণ চোখে তাকালাম না, লোকের বাড়ি চুরি করলাম না, ইঁদুরের ওপর ঝাঁপালাম না, চড়াইপাখি দেখে তাড়া করলাম না- ছোঃ! এটা একটা জীবন? ভারি মুষড়ে পড়ে বিবি। তার থিংক পজিটিভ মিশন গোড়াতেই টলে যায়।

মন খারাপ করে এদিক ওদিক তাকায় বিবি। দূর ছাই, তাকানোর আছেটাই বা কি? একটাও গাছ নেই, গাছে চড়াই পাখি নেই,  মাঠ নেই, মাঠে ইঁদুরের গর্ত নেই, এর নাম নাকি জিও প্ল্যানেট! দুত্তোর! এর নাম হওয়া উচিত ছিল মরো প্ল্যানেট। ও শুনেছে জিও সিমের ব্যবসায়ীরা এই জায়গাটা বানিয়েছে। এটা সত্যিকারের প্ল্যানেট নয়, একটা বানানো জায়গা,  পৃথিবীতে থাকতে থাকতে যারা হাঁপিয়ে উঠেছিল, তারা  সব এখানে এসে জুটেছে। যেমন বিবির মালকিন।  পৃথিবীতে থাকার সময় বিবি দেখত দিন নেই, রাত নেই উনি কম্পিউটারে টকাটক টকাটক লিখেই চলেছেন। উনি নাকি একজন বিখ্যাত লেখিকা। আর লেখার জন্যেই নাকি কিছু লোক ওঁর ওপর এমন চটা, যে এ শহর ও শহর পালিয়ে বেড়াতে হয় তাঁকে। আর তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে বিবিও। তবে এতদিন যেখানে যেখানে গেছে, ইঁদুরের কোন অভাব হয়নি, চড়াই পাখিও যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এই জিও প্ল্যানেট  একটা পোড়ো  জায়গা। এখানে খুব মরিয়া না হলে কেউ আসে না। যেমন তার মালকিন। এ শহর ও শহর ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীটার ওপর ঘেন্না ধরে গেছিল তাঁর। আর ঠিক সেই সময় জিও প্ল্যানেটের বিজ্ঞাপন তাঁর চোখে পড়ল।  
‘ আপনি কি পৃথিবীতে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছেন? সেই নিত্যি ধূল ধোঁয়া জ্যাম, নাক গলানো পড়শি, হিন্দু মুসলমান, বোমা, কাগজ, ফেসবুক? যদি সত্যিকারের সুখ চান তো চলে আসুন জিও প্ল্যানেটে। আপনার শান্তি বিঘ্নিত করার জন্যে এখানে একটা কুকুর বেড়াল অব্দি নেই!’

এইজন্যেই মালকিনের ওপর ভারি অভিমান হয় বিবির। যেখানে কুকুর বেড়াল অব্দি নেই, সেখানে যে ইঁদুর থাকবে না এইটুকু সহজ কথা মাথায় এল না? এদিকে নাকি এত বড় লেখিকা? হুঃ! নেহাত বিবি লেখে  না, আসলে একটু আলসে সে, লিখলে দেখিয়ে দিত লেখা কাকে বলে? কেন, সে বুঝি মাঝে মাঝে রঙের ডাব্বায় লেজ চুবিয়ে দেওয়ালে ছবি আঁকেনি? সেসব অবশ্য পৃথিবীতে থাকতে। এখানে এসে ইস্তক রঙ, তুলি, কাগজ, কলম চোখে পড়েনি। মালকিন বরাবর তো ল্যাপটপেই লেখে, এখানেও সেই ল্যাপ্টপটাই নিয়ে এসেছিল, ভেবেছিল এখানে শান্তিতে দিনরাত লিখবে। গাড়ির প্যাঁ পোঁ নেই, মাইকে রাম-রহিম ভক্তদের কান ফাটানো চিৎকার নেই, চাঁদার উৎপাত নেই, পুরসভা থেকে কলিং বেল বাজিয়ে ‘ছড়া ও ছবিতে ম্যালেরিয়া’ পুস্তিকা দেবার সুযোগ নেই, সবচেয়ে বড় কথা রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়ার কোন পাট নেই, সারাদিন নিজের যা ইচ্ছে করো, অঢেল সময়। অথচ এখানে এসে থেকে মালকিন একটা লাইন লিখেছে কিনা সন্দেহ। ল্যাপটপ খুলে বসে ঠিকই, কিন্তু চোখ থাকে জানলায়। জানলা দিয়ে চোখ বাড়ালে চোখ কোথাও আটকে যায় না, এই যা। অনেক দূরে দূরে একইরকম গোল গোল একেকটা বাড়ি, আর মধ্যে মধ্যে কমিউনিটি সেন্টার, ওখানে সবরকম খেলা, কেনাকাটা, গান বাজনার ব্যবস্থা। খাওয়ার টপ-আপ ওখান থেকেই ভরতে হয়। ওখানে গেলে সময় বেশ কেটে যায়, শুধু মানুষদের নয়, তাদের মতো পুষ্যিদের জন্যেও নানান খেলা আছে। খুব মজা হয় বিবির। কিন্তু এমন ঘাড়বেঁকা  মানুষ জন্মেও দেখেনি বিবি। উনি কিছুতেই কমিউনিটি সেনটারে যাবেন না। ওখানে গেলে নাকি কেবলই চেনা লোকের সঙ্গে দেখা। যে লোকটা ওঁর বই পুড়িয়েছিল, সেও নাকি এখানে এসে জুটেছে। সেদিন লোকটাকে দেখার পর বাড়ি ফিরে ফোনে  কার সঙ্গে খুব চেঁচামেচি করছিল মালকিন। বোধহয় যার কাছ থেকে এই জায়গাটা কিনেছে তাকেই বকছিল। অত চেঁচামেচির মধ্যে একটা কথাই বুঝল বিবি।
‘তাহলে তো আবার একটা পৃথিবীই বানালেন আপনারা? মাইনাস গাছপালা, নদী, অরণ্য’
বিবি ওমনি ম্যাও করে বলল ‘আর মাইনাস ইঁদুর? এটা বললে না তো?’ মালকিন ফোনে হাত চেপে বলে ‘উঃ আমার বেড়ালটাও হয়েছে তেমনি, যখনই একটা দরকারি আলোচনা করব, ওমনি এসে বকবক করতে শুরু করবে!’
 ব্যস অভিমানে রোঁয়া ফুলে উঠল বিবির।  সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল গটগট করে।

ঘণ্টা দুয়েক বিবির খোঁজ পড়েনি। বাড়ি থেকে ডাঁটের মাথায় বেরোলেও, রাগ যত পড়ে আসছিল তত তার ভয় করছিল। কোনদিন একা বেরোয় নি তো কোথাও। না মালকিন তার খারাপ নয়, ভালোও বাসে মোটের ওপর, কিন্তু ওই যে হিটলারি কায়দায় তাকে ঘেঁটি ধরে এখানে নিয়ে এল,একবারো মতামত জানার অপেক্ষা করল না, এতেই রাগ হয়েছে বিবির। হাঁটে হাঁটতে তার রাগ পড়ে আসছিল, একসময় ভয়ও থাকল না। কীসের ভয়? এখানে তো একটা  কুকুর পর্যন্ত নেই। পুরো চকচকে টাকের মতো ধূ ধূ প্রান্তর। মাঝে মাঝে ছোট ছোট বাড়ি, কমিউনিটি সেন্টার আর পার্ক। বিবি রেলিং -র ফাঁক দিয়ে একটা পার্কে ঢুকে পড়ল। পার্কে বসার সুন্দর বেঞ্চ, ঘাসের জমি, গাছগাছালি, একটা পুল। এগুলো সবই নকল, জানে বিবি। তাতে অবশ্য তার কিছু এসে যায় না। পোকা ধরা আসলের চেয়ে নকল খারাপ কীসের? পৃথিবীর সব কিছুতে নাকি বিষ, তাই তো তার মালকিন এখানে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু আসার পর কী হাহুতাশ! দিল্লিতে ওঁর জানলার সামনেই একটা মস্ত ঘোড়ানিম গাছ ছিল, সেই গাছটাকে উনি এতই মিস করছেন যে এক বর্ণ লিখতে পারছেন না! হুঃ যত সব ন্যাকামো। বিবি যে নিজের জীবনখানাই মিস করছে! তার জীবন মানেই তো ইঁদুর ধরা। সেদিকে যদি একটুও হুঁশ থাকে! পার্কে বসে থাকতে থাকতে তার মেজাজ শরিফ হয়ে গেল একটু পরেই। বেশ জায়গাটা। সারাদিন বাড়ি বসে না থেকে এখানে আসতে পারে তো তার মালকিন। একটা গাছ দেখে ওর ঘোড়ানিম বলেই মনে হল। গিয়ে বলতে হচ্ছে তো। হঠাৎ পার্কে টাঙ্গানো মস্ত পর্দায় নিজের ছবি ভেসে উঠতে দেখে চমকে ওঠে বিবি। ইনসেটে তার মালকিন কাঁদো কাঁদো গলায়  জানাচ্ছে- বিকেল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না তাঁর বেড়াল বিবিকে। খুঁজে দিতে পারলে তাঁর তিনটি বই পুরস্কার। কুলকুল করে হাসি পেল বিবির। বই পুরস্কার দিলে কে আর খুঁজে দেবে তাকে? পৃথিবী, মঙ্গল, স্পেস কলোনির কোথাও কেউ বই পড়ে না। শুনেছে চাঁদে নাকি একটু বই পড়া, ছবি আঁকার চল আছে, সামনের মাসে চন্দ্র মণ্ডলম সাহিত্য সম্মেলনে গল্প পড়তে যাওয়ার কথা মালকিনের। সে জন্যে মুখিয়ে আছে বিবি। তার ধারণা যেখানে গল্প, ছবি, গান আছে, সেখানে ইঁদুরও আছে। 
হঠাৎ একটা খুব চেনা আওয়াজে প্রায় লাফিয়ে ওঠে বিবি। এদিক ওদিক তাকায়। কেউ কোত্থাও নেই। তাহলে কি সে ভুল শুনল? না, ওই তো এবার বেশ জোরে ‘চিঁক চিঁক চিঁক! ঘাসের আড়াল থেকে, ওমা! একটা ছোট ইঁদুর উঁকি মারছে! বিবি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ইঁদুর! জিও প্ল্যানেটে ইঁদুর। আঃ কতদিন ইঁদুর খায়নি সে। লাফ মারার জন্য তৈরি হল মনে মনে। ওমা, এ কেমন ইঁদুর! পালাবার চেষ্টাই করছে না। বরং পর্দায় বিবির ছবি দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়ে ঘাসে লুটোপুটি খাচ্ছে। আহা রে, বোধহয় আনেকদিন পরে বেচারা চেনা কাউকে দেখল। কে জানে এ কার পোষা ইঁদুর নাকি বাক্স পেঁটরায় চড়ে নিজের অজান্তে এখানে চলে এসেছে। বিবি অবাক হয়ে দেখল, এটাকে খাবার কোন ইচ্ছেই তার হচ্ছে না। সে ইঁদুরটার পিঠে নরম করে তার থাবা রেখে বলল ‘আসছে মাসে আমার সঙ্গে চাঁদে বেড়াতে যাবি? আমার মালকিন তো তেনার লেখা নিয়েই ব্যস্ত। আমি যে একটা মানুষ থুড়ি বেড়াল তাঁর মনেই থাকে না। তোতে আমাতে খুব ঘুরব। শুনেছি  চাঁদের আর্কাইভে প্রচুর পুরনো দিনের টম অ্যান্ড জেরির সিনেমা আছে। দুজনে মিলে মজা করে দেখব, কেমন?’



অনিকেত

গৌর বৈরাগী


আজ আট মাস বাদে আবার চুরি করতে বেরুলো নিধিরাম। চুরি জিনিসটা এমনিতেই বেশ কমে গেছে । চুরি করার মত জিনিস লোকেরা আর বাড়িতে রাখছেই না। যেমন লোকেরা টাকা-পয়সা ঘরে রাখে না, ব্যাংকে রাখে। সোনাদানা ঘরে না রেখে ব্যাংকের ভল্টে রাখে। ঘরে থাকে ঢাউস ঢাউস কটা আলমারি। তাতে অবশ্য কাপড়-চোপড় ঠাসা থাকে। কিন্তু কাপড়চোপড় এত হয়ে গেছে বাজারে যে পুরনো কাপড় আর কেউ কিনতেই চায় না। তাই  জামাকাপড় নিয়ে লাভ হয় না। ঘরে অবশ্যই টিভি আছে, ফ্রিজ আছে। কিন্তু এসব বয়ে নিয়ে আসা খুব হ্যাপা। আনলেও ধরা পড়ে যাওয়ার খুব ভয়।  তাই টুকরো টাকরা চুরি করেই কাজ চালায় নিধিরাম। সে আসলে পেটিচোর। কিন্তু সেই চুরিটাও আট মাস ধরে বন্ধ ছিল তার। ওই যে কি একটা পোকা এসেছে। বাইরে বেরোলেই ধরছে মানুষকে। তাই সরকার থেকে কড়া হুকুম জারি হয়েছে। সব বন্ধ। কল কারখানা বন্ধ, দোকানপাট বন্ধ, গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ। দিনেরবেলাতেই রাস্তা খা খা করছে। রাতে তো কথাই নেই। তেমন হলে খায় কী নিধিরাম? ছেলেপুলেদেরই বা কী খাওয়ায়? 

তাই সে ঠিক করল রাতে তাকে বেরতেই হবে। সেইমতো আজ বেরিয়েছে। বেরিয়েছে মুশকিল আসান দত্তের বাড়ি। নিধিরাম খবর পেয়েছে এই লোকটা খাবার-দাবার স্টক করেছে প্রচুর। বাইরে সব দোকান বন্ধ, বাজার বন্ধ। মুশকিল আসান খাবে কি? ছেলেপুলেকেই বা কি খাওয়াবে? তাই আগেভাগে সব খাবার দাবার বাড়িতে স্টক করে রেখেছে। এদিকে বাড়িতে ঢোকার কোন উপায় নেই। গেট তালা বন্ধ। জানলা দরজার পাল্লা বন্ধ। সবাই চারপাশ এত বন্ধ করে রেখেছে যাতে পোকাটা না কোনভাবে ঢুকে পড়ে। ওই পোকার ভয়েই সবাই তটস্থ। কিন্তু পোকার ভয়ে ঘরে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে তাকে।  ছেলেপুলেদেরই বা কী খেতে দেবে সে! তাই আজ বেরিয়েছে। বেরিয়ে মুশকিল আসান দত্তর বাড়িতে এসে উপস্থিত। চুরি তাকে করতেই হবে আজ। সে এবার  বাড়িতে ঢুকবে।

তখনই অন্ধকারে মিশে যাওয়া একটা লোক ভুস করে সামনে ভেসে উঠলো। দড়ির মতো হাত পা। প্যাকাটির মত শরীর। চোখ দুটোর ভেতর গর্ত। আচমকা দেখলে ভয় পাওয়ার মতোই। কিন্তু নিধিরামের এখন ভয় পেলে চলবে না। তার দরকার খাবার। তাতে খানিক প্রোটিন থাকবে, খানিক ভিটামিন থাকবে।  বিনে পয়সায় সরকার থেকে চাল দিচ্ছে, ডাল দিচ্ছে, গমও দিচ্ছে খুব। কিন্তু পোকার বিরুদ্ধে লড়তে এখন শুধু ভাত ডালে আর হয় না। এরকমই সবাই  বলছে। ভাত ডাল যে তার বাড়িতে কম পড়েছে তা নয়। আসলে কম পড়েছে প্রোটিন আর ভিটামিন। এসবই যদি চুরি করা যায় সেই ধান্দায় আজ এসেছে নিধিরাম। জানালার গ্রিলে হাত  দিয়েছে ঠিক তখনই পাশ থেকে একজন কথা বলল। বলল, আজ্ঞে একটা কথা ছিল। খুব বিরক্তি নিয়ে তাকালো নিধিরাম। প্যাকাটির মতো সরু লোকটাকে চিনতে পারল না সে। রাগে কটমট করল শরীর। হারামজাদা, ডাকার আর সময় পেল না। রাগের গলায় নিধিরাম বললো, কে? প্যাকাটি শরীর বলল, আজ্ঞে আমি অদ্ভুত, অদ্ভুত দাস। নিধিরাম গলা তুলে বললো, কি বললে? —আজ্ঞে আমি অদ্ভুত দাস, আমাকে ভূতও বলতে পারেন। 

এত কষ্টের ভেতরেও হাসি পেল নিধিরামের। বলল, তোমারও কি প্রোটিন আর ভিটামিনের অভাব নাকি? —সেটা কী জিনিস নিধিরামদা? —ওটাই তো এখন আসল জিনিস অদ্ভুত। ডাল ভাতের অভাব নেই, অভাব হয়ে গেছে ওটার।
— "ওটা" টা কী? —ওই যে কি বলে না, "মিউনিটি" নাকি! শরীরে ওটা থাকলে পোকাগুলো আর কাছে ঘেষতে পারবেনা।
—আমার ওসবের কোনো সমস্যা নেই। পোকা আর ভূতকে ধরবে কি করে? এ ব্যাপারে ভূতের সাতখুন মাপ। আমার সমস্যা অন্য। —তোমার আবার সমস্যা কিসের অদ্ভুত? — আমার একটা অদ্ভুত সমস্যাই হয়েছে। ভূতেদের তো কেউ আর ভয় পাচ্ছে না। উল্টে এখন আমরাই ভয় পেতে চাইছি। কিন্তু মুশকিল হল কেউ আর আমাদের ভয় দেখাচ্ছে না। আচ্ছা জ্বালাতন হল দেখছি। বেশ খানিকটা রাগ দেখালো নিধিরাম। বলল, আমি জ্বলছি নিজের জ্বালায়, আবার উনি এলেন আমাকে জ্বালাতে। 

কথাটা একটু জোর হয়ে থাকবে। রাতও হয়ে থাকবে খানিক পাতলা। মুশকিলআসান দত্তের ঘুম ভেঙে গেলে  হয় না। সে গলা তুলে বলল,  কে কথা বলে? নিধিরাম বলল, আজ্ঞে আমি মুশকিল দা। মুশকিল বলল, আরে আমিটা কে? আমি হলুম নিধিরাম, আর আমার পাশে যাকে দেখছেন এ হল অদ্ভুত দাস। —তা   কী  জন্যে আমার বাড়ির পাশে এত রাতে এসে  ঘুরঘুর করছো তোমরা? —আজ্ঞে আমি এসেছি চুরি করতে।  —তা কী চুরি করতে এসেছ নিধিরাম? নিধিরাম একগাল হেসে বলল, পোকার আশীর্বাদে এখন ঘরে চাল রুটির অভাব নেই।  সরকার থেকে এখন চাল গম ফ্রিতে দিচ্ছে। এখন অভাব আছে শুধু প্রোটিন আর ভিটামিনের। —তুমি বুঝি তাই চুরি করতে এসেছ? —আজ্ঞে, কিছু মনে করবেন না মুশকিলদা। খবর পেয়েছি আপনার বাড়িতে থরে থরে সব মজুদ আছে। প্রোটিন ভিটামিনে ভর্তি আপনার বাড়ি। স্তূপাকার মাছ মাংস ডিমে ফ্রিজ ভর্তি। প্রোটিনের কৌটোয় আলমারী ভর্তি। মেডিসিন বাক্সে ভিটামিনের পাতা থরে থরে সাজানো। এদিকে আমাদের ঘরেতে শুধু ভাত আর রুটি। শরীরে "মিউনিটি" আসবে কোথা থেকে বলুন?
                    কথা শুনে হাহা করে হাসলো মুশকিল। বলল, গভর্মেন্ট তোমাদের কথাও ভেবেছে কী? ওইযে প্রোটিন ভিটামিন খেয়ে মিউনিটি বাড়াবার কথা বললে না, ওই কথা আর কি। শুধু টাকা দিয়েই ভিটামিন কিনতে হয় না। বিনা পয়সায়তেও বেশ ভালো ভিটামিন পাওয়া যায়। —সেটা কীরকম? —সেটা হল সূর্যের আলো। সূর্যের আলোতেও নাকি ভিটামিন ভর্তি। শুধু আধ ঘন্টা টাক সূর্যের আলোয় ভিজতে হবে তোমাকে। —এ যে দেখছি আজব কথা। অদ্ভুত দাস বলল, সূর্যের আলোয় লোকে গা শুকোয় আর আপনি বললেন ভিজে যেতে। তবে আমার এসব দরকার নেই। আমার ভেজারও  দরকার নেই, শুকোবারও দরকার নেই। —তবে তুমি এসেছ কিসের জন্যে?  —আমি ভয় পেতে এসেছি। তবে এসে দেখলুম ভয় দেখাবেন কি, আপনারা নিজেরাই ভয়ে অস্থির। ওই পোকার ভয়ে।

দুই

অহি-নকুল দত্ত সকালবেলা বাড়ির সামনের রোয়াকে বসে ব্রাশ করছে। আসলে তার মনটা একদম ভালো নেই। কি দিনকাল এলো। কথা কইবার একটা লোক পাওয়া যাচ্ছে না। হ্যাঁ, অহি-নকুল শুধু কথা বলবে তাও লোক পাচ্ছে না। ঝগড়া করা তো দূরের কথা। আসলে লোকটা খুব ঝগড়ুটে। দিনে অন্তত একটা ঝগড়া না করলে তার ভাত হজম হয়না। সেই লোক প্রায় দু’আড়াই মাস  হতে চলল ঘরবন্দি। শুধু ঘরবন্দি নয় মনবন্দিও। লোকেরা রাস্তায় বের হচ্ছে না। আর রাস্তায় বের না হলে, কার সঙ্গে ঝগড়া করবে অহি-নকুল? তাই তার মন খুব খারাপ। সকালবেলা ব্রাশ করতে করতে সে ভাবছে, কী করা যায়, কী করা যায়? তখনই দেখতে পেল একটা খেকুড়ে টাইপের ছেলে আসছে।

ছেলেটা যখন সামনে দিয়ে যাচ্ছে ব্রাশ করা থামিয়ে তার দিকে তাকাল অহি-নকুল। চিনতে পারল না। চুল উস্কোখুস্কো, রোগা সোগা, গরিব গরিব চেহারার লোক। গরিবরা সাধারণত ঝগড়া করে না, ঝগড়ার আগেই সারেন্ডার করে বসে থাকে। ওই ঝগড়ায় সুখ নেই। কিন্তু ডাটিয়াল ছোকরার আর কী করে দেখা পাবে অহি-নকুল?  ডাটিয়ালরা এখন পোকার ভয়ে ঘরে সেধিয়ে যাবে সে  আর কি করে জানবে সে। এখন যাকে সামনে পেয়েছে তাকে নিয়েই একটু নাড়াচাড়া করা যেতে পারে। অহি-নকুল বলল, কে যায়? 

ছেলেটা থতমত খেয়ে তাকালো। সে বুঝতে পারছে না প্রশ্নটা তাকেই করা হয়েছে কিনা! অহি-নকুল একটা ছোট্ট ধমক দিয়ে বলল, —তোমাকেই বলছি, হ্যাঁ তোমাকেই। বলি কে তুমি? —আজ্ঞে আমি অনি। —কোন অনি? —আজ্ঞে আমি পশ্চিমপাড়ার এটা ষষ্ট অনি। —কোন পশ্চিমপাড়া? —ওই যে, যে পাড়ায় আপনার বিখ্যাত গোলদারি দোকান। আমার দোকান আছে তো তোমার কি? —না না আমার কিছু নয়। আপনি কোন অনি জানতে চাইলেন তাই বলছি। —তা শব্দ হচ্ছে কেন? —কীসের শব্দ আজ্ঞে? —ওই যে হাঁটার সময় চটাস্ চটাস্ শব্দ। 

অনি নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে শব্দটাকে খুঁজে পেয়ে বলল, ওটা হাওয়াই চটির শব্দ। বেশ পুরনো হয়ে গেছে চটিটা। তার উপর ফিতেটাও ঢিলে হয়ে গেছে । তাই হাঁটতে গেলেই শব্দ হচ্ছে। —সকালবেলা ওই চটির শব্দ মোটেই ভালো নয়, তা জানো। অনি বললো, জানতুম না বড় বাবু। এইমাত্তর জানলুম। —জানলে যখন, তখন শব্দ টা বন্ধ করো। —এই করছি, বলে পা থেকে চটিজোড়া খুলে হাতে নিয়ে হাটা শুরু করল অনি। তাই দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল অহি-নকুল দত্তের। ছেলেটা, মানে ওই  অনি ছেলেটা বিচ্ছিরি রকম ভালো। হাতের কাছে ঝগড়াটা সাজিয়ে দিলুম, ছেলেটা সে দিকে ফিরেও তাকাল না। বেমালুম হাতে চটি নিয়ে চলে গেল।

সেটাই দেখে ফেললেন প্রতিকার সান্যাল। একটা ছেলে চটি পায়ে না পরে হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে। এ আবার কী কান্ড! কাছে আসতেই প্রতিকার বললেন, ভাই তোমার পায়ের চটি হাতে কেন? মহা ফাঁপরে পরল অনি। একজন বলল, —তোমার পায়ে চটি কেন? আরেকজন বলল, তোমার হাতে চটি কেন? কথাটা ভাবতে খানিক বিরতি নিয়েছিল সে। একটা জুতসই উত্তর যাতে দেয়া যায়। কিন্তু উত্তর দেবার আগেই লোকটা ভারী গলায় বলল, কি হল কথার জবাব দিলে না? 

অনি বললো, না মানে। প্রতিকার বলল, আমি কিন্তু যে সে লোক নই। মিথ্যে কথা বলে পার পাবে না হে। কথাটা সত্যি। প্রতিকার লোকটা যে সে লোক নয়। সে খুব প্রতিবাদী। সপ্তাহে চার খানা করে তার প্রতিবাদী চিঠি ছাপা হয় খবরের কাগজে। অন্যায় অবিচার দেখলেই তিনি কাগজে সম্পাদক সমীপেষু কলামে চিঠি লেখেন। আজ পর্যন্ত তার চারশো একুশটা  চিঠি লেখা হয়ে গেছে। কয়েকটা হলো এই রকম—

রাস্তার মোড়ে ডাস্টবিন চাই।

ব্যাংকে সিনিয়র কাস্টমারদের বসার বেঞ্চ চাই।

খানাখন্দে ভরা রাস্তায় পিচ চাই।

রাস্তার ধারে ইলেকট্রিক পোলে আলো চাই।

ইলেকট্রিক পোলে দিনের বেলা জ্বলতে থাকা আলো নেভাবার লোক চাই।

রাস্তায় টোটোর উৎপাত কমাতে হবে। এইরকম, এইরকম।

খবরে কাগজ খুললেই প্রতিদিনই প্রায় দেখা যাবে প্রতিকার সান্যাল এর নাম। চিঠি লিখে তিনি  বিখ্যাত হয়ে গেছেন প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে। তিনি সত্যিই অন্যায় দেখতে পারেন না। এই যেমন এখন, অনির হাতে হাওয়াই চটি দেখে তার মাথা গরম হয়ে গেল। অনি বুঝল, তার আর পালাবার পথ নেই। বাধ্য হয়েই অহি নকুল দত্তের কথা বলতে হলো তাকে। ওই লোকটার কথা শুনে আর ঘটনা শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠল প্রতিকার। —কি, এত বড় আস্পর্ধা! লোকটার টাকা আছে বলে কি ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে। আমিও প্রতিকার, চলো আজই একটা হেস্তনেস্ত করব। অনি আস্তে করে বললো, কি করবেন? —আমি কেস করব। আগে  আদালতে যাব। তারপর তোমার জবানিতে একটা চিঠি লিখব খবরের কাগজে। এই পর্যন্ত বলার পর তার মনে হলো, চিঠি লিখতে গেলে একটা নাম দরকার অথচ এই ছেলেটির নাম তিনি জানেন না। তাই জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি হে? ছেলেটা বলল ,আমার নাম অনি। —আহা অনিতো ডাকনাম। তোমার ভালো নাম কী? —আজ্ঞে আমার ভালো নাম অনিকেত। 

তিনি অনিকেত এর মানে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এই যে ছেলে, এর চেহারা পোশাক-আশাক কথাবার্তা যেরকম তাতে নিজের নামের মানে জানে বলে মনে হয় না। বেশি খোঁচাখুঁচি করলে দায়িত্বটা হয়তো তার ঘাড়ে এসে তাকেই বেশি ফ্যাসাদে ফেলে দেবে। তাই ওই পথ না মাড়িয়ে আস্তে করে বললেন, চলো হে  তাড়াতাড়ি চলো, আমাদের কাজটা সেরে ফেলি। বলে অনিকেতের হাতটা ধরে  রাস্তায় নামলেন প্রতিকার সান্যাল।  (ক্রমশ) 








নাটক

তোতাকাহিনী

মূল কাহিনী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নাট্যরূপ - সুব্রত নাগ

[ চরিত্র :- রাজা, মন্ত্রী, রাজপণ্ডিত, কোতোয়াল, ভাগনে, স্যাকরা ও নিন্দুক]

[প্রথম দৃশ্য]


    সম্মিলিত গান -

    ‘শোনো শোনো নগরবাসী, যারা আছ সবে

    রাজার কথা শুনলে পরে বড় পুণ্য হবে।

    রাজা গুণী রাজা জ্ঞানী রাজার পাপ নাই

    পারি পার্ষদ যারা থাকেন, তারাও মহান ভাই।

    ভাবেন সদা বুদ্ধি দিয়ে তাদের মগজ ঠাসা।

রাজাকে যে শলা দেবেন, তা নাকি বেশ খাসা।

    একে একে আসুন তারা সভা আলো করে

    দাদা দেখুন, দিদি দেখুন - ওদের দুচোখ ভরে।’

[প্রথমে মহারাজা, এক এক করে তাঁর পার্ষদবর্গ মঞ্চে প্রবেশ করেন।]

রাজা    -    আমি হলাম মহারাজা বীরবিক্রম রায়

        আমার নামে বাঘে-গোরু এক ঘাটে জল খায়।

        কোনো প্রজা যদি কভু বেয়াদপি করে,

        আমার সেপাই তাকে টুঁটি চেপে ধরে।

        তাই তো বলি রাজ্যে আমার সবাই থাকো চুপ,

        নইলে বিপদ, তখন আমার দেখবে অন্য রূপ।

[মহারাজা তাঁর আসন গ্রহণ করেন। মহামন্ত্রী প্রবেশ করেন।]

মন্ত্রী    -    মহারাজের মন্ত্রী আমি জ্ঞানীপ্রতাপ ঘোষ

        মনটা খুশী যখন দেখি ভর্তি রাজকোষ।

        মগজ আমার বুদ্ধি ঠাসা, কিছু পান রাজা

        কথা যদি না শোনে কেউ, ঠিকই পাবে সাজা।

        [মন্ত্রী আসন গ্রহণ করেন। সভাপণ্ডিতের প্রবেশ।]

সভাপণ্ডিত    -    বিদ্যে বোঝাই পণ্ডিত আমি বেজায় হাঁক ডাক

            অর্বাচীন মূর্খ যারা রাজ্য থেকে যাক।

            ন্যায় শাস্ত্র না জানলে রাজ্য হোক ভাগ

            পড়াশোনা না করলে হবেই আমার রাগ।

            [সভাপণ্ডিত বসেন; কোতোয়াল প্রবেশ করে।]

কোতোয়াল    -    আমি কোতোয়াল - কোষাগার রক্ষা করি, 

            যদি চোর উঁকি মারে সেথা - 

            পিছে থেকে ক্যাঁক করে ধরি।

            [কোতোয়াল বসে; স্যাকরা প্রবেশ করে।]

স্যাকরা        -    স্যাকরার পো সোনা রূপো নিয়ে কারবার করি,

            রাজা-রানীর গয়না গড়ি সোনা ভরি ভরি।

            [স্যাকরা বসে; নিন্দুকের প্রবেশ।]

নিন্দুক        -    আমি নিন্দুক, থাকি আড়ালে

            চুপ করে দেখে নিই- কত কামালে।

            দেখি কে ফাঁকি দেয়, কে দেয় ধোঁকা

            বুঝে নিই ঘাঘু কে, আর কে বোকা।

            [নিন্দুক বেরিয়ে যায়।]

রাজা        -    [গানের সুরে] বলো মন্ত্রী বলো- প্রজাদের কথা বলো, বেগড়বাঁই করছে কি কেউ- গ্রুপ কিংবা সোলো।

মন্ত্রী        -    এমনিতে রাজামশাই, নেই কোনো চিন্তা

            দিলখুশ প্রজারা - তেরে কেটে ধিন্ তা

            তবে কিনা ব্যাটা এক ভারি নিন্দুক

            সুবুদ্ধি কিছু নেই - স্রেফ উজবুক।

            বুঝি না কো নিন্দায় কী যে পায় সুখ।।

রাজা        -    আজব ব্যাপার! আস্পর্দ্ধা এত!

            একাই আছে, না পেছনে চ্যালা শত শত?

মন্ত্রী         -    না মহারাজ, ভাববেন না - স্রেফ চুনোপুঁটি

            খবর নিয়ে দেখেছি কি - পেছনে নেই খুঁটি।

            তবে কিনা গুহ্য কথা অনেক জানে ব্যাটা

            মানী, গুণীর মান রাখে না এমনতরো ঠ্যাঁটা!

রাজা        -    তবেই বোঝো! রাজার কথা জানছে কী করে নিন্দুকে?

            এর পরে না বলে বসে কী আছে রাজসিন্দুকে!

কোতোয়াল    -    মহারাজ, একটা কথা বলব কি?

রাজা        -    ফালতু না হলে বলো।

কোতোয়াল    -    সিক্রেট সোর্স করবে নাকি নিন্দুককে ফলো?

রাজা        -    [ভেবে] কথাটা বলো নি মন্দ,

            এতটুকু প্রমাণ পেলেই করব ফাটক বন্ধ।

মন্ত্রী        -    ফাটকের কথা উঠল যখন, নিন্দুকের কথা পরে।

            [কোতোয়ালকে] যে পাখীটাকে দেখিয়েছিলাম, সেটাকে আনো ধরে।

রাজা        -    পাখী? কোথায় পাখী? কেমন পাখী? মিষ্টি পাখী? 

            কোয়েল কিংবা দোয়েল - আহা বুকের মধ্যে রাখি।

মন্ত্রী        -    মিষ্টি নয়, দুষ্টু ভারী, বুদ্ধিখানা ভোঁতা

            উত্তরের ওই জঙ্গলেতে থাকে একটা তোতা।

ভাগনে        -    কথাটা কিন্তু মামা থুড়ি রাজামশাই, একেবারে সত্যি-

            তোতার জ্বালায় বনে ফল পাকে না এক রত্তি।

            ঠুকরে খেয়ে কামড়ে খেয়ে কত যে ফল নষ্ট

            করছে দেখে রাজভক্ত প্রজার মনে কষ্ট।

রাজা        -    মন্ত্রী, কোতোয়াল- শুনছি এ কি কথা?

            বনের ফল খাচ্ছে তোতা - ছিল না অভিজ্ঞতা।

            যেদিকটাতে দেখব না, সেদিকটাতেই লস্ ?

            এ ব্যাপারে ভাগনেটাকে করছি আমি বস।

ভাগনে        -    বলছি মামা থুড়ি রাজা চিন্তা করছি যেটা

            শিক্ষা ছাড়া বনের তোতা থেকে যাবে ঠ্যাঁটা।

            আজ্ঞা করুন তোতাটাকে বন্দী করে আনি

            দূর হয়ে যাক বাজারে সব ফলের টানাটানি।

রাজা        -    একশবার ,হাজারবার, শুনছ কোতোয়াল-

কোতোয়াল    -    আদেশ করুন মহারাজ, আপনার যা খেয়াল।

রাজা        -    চারটে সেপাই, পাইক নিয়ে এক্ষুনি যাও বনে,

            বেঁধে আনো তোতাটাকে আদেশ এক্ষনে।

            তোমরা সবাই রাজার মেজাজ ভালো করেই জানো

            রাতের মধ্যেই পাখীটাকে বন্দী করে আনো।

কোতোয়াল    -    প্রণাম করে শপথ আমি করছি রাজার কাছে

            বরকন্দাজ, পাইক নিয়ে খুঁজব গাছে গাছে।

            খপাত করে তোতাটাকে করব আমি বন্দী

            যতই ঠ্যাঁটা হোক না কেন, খাটবে না কো ফন্দী।

            [কোতোয়াল প্রণাম করে বেরিয়ে যায়।]


[দ্বিতীয় দৃশ্য]

[মহারাজ পায়চারি করছেন। পাশে দাঁড়িয়ে মহামন্ত্রী]

মন্ত্রী        -    মহারাজ, খবর কিছু এল? লোক লস্কর নিয়ে 

কোতোয়াল - অনেকক্ষণ তো গেল!

রাজা        -    ভাবছি সেটাই; অপদার্থ সব; 

অষ্টরম্ভা কাজে, মাইনে গিলছে গব গব।

মন্ত্রী        -    ফোন করে কি দেখব নাকি কোন চুলোতে আছে?

রাজা        -    ট্রাই করেছি, নো রিপ্লাই - নেই সে ধারে কাছে।

মন্ত্রী        -    তোতা ভুলে বনের মাঝে লাগাল কি ফিস্টি?

রাজা        -    সইব না কো, বলে দিলাম এমন অনাছিস্টি?

মন্ত্রী        -    আওয়াজ একটা পাচ্ছি বটে, দেখি জানলা দিয়ে 

        [উৎফুল্ল হয়ে] হ্যাঁ মহারাজ, ফিরছে ওরা তোতাটাকে নিয়ে।            

        সবুজ সবুজ, চিকন চাকন ভারি সুন্দর তোতা!

রাজা        -    হোক সুন্দর, পাখীর সাথে করছি না সমঝোতা।

        মুঠোর মধ্যে পেয়েছি যখন ভরব খাঁচাতে

        দেখি কোন দাদা, মামা পারে বাঁচাতে।

            [কোতোয়াল প্রবেশ করে।]

কোতোয়াল    -    নমস্কার, প্রণাম, আদাব মহারাজ-

            পালন করেছি আমি দিলেন যে কাজ।


রাজা        -    গেলি ক’টায়, এলি ক’টায় এতক্ষণ লাগে?

            ফিস্টিতে আজ কী কী খেলি সেটা বল আগে।

কোতেয়াল    -    অন্ ডিউটি রাজামশাই ফিস্টি কোথায় খাব?

            ঘাড়ের উপর ক’টা মাথা অন্য কোথাও যাব!

            ধড়িবাজ ওই পাখিটাকে ধরতে হল দেরি

            অনেক ছুটে অনেক ঘেমে তবে পড়াই বেড়ি।


রাজা        -    একটা তোতা ধরতে গিয়েই খাটনি এত জাদা?

            তিনটি প্রহর লাগিয়ে দিলি এমনি তরো গাধা!

মন্ত্রী        -    পাখি তো এল রাজামশাই, এবার হবে কী?

            থাকবে কোথায়? খাবে ছোলা, কাঁচলঙ্কা, ঘি।

        [ভাগনের প্রবেশ]

ভাগনে        -    এই যে মামা থুড়ি রাজা চলে এসেছি   

            তোতার ব্যাপারে সব অ্যারেঞ্জ করেছি।


রাজা        -    থাম রে বাপু - কই পণ্ডিত, বলো তো দেখি ভেবে 

            পাখিটাকে কী শেখালে কিছু সুফল দেবে?

        [সভাপণ্ডিত মাথা     চুলকে ভাবতে থাকেন।]

মন্ত্রী        -    ও পণ্ডিত, ভাবতে ভাবতে কাবার হল রাত

            জলদি করো, মাথা খাটাও, লাগাও তোমার হাত।

            বইপত্র লাগবে কী? সিলেবাস কী হবে?

            কে পড়াবে সকাল বিকাল? ইউনিট টেস্ট কবে?

রাজা        -    শোনো ভাগনে, এই পাখিটার সমস্ত ভার তোমার,

            ক’টা পুঁথি শেষ করল- লোক রেখো তো গোণার।

সভাপণ্ডিত    -    [মাথা চুলকে] শিক্ষা শুরুর আগে একথা কি ভেবেছি,

            এতদিন কেন তোতা পড়াশোনা শেখেনি?

            খড়কুটো দিয়ে গাছে ক্ষুদ্র যে বাসা

            বানিয়েছে তোতা সেটা মোটে নয় খাসা।

            অতটুকু বাসাতে বিদ্যে কি আঁটবে?

            বই, খাতা, ব্যাগ, পেন কোথায় বা রাখবে?

রাজা        -    বুঝলাম তো সবই- সমস্যা ঢের,

            বলো দেখি পণ্ডিত - উপায় কী এর?

(ক্রমশ)


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

http://www.jaladarchi.com/2021/09/childhood-vol-51.html





Post a Comment

1 Comments

  1. মৌসুমী মাসি! আজকের পূজোর সংখ্যা পড়তে আমার খুব ভালো লেগেছে, রবিঠাকুরের নাটকটা খুব ভালো লেগেছে। আমি বৈভবী সেনগুপ্ত বলছি। শ্রীপর্ণা দিদিভাইয়ের লেখা ' বিদ্যাসাগর, কথাকলি ও গোয়েন্দা রিমিল গল্পটা পড়তে আমার খুব ভালো লেগেছে। মন ছুঁয়ে গেল। আজকে আমি বাড়িতেই আছি।

    ReplyDelete