জ্বলদর্চি

ছায়া ছায়া অন্ধকার-১০/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/শিশির পাল

উপন্যাস 

ছায়া ছায়া অন্ধকার 

শিশির পাল 

অলংকরণ : সায়নী পাল 


পর্ব :১০ 

থানায় গিয়ে ধর্ণা দিযে বসে আছে লোকজন। একই ধরণের ঘটনা ঘটল শান্তি আশ্রমে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে, একই কায়দায় দু'জনকে হত্যা করা হয়েছে। এতে তো একজন অজ্ঞ মানুষও বুঝতে পারবে যে, দুটো ঘটনার কোনও না কোনও যোগসূত্র আছে। থাকতেই হবে। এই দাবীতেই এলাকার মানুষের ধর্ণা। আসল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। দোষীকে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। 

আমাকে আর আকাশকে ভিড়ের ভেতর থেকে ডেকে নিয়ে গেলেন আইসি। পুলিশ জানে কীভাবে এরকম ভিড়কে ম্যানেজ করতে হয়। 

টেবিলের একপাশে আমরা। অন্যপাশে থানার ইনচার্জ।আইসি। বাইরে জনতা বসে আছে। উত্তরের অপেক্ষায়। 

আকাশকে লক্ষ্য করে আইসি বললেন, 'ডাক্তারবাবু। আমাদের কাছে সব খবর থাকে। অঞ্জলি হত্যার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি কেউ জানলে, সেটা আপনি। আপনি বলুন আমাদের।' আকাশ একটু ইতস্তত করছে। আমার দিকে একবার জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে, চোখ তুলে নিল। আইসিকে বলল, 'এ আপনি কী বলছেন অফিসার। অঞ্জলি হত্যার ব্যাপারে আমি কীভাবে সবচেয়ে বেশি জানতে পারি? সারাদিন হাসপাতাল, রোগী করতে করতেই সময় চলে যায়।' আকাশকে থামালেন আইসি। বললেন, 'আর প্রতিদিন বিকেলে সন্ধ্যায় আপনারা আশ্রমে যান। তা তো মিথ্যে নয়।' 'হ্যাঁ। আমরা নিয়মিত যাই। কিন্তু এতে সমস্যা কোথায়?'
'আপনি অঞ্জলি দেবীর খুবই ঘনিষ্ঠ। এমনকি আপনাকে আটকানোর জন্য আপনার স্ত্রী এবং আপনার বাবা কেশববাবুর সাহায্যও চেয়েছিলেন। আমরা জানি। জানেন আপনি ?'
এ তো বিরাট ইন্দ্রজাল! আমিও ফেঁসে যাচ্ছি। নয়না এবং শিবনারায়নবাবু নির্ঘাত থানায় এসে সব বলে গেছেন। না হলে এত কথা পুলিশের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আকাশ স্তম্ভিত। আমার দিকে তাকায়। যেন বলতে চায়, 'কেশব, পুলিশ এত কথা জানল কী করে?' অবশ্য মুখে কিছুই বলল না। ফ্যালফ্যাল করে আইসির দিকেই চেয়ে রইল। পুলিশের কাছে হয়তো আরও তথ্য থাকতে পারে। আর কোনও কথা বলল না আকাশ।
আমি আইসিকে বললাম। 'স্যার। একটা কাজ তো করা যায়। আপনারা সুয়োমোটো কেস করুন। আর যদি আপনি চান, একটা টিম বানিয়ে, গোপনে আশ্রম বা লাগোয়া অঞ্চলে তদন্ত করাও যায়। আমি চাই সেই টিমে থাকতে।' কথা বলতে বলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি, 'আকাশ। তুই থাকবি তো টিমে?'
আইসি বললেন, 'আপনার প্রস্তাব তো মন্দ নয়। করা যেতেই পারে। আর তেমন টিম হলে তো, ডাক্তারবাবুকে থাকতে হবেই। তবে তার আগে আমি একবার ডিএসপি সাহেবের সঙ্গে কথা বলে যা করার করব।'
একটু বিরতি নিয়ে হঠাৎ আবার বললেন, 'ওই নেপালী ছোকরাটা, কী যেন নাম, ওকে আপনাদের কোনও সন্দেহ হয় কেশববাবু?'
আমি বলি, 'ও তো স্বরূপানন্দজির সময় থেকেই আছে। ওঁর সঙ্গেই শান্তি আশ্রমে এসেছিল। আশ্রমকে এতটাই বেশি ভালোবাসে যে, স্বরূপানন্দজির হত্যাকান্ডের পর, এমনকি রূপসীদেবী চলে যাবার পরও এই আশ্রমেই থেকে গেছে।'
'সেটাই সবচেয়ে সন্দেহের জায়গা। ও তো স্বরূপানন্দজির একনিষ্ঠ ভক্ত। ছায়াসঙ্গী ছিল। তারপরও কী করে এখানেই থেকে গেল!  ওর তো কোথাও চলে যাওয়ার কথা। এখানে থেকে গুরুর স্মৃতিচিহ্ন সব দেখে দিনের পর দিন কষ্ট পাওয়ার কথা। নাকি ওর কষ্ট হয় না? কষ্ট পাওয়ার নাটক করে!' 
আইসি বলার পর আমারও পিন্টুর ওপর কেমন সন্দেহ হতে শুরু করল।
'একমাত্র ওই আশ্রমের সমস্ত খুঁটিনাটি জানে। ওকে ধরলেই সব রহস্য উদ্ধার হয়ে যাবে।'
পিন্টুর মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। অমন সাধাসিধে চেহারা। অথচ, এত রহস্যের উৎসমুখ! 

বাইরের লোকজন চিৎকার চেঁচামেচি করছে। আমরা বললাম, 'স্যার আপনি বাইরে গিয়ে ঘোষণা করে দিন। না হলে এই জনতাকে সরানো যাবে না। চলুন আমরা সবাই গিয়ে বলি, খুব দ্রুততার সঙ্গে এই হত্যাকান্ডের তদন্ত করা হবে। দোষীর উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।' 

বিকেল হয়ে এসেছে। আইসি সাহেবের সঙ্গে আমি এবং আকাশও, সবাইকে জানালাম পুলিশের বক্তব্য। আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হতে হতে সবাই চলে গেল। আইসি বললেন, 'আপনারা আমার সঙ্গে থাকুন এখন। আজই আমরা অপারেশন স্টার্ট করব। আপনাদের খিদে পাচ্ছে বুঝতে পারছি। থানাতেই কিছু টিফিনের ব্যবস্থা করছি।' বলেই হাবিলদারকে ইশারায় ডেকে নিলেন। 

#
মান্ধাতার আমলের জিপ গাড়িতে আমি, আকাশ, আইসি সাহেব আর ড্রাইভার সহ দু'জন কনস্টেবল বেরিয়ে পড়লাম। অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে। আমাদের গাড়ির হেডলাইটের ফোকাসে শুধু রাস্তাটুকুই দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের গা বেয়ে পাথুরে মোরাম রাস্তায় চলতে চলতে গাড়িটা দাঁড়াল শান্তি আশ্রম থেকে বেশ কিছুটা দূরেই। পুলিশের হাতে টর্চ। ইচ্ছে করেই খুব সন্তর্পণে হাঁটছি সবাই। 

এখন আশ্রম পুরোপুরি ফাঁকা। পিন্টু ছাড়া দু'একজন থাকার কথা। আমরা গিয়ে দেখি আশ্রমের ভেতরে টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে বাইরের উঠোনের মতো জায়গাটায়।
কেউ নেই আশেপাশে। মনে সন্দেহ জাগে। পিন্টু কোথায়?
আইসি আমাদের সবাইকে গাইড করছেন। হাতের টর্চ দিয়ে সামনের রাস্তা দেখছেন। আমাদের হাতের ইশারায়, মুখের মৃদু শব্দে ডাকছেন। সন্ন্যাসিনীর ঘরটা ভেতর থেকে দরজা লাগানো। তাহলে কি ভেতরে কেউ আছে! খুব আলতো করে দরজায় চাপ দিতেই খুলে গেল। ঘরটা অন্ধকার। ভেতরে ঢুকে সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু ভেতরের দেওয়ালে একটা আয়তাকার আলোর রেখা চোখে পড়ছে। আমার কি দেখার ভুল? বুঝতে পারছি না। আইসি সাহেব আমার খুব কাছেই ছিলেন। ফিসফিস করে বললেন, 'কিছু বুঝতে পারছেন?'
আমি বলি, 'না।'
''এই দেখুন। এখানে একটা দরজা আছে। ভেতরে কেউ আছে নিশ্চয়ই। আলোর আভা আসছে।'
আমি ঠিকই দেখছি তাহলে। আসলে, পুলিশের সন্দেহের চোখ তো, তাই খুব তাড়াতাড়ি সব কিছুর এমন ব্যাখ্যা করতে পারে। আইসি সবাইকে সাবধান করলেন। বললেন, 'একদম আওয়াজ করবেন না। আমাদের সন্দেহ ঠিকই আছে। ভেতরে আছে কেউ। ধরতে হবে। আপনারা আমাকে ফলো করুন।'

বলতে বলতে গোপন দরজার কাছে এসে একটা ঠেলা দিলেন। বুঝলেন দরজা ভেতর থেকে লাগানো। তারপর সবাই মিলে একসাথে জোর ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছি না। আইসি টর্চ জ্বালিয়ে নিমেষে নীচে নেমে গেলেন। আমরা আবছা আলোয় কোনোরকমে নীচে নেমে এলাম দ্রুত। এবার তো ভয়ানক অবস্থা। হাড়হিম হওয়ার জোগাড়। কোথায় কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আশ্রমের ভেতরে, সন্ন্যাসিনীর ঘরের ভেতরে এমন সুড়ঙ্গপথ আছে, বেশ বড় পাতালঘর আছে, কোনোদিন জানতেই পারিনি। ঘরের চারপাশে সিন্ধুক, তোরঙ্গ নানা আসবাবপত্র। অন্ধকারে সব দেখা যাচ্ছে না। আকাশ কি জানে ? এসব ভাবার সময় নয় এখন! খুব সতর্ক থাকতে হচ্ছে। এরই মধ্যে অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পেলাম। একবার। দু'বার। আইসি চেঁচিয়ে সতর্ক করলেন। 'সবাই সাবধান। ওরা গুলি ছুঁড়ছে।' ভয়ে মেঝেতেই বসে পড়েছি আমি। কোনও কিছুর আড়াল খুঁজছি। মানুষের দৌড়াদৌড়ির শব্দ হচ্ছে। এটুকু বুঝলাম ভেতরে যারা ছিল তারা পালাচ্ছে। আইসিও ওদের পিছু নিলেন। আমরা সবাই আইসিকে ফলো করছি। খুব সাবধানে। অজ্ঞাত পরিচয় মানুষগুলোর পেছনে ছুটছে পুলিশ। তাদের টর্চের আলোয় আমরা দেখার চেষ্টা করছি। আমি আর আকাশ এই গোলকধাঁধায় পড়ে অন্ধের মতো সামনের দিকে দৌড়াচ্ছি। আতঙ্কে। কৌতূহলে। হাঁপাতে হাঁপাতে যে জায়গায় গিয়ে উঠলাম,  সেটা পাহাড়ের গায়ে, শান্তি আশ্রম থেকে অনেক দূরে থাকা একটা গোপন অংশ। চারপাশে ঘন জঙ্গল। সুড়ঙ্গের মুখে কায়দা করে ডালপালা চাপানো। সবাই বেরিয়ে গেলেও, আইসির তৎপরতায় একজন ধরা পড়ে গেল। সুড়ঙ্গের বাইরে নিয়ে এসে ওর চেহারা দেখতেই অনেক কিছু রহস্যের জাল খুলে গেল। পুলিশের গাড়িতে রাত্রেই ওকে নিয়ে আসা হল থানায়। সারারাত সুড়ঙ্গপথের মুখে, আশ্রমে পাহারায় থাকল পুলিশ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments