জ্বলদর্চি

আপন সংসারেই শরবিদ্ধ স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর/প্রসূন কাঞ্জিলাল

আপন সংসারেই শরবিদ্ধ স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর


প্রসূন কাঞ্জিলাল




একটা সময়ে গভীর বেদনায়  পিতা মাতা, স্ত্রী ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পরিজনদের কয়েকটি  চিঠি লেখেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর মহাশয়। একটি চিঠিতে ঈশ্বরচন্দ্র মাকে লেখেন :-----

 "নানা কারণে আমার মনে সম্পূর্ণ বৈরাগ্য জন্মিয়াছে, আর আমার ক্ষণকালের জন্যও সাংসারিক কোনো বিষয়ে লিপ্ত থাকিতে বা কাহারও সহিত কোনো সংস্রব রাখিতে ইচ্ছা নাই। বিশেষতঃ ইদানীং আমার মনের ও শরীরের যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে তাহাতে পূর্বের মত নানা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থাকিলে অধিক দিন বাঁচিব এরূপ বোধ হয় না। এখন স্থির করিয়াছি যতদূর পারি নিশ্চিন্ত হইয়া জীবনের অবশিষ্ট ভাগ নিভৃতভাবে অতিবাহিত করিব। এক্ষণে আপনার শ্রীচরণে এ জন্মের মত বিদায় লইতেছি।"

চিঠির শেষদিকে লিখেছেন ---  "আমি অনেকবার আপনার শ্রীচরণে নিবেদন করিয়াছি এবং পুনরায় শ্রীচরণে নিবেদন করিতেছি, যদি আমার নিকট থাকা অভিমত হয়, তাহা হইলে আমি আপনাকে কৃতার্থ বোধ করিব এবং আপনার চরণসেবা করিয়া চরিতার্থ হইব।"

এবং একই দিনে তাঁর পিতাকেও একটি আলাদা চিঠিতে তিনি লিখেছেন :---

 "সংসার বিষয়ে আমার মত হতভাগ্য আর দেখিতে পাওয়া যায় না। সকলকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিয়াছি। কিন্তু অবশেষে বুঝিতে পারিয়াছি, সে বিষয়ে কোন অংশে কৃতকার্য হইতে পারি নাই। যে সকলকে সন্তুষ্ট করিতে চেষ্টা পায়, সে কাহাকেও সন্তুষ্ট করিতে পারে না।"

সময়টা ১২৭৬ বঙ্গাব্দের ২৫শে অগ্রহায়ন। সাল ১৮৬৯। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বয়স তখন ৪৯। ততদিনে তাঁর আপোষহীন লড়াইয়ের ফসল,বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়েছে ১৮৫৬ এর ২৬ শে জুলাই। বিয়ে দিয়েছেন ৬০ জন বিধবার।খরচ হল প্রায় ৮৭,০০০ টাকা। উঠলো মোটে ৪২,০০০। নিজের ঋণ গিয়ে দাঁড়াল প্রায় ৩৫,০০০ হাজার টাকা।যার সুদ মেটাতে তাঁকে দিতে হচ্ছিল বছরে ৫,০০০ টাকা।

 দু বছর আগেই অর্থাৎ ১৮৬৭ সালে বীরসিংহ এর গ্রামের বাড়িতে পিতামাতার জীবৎকালেই তাঁদের একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেছে। ভাইয়েরা পৃথক হয়েছেন। প্রত্যেকেই সম্পত্তির আলাদা অংশ দাবী করলেন। অথচ সেই সম্পত্তির সবটাই কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিজের  একার অর্জিত সম্পত্তি। 
 
বিদ্যাসাগরের বিরক্তির সবচেয়ে বড় কারণ ছিল  তৃতীয় ভ্রাতা ঈশানচন্দ্রের বিদ্যাহীন, আদর্শহীন উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা, আর তা সত্ত্বেও তার প্রতি পিতামাতার স্নেহান্ধ প্রশ্রয়। ঈশানচন্দ্র সীমাহীন ঋণ করেই চলতেন আর তা শোধ করতে হত বিদ্যাসাগর মহাশয়কে। পিতা লিখে পাঠালেন: "তাহার অনেক ঋণ আছে, তাহা পরিশোধ করিয়া পাঠাইবে।"

বিদ্যাসাগর তাঁর ভাই শম্ভুচন্দ্রকে লিখলেন :-- "ইতিপূর্বে একবার তাহার যথেষ্ট ঋণ পরিশোধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। তৎকালে কোন কর্মের ভার দিব বলিয়াছিলাম ।সে কোন কর্মে লিপ্ত থাকিতে ইচ্ছা করে নাই।"

পিতাকে পাঠানো আর এক চিঠিতে তিনি লিখলেন :-- "কার্যগতিকে ঋণে বিলক্ষণ আবদ্ধ হইয়াছি। ঋণ পরিশোধ না হইলে, লোকালয় পরিত্যাগ করিতে পারিতেছি না। এক্ষণে যাহাতে সত্ত্বর ঋণমুক্ত হই, তদ্বিষয়ে যথোচিত যত্ন ও পরিশ্রম করিতেছি। ঋণে নিষ্কৃতি পাইলে কোন নির্জ্জন স্থানে গিয়া অবস্থিতি করিব। ... আপনকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যয় নির্বাহার্থে যাহা প্রেরিত হইয়া থাকে, যতদিন আপনি শরীর ধারণ করিবেন, কোন কারণে তাহার ব্যতিক্রম ঘটিবেক না।"

তাঁর স্ত্রী দিনময়ী দেবীকেও লিখেছিলেন :--  "আমার সাংসারিক সুখভোগের বাসনা পূর্ণ হইয়াছে আর আমার সে বিষয়ে অণুমাত্র স্পৃহা নাই। বিশেষতঃ ইদানীং আমার মনের ও শরীরের যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে ...। এক্ষণে তোমার নিকটে এ জন্মের মত বিদায় লইতেছি ...। তোমার পুত্র উপযুক্ত হইয়াছেন, অতঃপর তিনি তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করিবেন। তোমাদের নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যয় নির্বাহের যে ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছি, বিবেচনাপূর্ব্বক চলিলে তদ্বারা স্বচ্ছন্দরূপে যাবতীয় আবশ্যক বিষয় সম্পন্ন হইতে পারিবেক।"

দিনময়ী দেবী তাঁর পুত্র নারায়ণচন্দ্রের বিধবাবিবাহে [আগস্ট, ১৮৭০] এতটা মর্মাহত হয়েছিলেন যে স্বামীকে  কখনোই ক্ষমা করতে পারেন নি। যদিও এ বিবাহ নারায়ণচন্দ্রের নিজের পছন্দ ও উৎসাহেই হয়েছিল, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্ররোচনায় নয়। তবে বিদ্যাসাগর মহাশয়  অত্যন্ত খুশী হয়েছিলেন এবং নিজে উপস্থিত থেকে সেই বিয়ে দিয়েছিলেন। এই বিয়েতে তাঁর ভাই শম্ভুচন্দ্রেরও মত ছিল না। 

বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁর ভাইকে লিখেছিলেন :--  "আমি বিধবাবিবাহের প্রবর্তক, আমরা উদ্যোগ করিয়া অনেকের বিবাহ দিয়াছি এমন স্থলে আমার পুত্র বিধবা বিবাহ না করিয়া কুমারী বিবাহ করিলে আমি লোকের নিকট মুখ দেখাইতে পারিতাম না। নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে।"  ...........অথচ সেই পুত্র নারায়ণচন্দ্রই ১৮৭২ সালে পৃথক হয়ে যান।

নারায়ণচন্দ্রের কাছ থেকেও বিদ্যাসাগর মহাশয় কম আঘাত পাননি।  

কৃষ্ণনগরের উকিল যদুনাথ রায়ের পুত্র-বিয়োগের সান্ত্বনা দিতে তাঁকে  লিখেছেন :-- "পিতা ও মাতা হওয়া অপেক্ষা অধিকতর মহাপাতকের ভোগ আর নাই। পিতামাতাকে প্রকৃত প্রস্তাবে সুখী করেন, এরূপ পুত্র অতি বিরল। কিন্তু অসদাচরণ ... প্রভৃতি দ্বারা পিতামাতাকে যাবজ্জীবন দগ্ধ করেন এরূপ পুত্রের সংখ্যাই অধিক।"

পুত্রের সঙ্গে সম্পর্ক এতটাই তিক্ত হল যে তিনি তাঁর সম্পত্তির বিলিবণ্টন সংক্রান্ত শেষ উইলে প্রায় তিপ্পান্নজন আত্মীয়-স্বজন, আশ্রিত, বন্ধুবর্গ প্রমুখের জন্য বৃত্তি, মাসোহারা ও আর্থিক সাহায্য প্রভৃতির ব্যবস্থা করলেও পুত্র নারায়ণচন্দ্রকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে স্পষ্টভাষায় লেখেন :--  "আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত শ্রীযুত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী, এ জন্য ও অন্য অন্য গুরুতর কারণ বশতঃ আমি তাহার সংস্রব ও সম্পর্ক পরিত্যাগ করিয়াছি। এই হেতু বশতঃ বৃত্তি নির্ব্বন্ধস্থলে তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং এই হেতু বশতঃ ... ... আমার উত্তরাধিকারী বলিয়া পরিগণিত অথবা ... এই বিনিয়োগপত্রের কার্যদর্শী নিযুক্ত হইতে পারিবেন না।"

 প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বিদ্যাসাগর মহাশয় উইলে পুত্রকে ত্যাগ করেছিলেন বটে কিন্তু পুত্রবধূ ভবসুন্দরীর জন্য মাসিক ১৪ টাকা বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন।

 ১২৭৬ বঙ্গাব্দের ২৫শে অগ্রহায়ন  বিদ্যাসাগর গ্রামের গদাধর পালকে একটি চিঠিতে লেখেন:----
"নানা কারণ বশতঃ স্থির করিয়াছি আমি আর বীরসিংহায় যাইব না। তুমি গ্রামের প্রধান এই জন্য তোমাদ্বারা গ্রামস্থ সর্বসাধারণ লোকের নিকট এ জন্মের মত বিদায় লইতেছি ...। সাধারণের হিতার্থে গ্রামে যে বিদ্যালয় ও চিকিৎসালয় স্থাপিত আছে এবং গ্রামস্থ নিরূপায় লোকদিগের মাস মাস যে কিছু কিছু আনুকূল্য করিয়া থাকি ... ঐ সকল বিষয় রহিত হইবে না। ..."

 ১২৭৬ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে বীরসিংহ গ্রামে মুচিরাম শর্মার সঙ্গে মনোমোহিনী নামক এক বিধবার বিবাহকে কেন্দ্র করে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর অনুজ ভ্রাতৃদ্বয় দীনবন্ধু, শম্ভুচন্দ্র ও ঈশানচন্দ্রের এক দুঃখজনক বিরোধ লাগে। 

মুচিরাম-মনোমোহিনী তাঁদের অঞ্চলের দোর্দ্দন্ডপ্রতাপ বিধবাবিবাহ বিরোধী জমিদার হালদারদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য  বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগরের ভাইদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা ও বিয়েতে সহায়তা চান। এর আগে অন্য একটি বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠানে যোগদানের অপরাধে ঐ জমিদার বিদ্যাসাগরের শ্বশুরমশাইকে অপমান করেন এবং প্রায়শ্চিত্ত করতে বাধ্য করেছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাইয়েরা এই মুচিরামকে আশ্রয় দেন ও বিবাহে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। অন্যদিকে জমিদারের তরফ থেকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করে তাঁর কথা আদায় করেন যে তিনি এ বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকবেন।

 কিন্তু ঘটনাচক্রে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বীরসিংহে উপস্থিত থাকা অবস্থায়ই তাঁর ভাইয়েরা তাঁদের প্রতিবেশী একজনের বাড়িতে তাঁকে না জানিয়ে গোপনে বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

ঠিক পরের দিন ঐ অনুষ্ঠানের কথা জানতে পেরে বিদ্যাসাগর মহাশয় অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে তাঁর ভাইদের বলেন যে, " তোমরা তাহাদের (হালদারদের) নিকট আমাকে মিথ্যাবাদী করিয়া দিবার জন্য, এই গ্রামে এবং আমার সম্মুখস্থ ভবনে বিবাহ দিলে। ইহাতে আমার যতদূর মনঃকষ্ট দিতে হয়, তাহা তোমরা দিয়াছ। যদি তোমাদের একান্ত বিবাহ দিবার অভিপ্রায় ছিল, তাহা হইলে ভিন্ন গ্রামে গিয়া বিবাহ দিলে এরূপ মনকষ্ট হইত না। ... আমি তাহাদের নিকট মিথ্যাবাদী হইলাম। ... অদ্য হইতে আমি দেশত্যাগ করিলাম।"  


বিদ্যাসাগর মহাশয় সে রাতে অন্নগ্রহণ করেননি। শম্ভুচন্দ্রের কথায় "পরদিন প্রাতঃকালে অনাহারে ক্ষুব্ধ চিত্তে প্রিয় জন্মভূমি, সাধের বাড়িঘর চিরদিনের জন্য ত্যাগ করিয়া কলিকাতা যাত্রা করিলেন।"

১২৭৬-এ লেখা ঐসকল  পত্রগুচ্ছের পরেও প্রায় বাইশ বছর বিদ্যাসাগর মহাশয় বেঁচে ছিলেন, কিন্তু কখনো আর বীরসিংহ গ্রামে ফেরেননি।

১৮৯১ সালে মৃত্যু হয়েছে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের। আর ১৮৭৫ সালে (১২৮২ বঙ্গাব্দ) তৈরি করেছিলেন নিজের উইল। সেই উইলে ২৫টি ধারা। সর্বশেষ ধারায় লিখছেন — " আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী। এ জন্য ও অন্য অন্য গুরুতর কারণ বশতঃ আমি তাঁহার সংস্রব ও সম্পর্ক ত্যাগ করিয়াছি। এই হেতু বশতঃ বৃত্তি নির্ব্বন্ধস্থলে তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে...।"

নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় পরবর্তীকালে নারায়ণচন্দ্র বিদ্যারত্ন নামে পরিচিত হন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের একমাত্র পুত্রসন্তান। তাঁর বংশের তথাকথিত ‘প্রদীপ’। অথচ তাঁর সম্পর্কেই কতটা গর্বিত ছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। কেননা বিধবা বিবাহ প্রচলন নিয়ে যখন ঝড় উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে — 'যে পরের ঘরের ছেলেকে বিধবাদের সঙ্গে বিয়ে দিতে তিনি নাকি সিদ্ধহস্ত। কই বিদ্যাসাগরের পরমাত্মীয় কেউ তো এ পথে পা মাড়াল না।' সেই দুঃসময়েই বাবার পাশে দাঁড়িয়েছিল ‘কুপথগামী’ ছেলে। তবে নিন্দুকরা বলেন ‘বাবার পাশে দাঁড়ানোর জন্য নয়, হুগলির খানাকুল কৃষ্ণনগরের শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ১৪ বছর বয়সী বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর প্রেমে পড়েছিলেন নারায়ণ।'

সে যাই হোক, ভবসুন্দরীকে বিয়ে করে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে স্বস্তি দিয়েছিলেন নারায়ণচন্দ্র। সেকথা বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজেই চিঠিতে লিখছেন ভাই শম্ভুচন্দ্রকে — "ইতিপূর্ব্বে তুমি লিখিয়াছিলে, নারায়ণ বিধবাবিবাহ করিলে আমাদের কুটুম্ব মহাশয়েরা আহার-ব্যবহার পরিত্যাগ করিবেন, অতএব নারায়ণের বিবাহ নিবারণ করা আবশ্যক। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য এই যে, নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়াছে; আমার ইচ্ছা বা অনুরোধে করে নাই। যখন শুনিলাম, সে বিধবাবিবাহ করা স্থির করিয়াছে, তখন সে বিষয়ে সম্মতি না দিয়া প্রতিবন্ধকতাচারণ করা আমার পক্ষে কোনও মতেই উচিত কর্ম্ম হইত না। আমি বিধবাবিবাহের প্রবর্ত্তক; আমরা উদ্‌যোগ করিয়া অনেকের বিবাহ দিয়াছি। এমন স্থলে আমার পুত্র বিধবাবিবাহ না করিয়া কুমারী-বিবাহ করিলে আমি লোকের নিকট মুখ দেখাইতে পারিতাম না। ... নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে এবং লোকের নিকট আমার পুত্র বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবে, তাহার পথ করিয়াছে।"

উইল তৈরি করার মাত্র পাঁচ বছর আগে ১২৭৭ বঙ্গাব্দে এই চিঠি লিখছেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠছে, এই পাঁচ বছরে কী এমন হল যে পিতাকে গর্বিত করা পুত্র একেবারে "কুপথগামী পুত্র" হলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উইলটিকে পড়লে দেখা যায় এমন কেউ প্রায় নেই যিনি তাঁর জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অথচ কোনও মাসহারা বা এককালীন অনুদান পাননি। তাহলে কী এমন হল যে জীবনের ঝরাপথে সর্বস্ব বিলানো করুণাসাগর নিজে বঞ্চিত করছেন তাঁর একমাত্র কুলপ্রদীপকে সম্পত্তির ভাগ থেকে?

এই ‘কুপথগামী’ নারায়ণ বিদ্যারত্নই কিন্তু বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর পরই ১৮৯১ সালে বাবার অপ্রকাশিত জীবনচরিত প্রকাশ করছেন। ১৮৯২ সালে প্রকাশ করছেন ‘ভূগোলখগোলবর্ণনম্‌’। আর পরবর্তীতে 'বিদ্যাসাগর গ্রন্থাবলী' প্রকাশ (১৩০২ বঙ্গাব্দ) করতে গিয়ে সম্পাদকের ভূমিকা হিসেবে লিখছেন — ‘পূজ্যপাদ পিতৃদেব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মানবলীলা সম্বরণের পর অনেকেই বলেছিলেন যে, যাঁহার অমৃতময়ী লেখনীর প্রসাদে বঙ্গভাষা পুনর্জীবন লাভ করিয়াছে, সেই মহাত্মার পুস্তকগুলি গ্রন্থাবলীরূপে প্রকাশিত হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গ্রন্থাবলী মহামূল্য সামগ্রীর মধ্যে পরিগণিত হইয়া সর্ব্বত্র সাদরে পরিগৃহীত হইবেক।’

তাহলে ঠিক কী হয়েছিল পিতা-পুত্রের ভিতর যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে নারায়ণ চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন? এই প্রসঙ্গে প্রবেশমুখ হিসেবে একটি চিঠি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারিখ বিহীন এই চিঠিটি পুত্রবধূ ভবসুন্দরীকে লেখা। বিদ্যাসাগর মহাশয় লিখছেন — "আমি তোমাদের নিকট এ জন্মের মত বিদায় লইলাম। তোমাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যয় নির্ব্বাহের নিমিত্ত, আপাততঃ মাসিক একশত পঞ্চাশ টাকা নির্দ্ধারিত করিয়া দিলাম।"

১২৮২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে শশীভূষণ সিংহকে লেখা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে জনৈক মধুসূদন ভট্টাচার্য্যের স্ত্রী বিন্ধ্যবাসিনী দেবীকে তাঁর স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে সমাজের কিছু মাতব্বর উদ্যোগী হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নারায়ণ। অন্যদিকে সহায়-সম্বলহীন বিন্ধ্যবাসিনীকে মাসহারা দেন বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং। তিনি চান নিজের অধিকার বলেই ওই বিধবা স্বামীর সম্পত্তি পাক। বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজের ছেলে সম্পর্কে এই চিঠিতে লিখছেন — "নারায়ণবাবুও এক্ষণে একজন প্রধান লোক হইয়াছেন। তিনি যে যারপরনাই পিতৃদ্বেষী তাহারই পরিচয় দিতেছেন। নতুবা আমি এবং আমার পিতৃদেব যাহা করিয়াছি তিনি তাহার অন্যথা করিতে উদ্যত হইতেন না।"

কিন্তু পুত্রের কর্তব্যহীনতার কারণে গড়ে ওঠা এই বিচ্ছেদ স্থায়ী হয়নি। স্থায়ী হয়নি নারায়ণের উদ্যোগেই। তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের থেকে প্রথমে দূরে সরে গেলেও বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁকে ফিরিয়ে নেন। আর তার নেপথ্যে আছে ১২৯৫ বঙ্গাব্দের চৈত্রমাসে বাবাকে লেখা নারায়ণের এক মর্মান্তিক চিঠি। সেই চিঠি বাবা-ছেলের বেদনাদায়ক সম্পর্কের অশ্রু দলিল। সেখানে নারায়ণ ফিরতে চাইছেন বাবার কাছে, ক্ষমা ভিক্ষা করছেন, অনুতাপ করছেন, অক্ষরে অক্ষরে কাঁদছেন।

"যখন আপনি এ অধমের মুখের দিকে তাকাইতেও অনিচ্ছুক, তখন আমি কোন সাহসে আপনার নিকটে বা সম্মুখে দাঁড়াইতে যাইব। চাকরের মত থাকিব, ক্রমে অনুগ্রহ হয়, অনুমতি হয়, নিকটে যাইব। নচেৎ একধারে কুকুরের মত থাকিব। আমি যেমনই হই আপনার পুত্র। ...যদি আপনার চরণ সেবা করিতে না পাইলাম, তবে কিসে পরকালে উদ্ধার পাইব?"

এই দীর্ঘ চিঠিতে নারায়ণচন্দ্র নিজের বিধবাবিবাহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন — "একবার তো আপনাকে গর্বিত করতে পেরেছি, সেই আমার সার্থকতা।" জীর্ণ শরীর, ভগ্নচিত্ত, ক্লান্ত বাবার কাছে ফিরতে চেয়ে বলছেন — "দোষ যত গুরুতর হউক না কেন, ক্ষমার নিকট সকলই তুচ্ছ, তাতে আবার বাপ মায়ের কাছে। আমাকে চরণে আশ্রয় দিলে কেহ দোষ দিবে না, বরং মহাপুরুষেরই মহত্ত্বেরই পরিচয় দেওয়া হইবে। ...আমার জন্য একবার শেষ পরীক্ষা করুন, সাহস করিয়া বলিতে পারি, একক্ষণের জন্য, কোন বিষয়ে অণুমাত্রও আপনার অসন্তোষের কাজ করিব না।"

১২৮২ বঙ্গাব্দে উইল করেছিলেন। ১২৯৫ বঙ্গাব্দে এই চিঠি পেয়ে কোন বাবা আর সন্তানকে দূরে ফেলে রাখতে পারে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও পারেননি। ফিরিয়ে নিয়েছিলেন নারায়ণচন্দ্রকে। তবে এই অনুভবী চিঠির সঙ্গে নেপথ্যে কাজ করেছিল মৃত্যুপথযাত্রী তাঁর স্ত্রী দিনময়ী দেবীর কাতর প্রার্থনাও ।।

তথ্যসূত্র :--

১.অঞ্জলি বসু (সম্পাদিত) ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৭৬
২.অমরেন্দ্রকুমার ঘোষ ; যুগপুরুষ বিদ্যাসাগর : তুলিকলম, কলকাতা, ১৯৭৩
৩.অমূল্যকৃষ্ণ ঘোষ ; বিদ্যাসাগর : দ্বিতীয় সংস্করণ, এম সি সরকার, কলকাতা, ১৯১৭
৪.অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ; বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর : মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা, ১৯৭০
৫.ইন্দ্রমিত্র ; করুণাসাগর বিদ্যাসাগর : আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৬৬
৬.গোপাল হালদার (সম্পাদিত) ; বিদ্যাসাগর রচনা সম্ভার (তিন খণ্ডে) : পশ্চিমবঙ্গ নিরুক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি, কলকাতা, ১৯৭৪-৭৬
৭.বদরুদ্দীন উমর ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ : দ্বিতীয় সংস্করণ, চিরায়ত, কলকাতা, ১৯৮২
৮.বিনয় ঘোষ ; বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ : বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ
৯.বিনয় ঘোষ ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : অনুবাদক অনিতা বসু, তথ্য ও বেতার মন্ত্রক, নয়াদিল্লি, ১৯৭৫
১০.ব্রজেন্দ্রকুমার দে ; করুণাসিন্ধু বিদ্যাসাগর : মণ্ডল অ্যান্ড সন্স, কলকাতা, ১৯৭০
১১.মহম্মদ আবুল হায় আনিসুজ্জামন ; বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ : স্টুডেন্টস ওয়েজ, ঢাকা, ১৯৬৮
১২.যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ; বিদ্যাসাগর : পঞ্চম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৪১
১৩.যোগীন্দ্রনাথ সরকার ; বিদ্যাসাগর : ১৯০৪
১৪.রজনীকান্ত গুপ্ত ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : ১৮৯৩
১৫.রমাকান্ত চক্রবর্তী (সম্পাদিত) ; শতবর্ষ স্মরণিকা : বিদ্যাসাগর কলেজ, ১৮৭২-১৯৭২ : বিদ্যাসাগর কলেজ, ১৯৭২
১৬.রমেশচন্দ্র মজুমদার ; বিদ্যাসাগর : বাংলা গদ্যের সূচনা ও ভারতের নারী প্রগতি : জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৭৬ বঙ্গাব্দ
১৭.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ; বিদ্যাসাগর-চরিত : বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা
১৮.রাধারমণ মিত্র ; কলিকাতায় বিদ্যাসাগর : জিজ্ঞাসা, কলিকাতা, ১৯৪২
১৯.রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ; চরিত্র কথা : কলকাতা, ১৯১৩
২০.শঙ্করীপ্রসাদ বসু ; রসসাগর বিদ্যাসাগর : দ্বিতীয় সংস্করণ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৯২
২১.শঙ্খ ঘোষ ও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদিত) ; বিদ্যাসাগর : ওরিয়েন্ট, কলকাতা
২২.শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন ; বিদ্যাসাগর চরিত : কলকাতা, ১২৯৪ বঙ্গাব্দ
২৩.শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন ; বিদ্যাসাগর জীবনচরিত : কলকাতা।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments

  1. বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনের অনেক অজানা ঘটনা জানতে পারলাম ,এজন্য লেখক মহাশয়কে অসংখ্য ধন্যবাদ ।

    ReplyDelete