জ্বলদর্চি

দৌড়/(উৎসব ১৪২৮)/সূর্যকান্ত মাহাতো

দৌড়
সূর্যকান্ত মাহাতো


দিনদিন বয়স যত বাড়ছে লতাদেবীর গরিবী টাও যেন সমানে তাল মেলাচ্ছে। আজকাল তার দারিদ্র্যতা এতটাই মাথা চাড়া দিয়েছে যে দিন আনা দিন খাওয়ার অবস্থাটাও দিন দিন কেমন যেন রং হারিয়ে ফেলছে। সেই চিন্তায় রাত্রির ঘুমটাও ইদানিং তার অনেকখানি কমে গেছে। আর কেনই বা কমবে না! মানুষ তো ঘুমাতে যায় ক্লান্তির শেষে টুকু শান্তি পেতে, নিশ্চিন্ত হতে। কিন্তু লতাদেবীর শান্তি কোথায়! পরের দিন ছেলে মেয়ের মুখে কিভাবে খাবার তুলে দিবে সেটা ভাবতে ভাবতেই তো কখন যেন রাত্রি ফুরিয়ে যায়। ঘুম আর হয় কোথায়। ছেলে মেয়েগুলোকেও সেরকম ভাবে স্কুলের মুখ দেখাতে পারছে না বলে, মনের ভিতর একটা চাপা কষ্টে দিনরাত কেবল গুমরে মরে। তাদের মুখের দিকে তাকালেই মনটা কেমন হু হু করে উঠে। তখন নিজেকে বড়ই অপরাধী বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে চোখের জলটা তাকে সান্ত্বনা দিতে বেরিয়ে এসেও পারে না। তাই বোধ হয় লজ্জায় দ্রুত গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।

শরীরটা এখনও সায় দিচ্ছে বলেই  লতাদেবী সংসারটা টানতে পারছে। তার রোগা পাতলা শরীরকে এই মাঝ বয়সেও কোনও রোগে যে ধরতে পারল না এই তার রক্ষে। নইলে কি যে হত! সেই কাকভোরে ঘুম থেকে ওঠা, তারপর সারাদিন নিরলস পরিশ্রম করে করে অবশেষে মাঝ রাত্রিতে বিছানায় শুতে যাওয়া। তাও আবার ঘুমাতে নয়, এক রকমের মুখ লুকোতে বলা যেতে পারে। আসলে সন্তানদের স্বপ্নগুলোকে পূরণ করতে না পারার ব্যর্থতা যে তাকে কতখানি কষ্ট দেয় সেটা তার মতো একজন গরিব মা ছাড়া অন্য কেউ কিভাবে বুঝবে! কিন্তু লতাদেবী ছেঁড়া মাদুরে কোথাও মুখ লুকোবার জায়গা খুঁজে পায় না। আঁচল টাই তখন মুখের উপর তুলে ধরে। এভাবেই কোনও রকমে দুই মেয়ের বিয়ে দিল। ভাবল, এবার বোধহয় কিছুটা স্বস্তি হল। কিন্তু কোথায় স্বস্তি! স্বামীর মাথা ব্যথার অসুখটা হঠাৎ করে আবার বেড়ে গেল। এমনিতেই অসুস্থ ছিলেন। তার ওপর মানুষটা সেরকম কোনও কাজ করতেও পারত না। উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকাতেও তার কষ্ট হয়। কোনও উচ্চঃস্বরের শব্দও শুনতে পারে না। কেবল ঘরের একটা কোণই  তার জগৎ। খুব দরকার না পড়লে বাড়ির বাইরে তেমন একটা পা রাখে না।  

আজকাল স্বামীর ব্যথা ভরা মুখটা লতাদেবী কিছুতেই যেন সহ্য করতে পারে না। লোকটা যতদিন সুস্থ ছিল লতাদেবীকে রাণীর মতো করে রেখেছিল। চরম অভাবের সংসারেও কত সুখী ছিল তারা। আজ যখন স্বামী যন্ত্রণায় ছটফট করে তখন লতাদেবী মনে মনে খালি প্রার্থনা করে, ঠাকুর ওর ব্যথাটা আমাকে দিয়ে দাও। আর ওর মুক্তি হোক। অসহায় মানুষটা আর পারছে না। কিন্তু চাইলেই তো আর সবকিছু হয় না। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই তাই গরম তেল দিয়ে স্বামীর পাশে বসে মাথাটা পরম যত্নে মালিশ করে দেয়। তার নরম আঙুলের চাপে স্বামী কিছুটা হলেও আরাম বোধ করে। দুজনেই তখন নিস্তব্ধ থাকে। কেউ কোনও কথা বলে না। তবু যেন দু জনেই নীরবে কতসব কথা বলে চলে, একান্তে, নিজেদের মনে মনে। একজন ভালো থাকার প্রার্থনা করে তো অন্যজন ভালো হয়ে ওঠার।

হাসপাতালের ডাক্তারবাবু জানালেন একটা এম আর আই করাতে হবে। পাঁচ হাজার টাকার মতো খরচ পড়বে। ডাক্তারবাবুর কথা শুনে লতাদেবীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। পাঁচ হাজার টাকা! তার কাছে তো এই টাকাটা লাখ টাকার সমান! এত টাকা সে কোথায় পাবে? দুই মেয়ের শ্বশুর বাড়িও বেশ গরিব। তাদের কাছে হাত পাততে লতাদেবীর মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। কেমন যেন কিন্তু কিন্তু বোধ হচ্ছে। তার মনে হতে লাগল, তবে কী তার ভালোবাসার মানুষটা এভাবেই যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকবে! না। না। লতাদেবী বেঁচে থাকতে তা হতে দিতে পারে না। কিন্তু উপায়? স্বামী লতাদেবীর উদ্বিগ্ন মুখটা দেখে বলল, "ছেড়ে দাও। অতটাকা জোগাড় করতে তুমি পারবে না।"

কেঁদে ফেলল লতাদেবী। নিজেকে দুর্বল ভাবলে সেই কবেই তো তার সংসারটা ভেসে যেত। কিন্তু তা তো  কখনও হতে দেয়নি লতাদেবী। শক্ত হাতেই তো এতদিন হাল ধরে রেখেছে। আর আজ কিনা এত সহজেই হাল ছেড়ে দেবে? না। এটা তার চিরকালই স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই আজও পারবে না। স্বামীকে তাই বলল, "আমার উপর ভরসা রাখো। দেখো একদিন তুমি ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে।"

হঠাৎ একদিন লতাদেবী খবর পেল শহরের এক ক্লাব মধ্য বয়স্কদের ম্যারাথন দৌড়ের আয়োজন করেছে। তাদের ঘোষিত পুরস্কার মূল্য হল, প্রথম পুরস্কার পাঁচ হাজার টাকা(মহিলা বিভাগ ও পুরুষ বিভাগ), দ্বিতীয় পুরস্কার তিন হাজার টাকা, এবং পরের দশ জনকে এক হাজার টাকা করে দেবে।

লতাদেবী এমন খবর পেয়ে দারুণ খুশি হল। নতুন একটা রাস্তা যেন বেরিয়ে এল। টাকার জোগাড় কিভাবে হবে সেই চিন্তার জালে যখন ক্রমশই জড়িয়ে পড়ছিল, তখন হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতোই একটা আশার আলো এবার যেন দেখতে পেল। রাত্রিতে স্বামীকে ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করবে বলে জানাল। স্বামী তাকে কাছে ডেকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বারণ করল। বলল, "তুমি এই বয়সে অতটা দৌড়াতে পারবে না। ছেড়ে দাও। তোমার যদি কিছু হয়ে যায়, এই সংসারটার কী হবে একবার  বুঝতে পারছ? ওসব বাদ দাও, তাছাড়া আমি ধীরে ধীরে ঠিক সেরে যাব।"

লতাদেবী স্বামীর মুখের দিকে এক  গভীর দৃষ্টিতে তখন তাকিয়ে আছে। মানুষটা এখনও কত ভাবে তার জন্য। আর একটা লম্বা দৌড় সে শেষ করতে পারবে না, এই মানুষটার জন্য! একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল লতাদেবী। স্বামীর গলা অবধি বিছানার ছেঁড়া চাদরটা টেনে দিয়ে বলল, "আমার কিছু হবে না। দেখো, আমি ঠিক পারব।"

ম্যারাথনের সময় একটা বাধা হয়ে দাঁড়াল লতাদেবীর বয়স। তার বয়সটা যে অনেকটাই বেশি। অনেক ঝুঁকি হয়ে যাবে বলে ক্লাব কর্তারা তাকে নিতে চাইছেন না। তারা বয়সের কথা যদিও তেমন করে কিছু উল্লেখ করেন নি। অবশেষে লতাদেবীর অনেক কাকুতি মিনতির পর তাকে দৌড়ে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিলেন। এক ঝটকায় লতাদেবীর এমন সাহসী সিদ্ধান্তে ও তার অংশগ্রহণে সমস্ত ম্যারাথনের জৌলুস তিনি যেন একাই শুষে নিলেন। উপস্থিত প্রতিযোগী থেকে দর্শক সবার চোখ তখন কেবল লতাদেবীর উপর। এমনকি খবরটি দ্রুত চাউর হতেই শয়ে শয়ে মানুষ এসে উপচে পড়ছে, বয়স্ক লতাদেবীর দৌড় দেখার জন্য।

শাড়িটাকে হাঁটুর কাছে তুলে কোঁচা করে পরেছে। দু পায়ে দুটো ক্ষয়ে যাওয়া চটি। সাত সকালেই শুরু হয়েছে দৌড়। ছোটবেলায় জমির আলে, পুকুরপাড়ে, মেঠো পথে একটানা কত দৌড়ে বেড়াত। এখন প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে ফেলতে সেইসব দিনের কথা মনে পড়ছে তার। একটানা তখন ছুটে চলত, মাঠে, ঘাটে, বাড়ির উঠোনে। কিছুতেই যেন তার দম শেষ হত না।  আজ আবার চল্লিশ বছর পর সে ফের একবার দৌড়ের মুখোমুখি। আজও অদ্ভুত ভাবে কোথা থেকে যেন একটা বাড়তি শক্তি এসে ভর করেছে তার দুটো পায়ে। সেইসঙ্গে স্বামীর বেদনা মাখা শুকনো মুখটাও বারবার ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে। দৌড়ালেও মন যে তার পড়ে আছে প্রিয় মানুষটির কাছেই। শুধু শরীরটা কেবল রাস্তার বুকের উপর দিয়ে নিরলস ভাবে ছুটে চলেছে। মনে মনে ভাবছে, যদি সে পারে, কত খুশিই না হবে মানুষটা। একথা ভাবতেই একটু যেন জোর বেড়ে গেল লতাদেবীর। আসলে স্বামীর হাসি মুখটা দেখলে  সে মনে প্রাণে দারুন খুশি থাকে। তখন বিষণ্নতার মেঘটা যেন অনেকটাই কেটে যায়।
হঠাৎ একটা হোঁচটে তার অবচেতনের ঘোরটা কেটে গেল। একটা পায়ের চটি ফিতা ছিঁড়ে কোথায় যেন ছিটকে পড়ল। বেচারা চটিটাও লতাদেবীকে আজ সাথ দিল না। তাই বলে কি লতাদেবী থেমে যাবে? থামলে যে তার চলবে না। অন্য পায়ের চটিটা তখন ওখানেই ছুঁড়ে ফেলে দিল। এবার শুরু হল তার খালি পায়ের দৌড়। দৌড়-দৌড় আর দৌড়। পথ যেন আর ফুরোয় না। রাস্তার পাশের হাততালি, চিৎকার, মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট কোনও কিছুতেই তার ভ্রূক্ষেপ নেই। স্বামীর এম আর আই এর পাঁচ হাজার টাকাটাই এখন তার একমাত্র পাখির চোখ। বাকি সব কিছুই তার কাছে মূল্যহীন। 

একটা লম্বা দৌড়ের শেষে এল সেই সোনালী মুহূর্ত। মহিলাদের মধ্যে প্রথম সে। ট্র্যাকের শেষে পৌঁছে দেখে একটি চেয়ারে বসে আছে স্বামী। মৃদু হাততালির সঙ্গে মুখে মিটিমিটি সেই হাসি। ক্লাব কর্তারা নাকি শেষ মুহূর্তে লতাদেবীর দৌড় দেখেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এতক্ষন যে পা দুটো লম্বা রেসের ঘোড়া হয়ে উঠেছিল, সে দুটোই স্বামীকে দেখার পর বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ল। ভাগ্যিস দৌড় শেষ হওয়ার পূর্বে স্বামীকে দেখতে পায়নি! স্বামীর হাসিমুখটা দেখে চোখের জলটা সে আর ধরে রাখতে পারল না। এই হাসি মুখটাকেই তো চিরকাল বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে সে। সে জন্যই তো কত পরিশ্রম। সেখানে আজকের এই ম্যারাথন দৌড়টা তো কিছুই নয়। আজকের দৌড়টা ছিল  তার জীবনের কাছে, গরিবীর কাছে হেরে না গিয়ে একমাত্র জিতে ওঠার দৌড়। 

চারদিকে তখন চিল চিৎকার আর  মুহুর্মুহু হাততালির শব্দ আকাশে বাতাসে আতস বাজির মতো ফেটে পড়ছিল।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 
উৎসব ১৪২৮
☘️
তিনটি অণুগল্প / অর্ণব মিত্র

Post a Comment

1 Comments