জ্বলদর্চি

খপ্পর-১ (উপন্যাস) /(উৎসব ১৪২৮) অনিন্দ্য পাল

উপন্যাস 
খপ্পর 
অনিন্দ্য পাল  
চিত্র- জাহ্নবী সেন


পর্ব: এক 

এক. 
"সোম এই সোম! ওঠ, এবার রেডি না হলে তো ট্রেনটাই  মিস হয়ে যাবে। এগারোটায় বাড়ি না ঢুকলে না মা একদম ফুজিয়ামা হয়ে যাবে রে!"---কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে তপু এবার খেপচুরিয়াস হয়ে উঠলো। আর তপুর খেপে যাওয়া মানেই মুখটা পুরো পাবলিক ওয়াশরুমের হলদে প্যানের মত হয়ে যায়। বাংলা, ইংরাজি, ওড়িয়া, সানতালি এরকম অনেককটা ভাষাতে তুখোড় গালাগাল দিতে দিতেই এক ধাক্কা, তারপর যা হবার। সোম বিছানার চাদর খামচে মেঝেতে।" কি হলো রে?" যেন কিছুই হয় নি -এমন একটা ভাবে ফ্যাল ফ্যাল করে তপুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। "এই বোকা--, ভুলে গেছ  আমরা এখন কোথায়? এটা কি তোর কলকাতা? আর আমরা না হোটেলে আছি এখনও! মনে পড়েছে! শালা ঘুম দেখ না! কুম্ভকর্ণ বেঁচে থাকলে ইগোর জ্বালায় আজই আত্মহত্যা করতো। ওঠ রে, এবার ওঠ ওঠ! হাতে আর মাত্র মিনিট কুড়ি আছে। "--রাগ আর অনুনয় বিনয় মিশিয়ে অদ্ভুত টিউনিংয়ে এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে অবাক আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে থাকলো। অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নি,বলতে বলতে কখন হাঁটু মুড়ে সোমের সামনে বসে পড়েছে, নিজেও বুঝতে পারে নি। বুঝতে পারলো যখন সোম ধপাস করে মার্বেলের মেঝের উপর বসে পড়ে তার কোলের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে দিল। একে হাতে এতটুকু সময় নেই তার উপর সোমের এই রকম ক্যালানেপনা তপুর মেজাজ গরম করে দিল। চিৎকার করে একটা পাঁচ অক্ষরের চরম খিস্তি দিয়ে খামচে ধরলো সোমের চুল। ততক্ষণ চুল গুলো ছাড়লো না, যতক্ষণ না সোম খেমা দে -খেমা দে বলে লাফিয়ে উঠে পড়তে গেল। 
                 হোটেল থেকে যখন বেরুল দু'জন, হাতে মাত্র মিনিট সাত সময় আছে। 

       পাড়ার রাস্তায় ঢুকতে গিয়ে কেমন একটা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠলো দীপুর। কাঁচা দেশী মাল এর গন্ধ। ক্লাবের ভিতরে এখন রোজ রাতে শুঁড়িখানা বসছে। সন্ধ্যে হলেই যত জমির দালাল, বাজারের তোলাবাজ, চেও-চ্যাংড়া ছেলের ভিড় শুরু হয়। তাস, ক্যারাম, জুয়া চলতে থাকে। দশটা বাজলেই শুরু হয় মদের আসর। অথচ এই বছর দুই আগেও এই ক্লাবে তারা রবীন্দ্র জয়ন্তী, বসে আঁক প্রতিযোগিতা, বাৎসরিক খেলাধুলা, অবৈতনিক কোচিং সেন্টার -- কত কি না করেছে। এমনকি, রজতের লেখা নাটকও মঞ্চস্থ করেছে, বার দুই। অনেক বাহবাও জুটেছিল। আর এখন ক্লাব দোতলা হয়েছে। কমিটি বদলে গেছে, বদলে গেছে কাজকর্ম। 
ক্লাবের পাশ দিয়ে আসার সময় একটু উঁকি দিয়ে দেখলো দীপু। ছ-সাত জন ছেলে বসে আছে। টিভি চলছে। মদের বোতল, কয়েকটা প্লাস্টিক গ্লাস আর মাঝখানে একটা বেশ বড় গামলায় কিছু একটা আছে। আসর চলছে। মাধব আর পাটু কে চিনতে পারলো, বাকিদের চিনতে পারলো না। বাজারের কাছেই হওয়ায় অনেক অচেনা ছেলে ছোকরার ভীড় লেগেই থাকে এখন। তাদের সময় এসব হত না। এখন চলছে। চড়া গন্ধে বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না দীপু। পিছন ফিরে চলে আসতে যাবে এমন সময়, ক্লাবের পাশের বট গাছের নিচে অন্ধকার থেকে কেউ বলে উঠলো, 
--কি রে দীপু? দেখিস কি? ইচ্ছে করছে নাকি? চল ভিতরে চল, এক পেগ খেয়ে যাবিখনে। একটা বিশ্রী হাসি হেসে অন্ধকার থেকে একটা মানুষ বেরিয়ে এল। শঙ্কর। এই ক্লাবের হত্তা-কত্তা-বিধাতা, পাড়ার উঠতি দাদা। দীপুর পিঠে একটা হালকা চড় মেরে বললো 
-- কষ্ট হয় না খুব! রাজত্ব চলে গেল। এই কেলাবটাও হাতছাড়া হয়ে গেল। লোকে আর মোছে না তোদের। 
কি বলতো দীপু, হেলে গরু বুড়ো হয়ে গেলে ওরকম হয়। এখনও, বলছি আমাদের সঙ্গে চলে আয়, ভাল থাকবি। চাসতো পদ ও পেয়ে যাবি একটা- আমি করে দোবখনে। বুঝলি, চলে আয়, চলে আয়। 
    মাথাটা গরম হয়ে গেল দীপুর। কপালের রগ দুটো রাগে দপদপ করতে শুরু করলো। পিঠ থেকে শঙ্কর এর হাতটা সরিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে, প্যান্টের পকেটে স্মার্ট ফোনটা সুর করে বেজে উঠলো। মা। শঙ্করকে জবাব দিতে পারতো, কিন্তু ...
--হ্যাঁ মা বল 
ওপাস থেকে উমার একটু উৎকন্ঠিত গলা পাওয়া গেল। 
-- দীপু, তপু এখনও বাড়ি আসেনি তো! এই এগারোটা বাজতে চললো। তুই ও নেই। আমি কি যে করি না? এরম ভাবে আর পারি না, বুঝলি তো। লেখাপড়া শিখে  স্যায়না হয়ে এখন এই রকম খেলা দেখাচ্ছিস তো তোরা। আমি তো বলেছি যে আমাকে তোরা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আয়। তারপর যা পারিস কর। কিচ্ছু বলতে আসবো না! 
--- ওহ হো ! মা আমি এসে গেছি, পাড়ার রাস্তায় আছি, ক্লাবের কাছে। আর তপুকে দেখছি ফোনে পাই কিনা, তুমি অত চিন্তা কোর না ! কিন্তু দীপু জানে  যতক্ষণ না তপু বাড়ি ফিরবে ততক্ষণ পর্যন্ত মা শান্ত হবে না। আর তপু আজ এগারোটা বাজাবে, বলেই বেরিয়েছে। অবশ্য এটা শুধু তাকেই বলেছে। মাকে নয়। ছোট ভাই হয়ে, তপুর উপর খবরদারি সে করে না। বরং তপুর সঙ্গে তার সম্পর্ক বন্ধুর মতই। তার সব গোপন কথা তপু জানে, আর তপুও দীপুর কাছে তেমন কিছু গোপন করে না। সোমের সঙ্গে সম্পর্কের কথা তপু প্রথম থেকেই তাকে বলেছে। এমনকি আজ যে সোমের সঙ্গেই যাবে বর্ধমান, সেটাও দীপু জানে। 
      ফোনটা কেটে সবে পকেটে রাখতে যাবে এমন সময় আবার বেজে উঠলো। ততক্ষণে ক্লাব ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। 
পকেট থেকে বার করে দেখলো, একটা অজানা নম্বর। 
এত রাতে কে ফোন করতে পারে? ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতেই কেটে গেল ফোনটা। 

দুই. 
লম্বা গলার মদের বোতলটার ঢাকনাটা খুলে শুঁকে দেখলো ব্যানা, এই গন্ধটা একটু অন্যরকম, ঝাঁঝালো কিন্তু মিষ্টি। একটু নাড়িয়ে দেখলো। ভিতরে সামান্য একটু পড়ে আছে। পকেট থেকে একটা ছোট চ্যাপটা প্লাস্টিকের বোতল বার করে তাতে সেইটুকু সোনালী তরল ঢেলে নিল। তারপর জানলা গলিয়ে মদের বোতলটাকে ছুড়ে দিল বাইরে। সেখানে কাচের বোতলের স্তূপের উপর গিয়ে পড়লো ভারি বোতলটা, খ্যানখ্যানে আওয়াজ করে জানান দিল যথাস্থানে গিয়ে পৌঁছেছে। 
ওরকম আরও দু-চারটে বোতল থেকে ঝেড়ে-ঝুড়ে যখন তার পকেটের বোতলটা প্রায় অর্ধেক ভর্তি হয়ে এল, ব্যানা ঝুপড়িতে ফিরে এল। দরমার ঢাকনাটা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে আবার ঢাকনাটা যেমন ছিল আটকে দিল। ভিতরে একটা সস্তার ব্যাটারি-ল্যাম্প
জ্বলছিল। হালকা সাদা আলোতে ব্যানা দেখলো কুদ্দুস ল্যাদ খেয়ে ক্যাম্পখাটের উপর পড়ে আছে। রোজ যেমন থাকে। মদ ওকে গিলে নিয়েছে। আজ রাতের মত ওর খেলা শেষ। 
ব্যানা মেঝেতে পা ছাড়িয়ে বসে পড়লো। কাগজে মোড়া রুটি আর তড়কা বের করে একটা প্লাস্টিকের প্লেটে রাখলো। তারপর পকেট থেকে বোতলটা বার করে একবার আলোর দিক বরাবর চোখের সামনে ধরলো। ওর মুখে একটু আনন্দের হাসি। আজ জমবে ভালো। হাত বাড়িয়ে জলের প্লাস্টিকের জগটা টেনে নিয়ে দেখলো অল্প জল আছে। যাকগে ওতেই হয়ে যাবে। বোতলের ঢাকনাটা খুলে আর একবার নাকের কাছে আনলো ব্যানা। গন্ধটা দারুণ লাগছে তার। খাওয়া শুরু করে দিল সে। 

সাত মাস হল ব্যানা এখানে এসেছে। মা মারা যাওয়ার মাস চারেক পর। মা বাচ্চাটা নেবে বলেছিল। তার বাপের এক্কেবারে ইচ্ছা ছিল না। লোকটাকে বাপ বলে ডাকতে ইচ্ছা করতো না তার। লোকটা, মানে ব্যানার বাবা কখনো ঠিকঠাক সুস্থ থাকতো না। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর শুরু হত চোলাই গেলা, রাতে যতক্ষণ না নেশার ঘোরে রাস্তায় পড়ে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত চলতো মাতলামি। মা কে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে, তেমনটাই শুনেছিল ব্যানা, কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় মা এর লাশ নিয়ে ফিরে এসেছিল ওর বাবা। বাচ্চা নষ্ট করতে গিয়ে হাতুড়ে ডাক্তার নাকি ওর মার নাড়িভুঁড়ি ও টেনে বারকরে এনেছিল। ব্যানা এ সব শুনেছে চম্পার মার কাছে। মায়ের বিয়ে বেলার সই ছিল। চম্পার মা বলেছিল, তার নাকি একটা ভাই হত। হাতুড়ে আগে ভুল বলেছিল। মেয়ে হলে খরচ বাড়বে, তাই ব্যানার বাপ সে পথে যায় নি। কিন্তু কি হল! ফল আর গাছ দুই ই গেল- চম্পার মা বলেছিল। অনেক ক্ষণ কেঁদেছিল সেদিন ব্যানা।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments