জ্বলদর্চি

ছায়া ছায়া অন্ধকার-১/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/শিশির পাল

উপন্যাস 
ছায়া ছায়া অন্ধকার
শিশির পাল

অলংকরণ : সায়নী পাল



পর্ব :১ 

সকালের সূর্য প্রণাম সেরে, নদী থেকে বাড়ি ফেরার পথে, গাছের তলায় বসেছে বিজয়। একাকী। নিমগ্ন। এক গভীর ভাবনায় ব্যপৃত রয়েছে সে। আগামী যেন থমকে এসে দাঁড়িয়েছে, কবিতার প্রান্ত পংক্তির পাশে পূর্ণচ্ছেদের মতো। কিন্তু জীবন যে নদীর মতো সততই গতিশীল! সে তো থেমে থাকতে পারে না। যেখানেই থেমে থাকার সংকেত, সেখান থেকেই শুরু হয় নতুন অধ্যায়ের। এই বারো বছর বয়সে অন্তত এটুকু বোঝার মতো ক্ষমতা হয়েছে বিজয়ের। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে বুঝেছে, অন্যদের মতো তার জীবনের পথ ততটা মসৃণ নয়। ওর সঙ্গে যারা আছে এই দণ্ডকারণ্যে, শিক্ষান্তে তারা সবাই বাড়ি ফিরে যাবে। তাদের প্রত্যেকের বাবা মা, আত্মীয়জন আছে। তারা নিয়মিত আসে। বছরের বিভিন্ন সময়ে। দেখে যায়। বিজয়কে দেখার মতো কেউ আসে না। কখনও। তাহলে, গুরুজীই কি বিজয়ের বাবা? গুরুমাই কি তার মা? অথচ আলাদা করে বিজয় কখনোই বেশি স্নেহ পায় না তাদের কাছ থেকে। মাঝে মাঝে মনে হয় তার, বোধহয় এই জীবনই বৃথা। বাবা মায়ের আদর সে ঠিক করে পাচ্ছে না। কষ্ট হয়। অভিমানও।
সত্যিই কি সে অনাহূত এই পৃথিবীতে? কোনও উত্তর ওর জানা নেই। এক প্রবল মনখারাপ ওকে আজকাল ঘিরে ধরছে। এই উত্তর ওকে জানতেই হবে। না পারলে, যে দিকে দু'চোখ যায় ও চলে যাবে। 

দণ্ডকারণ্যের অগভীর জঙ্গল ঘেরা অঞ্চলে ছোট্ট একটা পাঠশালা চালান নিরঞ্জন এবং সুষমা। আবাসিক টোল বলা যায়। অনুন্নত হতদরিদ্র এলাকার এই টোলেই, পাশাপাশি গ্রামের একেবারে নিঃস্ব পরিবার থেকে প্রতিবছর শিশুরা আসে শিক্ষা নিতে। জঙ্গল এলাকায় থেকে, তারা ক্লাসের পড়া করে। খেলাধুলা করে। পরিবেশ রক্ষার কাজ করে। বড় হয়ে সাধারণ পরিবেশে মিশে যায়। সমাজের কাজে নিয়োজিত হয়। বহির্জগত থেকে কার্যত ছিন্ন এই আশ্রম। নিরঞ্জনকে গুরুজি আর সুষমাকে গুরুমা বলে ডাকে সবাই। 

যত দিন যাচ্ছে বিজয়ের মানসিক যন্ত্রণা ততই বাড়ছে। গতকাল সাহস করে একবার গুরুমার কাছে গিয়ে কিছু কথা বলেছিল।
'গুরুমা। আমার একটা কথা জানার আছে।'
'বল না বাবা। কী কথা?'
'এখানে সবার বাবা মা মাঝেমাঝেই আসে। আমাকে দেখতে কই কেউ তো আসে না? আমার কি কেউ নেই?'
স্তম্ভিত হয়ে যান গুরুমা। চুপ থাকেন একটুক্ষণ। এইরকম অবাক করা  প্রশ্নের জন্য তাঁর কোনও প্রস্তুতি ছিল না। একটু হেসে বিজয়কে কাছে টানলেন। বুকে জড়ালেন একবার। 'কী করে তোর মাথায় এইসব আজগুবি চিন্তা ঢুকছে? কে বলেছে তোকে, তোর কেউ নেই। এইটুকু বয়স থেকে তোকে মানুষ করছি। মা বলেই তো ডাকিস আমাকে। এত ভালোবাসি তোকে! শুধু পড়াশুনোটা ঠিকঠাক হওয়ার জন্যই সবার সঙ্গে রেখে পড়াই তোকে। এরকম কখনও ভাববি না বাবা। কষ্ট পাই।' বিজয় অনুভব করে, গুরুমা তাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরছে। মায়ের আদর পেতে থাকে বিজয়। কিন্তু এত কিছুর পরও বিজয়ের মন শান্ত হয় না। কই গুরুমা তো একবারও বললেন না , আমিই তো জন্মদাত্রী মা। কৌশলে কিছু কথা বলে গেলেন মাত্র। 

নাহ্! এই আশ্রম বিজয়ের জন্য নয়। ও আর থাকবে না এখানে। কষ্ট বাড়ছে ক্রমশ। 

#
আজকের এই সময় বড়ই অন্যরকম। রাতের অন্ধকার ছিঁড়ে তারাদের আলোয়, আলোছায়ার মতো দেখা যাচ্ছে আশপাশ। ভারি সুন্দর। নির্জন। অন্ধকারের গা বেয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ভোরের আলো। ভোর হবে একটু পরেই। 

নির্জনতাই ত্যাগের পথকে সুগম করে। এটাই সবচেয়ে আদর্শ সময়। ছেড়ে যাওয়ার। 

সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সুযোগ বুঝে নিজের ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিজয়। রাস্তা ঘাট কিছুই চেনে না সে। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা পথ চলে আসার পর দূর আকাশে সে দেখে সূর্য ওঠার প্রস্তুতি। মেঘহীন আকাশে তুলি দিয়ে জলরঙের টান। গেরুয়া আলোর আভা। কিন্তু সকাল হতে হতে ওকে পেরিয়ে যেতে হবে এ তল্লাট! 

দু'তিন পর আজ এসে পৌঁছেছে পুরি। সমুদ্রের পাড়ে এসে বসেছে। ক্লান্ত দীর্ণ কিশোরের মনে অপার শান্তি আসছে। সমুদ্রের অতল গভীরতার মতো তার মনও এখন অতল। ধীর।আগের চেয়ে অনেক বেশি শান্তি আসছে মনে। প্রভু জগন্নাথ দেবের পায়ে অন্তত নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবে এবার। 

মন্দিরের ভোগ খেয়ে রাত্রিযাপন আবার পরের দিন মন্দিরের বিভিন্ন কাজে লেগে থাকা। এভাবেই চলল কয়েকটা দিন। হঠাৎ বিভাসের নজরে পড়ল বিজয়। বিভাস মন্দিরের পান্ডা। দু'এক দিন তিনি নিঃশব্দে লক্ষ্য করলেন। বিজয়ের মতো অল্পবয়স্ক ছেলেকে একাকী দেখে মায়া হল। একদিন দুপুরে খাওয়ার পর, বিভাস ডাকলেন বিজয়কে। 

'ক'দিন ধরেই দেখছি তুমি মন্দিরেই আশেপাশেই আছ দিনরাত। বাড়ি কোথায় তোমার?'
বিভাসের কথায় ধরা পড়ে যাবার ভয়ে বিজয় বলল, 'আমার এখানেই বাড়ি। কাছাকাছিই।'
'আমি এখানে জন্ম থেকে আছি। কোনোদিন তো দেখিনি তোমাকে? ভয় নেই। আমাকে সত্যি কথা বলতে পার।' 

গৈরিক পোশাক। ধুতি। চাদর। ব্রাহ্মণের চিহ্নবাহি পৈতে।মুন্ডিত মাথায় টিকি। এমনই চেহারার এক বালক, করুণ চাহনিতে চেয়ে আছে বিভাসের দিকে। চুপচাপ। বিভাস গলে যান। বলেন, 'তুই তো আর বলবি না! আমার আর শোনারও দরকার নেই। চল আজ আমার সঙ্গে। আমার বাড়ি। আমার সঙ্গেই থাকবি আজ থেকে।'
বিজয় বাধা দিল না। কথা বলল না আর। অপ্রত্যাশিত অবলম্বন প্রাপ্তিতে ওর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রু।আনন্দের অশ্রু। 

পুরির সমুদ্রতট থেকে মাইল দুই দূরে একটা ছোট্ট ঘরে থাকেন বিভাস। স্ত্রী লক্ষ্মী এবং মেয়ে রুক্মিণীকে নিয়েই বিভাসের সংসার। রুক্মিনী প্রায় বিজয়েরই বয়সী। 

বিজয়কে দেখে লক্ষ্মী বেশ খুশিই হল। একবারও, বিজয়কে দূরের বলে ভাবল না। এক্কেবারে আপন করে নিল। নিজের ছেলের মতো করে। 

এত দিনের এত অস্থিরতায়, মনখারাপে যেন একটা আশা এবং আপাত আনন্দের প্রলেপ পড়ল। সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বিজয় মিশে যেতে লাগল পরিবারে। পরিবেশে। আগন্তুক ছেলেটি আস্তে আস্তে হয়ে উঠল বিভাসের পরিবারের পরম এক আশ্রিত। 

* * * * দশ বছর পর * * * * 

মন্দিরে পুজো করে, বাড়ি ফিরেছে বিজয়। আজকাল দুপুরে বিশ্রাম নেবার অবকাশ থাকে না একদম। দুপুরের খাবার খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়ল। একটু পরে, বিকেলের দিকেই দর্শনার্থীরা সাধারণত মন্দিরে ভিড় করে। বিজয় এখন পরিণত এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ পুরোহিত। মন্দিরের নিত্য পূজা করে। রুক্মিণী বিভিন্নভাবে সাহায্য করে ওকে। এটাই ওদের দৈনন্দিন। 

এর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটল। বয়সের সমতা, সম পরিবেশে সময় যাপন, একই পরিবারে থাকা, এসবের কারণে, আশ্রিত বিজয় অজান্তেই ঝুঁকে পড়ে রুক্মিণীর দিকে।রুক্মিণীও ঝোঁকে বিজয়ের প্রতি। গোপনে চলা এই সম্পর্ক একদিন উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। বিস্ফোরণের মতো। বিজয়ের জীবনের গতিপথ আবার অন্য দিকে বাঁক নিতে শুরু করে। 

'তোকে কি কখনও বুঝতে দিয়েছি, তুই আমার পরিবারের থেকে আলাদা কেউ ! নিজের ছেলের মতো করেই তো দেখেছি তোকে। তার প্রতিদান  তুই এভাবে দিবি, এক্কেবারে বুঝতে পারিনি এতদিন। নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে!' 
বিভাসের গলায় ক্রোধের চেয়ে আফসোসের আওয়াজ বেশি শোনা যায়। চুপ করে থাকে বিজয়। কিছু কি বলার মতো আছে তার ? পাশের ঘরে মায়ের কাছে রুক্মিণী কাঁদছে। গভীর রাত্রির স্তব্ধতায় মিশে যাচ্ছে বিভাসের দীর্ঘশ্বাস। বিভাস আবার বললেন, 'তোকে এতটাই ভালোবাসি আমি যে, তোকে ছেড়ে থাকা খুবই কষ্টের আমার কাছে। আবার, আমাদের সমাজ কে তো তুই জানিস, এই সম্পর্ক কিছুতেই মানতে পারবে না। আমার মান সম্মান সব ধুলায় মিশে যাবে।' অপরাধীর মতো শুনছে বিজয়।
'তোকে আমার একটাই অনুরোধ, তুই চলে যা এখান থেকে। অন্য কোথাও। অনেক দূরে কোথাও। আজই চলে যা। ভোর হওয়ার আগেই।'
'আজই!' যেন কিছুটা সময় চাইল বিজয়।
'আর একটা দিন সময় চাই আমার। যা কিছু ফেলে রেখেছি, একটু গুছিয়ে নিই। চলে যাব তারপর।' যোগ করল বিজয়।
'কোনও মায়া বাড়াবি না, বিজয়।'
'মায়া তো থাকেই। এত এত স্মৃতি! সব তো ফেলে যেতে হবে!' বিজয় স্বগতোক্তি করল, বিড়বিড় করে। 

বিজয় জানে, এটাই শেষ সুযোগ। একমাত্র সুযোগও। ওকে চলে তো যেতেই হবে। কিন্তু রুক্মিণীকে একা ছেড়ে যাবে কী করে? সারাদিন কথা বলার সুযোগ হয়নি। সন্ধের সময় একবারের জন্য ঠাকুরঘরে একা পেল রুক্মিণীকে। ওর হাত ধরে বলল, 'আজ রাতেই চলে যাচ্ছি। সবদিনের জন্য। কোনোদিন আর ফিরব না এখানে। তোকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে খুব। কষ্ট হচ্ছে তোর, আমার মতো ? মনে রাখবি তো আমাকে?' অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে বিজয়।
পাখির মতো চোখ তুলে তাকায় রুক্মিণী। তার চোখে যেন হাজারো জিজ্ঞাসা!
'আমিও তো যাব। আমি তোকে ছেড়ে থাকতে পারব না।' 

সমস্ত বাধা যেন কেটে গেল। কী ভাবে বাড়ি ছাড়বে বিজয়, কীভাবে নিয়ে যাবে রুক্মিণীকে সব ঠিক হয়ে গেল। 

গভীর রাতে বেরিয়ে গেল বিজয়। বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরেও এল। অপেক্ষা করছিল রুক্মিণী। এরপর বেরিয়ে পড়ল বিজয়ের হাত ধরে। বাবা মায়ের অলক্ষ্যে । সত্যি সত্যিই  যেন উড়ে গেল ওরা। অন্ধকার চিরে। সুদূরগামী পাখির মতো। দূর দিগন্তে। অজানা গন্তব্যে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments