জ্বলদর্চি

পাতি মানুষের পাঁচালি-১৩/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়


পাতি মানুষের পাঁচালি::১৩
-----------------------------------------
লাট্টু
-------
লাট্টুর তেরাে বছর বয়স তখন। শ্যামলা রং। মাঝারি গড়ন। অত্যন্ত উজ্জ্বল আর চঞ্চল দুটো চোখ। নাকের নীচে হালকা গোঁফের রেখা। গাল ভাঙতে শুরু করেছে। গলা না মেয়ের না ছেলের। বোঝা যায়না। সংক্ষেপে ,সে টিন এজে প্রবেশ করেছে।  সে সময় থেকে এ গল্পের শুরু। বাবা ব্যস্ত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। মা  মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বিজনেসের নেটওয়ার্কার। বাড়িতে আত্মীয় বলতে আর কেউ নেই। হাওড়ার এক ফ্ল্যাটবাড়িতে পারুল মাসির সঙ্গে সময় কাটায় লাট্টু। পারুল মাসি তার ছােটবেলা থেকে তাদের বাড়িতে। সৎ, দায়ীত্বশীল। বাবা-মা ছেলেকে তার হাতে স্বচ্ছন্দে ছেড়ে দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে  নিজেদের কাজ করে। ওদের কাজ, ছেলের স্কুল ,সব কিছুর পাট চোকার পর রাতে তিনজনের দেখা, কথাবার্তা আড্ডা হয়। পারুল মাসি বাড়ি ফেরে সে সময়। আবার চলে আসে পরের দিন ভােরবেলা।
লাট্টুর নাম লাট্টু হওয়ার পিছনে একটা মজার ঘটনা আছে। যখন সে মায়ের পেটে তখন মায়ের জরায়ুতে, যেখানে গর্ভস্থ শিশুর বাস, সেখানে  প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি জল ছিল ! সে জলের মধ্যে মনের আনন্দে ডিগবাজি খেত সে! কখনাে মাথা উপরে পাছা নীচে তাে কখনাে উল্টো। এই ঘুরপাক খাওয়ার কারণে মায়ের গাইনিকোলােজিস্ট ড. উপাধ্যায়কে খুব একহাত জব্দ করেছিল সে। তিনি ভেবেছিলেন প্রসবের সময় আগে মাথা বেরােবে—তাে বেরােলাে পা। এ কাণ্ড দেখে গাইনােকলজিস্ট হঠাৎ করে বলে ফেলেছিলেন—'মানুষের বাচ্চা তাে নয়! যেন লাট্টু !' ব্যাস! সেই থেকে লাট্টুর নাম লাট্টু হয়ে গেল।
আজকাল আর যৌথ পরিবারের চল নেই বিশেষ। সে ছিল আমাদের ছােটবেলায়। যখন কাকা, জ্যাঠা বাবা সব একসঙ্গে সপরিবারে বাস করত। এক হাঁড়ি । এক বাড়ির ছাদ। এক উঠান । বাচ্চাদের কাছে আনন্দময় জমজমাট পরিবেশ। তারা পিঠোপিঠি খেলতে খেলতে, মারপিট করতে করতে বড় হয়ে যেত। বড়রা টেরই পেত না তা।
লাট্টুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সেরকম নয়। শহরের যে জায়গাটাতে সে থাকে, সে জায়গাটা ফ্ল্যাটের জঙ্গল। মাঠ নেই, ঘাট নেই, গাছ নেই । সুতরাং তিন কামরার ফ্ল্যাটেই যত দাপাদাপি। খেলতে গিয়ে এটা ভাঙা, সেটা ভাঙা, দিনের শেষে বাবা-মায়ের বকুনি, এসব নিত্য বরাদ্দ তার।  তারপর আবার রাত পােহালে অবস্থা যে কে সেই। আজকাল অবশ্য দেশের, অবস্থা ভালাে নয়। টালমাটাল পৃথিবী। উপদ্রুত দুষ্কৃতিপুষ্ট পাড়া-বেপাড়ায়, মাঝে মাঝেই ছেলে-মেয়ে অপহরণের ঘটনা ঘটে। তারপর মােটা টাকা মুক্তিপন দিয়ে তাদের ছুটকারা মেলে অথবা যা হয় তা না বলাই ভালাে। লাট্টুর বাবা-মা বিত্তশালি বলে লােকে জানে। আর এ সব খবর তাে হাওয়ায় ওড়ে, সুতরাং আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চার মতাে লাট্টুকে মাঠে খেলতে পাঠাতে তার বাবা-মা একদম ভরসা পায়না। প্রথম প্রথম লাট্ট এ বন্দিজীবন নিয়ে বিস্তর রাগ করেছিল, পরে অবশ্য নিজে নিজেই বুঝেছিল মা-বাবার দুশ্চিন্তার কারণ। ফলে তার ভবিতব্য মেনে নিয়েছিল। সে কারণে স্কুলের বাইরে সেভাবে বন্ধুই তৈরি হয়নি তার  এবং একই কারণে সে একটু মুখচোরা ইনট্রোভার্ট ধরনের। যে সকল বাচ্চারা কারণে অকারণে মানুষের সঙ্গে ফরফর করে কথা বলে তেমন নয় সে।
সে বছর তার ক্লাস সেভেন হবে। হাওড়া জিলা স্কুলের ছাত্র। যখন স্কুলে ভরতি করার তােড়জোড় চলছিল তাকে তখন পাড়াপড়শী ও তথাকথিত শুভানুধ্যায়ীরা লাট্টুর বাবা-মাকে উপদেশ দিয়েছিল তাকে একটা নামিদামি স্কুলে ভরতি করতে। তারা সে বিষয়ে কর্ণপাত করেনি। তাদের চিন্তাধারা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের চিন্তাধারার সঙ্গে ঠিক মেলে না। তাদের মতে, নামী স্কুল আর ভালাে স্কুল সমার্থক নয়। নামী হলেই ভালাে হবে অথবা ভালাে হলেই নামী হবে এরকম নয়। তা ছাড়া পড়াশােনার ব্যাপারটা কেবলমাত্র স্কুলের উপর নির্ভর করে না। তা নির্ভর করে অনেকটাই ছাত্রছাত্রীর মেধা, তাগিদ এবং বাবা-মায়ের সন্তানের প্রতি মনযােগের উপর। ভবিষ্যতের আচ্ছা আচ্ছা খ্যাতিমান মানুষ অতীতে গ্রামের এঁদো স্কুল থেকে পড়াশােনা করে বড় হয়েছে এবং এ যুগেও সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বলে  তারা মনে করে না। তা ছাড়া বাড়ি থেকে নামী স্কুলে যেতে এবং সেখান থেকে ফিরতেই যদি তিনঘণ্টা সময় চলে যায় তাহলে বাচ্চা পড়বে  কখন, বিশ্রাম  করবেই কখন?
স্কুল সামনে থাকলে পুরাে ব্যাপারটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, আর অকারণে দুশ্চিন্তা হয় না। তার উপরে তাদের দুজনেরই  কাজের চাপ। দূরে কী ঘটছে তা আন্দাজে বােঝার থেকে কাছের স্কুলে রেখে তার সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ রেখে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সহজ ও নিরাপদ।
লাট্টুর শৈশব তাে সেরকম ছিলই না, তার উপর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়ার চাপ বাড়ছিল। আগে তাে বাবা তার পড়াশােনা নিয়ে মাথা ঘামাতােই না, মাও বেশ রিল্যাক্সড ছিল। আজকালকার বাবা-মাগুলাে যেন কীরকম!
ছােটবেলা থেকেই ছেলেমেয়ের পড়াশােনা নিয়ে এত টেন্সড  আর হাইপার হয়ে থাকে যেন পনেরাে বছর বয়সেই ছেলে সব বিষয়ে সবার সেরা হয়ে পৃথিবী কাঁপিয়ে দেবে! আরে বাবা! মাথায় নিতে পারা’ বলে তাে একটা কথা আছে তো নাকি! যে বয়সে যেটা! যে ম্যাচুরিটিতে যেটা! বাবা-মায়ের প্রত্যাশা দেখে এখন হাসব না কাঁদব ভেবে পাই না! এখনকার বাবা-মায়েরা যখন ছােট ছিল, তাদের শৈশব কি দোমড়ানাে মােচড়ানাে ছিল এমন? ছিল না বলেই বােধহয় এই চাপের যন্ত্রণাটা বােঝে না তারা!  লাট্টুর বাবা-মা’ও সবার দেখাদেখি ছেলেমেয়ের পড়াশােনা নিয়ে ব্যাপক টেনশন শুরু করল ধীরে ধীরে। অর্থাৎ ভেড়ার পালে পা মেলাল ! এমনিতে এক ফোঁটা নজর দেওয়ার সময় নেই লাট্টুর উপর। কিন্তু পড়াশােনা নিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর করতে কে ছাড়ে? আগে লাট্টু এসব গায়ে মাখত না। এখন ভীষণ বাের লাগে  তার । রাগ হয়ে যায়! এমনিতে পরীক্ষায় ফল খারাপ করে না সে। ক্লাসের প্রথম পাঁচজনের মধ্যে থাকে তাে বটেই! তাতে বাবা-মা আর খুশি কোথায় ? তাদের আরও চায় ! ফার্স্ট হতে হবে। সেকেন্ড হওয়া বলে নাকি কিছু হয় না। সেকেন্ড মানে ফার্স্ট না হতে পারা। চঁদে কে দ্বিতীয়বার গেছিল তা মনে রেখেছে কেউ? বাবা মায়ের এহেন নেতিবাচক কথা শুনে  লাট্টুর ভীষণ অবাক লাগে। অন্তত তার তাদের কাছ থেকে সে আর একটু অন্যরকম ট্রিটমেন্ট আশা করেছিল সে! মনে হচ্ছে যে-ই যায় লঙ্কায়। সে-ই হয় রাবণ! ছােট্ট মাথা লাট্টুর।  জগৎ দেখেনি বেশি। অভিজ্ঞতা কম, সেই ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা দিয়েই বাবা মাকে বােঝানাের চেষ্টা করেছিল যে তার প্রতি তাদের এই অ্যাটিচ্যুড ঠিক নয়। বাবা-মা যথারীতি কান দেয়নি। চোখ থাকতেও কানা হলে যা হয় আরকি!
এই চাপ বিষয়টাকে ভীষণ ভয় পায় লাট্টু। ভয় পাওয়ার কারণ প্রাজ্ঞ। প্রাজ্ঞ তার পাশের বাড়ির। ক্লাস নাইনে পড়ে। পড়াশােনায় মাথা ভালাে। ধীরস্থির। এ হেন ছেলেও একদিন বাবা-মায়ের প্রত্যাশায় চাপে দিশাহারা হয়ে মাথাটাই বিগড়ে বসল! প্রথমে পড়াশােনা বন্ধ, তারপর বাবা-মায়ের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনােভাব, তার পর মারপিট । লাট্টুর খুব ভয় করে প্রজ্ঞার এ দশা দেখে। সে মনে প্রাণে ভালােবাসে তার বাবা-মাকে! যদি এ দশা তারও হয় তাহলে ? বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকবার শেয়ার করেছে তার এ আশঙ্কার কথা। তারা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। পাগলামাে নাকি একটা জিন ঘটিত রােগ, এবং তাদের বাড়িতে পুরনাে ইতিহাসে কোনাে পাগল নেই। সুতরাং ও সব ভেবে লাভ নেই। তার আশঙ্কা যে অমূলক নয় তা লাট্ট প্রথম টের পেল ক্লাস সেভেন থেকে এইটে ওঠার ফল হাতে পেয়ে। ফল আশনুরূপ হয়নি। এক এক জন এক এক স্টাইলে পড়শােনা করে। তার কোনাে স্টিরিওটাইপ নিয়ম নেই। লাট্টু যেমন! সে অল্পেই সব কিছু বুঝতে পারত। সে কোয়ালিটিতে বিশ্বাস করত আর তার বাবা মা কোয়ান্টিটিতে! তাদের মতে রােজ দুবেলা বসতে হবে। রবিবারও। পরীক্ষার সময় ঘাড় খুঁজে পড়ে থাকতে হবে। সে কি ফাঁকিবাজ নাকি গরু-গাধা?
বই নিয়ে, সামনে বসে আবােলতাবােল ভাবে যদি, তাহলে বাবা-মা বুঝতে পারবে তা? আর ফোকাস একবার নষ্ট হলে তা ফেরে কোনােদিন?
দশম হয়ে ক্লাস এইটে ওঠার পরই ক্লাস টিচার চারবার মাকে স্কুলে ডেকে পাঠিয়ে ভারী  ভারী জ্ঞান দিয়ে তাদের মেজাজটা আরও বিগড়ে দিল। ফলে বাড়ি গিয়ে সেই বয়সের ছেলের পিঠে না দিয়ে তার মুখে যা বলল  তারা,তাতে তার যন্ত্রণা বাড়ল বই কমল না।
এমনিতেই বয়ঃসন্ধিকাল ব্যাপারটা খুব গােলমেলে। না ছােট, না বড় এই সময়টায় মানুষ অনেকগুলি মানসিক, শরীরিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়! এ সময়ে অভিভাবকদের সামান্যতম ভুলেও বিশাল ক্রাইসিস হতে পারে বাচ্চার! লাট্টু সেরকম কিছু করল না, কিন্তু জেদের বশে পড়াশােনা একদম বন্ধ করে দিলো। প্রথমে বাবা-মা বুঝতে পারেনি সেটা। তার পর ক্রমশ সব বুঝে প্রথমে ধমকে, ভয় দেখিয়ে তারপর ইমােশনাল অত্যাচার করে, শেষে অনুনয় বিনয় করে যখন কিছুতেই তাকে বাগে আনতে পারল না, তখন কী রকম যেন একটা ভয় করতে শুরু করল তাদের ! মানুষের স্বভাবে খারাপ। মানসিকতা খারাপ। ছেলেমেয়েদের অ্যাচিভমেন্টের সব কৃতিত্ব তাদের আর ব্যার্থতার দায় সব ছেলেমেয়েদের।
লাট্টু আস্তে আস্তে খারাপ সংসর্গেও পড়তে শুরু করল। খানিকটা কৌতূহল খানিকটা রাগের বশে। নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেতে বয়ঃসন্ধি কালে তীব্র ইচ্ছা থাকেই। এক্ষেত্রে অবশ্য লাট্টুর কৈফিয়ত দেওয়ার যথেষ্ট যুক্তি ছিল। বিগড়ে
 যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তার বাবা-মা’র দায়ীত্বজ্ঞানহীন আচরণের কথাই সে সবসময় বলত। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের এটা একটা সমস্যা যে বাচ্চা বড় হওয়ার পরেও তারা সেই কড়া দাপুটে বাবা-মাই থাকতে চায় , বন্ধু আর হতে পারে না কিছুতেই। হয়তাে আর্থিক অভাব এবং অস্তিত্বের সংকট তার জন্যে খানিকটা দায়ী। অথচ এসময় আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের কারণে বাবা-মায়ের কাছে থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আশা করে বাচ্চারা। যখন ব্যাপারটা ঘটে না, তখন সব কিছু ওলােটপালােট হয়ে যায়। সামলানাে যায় না। ছেলের এ অবস্থা যখন নিজেরা বাগে আনতে পারল না তখন বন্ধুদের পরামর্শে একরকম বাধ্য হয়েই মনােবিদের পরামর্শ নেয়ার কথা ভাবল লাট্টুর বাবা-মা, লাট্ট প্রথমে তাে কিছুতেই রাজি নয়। সে কি পাগল নাকি যে পাগলের ডাক্তার দেখাতে হবে? তারপর বাবা-মা, এবং তাদের বন্ধুবান্ধবেরা খুব করে বােঝানােতে নিমরাজি হল সে। ডাক্তারবাবু সব দেখেশুনে লাট্টর আড়ালে বাবা-মাকে পরামর্শ দিলেন ছেলের প্রতি সদয়, স্নেহশীল, ও যত্নশীল হতে। এ-ও বলে দিলেন আসল চিকিৎসা কাউন্সেলিং। তবে এতে সারতে সময় লাগবে। পরস্পরের বন্ধু হতে না পারাই যত নষ্টের মূল এক কথায় পরিস্কার বলে দিলেন ডাক্তারবাবু। সামান্য একটা ভিটামিন ছ'মাসের জন্য খেতে দিলেন। সে যাত্রা লাট্টুর চিকিৎসা শুরু হল।
-'সত্যিই লাট্টুকে বেশি চাপ দেওয়া হয়ে যাচ্ছে!'—মাঝে মাঝেই মনে মনে ভাবত লাটুর বাবা কিন্তু মায়ের মুখের উপর সাহস করে সে কথা বলতে পারত না।মাঝে মাঝেই তার ছােটবেলার কথা মনে হয় লাট্টুর বাবার। তার মা অতি সাধারণ পড়াশােনা না করা গৃহবধূ ছিলেন। কোনােক্রমে বাংলায় নিজের নামটা সই করতে শিখেছিলেন, তা'ও বাবার চাপে পড়ে। বাবা ব্যবসার কাজে হিল্লিদিল্লি করে বেড়াতেন । মাকে একার হাতে সামলাতে হতো সবকিছু। পড়াশােনা বিশেষ করত না লাট্টুর । শুধু তার বাবা বহুদিন বাদে বাদে বাড়ি আসলে তার সামনে সে গভীর মনােযােগের সঙ্গে বই নিয়ে বসে পড়াশােনার ভান করত। বাবা নজরও দিতেন না, রেজাল্ট ভালাে হতো না। ফেল হতো না—এই পর্যন্ত। মায়ের ওসব দিকে নজর দেওয়ার সাধ্য ছিল না, কিন্তু কষ্ট পেতেন, মাঝে মধ্যে আড়ালে চোখের জল ফেলতেন। একদিন তা দেখে ফেলে তার ভীষণ মনখারাপ হয়েছিল। | এই চোখের জল’ নাকি বাবার কিছু না গ্রাহ্য করা—কিসে যে ক্লাস এইট থেকে লাট্টুর বাবার হঠাৎ চোখে পড়ার মতাে পরিবর্তন হয়েছিল তা সে এখন মনে করতে পারে না বটে তাবে তারপর সে বড় হওয়ার জন্য সেই যে দৌড় শুরু করল, সে দৌড় আর থামেনি।


কী হয় শৈশবকে হত্যা না করলে ? কি হয় গােটা জীবন ধরে দৌড়তে শুরু করার আগে কিছুদিনের জন্য শিশুকে হেসে খেলে কাটাতে দিলে?  লাট্টুর বাবা বােঝে, এবং সে জানে, মা-ও বােঝে সব। কিন্তু তাদের বােঝার কথা যদি লাট্টু বুঝে ফেলে তাহলে কী হবে? তখন সে ইঁদুরদৌড়ে পিছিয়ে পড়বে যে! বড় গােলমেলে আর অদ্ভুত যুগে জন্মেছে লাট্টু। বাবা-মা বোঝে কোনটা লাট্টুর প্রতি অন্যায় আর কোনটা নয়। তবু সচেতনভাবে অন্যয়টাই করে যেতে হয় তার প্রতি। আচ্ছা তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় যে এসব ব্যাপার স্যাপার ওভারকাম করে লাট্টু ঠিকঠাক দৌড়তে শুরু করল তার পর ঠিকঠাক মানুষও হয়ে গেল তখন কি সে তার ছােটবেলার স্মৃতির মাথায় রেখে তার উত্তরপুরুষের প্রতি আচরণে সহৃদয় হবে? নাকি নিষ্ঠুর হয়ে তাদের বারােটা বাজাবে? এ প্রশ্নর উত্তর খুব জটিল। দুটি বিষয়ই দেখা যায়। কী হবে আগে থেকে বলা কঠিন।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ হঠাৎ ভীষণ টেনশন হয়ে যেত লাট্টুর বাবার। তখন সে রাতেরবেলায় সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর সাততলা ফ্ল্যাটের ব্যালকনি দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত আর কী যেন সব ভাবত। মনে পড়ত তার ছােটবেলাকার কথা। কত আনন্দের ছিল সে সব দিন। ভাবে এখনকার কথা । কত জটিল হয়ে গেছে আজকের পৃথিবী! তখন খেলার মাঠ ছিল, গাছপালা ছিল, পুকুর ঘাট ছিল, পাখপাখালি ছিল। দুধ দেওয়া মাসি’, ফুল দেওয়া ‘পিসি', 'হারুর মা’ চাকরানি। সব যেন এক একটা রূপকথা চরিত্র। সে রামও নেই। সে অযােধ্যাও নেই! বিকেল ছটার সময়’ ‘পাগলা বানি’ শোনপাপড়ি'র ঝুড়ি গলায় ঝুলিয়ে ‘শাে...ন...পা...প...ড়ি’ বলে লম্বা করে টান দিলে   মন  চলে যেত সে দিকে! মনে আছে। লাট্টুর বাবা খায়নি কোনােদিন। সে ব্যাপারে তার ক্ষোভও নেই কোনাে, তবু এখনাে মনে হয় বােধকরি কি না জানি খেতে ছিল সেগুলাে! মনে আছে পয়লা বৈশাখ ধূমধাম করে লক্ষ্মী
গনেশ’ পুজো! বাবা প্রতিবছর ধূমধাম করে আয়ােজন করতেন পুজোর। একদম ভােরবেলা উঠে বাড়ির সামনেটা কলাগাছ, কামিনি ফুল আর পাতা দিয়ে সাজানাে হতো। বাড়িতে নিমকি, জিভেগজা, আঙুলগজা তৈরি হত। গােটা দিন ঘরে ব্যবসার পার্টনারদের যাতায়াত, খাওয়া দাওয়া হুল্লোড়। মনে আছে দুর্গাপুজোর ভােরে শিউলিতলা থেকে শিউলিফুল কুড়ােতে গিয়ে শুয়াপােকার রোঁয়া গায়ে লাগা! মনে আছে কালিপূজার পটকা ফাটানাে! মনে আছে পিকনিক্ বিষ্টুপুরের মেলা ছুতােনাতায় পড়াশােনা বন্ধ! কোথায় যে গেল সেসব দিনগুলাে!  লাট্টুর বাবা-মা ভাবে, তাদের কপালটাই এরকম। এখন যখন দীর্ঘ লড়াইয়ের পর একটু সুখ স্বাচ্ছন্দের মুখ দেখার কথা, তখন ছেলের এই অবস্থা। তাদের সুখে থাকতে দেবেনা বলেই হয়তাে ঠিক করেছেন ভগবান! তারা জানে
কেউ'ই সুখে নেই আর আজকাল। এক জীবনে সব পাওয়া হয় না, কোনাে না কোনাে ব্যাপারে অভাব বােধ রেখেই দেন তিনি। তার উপর আবার এই ভেড়ার পালে পা মেলানাে! ইঁদুর দৌড়ে শামিল হওয়া! সুখ গিয়েছে বনবাসে!


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments