জ্বলদর্চি

অন্ত্যেষ্টি-২/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/ সন্দীপ দত্ত

উপন্যাস।। অন্ত্যেষ্টি।। সন্দীপ দত্ত



কোথাও বেরোনোর আগে মুখে পান নেওয়াটা কাবেরীর বরাবরের অভ্যেস। বিশেষ করে ট্রেনে বা বাসে চাপবার সময় তো নিতেই হয়। ট্রেনে উঠলে শরীর দোলে আর বাসে উঠলে গা গুলিয়ে যায়। বয়েস যখন কম ছিল তাঁর,যানবাহনের ধোঁয়া নাকে লাগলেই আড়পাড় করত ভেতরটা। শাশুড়ি তাঁকে পান খাওয়া শেখান। কোনও সুপুরি খয়ের নয়,শুধু পানের পাতাটা মুখে রাখলেও দিব্যি যেতে পারেন অনেকটা পথ।
     আজ অনেকটা পথই যেতে হবে কাবেরীকে। সেই কলকাতা। সঙ্গে অবশ্য স্বামী অনুপম যাবেন। আর অনুপম যাওয়া মানেই গাড়িভাড়া। মানুষটা আজকাল আগের মতোন ভিড়ভাট্টা সহ্য করতে পারেন না। গত মাসে পঁচাত্তর পার করেছেন। শরীরে হাজাররকম রোগ। প্রেশার,সুগারের ওষুধ ছাড়াও চলে আরও অনেক ওষুধ। তবু অসমর্থ শরীর নিয়েও অনুপম আজ যাবেন। খবরটা শোনার পর থেকেই মনটা ভাল লাগছে না তাঁর। কতটুকুনিই বা বয়স চয়নের! পঞ্চাশ পেরিয়েছে কি পেরোয়নি। ভগবানের এ যে কী খেলা!
      খবরটা আজ সাতসকালে যখন প্রথম শোনেন অনুপম, মুহূর্তের জন্য চোখে অন্ধকার লেগেছিল। চয়ন কোমায় চলে গেছে! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কাবেরী তখনও বিছানায়। গতরাতে প্রতিবেশী মৃন্ময়বাবুর ছোট ছেলের বৌভাতের নিমন্ত্রণ ছিল বাড়ির সকলের। খাওয়াদাওয়া সেরে ফিরতে ফিরতে রাত হয়েছিল। শুতে শুতে প্রায় একটা। আজকাল অনুষ্ঠান বাড়িতে খুব একটা যান না অনুপম। খাওয়ার ব্যাপারে ডাক্তারের কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। মৃন্ময়বাবু তাঁর অফিসের কলিগ ছিলেন একসময়। তাই সকাতর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি তিনি। মুখে তেমন কিছু না দিলেও যেতে হয়েছে।  সবাই মিলেই গিয়েছিলেন। কাবেরী, তিনি,বৌমা বিতস্তা আর আট দশ বছরের নাতি আর্য।ছেলে সায়ন্তন বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে শিলিগুড়িতে। ওখানে ওর বেসরকারি ব্যাংকের চাকরি। মাসে এক থেকে দু'বার আসার সুযোগ পায়।
     অন্যদিন অনুপম মনিং ওয়াকে বেরোন পাঁচটার কিছু আগে পরে। আজ বেরোতে বেরোতে ঘড়ির কাঁটা ছ'টা পার হয়ে গিয়েছিল। তবু বেরোনো হল না। রেডি হয়ে দরজা খুলতে যাবেন,ফোনটা তখনই আসে। প্রথমে বিতস্তাই ধরেছিল। গলাটা ঠিকমতো বুঝতে পারেনি সে। তাই শ্বশুরমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দেয়।
     অনুপম ধরতেই ও প্রান্ত থেকে সুখেন বলল,"আমি চয়নদার শ্যালক সুখেন বলছি। চিনতে পরছেন তো দাদা?"
সুখেনকে খুব বেশি দেখা হয়নি জীবনে। হয়তো একবারই। চয়নের বিয়ের সময়। অনেক বছর আগে। কিন্তু সম্পর্কে যে চয়নের শ্যালক। ঋষভের মামা। তাই অস্থির হয়ে অনুপম জিগ্যেস করলেন,"হ্যাঁ সুখেন বলো। সবাই ভাল আছে তো? তোমাদের বাড়ির সবাই,চয়ন,বৈশাখী,ঋষভ,ঐশী?"
"আমাদের বাড়ির সবাই ভাল দাদা। চয়নদাই ভাল নেই।"
"ভাল নেই! মানে? কী হয়েছে চয়নের? তুমি এখন কোথা থেকে কথা বলছ?"

"গত পরশু রাত দুটোর সময় চয়নদাকে বেলভিউ নাসিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে। বাড়িতেই স্ট্রোক হয়। ওদের প্রতিবেশী তালুকদারবাবুই ভর্তি করেন। দিদি আমাকে ফোন করে কাল ভোরে। আমি কালই বেলা দশটা নাগাদ কলকাতায় এসে পোৌঁছে যাই। সেই থেকে দিদির পাশেই আছি। খুব আপসেট হয়ে গেছে দিদি। ভীষণ কান্নাকাটি করছে। কিছুতেই বোঝাতে পারছি না। গতকাল সন্ধে থেকে চয়নদার অবস্থা আরও খারাপ। রাত থেকে কোমায় চলে গেছে। ডাক্তার বাহাত্তর ঘন্টা সময় দিয়েছে। কী হবে,কিছু বোঝা যাচ্ছেনা। কোমায় চলে যাওয়ার কথাটা দিদি শুনেছে। বাহাত্তর ঘন্টার কথাটা বলতে পারিনি।" কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুখেন।
ধ্বস্ত অনুপম নিজেকে সামলে বললেন,"ঋষভ আর ঐশীকে খবর দেওয়া হয়েছে?"
"হ্যাঁ দাদা। খবর পেয়েই ঋষভ কাল রাত্রে পৌঁছে গেছে। ঐশীকে আমি সকালেই নিয়ে এসেছি আসার পথে। ও তো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। শুনলাম আর দিন পনেরো পর নাকি একটা পরীক্ষা। আপনারা কি একবার....."
"হ্যাঁ,হ্যাঁ,আমরা যাব। এ খবর শোনার পর কি ঘরে বসে থাকা যায়? খুব কষ্ট হচ্ছে সুখেন। কাবেরীকে কথাগুলো কেমন করে বলব,ভাবছি।"
"হ্যাঁ দাদা,আসুন। ছাড়ছি।"
     কথাগুলো প্রথম বৌমা বিতস্তাকেই বলতে হল অনুপমকে। শুনে বিতস্তার চোখও ছলছল করে। এ বাড়িতে সায়ন্তনের বউ হয়ে আসার পেছনে চয়নমামার অনেকখানিই হাত। সম্বন্ধটা একরকম চয়নমামার জন্যই হয়।
শ্বশুরমশাইকে সাহস দিল বিতস্তা। শাশুড়িকে আস্তে আস্তে বলল সব। শুনেই কেঁদে ফেললেন কাবেরী। তাঁর থেকে পনেরো বছরের ছোট ভাই চয়নকে একবার দেখার জন্য আকুল হয়ে উঠলেন। সবার ছোট। অয়ন,কাবেরী,কুন্তলা,চয়ন। গিরিধারী আর সরসীবালার সাজানো সংসারে চার ছেলেমেয়ে। স্মৃতি হামলে পড়ল কাবেরীর চোখে।
     বিতস্তা বলল,"আপনারা যান মা। মামাকে একবার দেখে আসুন। আজ আর আর্যকে স্কুলে পাঠাব না" 
     মনটা একেবারেই ভাল নেই কাবেরীর। বেরোনোর সময় পানটা নিতে তাই ভুলে যাচ্ছিলেন। অনুপমই শেষে মনে করিয়ে দিলেন।"পানটা মুখে নিয়েছ? তানাহলে তো রাস্তায় তোমার আবার গা গুলোবে।"

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments