পাতি মানুষের পাঁচালি::২
-------------------------------------
কপট মানুষ। অকপট মানুষ।
---------------------------------------
জন্মের পর থেকে শরীর সচল ও জ্ঞান থাকা ইস্তক মানুষ যত ঘটনার সাক্ষী হয় আর কত ঘটনা সে নিজে ঘটায় তা যদি সঙ্গে সঙ্গে লিখে রাখতে পারত এবং তার শতকরা দশ ভাগও যদি সাহিত্য রসে উত্তীর্ণ হতো, তাহলে সাহিত্যের ভান্ডার যে কত রঙ ও রসের সৃষ্টিতে ভরে উঠত তা বােধহয় বলে বােঝাতে হবে না। ভাগ্যিস সে রকম ঘটে না! মানুষ আর পাঁচটা পশুর মতাে অকপট নয়। সে ভীষণ ইমেজ সচেতন। মন যা ভাবে সব ক্ষেত্রে তা প্রকাশে তার আপত্তি থাকে। থাকাটাই স্বাভাবিক। আমার ধারণা, এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত এমন কোনাে আত্মজীবনী নেই যেখানে শতকরা একশাে ভাগ অকপট হতে পেরেছে জীবনের কারবারি। হওয়া যায় না। কারণ, সে যে কত অকপট বা বেপরােয়া এটা বােঝানাের জন্যও মানুষকে একাধিক মিথ্যাচার করতে হয়। সে মিথ্যের সঙ্গে বাস্তবের কোনাে যােগ নেই। অন্যে যে তার দিকে সৎ ও সফল মানুষ হিসেবে সপ্রশংস দৃষ্টিতে চাইবে এ কল্পনা মানুষ করেই । অথচ হতেই পারে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষটা আদৌ ততখানি সৎ নয়। এ দ্বিচারিতার কারণ বিশ্লেষণ করা আমার কম্ম নয়, কারণ আমি মনোবিদ নই । তাছাড়া আমার মূল্যায়ন যে পক্ষপাতহীন ও বাহুল্য বর্জিত হবে এরকম কোনাে নিশ্চয়তা আমি সাধারণ মানুষ হিসেবে দিতে অপারগ। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ নিজে তার নষ্টামি বােঝেনা । মনের গভীরে থাকলেও, তার আচরণ সমাজ ও অন্যান্য পরিচিত মানুষদের জানান দেয় তা। যখন বয়স কম ছিল তখন এ বিষয়টা আমাকে অবাক করত। যন্ত্রণা দিত। এখন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে শিখেছি কিসে কি হয়, ফলত কোনাে ঘটনা এখন আমাকে বিশেষ তাতায় না, পীড়া দেয় না। হতে পারে, হয়তাে বা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুভূতিগুলাে ভোঁতা হয়ে যায়, আবার এ'ও হতে পারে যে পরিণতির কারণে বহিঃপ্রকাশে সংযমী হয়ে বাঁচতে শেখে মানুষ। আমার বাবা কালের নিয়মেই আমার থেকে বয়সে বড়। এ ব্যাপারে তাঁর মতামত জানতে চেয়েছিলাম কিছুদিন আগে। বাবা ঘোলা স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিলেন। হয়তো এ হাসির যে অর্থ আমি করেছিলাম বাবা তেমন কিছু ভেবে হাসেননি । কিন্তু এ কথা নিশ্চিত ভাবে জানি যে, হাসির আসল মানে উদ্ধার করার জন্য যখন আমি বাবার বয়সে পৌঁছব তখন তার সত্যাসত্য যাচাইয়ের আর কোনাে উপায় থাকবে না।
তৃতীয় গ্রহের এ জীবজগৎ সবসময় কোনাে না কোনাে খেলার জন্য খ্যাত। তা চলে আমাদের সামনে বা অগােচরে। সবকিছুর হিসেব রাখি না আমরা। ইচ্ছে, উপায়, কোনােটাই নেই আমাদের। যুক্তিগ্রাহ্য কোনো কারণ নেই কিছু কিছু ঘটনা ঘটার। কিন্তু তবু তারা ঘটে।
জীবন তার চলার পথের বাধা, বিপত্তি কোনােকিছুকেই পরােয়া করে না। কারাে জন্য দাঁড়িয়েও থাকে না সে। দাঁড়িয়ে থাকা মানে মৃত্যু । অমরত্ব অলীক ভাবনা এ কথা মেনে নিলেও, কজনই বা সে ভাবনাকে স্বীকার করার সহনশীলতা দেখায়?
আমার জীবনপ্রবাহ এবং খ্যাতিমান মানুষদের জীবনপ্রবাহ বারবার মিলিয়ে অবাক হয়ে বারবার যেটা দেখেছি তাতে মনে হয়েছে যে, এমন কিছু অমিল তাে নেই দুইয়ের মাঝে, তবু তাঁরা তাঁরা, আর আমি আমি। বুঝতে চেয়ে মাঝে মাঝে গুলিয়ে গেছে সবকিছু তবু , নিজেকে মহাপুরুষ আর মহাপুরুষদের ছাপােষা ভাবতে পারিনি। ভাবনার গতিপথ বাধায় বাধায় পূর্ণ, একটা স্তরের পর কোথাও না কোথাও সে আটকে যায় ! যে ভাবনা শেষ করতে পারে না মানুষ তাকে অবাস্তব বা অলীক বলে আখ্যা দেয় সে। ছোটবেলায়, সঠিক কখন সে সময় মনে নেই এখন, দেখা দুজনের চরিত্রের কথা এখনো পরিস্কার মনে আছে আমার। তাদের একজন নিশিকান্ত মল্লিক। লােকে নিশা’ বলে চিনত তাকে। আরেকজন ‘খাঁদু’। যার পুরাে নাম আমি বহু চেষ্টাতেও উদ্ধার করতে পারিনি। নিশা'কে আমি প্রথম দেখি যখন, তখন তার বয়স চল্লিশও হতে পারে, ষাটও হতে পারে। কিছু মানুষের কাঠাম এমন হয় যে, কিছুতেই তাদের বয়স বোঝা যায়না। নিশার বাড়ি গৌরাঙ্গতলা। মাথা সবসময় টাক পড়ার হুমকি দিচ্ছে। আখের মতাে তীক্ষ্ণ শরীর। পাছা বলে কোনাে বস্তু নেই। পায়ে চটি, গায়ে জামা দেখিনি, বড়জোর কালেভদ্রে শীতকালে একটা স্যান্ডাে গেঞ্জি পরত সে। দাদা শশীর সঙ্গে দাওয়ায় বসে বসে হুঁকো টানত অবসরে। অবসর যে বিশেষ ছিল এমন নয়। মাঝে মধ্যে ,অথবা বলা ভালাে, প্রায় সবসময়ে দুই ভাইয়ের ডাক পড়ত শহরের এধার ওধার থেকে। পেশাটা অদ্ভুত। কেউ মারা গেলে মৃতদেহ বহনকারী খাটিয়ার সামনে সামনে শশীর গান ও খঞ্জনি বাদনের সাথে নিশা খোল বাদক হিসেবে চলত। শ্মশান যাত্রীদের ভাষায় ব্যাপারটাকে বলা হতো ধম্বল। বুড়াে হাবড়া মারা গেলে আয় কম, ছেলে ছােকরা গেলে বেশি। অর্থাৎ ক্লায়েন্টের চোখে যত জল, তাদের মুখে তত হাসি।
ছােটবেলা থেকে আমি কৌতুহলী, ফক্কর। তাকে এ পেশায় আসার কারণ জিজ্ঞাসা করাতে নিশা বলেছিল,'পেট যে কত বড়া বালাই খোকাবাবু, তা বড় হলে বুঝতে পারবা!’ ,এ হেন নিশার সুন্দরী তন্বী একটা বউ আর গােটা পাঁচেক সুস্থ সবল বাচ্চা ছিল। তাদের নিয়ে সে শীতকালে বেলা দুটো থেকে চারটে আর গরম কালে চারটে থেকে ছ'টা ‘চাতরা’র ধারে বসে ফুর্তিতে গল্প করত, আড্ডা মারত। ওই সময়টুকু তাকে হাজার ডেকে, দ্বিগুন পারিশ্রমিক দিয়েও পাওয়া যেত না। মৃত্যু যে মানুষের পেটের ভাত, তার মধ্যে এই এক ঝলক জীবন আমাকে অবাক করেছিল খুব। তখন চেষ্টা করে বুঝিনি, এখন চেষ্টা ছাড়াও বুঝি তার সঠিক কারণ। জাগতিক সমস্যায় জর্জরিত যে মানুষটাকে আমরা বাইরে থেকে দেখি, অনেক ক্ষেত্রে ভিতরে সে অন্য একটা মানুষ। একের সঙ্গে অন্যের বন্ধুত্ব বা শত্রুতা কোনােটাই নেই। একজন বাইরের আরেকজন ভেতরের সত্তা। কোনটাই মিথ্যে নয়। যে নিশা অতি যত্নে লালন করেছিল তার বউ বাচ্চাদের, তার মরার পর সে চার পাঁচদিন লাশ হয়ে পড়েছিল তার সাধের চাতরার ধারে, আর শেয়াল কুকুরের খাবার হয়েছিল । দেখে বুঝেছিলাম যে ক্ষুদ্র স্বার্থের বাইরে মানুষ কারো নয়। ফলত ওই পরিস্থিতিতে ছেলেমেয়েরা মিশে গেছিল জগতের ভিড়ে। বউ ভেগেছিল অন্যের সঙ্গে। সময়টা সত্তরের দশক শেষ দিকের। জায়গাটা বহরমপুরের খাগড়ার শেষপ্রান্তে প্রায় গ্রাম জাতীয় একটা জনপদ।
খাঁদুকে দেখি আরও বছর চারেক বাদে। স্বর্গধামের মুদ্রণি প্রেসের কাছাকাছি কাঁসাপট্টিতে। বয়স, ওর নিজের কথা অনুসারে, পঁয়ত্রিশ বছর। অপদার্থ ব্যর্থ মানুষ। ফুলাে শরীর, ঢুলাে চোখ। ফুলে থাকা সাদা অস্বাস্থ্যকর ফাটা ঠোঁট। পরণে শতচ্ছিন্ন জামাকাপড়। পশমের মতাে চুল। গায়ের আসল রং কী তা বােঝার সাধ্য নেই আজন্ম লালিত নােংরার কারণে। সে কালে কাঁসার বাসন ঝকঝকে করার জন্য ,খরখরে শক্ত বালি পাথরের বড়, লম্বালম্বি ভাবে ঘুরতে থাকা গোল চাকার পরিধির বরাবর আড়াআড়ি ভাবে বসিয়ে তাতে ঘষে তার উপরের স্তর তুলে ফেলা হতো। চাকাটা ঘুরত একটা পুলির মাধ্যমে। পুলির কেন্দ্রভাগে একটা দড়ি লাগানাে, সে দড়ি নাগারে টানতে আর ছাড়তে হতো একজনকে, যাতে চাকতিটা লাগাতার ঘােরে। পুরাে ব্যাপারটার স্থানীয় মহলে নাম ছিল, 'কাসা কোঁদা!’ মূর্খ খাঁদু তা অবশ্য জানত না। তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলত, ‘ওই কাসা পোঁদে না, কাসা পোঁদে ? ওই যে তানতে হয় ? (মানে টানতে হয়।), সেই আমি তা...নি!’ ‘টানি’ শব্দটা এভাবেই উচ্চারণ করত সে, যেন বিরাট গর্বের কাজ একটা, এবং তার উপরেই তার বাঁচা মরা নির্ভর করছে। গর্বের ব্যাপারটা অবশ্য আপেক্ষিক! কারও অল্পে আশ মেটে না আবার কেউ বাড়ির জন্য সামান্য একটা কাচের গ্লাস কিনলেও তৃপ্তিতে তার চোখ চকচক করে। খাঁদু সে যুগে গােটা দিন ‘তেনে’ বারােআনা পেত মালিকের কাছ থেকে। তার পর রাতের বেলা তাড়ি আর বিড়িতেই শেষ হয়ে যেত তা। তারপর গােপাল ঘাটের ধারে যে গোপাল জিউয়ের আখরা আছে, সেখানে থালা নিয়ে বসে থাকত। গােগ্রাসে আখরার ভােগ গিলে, তিন চার আঁজলা গঙ্গার জল খেয়ে রাতে যখন আখড়ার দাওয়ায় ঘুমােতে যেত সে, তখন ‘নিদ্রিত’ না ‘মৃত’ বােঝার উপায় থাকত না। আবার ভােরবেলায় উঠে চিতার আগুনে একটা বিড়ি ধরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কাঁসাপট্টিতে ফিরত। তার পর জুতে যেত জোয়ালে।
খাঁদু ‘যুগান্তর’ পড়ত। জিজ্ঞাসা করাতে একদিন তার জীবনের কথা বলেছিল। বাবা ছিলেন করিমপুরের অবস্থাপন্ন শিক্ষক। পড়াশােনার পরিবেশ বাড়িতে। দুই ভাই এক বােন। বাবা-মায়ের সংসার থেকে কবে, কেন কিভাবে দলছুট হয়ে সে এখানে এসে পড়েছিল সে গল্পও শুনেছিলাম। সেটা এক অন্য কাহিনি। অন্য কোনদিন বলা যাবে। তবে অবাক হয়েছিলাম সন্দেহ নেই। বাহ্যিক আবরণ, আভরণ, ধূসরতা, মলিনতাই যে মানুষের সব নয় একথা বােঝার বয়স হয়নি সে সময়, তাই একটু বেশিই বিস্মিত হয়েছিলাম সবকিছু জেনে বুঝে।
খাঁদুর মৃত্যু অবশ্য অত শােচনীয় হয়নি। মরার পর তার তিনকুলের কেউ না আসলেও বিয়াল্লিশ বছরের খাঁদুকে গােপাল ঘাট শ্মশানের মাতাল ডােমেরা অতি যত্নে পুড়িয়েছিল আপনার জন ভেবে।
মানুষ হয়ে জন্মানাের পর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত চরমতম সাফল্য যা হতে পারে তা হল নিজেকে ঠিকঠাক চেনা বা বিশ্লেষণ করা। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত ধারণা। এবং সাথে এটাও মনে হয় যে এ ব্যাপারে সাফল্যের মুখ এখনো পর্যন্ত কেউ দেখেনি। এর কারণ একাধিক। কখনো ইচ্ছে আছে উপায় নেই। ধরে নেওয়া যাক আমি মানুষটা মনের দিক থেকে খুব সৎ। যে কোনোরকম অনৈতিক কাজে আমার আপত্তি। আমার এ গুণের উপর ভিত্তি করে একটা বিশ্বাসযােগ্যতা গড়ে উঠল ধীরে ধীরে। কত লােক সমস্যায় আমার মতামতের উপর নির্ভর করে। প্রাথমিকভাবে ব্যাপারটা যুক্তির কারণে গলেও যতদিন যায় তত তার থেকে যুক্তি উধাও হয়ে মানসিক নির্ভরতাটা মুখ্য হয়ে ওঠে। এই নির্ভরতার ভরসায় যারা বেঁচে আছে তাদের কাছে আমি দেবতা বিশেষ। এই পরিস্থিতিতে অন্যের প্রত্যাশা পূরণের চাপে পড়ে আমি যদি তাদের কোনােদিন একথা বলি যে, আমিও একটা সাধারণ রক্ত মাংসের মানুষ, আমার মূল্যায়ন ও মতামতেও ভুল হতে পারে, তাতে যে বিশ্বাসভঙ্গের হতাশাটা তাদের মধ্যে তৈরি হয় তাদের, সে তো আমার পক্ষেও বিড়ম্বনার! তাদের চাপ লাঘবের বদলে তাদের ভরসার প্ৰতি অবমাননাও বটে তা! তার নৈতিক অধিকার তো আমার নেই! সুতরাং এ ক্ষেত্রে কপটতা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে মেলে ধরার সততায় জলাঞ্জলি দিতে হয় আমাকে। অর্থাৎ বৃহৎ জনগােষ্ঠী ও সমাজের লাভের স্বার্থে নিজে মনের দিক থেকে ফুরফুরে থাকার ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থকে বিসর্জন দিতে হয়। এদিক থেকে বিচার করলে এক ব্যাপারে আমি ব্যর্থ।
আবার অনেক ক্ষেত্রে উপায় থাকলেও ইচ্ছে থাকে না। যে যা পাওয়ার যােগ্য নয় কোনাে অজ্ঞাত কারণে তার সে অর্জন তাকে এত বেশি মহিমান্বিত করে তােলে যে সেই শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতির লাভের লােভ বেচারা কোনাে মতেই সংবরণ করতে পারে না। সাধারণত মানুষ নিজেকে সব সময় নিজের থেকে উন্নততর মানুষ হিসাবে দেখার স্বপ্ন দেখে। সে স্বপ্ন প্রকৃতপক্ষে তাকে উপরে না তুলে বেশি করে মানসিক অবক্ষয়ের দিকেই ঠেলে দেয়, এবং ব্যাপারটা বুঝেও তার বিশেষ কিছু করার থাকে না। এমনই মােহ স্বীকৃতির। এই আমার কথাটাই ধরা যাক না! আমি এখনও পর্যন্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না যে আমি মানুষটা আসলে কী বা কে। ছােট থেকে শুরু করে আজ অব্দি বহু শারীরিক মানসিক ও আত্মিক পরিবর্তন ঘটেছে আমার মধ্যে। তার মধ্য দিয়ে আমার মানুষ হিসাবে উত্তরণও যেমন হয়েছে, সেরকম কিছু ক্ষেত্রে অবতরণও ঘটেছে। নিজেকে ঠিকঠাক চেনার ব্যাপারে বিভ্রান্তিও তৈরি হয়েছে তার ফলে । একদম ছােটবেলায় যখন পারিপার্শ্ব সম্বন্ধে জ্ঞান হতে শুরু করেছে তখন আমি ছিলাম অতিমাত্রায় ঈশ্বর বিশ্বাসী। ব্যাপারটা হাস্যকর রকমের পাগলামির পর্যায়ে চলে গেছিল তখন, এ কথা বলা যায়। ইট, কাঠ, পাথর, পােড়ােবাড়ি, উইঢিবি সবকিছুর মধ্যেই জাগ্রত ঠাকুর দেবতার সন্ধান পেতাম সে সময়। সেগুলিতে মাথা ঠেকিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে মানুষের বিদ্রুপের খােরাক হতাম প্রতিদিন, প্ৰতি মুহূর্তে। এ ব্যাপারে চলেছিল কলেজে ঢােকার আগে পর্যন্ত। কলেজে ঢোকার পর আমি আবার হয়ে গেলাম ঘোরতর নাস্তিক। পৃথিবীর সব স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যেই তখন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের গন্ধ পাই । ধর্মাচারীদের পাপাচারী বলে মনে হয়। অতিমাত্রায় সাহসের অভাব আর ‘ভালােথাকা’-র পিছুটানের কারণে ভাগ্যিস সে সময় সামাগ্রিকভাবে নিজের জন্য ক্ষতিকর বা সমাজের জন্য হাস্যকর কিছু করে বসিনি! তার পর ধীরে ধীরে দিন গেল। বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবাস্তব আবেগ কমে যুক্তি বাড়ল। মনে হতে শুরু করল ধর্মাচার, ভ্রষ্টাচার, আস্তিকতা, নাস্তিকতা সবই আসলে এক একটা মুদ্রার এ পিঠ আর ও পিঠ। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একান্ত ভাবেই তাদের ব্যক্তিগত যারা যে পথের অনুসারী।
আরো একটা বিষয় ছিল স্বজনের প্রতি টান ও কর্তব্যের বিষয়টা। মনে আছে ক্লাস টেন পর্যন্ত ভীষণভাবে বাবা মায়ের বাধ্য ছিলাম আমি। কিছুটা বয়ঃসন্ধির শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের কারণে, কিছুটা বাইরের বা নিষিদ্ধতার প্রতি টানে এর পর অবাধ্যতা অভব্যতা শুরু হয় তাঁদের প্রতি। সে সময়টা আমার প্ৰতি তাঁদের দুশ্চিন্তাকে বিদ্রুপ করে, স্নেহকে অবজ্ঞা করে, এক বীভৎস আনন্দ পেতাম। ঘরের থেকে বাইরেটা আপন হয়েছিল সে সময়। কতবার আমার আচরণে ব্যথিত বাবা-মাকে দুঃখিত, বিচলিত হতে দেখেছি, কিন্তু গ্রাহ্য করিনি। এ দশা বহুদিন ছিল। ধীরে ধীরে তা কাটে গ্র্যাজুয়েশনের পর। তারপর সময়ের প্রভাবে ও প্রবাহে তাঁদের বয়স বেড়েছে, আমার তাঁদের প্রতি ভালােবাসা স্নেহে পরিণত হয়েছে। জীবনে তাঁদের মূল্য বুঝতে শিখেছি। মনে আছে, পরবর্তীতে বয়সের কারণে আমার ভাই যখন ঠিক আমার মতাে বিশ্রী ব্যবহার করত বাবা-মা’র সঙ্গে, আমার খুব কষ্ট হতো। বােঝাতে গিয়ে পিছিয়ে আসতাম আঘাত পাওয়ার ভয়ে। নিজেকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়াস-ই তা ছিল হয়তাে বা! এখন অবশ্য মাঝে মাঝে এও মনে হয় বলেই বা কী হতো? মানুষ কি আর বােঝালে বােঝে? এ তাে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাওয়া অনুভবের বিষয়।
জীবনের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কত বাঁক, কত চড়াই উৎরাইই তাে পেড়োলাম! কিন্ত তবু মাঝে মাঝে কালকের আমি আর আজকের আমিকে কিছুতেই মেলাতে পারি না। ভবিষ্যতের ‘আমি’র জন্য কী অপেক্ষা করে আছে সেটা ভাবতেই মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করে! মনে হয় এই যে দ্বিচারিতার প্রবাহ, এ কি সার্বজনীন? বিশ্বজনীন? আমার এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতাে অকপট মানুষ কোথায় খুঁজে পাব আমি?
অথচ আমরা জীব হিসেবে সর্বােৎকৃষ্ট! আমরা উন্নততম এবং উন্নতিকামী। এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়াও বেশ কঠিন যে মনুষ্যেতর প্রাণী যারা তাদের মধ্যে এমন কেন ঘটে না! কেউ কি দেখেছে প্রভুভক্ত কুকুর কোনােদিন অহেতুক আক্রমণ করে বসল তার প্রভুকে? এরকম ঘটলে আমরা বলি ‘কুকুরটা খেপে গেছে!’ কই! মানুষের ক্ষেত্রে তা তো বলি না!
এমন তো কতই ঘটে, যে যাকে ছাড়া আজ জীবন চলে না, কাল তাকে ভুলে দিব্যি চলে যায়। আজ যাকে চোখে হারাই, কাল তাকে মেরে তাড়াই। অথচ আমাদের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেনি। অতি আধুনিকতা ও লাগাম ছাড়া স্বাধীনতাও আমাদের পরস্পরবিরােধী আচরণের কারণ হতে পারে। কুকুর জাতীয় প্রাণীদের যৌন মিলন এবং সন্তান ধারণের সময় বছরে একবার। মানুষের এরকম কিছু নেই। কেন এমন হয় তা জানা নেই।
আমরা অনায়াসে গরুর দুধ দুয়ে নিয়ে আমাদের শিশুকে খাওয়াই। গরু আপত্তি করে না, করলেও আমরা শুনতাম না, কারণ আমরা বুদ্ধিমান। আমরা কেউ তৃণভােজী, কেউ মাংসাশী, কেউ মিতাহারী, কেউ ভােজনবিলাসী, কেউ শান্ত, কেউ চণ্ডাল, কেউ সৎ, কেউ অসৎ। আবার কোনাে কোনাে সময় আমরা এই আলাে, এই অন্ধকার। তৃণভােজী বাঘ, মাংসাশি ছাগল এসব দেখা যায় না। একই রকম পরিস্থিতিতে চতুষ্পদ ও শ্বাপদের আচরণ আন্দাজ করা যায়, কিন্তু মানুষের ?
ক্ষুধার্ত সিংহ শিকারের পিছনে দৌড়ে তাকে ধরতে পারলে কেবল আদর করে তাকে ছেড়ে দেয়, এরকম কি ঘটতে পারে ? কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে পারে। এ আমি বহুবার বহু ভাবে দেখেছি।
এই যে এক একজন মানুষের এক এক পরিস্থিতিতে এক এক রকম সত্তা এর কারণ কি জিনগত নাকি পরিবেশগত? কে উত্তর দেবে এ জটিল প্রশ্নের ?
কতকিছুই তাে পৃথিবীতে আবিস্কার হয়ে গেল মানুষের জন্মের পর থেকে। আমরা প্লেনে চড়ছি, মেশিন চালিয়ে গান শুনছি, ভ্যাপসা গরমে শীতের আমেজ পেতে এ.সি. চালাচ্ছি, দূরে বসা বন্ধুর সঙ্গে লাইভ চ্যাট করছি, কাগজ কলম ছাড়া বড় বড় অঙ্ক কষে ফেলছি, আর এ কারণটা জেনে উঠতে পারলাম না এখনো ?
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
0 Comments