উপন্যাস।। অন্ত্যেষ্টি।। সন্দীপ দত্ত
৫
মিস্টার শোভন তালুকদারের সাথে কথা বলে লোকটিকে খুব মিশুকে মনে হল অয়নের। মিশুকে কিন্তু টাকাঅলা। চাপা একটা দাম্ভিকতা যেটা রয়েছে,তা অয়নের কাছে তেমনভাবে প্রকাশ করলেন না। চয়ন কথায় কথায় দু'একবার তালুকদার সম্পর্কে অয়নের কাছে গল্প করে কিছু বলে থাকবে হয়তো। তবে লোকটি নিজেই নিজের সম্পর্কে অনেক কথা বললেন আজ। বললেন,গত ষাট বছর ধরে তাঁরা কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। আগে এজেসি বোস রোডের কাছে থাকতেন। তখন তাঁর বাবা বেঁচে। ওখানেই পৈত্রিক বাড়িটা ছিল। যেহেতু একমাত্র ছেলে,তাই বাবার মৃত্যুর পর পৈত্রিক বাড়ি বিক্রি করে আহিরীটোলার একটা তৈরি বাড়ি কেনেন বছর পনেরো আগে। ভদ্রলোক বলছিলেন,"আমিও বাড়ি কিনলাম আর ছ মাসের মধ্যে চয়নদাও এল। সেই থেকে আমরা প্রতিবেশী। আমরা হয়তো সমবয়েসিই হব।তবু নাম ধরে ডাকতে আমার ভাল লাগেনা। বিশেষ করে ওর ক্ষেত্রে তো নয়ই। মানুষটা খুব সমঝদার। পরোপকারী। অন্যের কথা ভীষণ ভাবে। ও-ও আমাকে নাম ধরে ডাকেনি কখনও। বরাবর শোভনদা। খুব ভাল মানুষ। আপনি ভীষণ লাকী বড়দা অমন একটা ভাই পেয়ে। আমি শুধু একটা জিনিসই বুঝতে পারছিনা,ওরকম মানুষের হঠাৎ এমন হল কী করে? নিয়মিত শরীরচর্চা, নিয়ম করে খাওয়াদাওয়া,আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিনা চয়নদা হাসপাতালে। কোমায় চলে গেছে।"
রাজীব,রাকেশ তাদের বউদের নিয়ে হাত কয়েক তফাতে দাঁড়িয়ে আছে এখন। অয়ন দেখতে পেলেন,সেখানে সুমিত্রাও বৈশাখী আর ঐশীর মাঝে। রয়েছে সজল ও সুখেনও। অনুপম আর শশাঙ্ক কাবেরী,কুন্তলাকে নিয়ে চয়নকে ভেতর থেকে একবার দেখে এসে সামনাসামনি কোথাও। অয়নের চোখ বরাবর খানিকটা দূরে ঋষভ দাঁড়িয়ে আছে পিনাকের মুখোমুখি। বিকেলের আলো এবার নিভে যাবে। তারই একটা প্রস্তুতি শুরু করেছে প্রকৃতি। সৃর্যের গা থেকে আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে সোনালি অলংকার।
হঠাৎ অয়নের কানে এল,রাজীবের বউ পাপিয়া গলা তুলে ঋষভকে বলছে,"তোদের গাড়িটা কোথায় রে,ঋষভ? দেখতে পাচ্ছি না।"
ঋষভ কিছু বলার আগেই পিনাক বলল,"এখানে গাড়ি রাখার পারমিশন নেই কাকিমা। পার্কিং জোনে রাখতে হয়।" বলেই ঋষভকে নিচু স্বরে বলল,"তোর মেজদাদুর বউমা,না? তোদের দেশটা কোথায় যেন ঋষভ?"
"পুরুলিয়া। গেছিস কখনও?" ঋষভ বলে।
"নারে,ওদিকটা যাওয়া হয়নি। মুকুটমণিপুর গিয়েছিলাম একবার। কলেজ ট্যুর থেকে একবার সব ফাইনাল হয়ে গিয়েছিল অযোধ্যা যাওয়ার জন্য। হলনা। হঠাৎ করেই সব ক্যান্সিল। .....ঋষভ প্লিজ,থম মেরে থাকিস না। একটু স্বাভাবিক থাক। আমরা তো আছি।"
সত্যিই ঋষভ চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিল। বাহাত্তর ঘন্টা পার হতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি। রাতটুকু। ডাক্তার এখনও তেমন কিছু বলছে না। কোমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেনা বাবা? চিকিৎসায় একটুও কি সাড়া দিচ্ছে না! কেন এমন হল বাবার?
বেলভিউ হাসপাতালটাকে টিভির পর্দায় অনেকবার ফুটে উঠতে দেখেছে কাঞ্চনা। এখানে নাকি অনেক বড় বড় লোকের চিকিৎসা হয়। যারা দশ জনের একজন। যাদের ছবি খবরের কাগজে বেরোয়। ওর চোখদুটো তাই এদিক ওদিক ঘুরছিল। কিন্তু আজ তেমন কাউকে চোখে পড়ল না,যাদের পরিবার পরিজনের পেছনে মিডিয়া ছুটবে। শুধু মাথায় গান্ধী টুপি পরা হোমড়াচোমড়া এক লোককে দেখল গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত হাসপাতালের ভেতর ঢুকে যেতে,যার সাথে দুজন মাত্র লোক। কোনো মিডিয়া নেই।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন তালুকদার। ঠোঁটে নেওয়ার আগে অয়নের দিকে তাকালেন। "এসব আপনার চলে নাকি দাদা?"
অয়ন আমতা আমতা করলেন। "না মানে,এসব আমি ঠিক.....সারাদিনে চার পাঁচটা বিড়ি খাই।"
অয়নের কথা শুনে হাসলেন শোভনবাবু। "ধূমপান তাহলে করেন। নিন,আজ একটা সিগারেট খান।" একটা সিগারেট অয়নের দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। "কী হল,ধরুন!" তারপর বিদেশি দামি লাইটারটা এগিয়ে দিলেন।
"তখন রাত প্রায় দুটো। আমার মিসেস আর আমি ছিলাম দোতলায়। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ স্বপ্নের মতো ছেঁড়া ছেঁড়া কানে এল,নিচে কেউ যেন ডোরবেল বাজাচ্ছে। ছেলে নিচেই থাকে। ঐ সময় বোধহয় বাথরুমে গিয়েছিল। তাই তাড়াতাড়ি নেমে আমিই দরজা খুললাম। খুলতেই অবাক। চয়নদার স্ত্রী। কান্নাকাটি করতে করতেই ছুটে এসেছেন। ওনার মুখ থেকে সব শুলাম। চয়নদার তখন অলরেডী দু'বার বমি হয়ে গিয়ে সেন্সলেস। গ্যারেজ থেকে তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করল ছেলে। বাড়িতে তালাচাবি দিয়ে অচেতন চয়নদার শরীরটা নিয়ে সবাই উঠলাম গাড়িতে। আমার স্ত্রী চয়নদার মিসেসকে ধরে বসল। খুব কাঁদছিলেন বউদি। গাড়ি ছেলে চালিয়ে নিয়ে গেল। আমি চয়নদাকে সযত্নে ধরে বসে রইলাম। বেলভিউতে আমার দু' চারজন ডাক্তার বন্ধু রয়েছে। তাই এখানেই এলাম।" কথাগুলো বললেন তালুকদার। প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটা খুব সাবধানে এমন করে ফেললেন যাতে কেউ টের না পায়। কথা বলতে বলতে এটা যে হাসপাতাল চত্বর,ভুলে গিয়েছিলেন। অয়নকেও বললেন,সাবধান হতে।
"একটা কথা আপনাকে জিগ্যেস করছি,কিছু মনে করবেন না তো?" শোভন বললেন।
"কী ব্যাপারে?"
"কথাটা আপনাকে জিগ্যেস করা শোভনীয় হবে না,তাও.....। আসলে চয়নদার স্ত্রীর কাছেই কথাটা জানতে চেয়েছিলাম। কিন্ত ওনার কাছ থেকে তেমন কোনও উত্তর পাইনি। তাই ভাবলাম আপনি যদি কিছু জানেন।.....আচ্ছা,চয়নদা কি কোথাও লোন টোন করেছিলেন?"
"লোন!" অবাক হলেন অয়ন। "এসব ব্যাপারে আমি কী জানি বলুন। দেশে থাকি। কোনওদিন চয়ন ঋণসংক্রান্ত কিছু বলেনি আমায়।"
"আসলে ডক্টর রাঠোর বলছিলেন,অতিরিক্ত চাপ থেকে এইধরনের স্ট্রোকগুলো হয়।একেবারে ব্রেনে গিয়ে ধাক্কা মারে।" বললেন তালুকদার।
সন্ধে ছ'টার দিকে দেশ থেকে যারা এসেছিল,সবাই চলে গেল। চলে গেলেন অনুপম, কাবেরী, শশাঙ্ক, কুন্তলাও। সুমিত্রা,অয়ন কেউই রইলেন না। থাকল শুধু সুখেন। বোনের আজ বিপদ। ছেড়ে চলে যেতে আর যে কেউ পারুক,সে পারবেনা।
রাত দশটার দিকে বৈশাখী আর ঐশীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল। যেতে কি চায়! সুখেন আর ঋষভ থাকল হাসপাতালে। রাত এগারোটা পর্যন্তও ডাক্তার আশ্বাস দিলেন।
ভোর পাঁচটা কুড়িতে মারা গেল বাহান্ন বছরের চয়ন। ঋষভ আর ঐশীর বাবা। বৈশাখীর স্বামী।
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
0 Comments