জ্বলদর্চি

পাতি মানুষের পাঁচালি-১০/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়


পাতি মানুষের পাঁচালি::১০
---------------------------------------
সম্পর্ক
---------------
মানুষের যা আছে, সে বস্তুটা সাধারণ । সে তাে সবার কাছেই যাকে! আর যা নেই, তা যত তুচ্ছই হােক না কেন,  মহার্ঘ বস্তু। যে ভাবেই হােক, তা পেতে হবে। আবার ধরা যাক প্রচুর চেষ্টা চরিত্র করে তা পাওয়া গেল। কিছুদিন কাটতে না কাটতেই তার মূল্য মহার্ঘ থেকে শূন্যতে নেমে এল আবার। তখন আবার শুরু অন্য একটা বিষয় নিয়ে ঝাঁপ। অর্থহীন বিষয় হলেও অসুবিধা নেই। জীবনে উত্তেজনা চাই লাগাতার।
মানুষের এ এক অদ্ভুত বিলাসিতা। ব্যাপারটা কেবলমাত্র বিষয় সম্পত্তি টাকাকড়ির ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য নয়। যে মানুষ অন্য মানুষের সঙ্গে  দূরত্ব বজায় রেখে চলে সে অতি সাধারণ হলেও, তার প্ৰতি মানুষের দুর্নিবার আকর্ষণ। অথচ কোনো মানুষ বিদগ্ধ পণ্ডিত হলেও, অন্যের  সঙ্গে মেলামেশা করলে তার কোনো মূল্য নেই। 
এ আবর্তে মানুষের ঘুরপাক খাওয়া ছাড়া কোনাে গতি নেই। যেদিন থেকে মানুষ নিজেকে অতি বুদ্ধিমান ভেবে অতি গর্দভের মতাে নিজের জীবন চালাতে শিখেছে সেদিন থেকেই,  মানবিক মূল্যবোধের নিক্তিতে তার অবনতির শুরু। দেবর্ষি এবং দেবশ্রীর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই, একটু গভীরে যেতে হবে পুরােটা বুঝতে গেলে। এমনিতে দেব আর দেবীর দাম্পত্য জীবনে কোনাে সমস্যা ছিল না। দুজনেই পড়াশােনায় ভালাে ছেলেবেলা থেকে। দুই পরিমণ্ডলে দুই আর্থসামাজিক পরিকাঠামােতে মানুষ। দেবর্ষির বাবা শিবপুরের একটা কলেজের কেমিস্ট্রির প্রফেসর। ছাত্রদরদী জনপ্রিয়। মা হাইস্কুল টিচার। দেবর্ষি এক মাত্র সন্তান তাঁর। দেবশ্রীর বাবা কেন্দ্র সরকারি কর্মচারী। মা শিক্ষিতা গৃহবধূ। থাকেন দুর্গাপুরের বেনাচিতিতে। দেবশ্রীও তাদের একমাত্র সন্তান। দেবর্ষি শান্ত লাজুক স্বভাবের আর দেবশ্রী টমবয় গােছের। মানুষ হিসাবে দুজনেই সাদা। বাবা-মায়ের প্রতি দুজনেরই সমান টান ও ভালােবাসা। দুজনেই প্রাকবিবাহ সম্পর্কে বিশ্বাস করে না। দুজনেরই ফোকাস পড়াশােনা করে মানুষ হয়ে বাবা-মায়ের সব রকম ভার লাঘব করে তাদের শান্তি দেওয়া। ঘটনাক্রমে দুজনেই এন্ট্রাস পাশ করে আই.আই.টি খড়গপুরে ভরতি হল। আই.আই.টি সে সময় ছাত্র রাজনীতি বর্জিত ছিল। সুতরাং সেদিক থেকে কোনাে অসুবিধে নেই। শুধু পড়াশােনা করা যাদের ইচ্ছে, স্বচ্ছন্দে তারা তা-ই করতে পারত। ক্লাসের ভালাে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পড়াশােনা নিয়ে একটা নীরব রেষারেষি থাকে। ওদের দুজনের মধ্যে তা ছিল। মাঝে মাঝে একে অপরকে টেক্কা দেয়। এ ভাবে খেলা খুব জমে উঠল মানসিক স্তরে।
একটা ব্যাপারে দুজনের খুব মিল ছিল। দুজনেই খুব রুচিশীল এবং সংস্কৃতি মনস্ক। সুতরাং ব্যক্তিগত রেষারেষির কোনাে প্রশ্ন ছিল না। বরং দুজনে দুজনের প্রতি একটা টান অনুভব করত প্রথম থেকেই। পরস্পরকে দেখলে ভালাে লাগে, কথা বললে রােমাঞ্চ হয়। দু একদিন দেখা না হলে মনখারাপ হয়। এতে অবশ্য কেউ-ই বিশেষ অবাক হয়নি তাদের দুজনের। যেন এরকমই হওয়ার কথা ছিল। এরকম করতে করতে দুজনের মধ্যে একটা প্রেমের সম্পর্ক গঠে উঠল ধীরে ধীরে। সাধারণ প্রেম নয় অবশ্য। দুজনকে পার্ক, সিনেমাহল, মেলা, মল এসব জায়গায় দেখা যেত না। ব্যাপারটা ছিল একেবারেই মানসিক স্তরে। দুই পরিবার মনের দিক থেকে খুবই প্রগতিশীল। সুতরাং সম্পর্কের জানাজানি হওয়ার পর দুই পরিবারের মধ্যে কোনাে রকম কাদা ছােঁড়াছুঁড়ি হয়নি। আজকের এই তথাকথিত উন্নত মানসিকতার যুগেও মানুষ তাদের ছােট ছােট হীনতাগুলিকে বিসর্জন দিতে পারে না। আজো জাতের নামে বজ্জাতি হয়। ছােট্ট কারণে ভাইয়ে ভাইয়ে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়। ছেলে বাবাকে খুন করে। ভালােবাসার বিয়ে যৌতুকের খপ্পরে পড়ে ভেস্তে যায়। সেদিক থেকে ব্যতিক্রম এই দুটি পরিবার একমত হয়ে তাদের ছেলেমেয়ের রেজিস্ট্রিটা সমাধা করে প্রতিবেশী দের সরস আলােচনা ও টিপ্পনি এক কথায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বিয়ে হয়েছিল তার থেকে আরও ছ'বছর পর। ততদিনে তাদের পাশ করার পর ক্যাম্পাসিং হয়ে গেছে। একটা করে জুনিয়ার অ্যাপ্রেনটিসশিপ করে চাকরি ছেড়ে এম.টেক ভরতি হয়ে পাশ করাও হয়ে গেছে। দুজনে আলাদা দুটো আইটি কোম্পানিতে  পদাধিকারী।
সে সময় দুজনের বয়স তিরিশের কোঠায়। সুতরাং সময় নষ্ট করার উপায় ছিল না বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে। এক সন্তানের পক্ষপাতি ছিল না তারা। তাতে করে নাকি একা একা বড় হতে হয় বাচ্চাদের। মানসিক বিকাশ ভালাে হয় না।
পিঠোপিঠি দু’জন থাকলে একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে, ঝগড়াঝাটি করে বড় হয়ে যায়। বাবা-মায়ের চাপ থাকেনা।
 পরিকল্পনা মোতাবেক দু বছরের মধ্যে যমজ বাচ্চা রবি ও শশি জন্মে তাদের বাড়িতে একেবারে চাঁদের হাট বসিয়ে দিল। তারা বড় হয়ে উঠতে থাকল নিজেদের মতাে করে। মেয়ে শশীর প্রকৃতি বাবার মতাে। ছেলে রবির মায়ের মতাে। কাজের অবসরে দুজনের দিকে তাকিয়ে তাদের আদর করে সুন্দর সময় কেটে যেত দুজনের। 
দুজনের বয়স  তখন  চল্লিশ। ছেলেমেয়ে দুজনেই ক্লাস থ্রিতে পড়ে বড় স্কুলে। সেই সময় তাদের দাম্পত্য জীবনে ছন্দপতন শুরু হয় প্রথমবার, যদিও আবহটা শুরু হয়েছিল আরও বছর তিনেক আগে। সম্ভবত সম্পর্কে মলিনতা আসার পক্ষে এটাই সব থেকে গোলমেলে সময়। পরস্পরের সম্বন্ধে ভালাে, মন্দ সবকিছু জানা হয়ে গেছে। একে অপরের সামনে একদম খােলা খাতা। বাচ্চারা হাত-পা গজিয়ে বড় হওয়ায় নিজেদের দিকে একটু তাকানাের সময় পাওয়া গেছে সবেমাত্র। ঠিক এই সময় খােলা জানালা দিয়ে মুক্ত হাওয়া বাতাস ঢােকে অনেকের সংসারে। পরকীয়া প্রেমের আবহ তৈরি হয়। সে এক তীব্র ভালােলাগার বিষয়। কথায় বলে পুরুষ মানুষ বহুগামী, সে এক নারীতে সন্তুষ্ট নয়। বিশেষ করে মধ্যবয়সে যখন বিধি নিষেধের আগলটা অনেকটাই আলগা হয়ে গেছে। | দেবর্ষির পি.এ মধুপর্ণা তার থেকে বয়সে দশ বছরের ছােট। বিবাহিত কিন্তু ডিভাের্সি। দশবছরের বাচ্চাকে নিয়ে সন্তোষপুরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে। সঙ্গে বিধবা বৃদ্ধা মা। তিনি সংসার ও বাচ্চা দেখাশােনা করেন। অফিসে আসার পর অঢেল সময় হাতে। দেবর্ষি বিশেষ কাজও দেয় না তাকে, বেশিটা নিজেই করে। মধ্যবয়স্ক পুরুষমানুষদের সৌন্দর্যর আকর্ষণ  অন্তঃসারশূন্য সাধারণ মহিলাদের কাছে সবসময় বেশি। বিশেষ করে সে পুরুষ মানুষ যদি স্বচ্ছল হয়। দেবর্ষিকে পছন্দ না হওয়ার কোনাে কারণ নেই সেদিক থেকে। মধুপর্ণা সাধারণ মেয়ে নয়। ফলে সেটা মধুপর্ণার কাছে বিবেচ্য না হলেও দেবর্ষির ভালোমানুষি, সৌজন্যবোধ ও  ভদ্রতার কারণে মধুপর্ণার দুর্বলতা তৈরি হল দেবর্ষির প্রতি। প্রথমে দেবর্ষি বােঝেনি ব্যাপারটা। বিভিন্ন অছিলায় মধুপর্ণার ঘনঘন তার ঘরে আসার মধ্যে কোনাে রকম গন্ধ পায়নি সে। পরে যখন বুঝল তখন  সে খুব অবাক হয়ে দেখল ভীষণ এক ভালােলাগা খেলে যাচ্ছে তার মধ্যেও। বুঝল এরকম একটা সম্পর্ক বহুদিন থেকেই চাইছিল সে। সুতরাং মধুপর্ণার আমন্ত্রণে এক কথায় সায় দিয়ে সে জড়িয়ে পড়ল এক মানসিক সম্পর্কে। কোথায় পড়ে রইল সংস্কার আর নিয়মানুবর্তিতার বাঁধুনি।
প্রেমের মানে আগে যে ভাবে করত দেবর্ষি, এখনো সেভাবে করে । আগে মন প্রাধান্য পেত তার সম্পর্কের। এখনো তাই। চোখের দৃষ্টিতে কথা হয় দুজনের। পরস্পর নীরবে পাশাপাশি বসে সময় কাটাতে ভালোবাসে।
কিছুদিন পর থেকেই দেবশ্রী কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিল। দেবর্ষি দেরি করে বাড়ি আসে। তার কথা মন দিয়ে শােনে না। বহুদিন হল, নিরামিষ একটা ঘনিষ্ঠতাও করে না তার সাথে। প্রেমের কথা বলা তাে অনেক দূরের ব্যাপার। আগে তার রাগ করাকে এনজয় করত দেবর্ষি এখন পাল্টা এবং দ্বিগুন রাগ করে। ছেলেগুলাে বিরক্ত করলে মেজাজ হারিয়ে দু’ঘা দিয়ে দেয়। অফিস থেকে ফিরতে দেরি করে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করে। ব্যাপারটা আর একটু বিশদে জানার জন্য দেবশ্রী এক প্রাইভেট ডিটেকটিভ নিযােগ করল এবং একমাসের মধ্যে দেবর্ষির সম্পর্কে সবরকম তথ্য চলে এল দেবশ্রীর কাছে। | আগে হলে অবাক হত দেবশ্রী। একটা বয়সের পর কোনাে পরিস্থিতিতেই অবাক হয় না মানুষ। ভেঙে পড়ে না এ নিয়ে । সুতরাং সে বেশি আচরণে বেশি হেলদোল দেখাল না, মনের ভিতরে যাই ঘটে যাক না কেন! আরো একটা কারণ ছিল অবশ্য। জীবনের গতনুগতিকতা কাটাতে ততদিনে অফিস কলিগ দীপাঞ্জনের সঙ্গে তার একটা সম্পর্কের রসায়ন তৈরি হয়েছে। এবং তা নিয়ে মুখরােচক চর্চাও শুরু হয়েছে অফিস চত্ত্বরে। দেবশ্রীও একেবারে ফিজিক্যাল নয়। তার জীবনদর্শনে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি তখনও পর্যন্ত। তখনও তার কাছে প্রেম মানে পরস্পরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, বর্ষার দিনে হাতে হাত রেখে ঘরে বসে থাকা, দেখা না হলে মনখারাপ হওয়া ইত্যাদি ।
সেদিক থেকে দেখলে বেশ বুঝদারই বলতে হবে দীপাঞ্জনকে , কারণ সেও কখনো দেবশ্রীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করেনি। বরং তার মানসিক টানাপােড়েনের সময়  লাগাতার তার পাশে থেকে নৈতিক সমর্থন জুগিয়ে গেছে। এতে ফল ভালাে হয়েছে অবশ্য। তাদের সম্পর্ক শক্ত বিশ্বাসের ভিতের উপর দাঁড়িয়েছে ক্রমশ, কারণ সম্পর্ক টিকে থাকার প্রাথমিক শর্ত হল পারস্পরিক বিশ্বাস, তার থেকে আস্থা, আস্থার থেকে ভরসা এবং শেষে ভালােবাসা। দৈহিক আকর্ষণ, সম্ভোগ এগুলো ক্ষণস্থায়ী বস্তু মাত্র। আজকের রােমাঞ্চ কালকে ফিকে হতে হতে বিস্বাদ ও তেঁতো হয়ে যায় ক্রমশ। দীপাঞ্জনের সঙ্গে ঘনিষ্টতার কারণে দেবর্ষি যে দেবশ্রীর জীবনে অতীত ছায়া হয়ে গেছিল এরকম মােটেই নয়। বরং উভয়ের উভয়কে নিয়ে ছিল গভীর উৎকণ্ঠা এবং তীব্র মানসিক যন্ত্রণা ও অপরাধবােধ।
মানুষের জীবনে ও স্ববিরােধ আর সম্পর্কের টানাপােড়েন না থাকলে কী সুন্দরই না হতাে সবকিছু! চাপমুক্ত ও বিতর্কহীন জীবন কাটত তার। যা অনায়াস অর্জিত নয় তার দিকে মানুষের দুর্নিবার টান। তা অর্জন করার পথ যতই বিপদসঙ্কুল হােক না কেন মানুষ তার শেষ দেখে ছাড়বেই ছাড়বে। পথের শেষে যদি এ-ও দেখা যায় যে, সে যার পিছনে দৌড়ল  তা অতি অকিঞ্চিৎকর তবু 'কুছ পরােয়া নেহি'। আসলে পার্থিব আর অপার্থিবকে পাওয়ার দোলাচলে মানুষের জীবন কখনো আলো তো কখনো আঁধারিতে। একদিকে অতল গহ্বর আর এক দিকে ঝুঁকিহীন মানসিক সমৃদ্ধি! কী নেবে মানুষ?
এ বিভ্রান্তির জেরে কখনো কখনো নাভিশ্বাস হয় তার। যন্ত্রণা বাড়ে সন্তানদের। তাদের বয়স বা ভালােমন্দ বােঝার ম্যাচ্যুরিটি তৈরি হওয়ার আগেই তারা মানসিক লড়াইয়ের জাঁতাকলে পড়ে যায়। বিষয়টা অনেকটা প্রথম বর্ষার গজানাে কচি ঘাস বুনাে ফুলগুলির মতাে তাদের না আছে কোনাে আগল, না আছে নিরাপত্তা। হয় গােরুছাগলের  খাদ্য হয় তারা অথবা পায়ে পিষ্ট হয়ে দুমড়ে মুচড়ে জীবন শেষ হয় তাদের। দেব ও দেবীর কাহিনি এখানেই শেষ হয়নি অবশ্য। হয়নি কারণ তারা দুজনেই সাধারণ মানুষের থেকে উন্নততর দুটো জীব ছিল। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে আর তার জোয়ারে বেশিরভাগ মানুষ ভেসে যায় পিছুটান ভুলে। কিন্তু দেব ও দেবীর প্রাথমিক বিশ্বাসের শিকড় এত শক্ত ভাবে গেঁথে ছিল তাদের মনের মাটিতে  যে সে শিকড় আলগা হয়ে যায়নি কখনো। সব সম্পর্কই পলি জমে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। ফলে গভীরতা কমে মলিনতা আসতে থাকে তাতে। ওদের দুজনের মধ্যেও ঠিক তাই-ই হয়েছিল। এর পর সময়ের সঙ্গে যখন বুঝতে শুরু করল দুজনে যে, এ সম্পর্কগুলির মধ্যে শেষ পর্যন্ত প্রাপ্তি কেবল , যন্ত্রণা , তখন আবার ঘরে ফেরার টান অনুভব করল দুজনে। স্বার্থের সঙ্গে স্বার্থহীনতার যেখানে সংঘাত, পার্থিব আকর্ষণের সঙ্গে অপার্থিব ভালােবাসার যেখানে রেষারেষি, সেখানে প্রাথমিক কিছু ধোঁয়াশা থাকলেও জয় হয় সেই নিঃস্বার্থ ভালােবাসার-ই। এক্ষেত্রে তাই হয়েছিল । আবার ঘরে ফিরেছিল দুজনে। আবার ঝলমল করে হেসে উঠেছিল বাচ্চাদুটি। আবার চাঁদের হাট বসেছিল তাদের সংসারে।
এ ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে আমার মনে গভীর ক্ষত তৈরি করে রেখেছিল। কালের নিয়মে তার উপর আস্তে আস্তে দুঃখ ভােলার আস্তরণ পড়লেও একটা ব্যপারে ধন্দ যায়নি আমার, সেটা হল—ভুল কোনটা ? প্রথমটা না দ্বিতীয়টা ! প্রথমটা যদি ভুল হবে তাহলে দীর্ঘদিনের বিশ্বাস ও উষ্ণতার সম্পর্কটা পরিণতি পায় কীসের ভিত্তিতে? আর দ্বিতীয়টা ভুল হলে দুটি সৃষ্টিশীল মানুষ দূরদৃষ্টি উপেক্ষা করে কেবলমাত্র ক্ষুদ্র বাহ্যিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য মােহের ফাঁদে পা দেয় কীভাবে?  মােহরুপ এ কৃষ্ণগহ্বরের তল খুঁজতে গিয়ে ইতিহাসে কত পদস্খলনের কাহিনি লেখা হয়েছে। উপর উপর ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে মানুষ দেখে তার সম্পর্কে মূল্যায়ন করা খবুই সহজ কিন্তু তাতে বাস্তব ভিত্তি থাকে না কোনো। এ অবমূল্যায়ন অতীতেও ঘটেছে। ভবিষ্যতেও ঘটবে। 


ইতিহাস পড়ে যেমন ঐহিহাসিকের পেক্ষাপটে অথবা কিছু গবেষকের আন্দাজের উপর ভিত্তি করা তথ্যে তা বিচার করতে হয়, যা  ভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রতি পদে, সেরকম মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা তৃতীয় কোনাে সূত্র থেকে শুনে তার বিচার করতে গেলে তা মুর্খামিরই নামান্তর হয়। একথা কেবলই মনে হয় যে অতীত বা বর্তমান যে কোনাে কাহিনি বা ঘটনার যদি একাধিক লিপিকার হতাে, তুচ্ছ গ্রামীণ লােককথাগুলিও যদি একাধিক চারণ কবি দ্বারা বর্ণিত হতো তাহলে অনেক স্বচ্ছ ও পক্ষপাতহীন হত ওই ঐতিহাসিক দলিলগুলি। সঠিক মূল্যায়নের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। মানুষ কেন অন্য মানুষের সঙ্গে তাদের স্বাভাবিক সম্পর্কগুলির মাধুর্য্যকে খাঁচায় বন্দি করতে গিয়ে আসলে বন্দি করে ফেলে তাদের পাখির ডানার মতো মন গুলিকে?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments