জ্বলদর্চি

অন্ত্যেষ্টি-১২/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/ সন্দীপ দত্ত

উপন্যাস।। অন্ত্যেষ্টি।। সন্দীপ দত্ত

১২

তিতান্ন'র আগের দিন সন্ধেবেলা কলকাতা থেকে ঋষভের ফোন'টা পাওয়ার পর মাথাতে রাগ'টা আরও নতুন করে চেপে বসল রাজীবের। সেই রাগ নিয়েই কাল বিনিদ্র রাত কেটেছে,ঘুম হয়নি। প্রভা কাকিমার এখনও ও বাড়িতে থেকে যাওয়াটা কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না রাজীব। শুধু রাজীব একাই নয়,রাকেশ,সজল এমনকি অয়ন পর্যন্ত বেশ অসন্তুষ্ট। সাহসটা তো ওর কাছ থেকেই পাচ্ছে ছেলেটা। তানাহলে ঐটুকুনি এক ছেলে,যার গাল টিপলে এখনও দুধ বেরোয়,ওরকমভাবে গলার জোর দেখাতে পারে? বলে কিনা,"বাবাকে নিয়ে গিয়ে কোথায় তুলব? দাদুর বাড়িটা থাকলেও একটা আলাদা ব্যাপার ছিল। পৈত্রিক ভিটে। প্রত্যেক ছেলের সমান অধিকার। গাঁয়ের লোক যেমন পাঁচকথা বলতে পারবে না বরং উল্টে ভাল বলবে,ঐ ব্যাপারটার মধ্যে যুক্তিও রয়েছে। কিন্তু  বাবার নিজের বাড়ি থাকতে ভাইয়ের বাড়িতে অন্ত্যেষ্টি হবে কেন? এতে তো বাবাকেই অপমান করা হয়। আমি ছেলে হয়ে বাবার এ অপমান হতে দেব কেন? তোমরা সকলেই আমার কাকু জেঠু।বয়েসে অনেক বড়। তোমাদের সকলকেই আমি শ্রদ্ধা করি। তবু এ কথাটা আমার না বললেই নয়। আর আমাকে ছোট ছোট বলে তোমরা যে অজুহাত'টা সামনে রাখছ,আমার মনে হয় ওটা ঠিক নয়। আজ পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর বাবা এই কলকাতায় রয়েছে। এখানে আমাদের বড় হওয়া,পড়াশুনো,ঘরবাড়ি সব। আজ বাবার মৃত্যুর পর পারলৌকিক কাজকর্ম যদি এখানে করাই হয়,সেটা কি খুবই দোষের? কি জানি,আমার তো তা মনে হয় না।" ঋষভের বলা কথাগুলো সেদিন থেকে বুকে গেঁথে গিয়েছিল রাজীবের। ফেরার সময় সেদিন সারাটা রাস্তা  অয়ন কেন কোনও কথা বলেননি,বুঝতে পারেনি রাজীব। তিন ঘন্টার ওপর পথটা যেখানে রাজীব,রাকেশ,সজলদের মৃত চয়ন ও তার পরিবারের লোকদের এমনকি প্রভাকে পর্যন্ত তীব্র ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে কেটে গেছে,অয়ন সেখানে নিশ্চুপই ছিলেন। অয়নের বয়সটাকে গুরুত্ব দিয়ে ওরা ভেবেছিল,দাদা দাদার মতো থাকুক। সেই একই মানসিকতা নিয়েই কাল সন্ধেতে ঋষভের ফোন পাওয়ার পরই বংশীধারীর দুই ছেলে এবং রাসবিহারীর ছেলে অয়নের বাড়িতে খানিকক্ষণ বসেছিল। "দাদা,ওরা তিতান্নতে যেতে বলছে। কী করবে?" রাজীব অয়নের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল।
অয়ন কিছু বলার আগেই সুমিত্রা বলেছিলেন,"তোমাদের কথা যখন শুনল না,ওখানে তিতান্ন খেতে যাওয়ার কী দরকার? প্রভা কাকিমা রয়েছে,ওকে নিয়েই নিয়মটা করুক। ও তো  এখন সবার বড়।"
বউদির কথা শুনে খুশি হয়েছিল রাজীব রাকেশ'রা।
অয়ন বলেছিলেন,"তোরা দেখ,কী করবি। আমার শরীর ভাল নেই।"
"করার তো কিছু নেই। আমরা ঠিক করেছি,যাব না। প্রভা কাকিমাই ওদের সবচেয়ে আপন হয়েছে আজ। ওকে নিয়েই থাকুক।" রাকেশ বলেছিল।
"আমরা শুধু  দেখব ঘাটের দিন পর্যন্ত কী করে। মন পাল্টে ঋষভ যদি ওর বাবার অন্ত্যেষ্টি'টা এখানে এসে করে তো ভাল কথা। নইলে......"
"নইলে?" রাজীবের কথা শুনে সজল,রাকেশ এমনকি সুমিত্রা পর্যন্ত উদগ্রীব। সজলের জিজ্ঞাসা যেন ওদের প্রত্যেকের।
"ওদের সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দেব। আমাদের সমাজ থেকে ওরা আলাদা হয়ে যাবে। বাদবাকি জীবনে ওদের দেওয়া কোনও খবরে আমরা কোনও নিয়ম মানব না। কী,তাই তো দাদা?" অয়নকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথাগুলো কাল বলেছিল রাজীব। 
এ কথার কোনও প্রতিকথা বলেননি অয়ন। শারীরিক অসুস্থতার প্রসঙ্গ তুলে শুধু বলেছিলেন,"এখন তোরা সব যা। আমি আর বসে থাকতে পারছি না।"
"সে নাহয় যাচ্ছি। তবে আর একটা কথা তোমায় জিগ্যেস না করলেই নয়।"
"কী কথা রাজীব?" অয়ন অবাক হয়ে তাকালেন রাজীবের দিকে।
"না বলছিলাম যে,যদি ওরা আসে,ধরো ঘাটের দিন সকালে এল,শ্রাদ্ধশান্তির সমস্ত আয়োজন কি অত তাড়াহুড়ো করে করা সম্ভব? তাই একটু আধটু কাজ কি গুছিয়ে রাখবে দাদা? ঐ যেগুলো শুকনো কাজ। রান্নার জন্য কিছু কাঠ কিনে রাখা,রাধুনির কানে কথাটা জাস্ট একটু তুলে রাখা.....এইসব আর কী! গাঁয়ের দশটা লোককে খাওয়াতে তো হবে। শ্রাদ্ধের জন্য ভুবন বামুনকেও একবার বলে রাখা ভাল। আমাদের বংশের সমস্ত কাজ তো ওই করে। ঋষভ যে এখানকার কিছুই চেনে না। কাকা জ্যাঠা হয়ে আমাদেরকেই তো ওকে সাহায্য করতে হবে।" 
"আর দু'একটা দিন কাটুক না। বললে বলতে হবে। ছেলেটার তো অসুবিধে করতে দেওয়া যাবে না। যদি আসে,আমাদের মুখ চেয়ে আসবে সে। আয়োজন তো করতেই হবে। তবে এখন নয়। ফোনে আরও কিছু বলে নাকি দেখি।"
      কাল সন্ধেয় অয়নের সাথে কথাবার্তর সমস্ত আলোচনাটাই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আজ সকালে পাপিয়াকে বলল রাজীব। বলেই শান্ত থাকল না সে। বউয়ের চোখের তারায় লোভের আগুন জ্বালিয়ে দিল। গনগনে সেই আগুনের আঁচ এসে লাগল রাজীবের গায়ে। সেই কোন্ ভোররাত থেকে অনর্গল বকে চলল। স্বামীর প্রতিটা কথা এই মুহূর্তে তার কাছে অমৃত। তবে সে অমৃতকে আরও মধুর করার জন্য এখন কিছু কৌশলের দরকার। সামনে অনেক বড় সুযোগ। একটু ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হবে খালি।
পাপিয়া বলল,"দাদা বারণ করুক,তুমি কালই স্বপনদাকে কিছু জ্বালানি কাঠের কথা বলে রেখে দাও। এমনভাবে বোলো,যেন রেডি রাখে। আমরা বললেই যেন পাই। ঋষভ যদি আসে,চয়নদার শ্রাদ্ধটা যেন ঘটা করে হয়। নিমন্ত্রিতদের তালিকাটা আমরা একটু দীর্ঘ করব,বুঝলে? তাতে যদি খরচ একটু বাড়ে তো বাড়ুক। কারও মুখে যেন নিন্দে শুনতে না হয়। অয়নদার এই তো বয়স। তার ওপর অসুস্থ। সমস্ত কাজঘর'টা তোমরা দু'ভাইয়ে মিলে এমনভাবে সামলাবে,গ্রামের লোক যেন একবাক্যে  স্বীকার করে,'রাজীব রাকেশটা ছিল বলে তাই। ওদের টাকার জোরেই এত কিছু। ঋষভের আর কতটুকু  ক্ষমতা। নতুন চাকরি। বেতনও হয়তো সামান্য। রাজীব রাকেশের টাকাতেই তো হল সব।' আর একটা কথা তোমায় বলছি। চয়নদার অন্ত্যেষ্টির কাজ শেষ না হওয়া অব্দি ঋষভ যদি ওর মা আর বোনকে নিয়ে এখানে আসে,খুব ভালবাসতে হবে ওদের।

 ভালবাসাতেই ওদের মন নরম করে দিলে দেখবে,লোক খাওয়ানোর জন্য ম্যারাপ'টা আমরা আমাদের উঠোনে বাঁধতে পারব। শ্রাদ্ধশান্তির কাজ'টা দাদার বাড়িতে হবে আর খাওয়ানোর ব্যাপারটা এখানে। এতে আমাদেরই লাভ'টা বেশি। সেদিনের ছেলে ঋষভ এসবের কী বোঝে? ভোম্বল আর বেচুর পেছনে যে টাকাটা শুধু শুধু খরচ করলে তোমরা,মনে রেখো,তা সুদেআসলে তুলতে হবে। টাকার কথা বলছি না। এ গাঁয়ের প্রত্যেকেই যেন তোমাদের অনেক বড়লোক ভেবে সমীহ করে।" কথাগুলো রাজীবকে শিখিয়ে পাপিয়া আর বিছানায় থাকতে চাইল না। জানালার শার্সি ভেদ করে রোদ এসে পড়েছে চাদরে। ঘড়িতে চোখ রাখতেই চমকে গেল সে।আটটা বেজে পাঁচ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments