জ্বলদর্চি

পাতি মানুষের পাঁচালি-১২/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

পাতি মানুষের পাঁচালি::১২
--------------------------------------
এক অত্যাচারিতা ও এক শঠের কাহিনি
-------------------------------------------------------
উদারতা বিষয়টি আসলে কী? যে মানুষটি নিজের জীবনযাপনে, অন্যে উদার থাকুক বলে দাবি করে, , সে ব্যাপারটাই যদি তার নিজের জীবনে ঠিক উল্টো ভাবে ঘটত তাহলে কি সে সমান উদারতা দেখাতে পারত নাকি মুখােশ খুলে যেত? যেমন ধরা যাক, একটি ছেলে বিবাহিত অথচ তার একটি বিশেষ বান্ধবীও আছে। সে ভাবে এ বিষয়টি তার স্ত্রীর মেনে নেওয়া উচিত। এবার তার স্ত্রীরও যদি এক বিশেষ বন্ধু থাকে, তাহলে সে কি তা মেনে নেবে? স্বামী  ও স্ত্রী  ঠিক কতদিন দাম্পত্য কাটানাের পর তাদের মধ্যে বিশ্বাস এবং আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয় ? বিশেষ করে যখন দুজনের কারও মধ্যেই আপাত দৃষ্টিতে অনুদার কোনো মানসিকতা নেই ?
আপনি  হয়তো বলবেন, এ আর কী এমন কঠিন প্রশ্ন? পাঁচ বছর বড়জোর! এত সময় নেওয়ার কারণ হলো , বিয়ের আগে তারা যখন প্রেমিক প্রেমিকা, তখন মুখােশের আড়ালে  তারা তাদের খামতিগুলিকে লুকিয়ে রাখে। বিয়ের পর অভিনয় ও আসলের ফারাকটা বুঝতে পাঁচটা বছর সময় লাগতেই পারে! খারাপ ভাবেননি আপনি! তবুও বলি মানুষ নামে জটিল প্রাণীটির ক্ষেত্রে কোনাে মূল্যায়নই ঠিকঠাক খাটে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ! সে পাঁকাল মাছের মতাে মানুষের ভাবনাকে বুড়াে আঙুল দেখিয়ে এদিক ওদিক শটকে পড়ে। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ যারা এতখানি ঝুঁকি নিয়ে মানুষ নামক জটিল জীবের প্রকৃতি ও চরিত্র মূল্যায়ন করে, তাদের,  ভবিষ্যত বাণী ব্যর্থ হতে পারে,এই প্রস্তুতিটাও থাকা উচিত! আর এ যদি একটা খেলা খেলা ব্যাপার হয়, তাহলে খেলার মাঠে আবেগের কোনাে জায়গা নেই। হারজিত মনে রাখলে পরের লড়াইয়ে ঝাঁপানো কঠিন হয়ে পড়ে। সফল বা ব্যর্থ ভবিষ্যৎ বাণী দুইয়েই স্পোর্টিং স্পিরিট থাকতে হয়। এর প্রেক্ষিতে প্রথা ও কিংকরের দাম্পত্যের গল্পটা একবার শুনে ফেলা দরকার। গল্পের শেষ যখন তখন তাদের বিয়ের বয়স কুড়ি বছর। মেয়ের বয়স আঠারাে বছর। তারা যথাক্রমে চল্লিশ এবং বিয়াল্লিশ বছর।
কিংকর হঠাৎ করে প্রথাকে বিয়ে করে ফেলতে বাধ্য হয়েছিল । কারণটা বেশ জটিল। সে সময়টা কিংকর একটা এন.জি.ও'তে কাজ করত যাদের কাজ ছিল ধর্ষিতা অসহায় মেয়েদের কাউন্সেলিং করে ,আইনি লড়াই করে তাদেরকে সমাজের মূলস্রোতে পূণর্বাসন দেওয়া। ব্যাপারটা ভীষণ কঠিন কারণ, থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাছারি করে প্রাথমিক ভাবে তাদের বিষয়টা সমাধান হয়ে গেছে মনে হলেও সমস্যার শিকড় অনেক গভীর থাকে। সাধারণত মূলস্রোতের ফেরার পথে তারা আবার বিপদের ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে। এ সমাজ অনেক ভদ্রবেশী শ্বাপদ আছে যাদের এমনিতে বড় একটা চেনা যায় না। মনের মতাে শিকার পেলে তারা নখদাঁত বের করে পরম তৃপ্তিতে তা ছিঁড়ে খায়।
প্রথা অভিভাবকহীন বারো বছর বয়স থেকে। এক রেল অ্যাক্সিডেন্টে  বাবা, মা, দুজনেই মারা গেছিল তার। সে কোনোক্রমে বেঁচে যায়, ঈশ্বরের আশীর্বাদ বা অভিশাপে। তারপর এক সহৃদয় পুলিশ অফিসারের বদান্যতায় এক হােমে তার স্থান হয় সেই ছ বছর বয়স থেকে, সে হোমের নাম ইচ্ছে করে গােপন রাখতে হলো। ‘হােম’-মানে বাড়ি, অর্থাৎ মানুষের পরম নিশ্চিন্তে আশ্রয় পাওয়ার স্থান!  ‘হােম’ মানে অবশ্য যজ্ঞও।  প্রথার শরীর নিয়ে আট বছর ধরে কামনার যজ্ঞ করেছিল হােমের মালিক তারক কবিরাজ (কাল্পনিক নাম) । কিংকর যখন একরাতে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে, তখন সে ছ'মাসের বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘরের সিলিং ফ্যান থেকে গলায় ওড়না'র ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে সুইসাইড করতে যাচ্ছে। মেয়েটাকে বাঁচাতে সেবার সাতপাঁচ ভাবার সময় পায়নি সে। পেটে বাচ্চা সমেত প্রথাকে বিয়ে করে তিনমাসের মাথায় তাকে মা হওয়ার সুযােগ দিয়ে নিজে পিতৃত্বের দায় স্বীকার করেছিল কিংকর।  বাহবা পেয়েছিল তার জন্য। সমাজ ও পরিচিত মহলে কিংকরের ইমেজ ছিল স্ফটিক স্বচ্ছ। সুতরাং  প্রথার এ ব্যাপার বিশ্বাস করা স্বাভাবিক ছিল  যে, ভবিষ্যতে তার জীবন এক দেবতার সঙ্গে কাটবে।  কিন্তু ওই যে বললাম, মুখােশের আড়ালে যে মানুষটি বাস করে সে তখনই তার মুখটা মুখােশের বাইরে আনে যখন তার স্বার্থে টান পড়ে বা সমাজের ভালাে করার দায়গুলাে একান্তই গােটা জীবন ধরে তার কাঁধে জোয়ালের মতো চেপে বসতে থাকে। প্রথা যে আরো বড় গাড্ডায় পড়েছে তা  সে টের পেল বিয়ের কিছুদিন  পরে।
খুব প্রগতিশীল , ব্যাতিক্রমী ও সাহসী মানুষেরা সমাজ যা ভাবে তার উল্টো পথে ভেবে স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে পারে। এদেরও মাঝে মাঝে এ কারণে মানসিক হতাশা হয়, মনে হয়—মূলস্রোতে চললেই বােধহয় ভালাে হতো। বিষয়টা হল, কিছুদিন পর থেকেই কিংকরের মনে হতে শুরু করল প্রথা তাে অন্যের উচ্ছিষ্ট এক মহিলা। তাকে তাে আর তার পক্ষে পুরােটা পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ মানুষটার হয়তাে পূণর্জন্ম হয়েছে কিন্তু শরীরটা তাে সেই ক্লেদাক্তই! 
এ ধরনের ভাবনাগুলাে খুব ক্ষতিকর। একবার যদি মনে বাসা বাঁধে তাহলে সব সম্পর্কের শেষ করে ছাড়ে সে। কিংকরের মনে হতে শুরু করল, এই যে প্রথা বছরের পর বছর ধরে মুখ গুঁজে ধর্ষিতা হয়েছে তাতে নিশ্চিত তার দিকে থেকে কোনাে সায় ছিল, অন্যথা একবারের জন্যও তার প্রতিবাদ সমাজের গােচরে আসত! ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে প্রথার সম্বন্ধে তার এমন একটা ঘৃণা তৈরি হল যে বেচারা বিয়ের  মোহ কেটে যাওয়ার পর থেকে দাম্পত্যের স্বাদ-ই আর পেল না। প্রথম কিছুদিন সে ভেবেছিল যে কিংকর লাজুক, সে কারণে সে তার দিকে ঘেঁষছে না। তারপর যখন এই না ঘেঁষার ব্যাপারটা অস্বাভাবিক রকম দীর্ঘ হয়ে গেল তখন সে ভাবল—কিংকরের অন্য সমস্যা নেই তাে? ডাক্তার দেখে শুনে সে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়ার পর প্রথার সত্যি সত্যিই ভয় হতে শুরু করল।  বাইরে বাইরে কিংকর যথেষ্ট কর্তব্যনিষ্ট। কোনাে কিছুরই ক্রটি হতে দেয় না। কিন্তু প্রথার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা আসলেই তার কেমন যেন হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যায় । ঘেন্না লাগে ।বমি পায়। এমনিতে প্রথা ঠান্ডা প্রকৃতির মেয়ে। সে ভাবল যে ব্যাপারটা তাে সত্যিই বেশ কঠিন! এ পরিস্থিতির সঙ্গে, পুরুষ হলে, সে ও মানিয়ে নিতে পারত কিনা সন্দেহ, সুতরাং চুপচাপ ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করাটাই যুক্তিযুক্ত। সময়-ই সব ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে দেয়। আর কিংকরের প্রতি তার তাে কেবল ভালােবাসা ছিল এমন নয়। শ্রদ্ধাও ছিল অসম্ভব। সুতরাং এতটুকু ত্যাগস্বীকার করাটা তাে তার কাছে জলভাত!
কিন্তু পরিস্থিতির তাে উন্নতি হলই না, বরং উত্তরােত্তর অবনতি হতে শুরু করল। প্রথাকে খুঁটিনাটি সব ব্যাপারেই সন্দেহ করে কিংকর। মেয়ের স্কুলে তাকে ছাড়াতে গিয়ে দেরি হলে অন্যরকম ভাবে। বাজারে গিয়ে জ্যামের কারণে রাস্তায় লেট হলে তুলকালাম করে। এমনকি বাড়িতে দুধ দিতে আসা কিশোর ছেলের সঙ্গে সামান্য কথা বললেও বাঁকা কথা বলতে ছাড়ে না সে। প্রথা হাউসওয়াইফ। কিংকর তখনাে সেই  এন.জি.ও'তে কর্মরত। ছুতােনাতায় ডুব মারা, ফাঁকিবাজি এই সব শুরু করেছে। প্রমােশনের কারণে মাইনে বেড়েছিল । তাতে বেশ সংসারটাও চলত তার। কিন্তু ফাঁকিবাজি একদিন এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছল যে কোম্পানি বাধ্য হল তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে। চাকরি যাবার কারণে এরপর সারাদিন বাড়িতেই বসে কাটাতে হতো তাকে। প্রথা কর্তব্যের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ভুলভ্রান্তি করলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলত কিংকর। কথায় কথায় অতীত তুলে খোঁচা মারত প্রথাকে এবং সে যে কত বড় মহৎ এ কথাটা জাহির করত সব সময়। এদিকে মেয়ে বড় হওয়াতে খরচাপাতিও বেড়েছে। সামান্য কিছু জমানাে টাকা ছিল তা-ও শেষ। এ রকম অভাবে কিছুদিন কাটানাের পর প্রথা ভাবল এবার সংসারের হাল ধরার জন্য  তারও কিছু একটা করা দরকার।
অ্যাকাউন্টসের কাজ জানত সে । সঙ্গে কমিম্পউটারও শিখেছিল । সুতরাং জোগাড় যন্ত্র কবে ছােটকাকার বন্ধু বিদ্যুতাক্ষ মল্লিকের মার্কেটিং এজেন্সির অফিসের ফ্রন্ট ডেস্কে একটা কাজ পেয়ে গেল সে। অন্য কোনাে পরিবার হলে এতে সংসারের অভাব ও চাহিদার আনেকখানিই সুরাহা হতো। কিন্তু এ তো কিংকরের সংসার ! যা একবার ভেবে নিয়েছে তা নিয়েছে । তার থেকে একচুল নড়ানাের ক্ষমতা নেই তাকে! কাজের প্রতি  প্রথার নিষ্ঠা ও মনযােগ দেখে কিংকর ভাবল, প্রথা বােধহয় কাকুর বন্ধুর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছে। প্রথা আবার ঠিক উলটো পথের, পথিক। সে কিংকরকে এতখানিই বিশ্বাস করত যে এটা মেনে নিতে তার কোনাে সমস্যাই হতাে না যে, কিংকর বাড়িতে আছে যখন, একাধারে মেয়ের বাবা ও মায়ের কর্তব্য একাই সে সামলে নিতে পারবে। | ভুল ভেবেছিল অবশ্য। কিংকরও ভুল ভেবেছিল। নিজেকে উদার ভাবতে ভাবতে এক সময় সঠিক সত্যিটাকে বিস্মৃত হয়েছিলে যে সে নিজে একজন অতিসাধারণ মানুষ, তার কাছে উদারতা বিলাসিতার নামান্তর। যে মেয়েকে নিজের মেয়ের মতাে ভালােবাসা দিয়ে তাকে ভালােবাসার কাঙালি হতে দেবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল কিংকর, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল  ছুতােনাতায় তার গায়ে হাত তুলতেও বিশেষ পিছপা হচ্ছে না সে। মেয়ে এসব ব্যাপারকে কোনাে গুরুত্ব দিত না কারণ মা শিখিয়েছিল, ছেলেমেয়েক বাবা-মা শাসন করেই এবং ভালাের জন্যই করে। এরকম হতে হতে ব্যাপারটা চরম আকার নিল একদিন যেদিন প্রথার সঙ্গে সামান্য একটা তর্কাতর্কির জেরে কিংকরের মারের চোটে মাথায় অঘাত পেয়ে হাসপাতালে ভরতি হতে হল মেয়েকে।
ব্যাপারটা বাড়তে বাড়তে এমন একটি সময় এমন একটি পর্যায়ে  এসে দাঁড়াল যে কিংকরকে সাইক্রিয়াট্রিস্ট কনসাল্ট করতে হলো। বহু অনুরােধে কিংকরকে রাজি করিয়েছিল প্রথা। সাইক্রিয়াট্রিস্ট দেখে শুনে মতামত দিলেন পরিস্থিতি যে রকম জটিল তাতে বিবাহবিচ্ছেদ-ই তাদের দুজনের বাঁচার একমাত্র সম্ভব্য পথ। এতে কিংকরের পাগলামি ও জেদ আরাে বেড়ে গেল। অত্যাচার করলেও কিংকরের একটা অদ্ভুত প্রিঅকুপাইড বিলিফ ছিল এর ব্যাখ্যা হিসাবে। কিংকর অনুভবই করত না যে প্রথাকে যন্ত্রণা দেওয়াটা তার প্রতি অন্যায়, কারণ নিজেকে কষ্ট দিলে অন্য কারাে অনুমতির প্রয়ােজন হয় না, আর প্রথা তাে তার নিজেরাই অংশ। প্রথা কিংকরকে ভালােবাসলেও এ তত্ত্বেও সারবত্তা বুঝত না সে। বােঝার কোনাে কারণও নেই। কারণ এ অস্বাভাবিকতায় তার কোনাে আগ্রহ ছিল না। কিন্তু সমস্যা ছিল মেয়েকে নিয়ে । তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে বেচারির কী অবস্থা হবে সে কথা ভেবে সে কোনরকম চরম পদক্ষেপ নিতে পারছিল না। একদিন মেয়ের চিন্তা আর অন্যদিকে কিংকরের অত্যাচার এই দুইয়ে জীবন যখন দুর্বিসহ সেরকম একটা সময় হঠাৎ করে হােমের পুরনাে বান্ধবী আজমিরার সঙ্গে  তার বাজার করতে বেরিয়ে  দেখা হয়ে গেল একদিন। হােমে থাকার সময় থেকেই সে খুব মারকুটে ও ডাকাবুকো থাকার কারণে হােমের মালিক তাকে ভােগ করতে সাহস করেনি। সে সাহস তার আজো কমেনি। যে সব মেয়েরা বিভিন্ন কারণে অপরাধচক্রে জড়িয়ে গেছে , এবং যারা আবার মূলস্রোতে ফিরতে আগ্রহী তাদের উদ্ধার করে তার প্রতিষ্ঠানে রেখে সমাজে ফেরার যােগ্য করত সে। কতবার দুস্কৃতি আক্রমণে মরতে মরতে বেঁচে গেছে।  কিন্তু ভয়ে পিছু হটেনি।
প্রথা তার সহকর্মী হতে আগ্রহ প্রকাশ করল। আজমিরার রাজি হল সানন্দে, কারণ তারও যােগ্য সহযোগীর দরকার ছিল। ওদিকে কিংকরের অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। তার পাগলামাে, সন্দেহবাতিক মনােভাব ও প্রবল আত্মসম্মানবােধ সবকিছুর মিশ্রণে তার একেবারে জেরবার অবস্থা। প্রথা তাকে ধীরে ধীরে উপেক্ষা করতে শিখেছিল।   তারই ফলশ্রুতি কিংকরেরর কড়া ডােজে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা। পুরনাে এন.জি.ও'র সহকর্মীরা অর্থের জোগান দিয়ে,  সরকারি হাসপাতালে ভেন্টিলেটারে রেখে সে যাত্রা প্রাণ বাঁচিয়েছিল তার। পরবর্তী কালে তাকে অক্লান্ত সেবা করে সুস্থ করেছিল শঙ্করী। শঙ্করীর সম্পর্কে গােপন তথ্যগুলি পরে পাওয়া গেছিল এন.জি.ও'তে তার পুরনাে সহকর্মীদের কাছে থেকে। শঙ্করীর সঙ্গে কিংকরের আজকের একদিনের আলাপ নয়। এন.জি.ও'তে চাকরি করা কালীন দুজনের সম্পর্ক বহুদিন গড়িয়েছিল।  পরে ‘প্রথা’ কাণ্ডে সবকিছু ওলােটপালােট হয়ে যায়। কিন্তু তলে তলে শঙ্করীর সঙ্গে যােগাযােগ তার ছিলই। যদিও প্রথাকে তা সে ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেয়নি কিংকর। একদিকে লােক সমাজে তার ভালাে থাকার বাসনা, অন্যদিকে শঙ্করীর প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ এই দুইয়ের টানাপােড়েনে কিংকর বেশ চাপে থাকত মনে মনে।  মানুষ নিজের অবাঞ্ছিত কাজের স্বপক্ষে সব সময় যুক্তি খাড়া করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চায়। শংকরের যুক্তি ছিল শঙ্করী কেবল তার পুরোনো পরিচিত বই কিছু নয়।
ওদিকে প্রথার কিংকরের প্ৰতি মনযোগ ছিল একমুখী । সে কিংকরকে তার জীবনের সাফল্য , ব্যর্থতা যা কিছু ছিল সবটুকু দিয়ে বসেছিল, বিনিময়ে তার সততা পরীক্ষা করার জায়গাতেই  সে ছিলনা। তার কাছে, কিংকর যা করবে তাই সঠিক।
কিংকর সুস্থ্য হয়নি। কোনােরকমে বেঁচে যাওয়ার পর পাগলামাে দ্বিগুন মাত্রায় ফিরে এসেছিল তার। এখন সে প্রথাকে ফোনেও কারাে সঙ্গে কথা বলতে দেখলে রেগে যায়, মারধাের করে। শঙ্করী নতুন করে কিংকরকে পাওয়ার আশায় তাকে সাড়িয়ে তুলে যখন বুঝেছিল যে, সে ব্যাপারটা সম্ভব নয় তখন পালিয়েছিল দৃশ্যপট থেকে।
এ ঘটনা সামনে থেকে দেখে আমার মনে অনেকগুলাে প্রশ্ন জেগেছিল যে গুলির যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা এখনাে আনমনে হাতড়ে চলেছি আমি।
প্রথম : মানুষের প্রতি মানুষের অধিকারবােধ কতটুকু থাকা উচিত? যে অধিকারবােধ অন্যের বাঁচাকে দুর্বিসহ করে তােলে সে অধিকার বােধ থাকার প্রয়ােজন কতখানি? একে গুরুত্বই বা কতখানি দেওয়া উচিত?
দ্বিতীয় : ‘কেউ একান্তভাবে আমার’–এ মানসিকতা যাদের, নিশ্চয় সেই ‘আপনজন’-এর অধিকার ও স্বাধীনতা হরনের ইচ্ছে থাকে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হল—'আমিও তাে আমারই!'—তাহলে কি অহরহ আমি আমার স্বাধীনতা হরণ করে তৃপ্তি পাই? নাই পাই যদি, তাহলে আমি যার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করি সে আমার প্রিয় হবে কী করে? এটা কী একধরনের মানসিক দ্বিচারিতা নয়? 
তৃতীয় : যে কাজের দায়িত্ব নেওয়ার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মানসিক স্থিতি মানুষের নেই, সেই দুর্বিসহ দায়িত্ব নিয়ে মানুষ তার কপটতাকেই প্রশয় দেয় নাকি? নিজেকে মহান প্রমাণ করতে গিয়ে সমাজের কাছে এভাবে খেলাে হওয়ায় সত্যিই কি জরুরি? চতুর্থ : যে ভালােবাসা মানুষকে যন্ত্রণা আর অবিশ্বাসই দিয়ে যায় , সে ভালােবাসা কি ভালােবাসা না অন্য কিছু?

আমি জানি, সমাজও কোনােটারই উত্তর দেবে না, কারণ মানুষের ভালাে থাকাতে তার কোনাে দায় বা মন্দ থাকতে দায়িত্ব নেই। মানুষকে নিজের মতাে করে বানিয়ে নিতে হবে সবকিছু। সমাজের মাথারা, তাত্ত্বিকেরা স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রার অভ্যস্ত, তারা এসব ছােটখাটো ব্যাপারে মাথা ঘামাবে কেন? প্রথার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল তিনবছর আগে, তার দুবছর আগে কিংকর মারা গেছে। আত্মহত্যার প্রবণতা একটা রােগ এবং তার শিকড় সন্ধান করা দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের ঘুমিয়ে থাকাটা আরও বড় রােগ। প্রথার মুখ থেকে শােনা কথা—পাঁচ বছর আগে প্রায় দিন নিখোঁজ থাকার পর মানকুন্ডু স্টেশনের লাইনের ধারে যে মুন্ডহীন লাশ পাওয়া গেছিল শান্তভাবে তা কিংকরের’ বলে সে শনাক্ত করে এসেছিল সে। প্রাথমিক ভাবে থানা-পুলিশ সংক্রান্ত হয়রানি হলেও,  সে সব মেটার শেষে বুকের মধ্যে থেকে একটা ভারী পাথর সরে গিয়ে  অদ্ভুত শান্তিতে ভরে গেছিল প্রথার মন। যে মানুষটাকে প্রথা চিরকাল নিঃস্বার্থ ভাবে ভালােবাসা ও শ্রদ্ধাই দিয়ে গেছিল, তার এভাবে মরে যাওয়া প্রথার কাছে বরং ছিল মন্দের ভালো। সে  বেঁচে  থাকলে কি-ই বা ভালাে প্রাপ্তি হতে পারত প্রথার?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments